শুক্রবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মহাপিরামিডের অন্দরমহলে

শাকুর মজিদ

মহাপিরামিডের অন্দরমহলে

পিরামিডের ভিতরের সেই জায়গাটি আসলেই কেমন ছিল তা দেখার জন্য ১০০ পাউন্ড দামি একখানা টিকিট আছে আমার হাতে। এ টিকিট সবাই চাইলেও পায় না। দিনে মাত্র ১৫০ জন ট্যুরিস্টকে এটা দেওয়া হয়। যে আগে আসে সে আগে পায়। ১৫০ জন হয়ে গেলে সেদিনের মতো বন্ধ হয়ে যায় টিকিট দেওয়া। আমি টিকিটখানা নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই মন খারাপ করা সাইন বোর্ড দেখি। নো ফটোগ্রাফি। আমি তো জানি এখন আর কোনো গোয়েন্দার আর কোনো দরকার নেই কোন পথে গিয়ে মূল রতেœর সন্ধান পাবে তা জানার, তবে কেন এ সাবধানী? প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কেউ নেই। আমি আমার সহপর্যটকের হাতে ক্যামেরা গছিয়ে ঢুকে পড়ি ভিতরে। সেখানে টর্চ হাতে এক লোক দাঁড়িয়ে। আমরা ৪-৫ জন এক হওয়ার পর এদের নিয়ে তিনি ছুটলেন। আমরা একটা সুড়ঙ্গের ভিতর ঢুকে পড়লাম এবং খানিক হাঁটার পরে টের পেলাম এ সুড়ঙ্গটির উচ্চতা ৪ ফুটের মতো, এবং এর প্রস্থ এমন যে একজন লোক কেবল প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে যেতে পারবে, অপর পাশ থেকে কেউ আসতে পারবে না। ফুট দশেক হাঁটার পর গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে যাই। ভরসা সামনের গাইডের টর্চের আলো। ভয় হচ্ছে, অক্সিজেনের সমস্যা যদি হয়? আমি কি ফেরত আসব? সে সুযোগ তো নেই, আমার পেছনে এক স্থুলকায়া ফর্সা রমণী। তিনি ইংরেজিতে বকাবকি করছেন, কেন তার স্বামী তাকে এ সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে নিয়ে এলো এসব। আমি কাকে বকা দেব? আমি তো নিজেই এসেছি। এখন সামনে কুঁজো হয়ে উপরের দিকে হাঁটা ছাড়াতো আমার কোনো পথ নেই। হাঁটছি আর টের পাচ্ছি একটা রাম্পের ওপর দিয়ে আমরা পার হচ্ছি এবং ক্রমশ উপরের দিকে উঠছি। আমাদের ফার্স্ট ইয়ারে হিস্ট্রি অব ওয়ার্ল্ড আর্কিটেকচার পড়ার সময় এটার নানা রকম মাপজোখ মুখস্থ করেছিলাম। ছবি এঁকে এঁকে দেখাতে হতো এর ভিতরকার তিনটা চেম্বারকে। একসময় পেন্সিল দিয়ে যে সুড়ঙ্গ আঁকতে বাধ্য হয়েছিলাম পরীক্ষা পাসের জন্য, এখন দেখি সেই সুড়ঙ্গের ভিতর যাত্রী হয়েছি আমি। এক সময় একটা ট্রানজিট লাউঞ্জের মতো জায়গায় এসে আমরা পৌঁছলাম। জায়গাটা বেশ বড়। এখানে মাথা তুলে দাঁড়ানো যায় এবং আলোর ব্যবস্থা আছে। এখান থেকে আর তিন দিকে তিনটা পথ চলে গেছে। বুঝলাম, পাজল তৈরির জায়গায় এসে গেছি। তিনবার তিন দিকে গেলেতো একবার যে কোনো চোর এটা পেয়ে যেত। কিন্তু নানা কায়দায় কতগুলো ফলস চেম্বার নাকি বানানো ছিল। এ রকম একটা বাঁক পেরিয়ে পেয়ে যাই রানীর কুঠরি, কুইন্স চেম্বার। তার উপরে আরেকটা চেম্বার, তার উপরে রাজার। রাজা তার রানীকে নিয়ে একই কবরে থাকবেন এজন্য এ ব্যবস্থা। এ পথ অনুসরণ করে আমাদের আগ্রার শাহজাহান বানিয়েছিলেন তাজমহল, এ ফারাওদের এ কাণ্ডকারখানার আরও চার হাজার বছর পর। দুই রাজাই মৃত্যুর পর ইতিহাসের আবর্জনায় ঠাঁই পেয়েছেন আর তাদের কর্মযজ্ঞটাকে উপজীব্য করে খাচ্ছে আগ্রা আর গিজার আজকের জনগণ।

ফারাও রাজা খুফুর কাহিনী প্রথম বিশ্বকে শুনিয়েছিলেন ইতিহাসের জনক হিরোডিটাস, তাও প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, খুফুর মরে যাওয়ার দুই হাজার বছর পরে তিনি তার কাহিনী সংগ্রহ করেছিলেন। হিরোডিটাস খুব একটা ভালো কথা লিখেননি তার নামে। বলেছেন যে, তিনি অত্যন্ত স্বার্থপর, আত্নপ্রেমী, নির্দয় ও লোভী শাসক ছিলেন। ৬৩ বছর ধরে তিনি নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রথমেই সব মন্দির বন্ধ করে দিয়ে সব মিসরীয়কে তার প্রতি অনুগত হতে বাধ্য করেছিলেন। এবং সব কাজ বাদ দিয়ে তার জন্য কবর নির্মাণের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সম্রাট শাহজাহান যেমন তাজমহল নির্মাণ করতে গিয়ে রাজকোষ খালি করেছিলেন, খুফু (খিওপস)ও তেমনে পুরো মিসরে দুর্ভিক্ষ লাগিয়েছিলেন। হিরোডিটাস লিখেছেন যে এক সময় খিওপসের টাকা শেষ হয়ে গেলে তিনি নিজ কন্যাকে দিয়ে পতিতাবৃত্তি পালন করালেন। কন্যার কাছে আসা খদ্দেরদের কাছে কন্যা অতিরিক্ত একটা পাথর চাইতেন। সেসব পাথর দিয়ে পিতার কবরের পেছনে তারও একটা ছোট কবর বানানো হয়। সেটার প্রতিটার বাহু ছিল ১৫০ ফুট দীর্ঘ।

খুফুর পিরামিডের ভিতর আমরা কতগুলো খালি সুড়ঙ্গ পথ ছাড়া আর কিছু দেখি না। এখানে মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেওয়ার পর আমাদের দলের বাকি সবাই এসে দাঁড়ালে আবার আরেকটা সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে খানিক যাওয়ার পরে এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। এটাই নাকি মূল চেম্বার। এখানে আসার আগে থেকে আমরা এক ধরনের হামিং শুনতে পাচ্ছিলাম। আমাদের আগে যে দলটি এসেছিল তার সঙ্গে আসা গাইডের নেতৃত্বে কিছু লোক ওখানে গিয়ে হু হু ধ্বনি তুলছে। মজার ব্যাপার যে এই বুরিয়াল চেম্বারের একুইস্টিক সিস্টেমটা এতটাই চমকের ছিলও যে, তা বানানোর সাড়ে চার হাজার বছর পরের পর্যটকের কাছে এটা এক বিস্ময়। পিরামিডে বিস্মিত হওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে, এটাও তাই। এখানে যে কোনো শব্দ উৎসারিত হলে সমান তীক্ষèতায় তা প্রতিসরিত হতে হতে প্রতিধ্বনি তুলে, ইকো সৃষ্টি হয়।  ফারাও রাজা খুফুর মমিটা এখন কোথায় আছে জানি না। হয় ব্রিটিশ মিউজিয়ামে, নয়তো কায়রোর জাতীয় জাদুঘরে, কোথাও আছে, তবে এখানে নেই। এখানে আছে একটা খালি কফিন, তাও পাথরের বানানো। এ জায়গাটা বেশ প্রশস্থ। এক সময় এখানে পাওয়া গিয়েছিল ১৪২ ফুট লম্বা সুগন্ধি কাঠের তৈরি এক নৌকা। এ নৌকাটি ছিল খণ্ড খণ্ড কাঠের টুকরো দিয়ে নিখুঁতভাবে জোড়া লাগানো। এ ধরনের কাঠ সাড়ে চার হাজার বছরের পুরনো। খুফুর পুত্র নৌকাটি তার পিতার সমাধিতে রেখে দিয়েছিলেন এই বিশ্বাসে যাতে মৃত পিতাকে স্বর্গে যেতে হলে তার তো বাহনের দরকার। ধারণা করা হয় ফারাওরা নীলনদে যখন তখন ঘুরে বেড়াতেন। মৃত্যুর পরও যাতে তারা ঘুরতে পারেন সে জন্য এ ধরনের নৌকা রাখা হয়েছিল তাদের সমাধিস্থলে। নৌকাটি ছিল সবুজ রঙের। দাঁড়ের মাথায় বাজপাখির মাথা বসানো। সঙ্গে পদ্মপাতার চমৎকার নকশা। খুফু বা খিওপস বা খিওপসের এ রাজকুঠরিতে এখন প্রতিদিন ১৫০ জন দর্শক ঢুকেন। বিগত প্রায় দুই হাজার বছরে এর ভিতরে বহুজনই ঢুকেছেন। আগে কেবল মিসরজয়ী বীরেরা এর ভিতরে ঢুকতে পারতেন। আব্বাসী যুগের শাসক মিসর জয় করে এর ভিতরে ঢুকে কিছুই পাননি। জিনিসপত্র খালি দেখেছেন সেই নবম শতকেই। তারও আগে ঢুকেছিলেন আলেকজান্ডার। আঠার শতকের একেবারে শেষের দিকে ঢুকেছিলেন ফরাসি জংবাজ বীর নেপোলিয়ান। গ্রিক যোদ্ধা আলেকজান্ডার ২৪ বছর বয়সে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে এসেছিলেন এখানে, আর ফরাসি আক্রমণকারী নেপোলিয়ন এসেছিলেন ১৭৯৮ সালে। দুজনই এসে মিসর জয় করে এর রাজ কুঠরি দেখে গেছেন। নেপোলিয়নেরটা অনেক নাটকীয়। তার নির্দেশে তিনি একা এ কিংস চেম্বারে প্রবেশ করেন, তার কোনো সঙ্গীকে তিনি রাখেননি। কি দেখেছিলেন নেপোলিয়ন? এমন প্রশ্নের জবাব তিনি কখনোই দেননি, এও এক বিস্ময়। এ শবাধারের দেয়ালে কিছু লেখা, কিছু চিত্র। এগুলো থেকেই গবেষকরা তাদের নাম, জম্ন-মৃত্যুর ইতিহাস জেনেছিলেন। চিত্রের ভাষা বুঝে বুঝে লিখেছিলেন তাদের ইতিহাস। এখান থেকেই ধারণা নিয়ে পিরামিড নির্মাণের সম্ভাব্য কাহিনী শুনিয়েছেন। এরপরও নিশ্চিত হওয়া যায়নি, ঠিক কী কৌশলে তখনকার দিনে সুউচ্চ পিরামিডগুলো তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল। কারও মতে, নির্মাণাধীন পিরামিডের একপাশ থেকে মাটি বা পাথরের ঢাল তৈরি করে তার ওপর দিয়ে ভারী পাথর টেনে টেনে তুলে পিরামিড বানানো হয়েছে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই এ মত প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের মতÑ পিরামিড যত উঁচু হবে, ঢাল তত প্রশস্থ করতে হবে। এভাবে পরামিডের চূড়া পর্যন্ত পৌঁছতে ১৩ মাইল লম্বা ঢাল বানাতে হবে, যা অসম্ভব। আবার আরেক মতানুসারে, পিরামিড বানানো হয়েছে ধাপে ধাপে চারপাশ দিয়ে ছোট ছোট ঢাল বানিয়ে। অপর একটি মতে, পিরামিডের চারপাশ মাটি দিয়ে ভরাট করে নির্মাণকাজ শেষ করা হয়েছে। পরে মাটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বলা বাহুল্য সবকিছুই ধারণা মাত্র। এর প্রকৃত রহস্য অজানা।  জানা যায়নি মমি তৈরির রহস্যও। তবে এটা অনুমান করা যায় যে, পিরামিড তৈরির আগে থেকেই মমি তৈরি শিখেছিল মিসরীয়রা। ফারাও রাজবংশের রাজাদের মমি সমাধিস্থ করা হতো পিরামিডের ভিতর। মৃতদেহ দীর্ঘদিন সংরক্ষণে রাখার জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে মমি বানানো হতো। ৭০ দিন সময় লাগত একটা লাশ প্রসেস করে মমি বানাতে, এ কাজে তারা বেশ কিছু রাসায়নিক পদার্থও ব্যবহার করত। আধুনিক বিজ্ঞানীরা এখনো এ রহস্যের কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে গ্রেট পিরামিড নির্মাণের লিখিত ইতিহাস খুব কমই পাওয়া যায়। গ্রানাইট পাথরে নির্মিত খুফুর একটি মাথা এবং মমি চেম্বারে আইভরি দিয়ে নির্মিত খুফুর একটি ছোটখাটো মূর্তি পাওয়া গেছে মাত্র।  এখানেই পিরামিডের শীর্ষ চ‚ড়ার বিন্দুর ঠিক নিচে রাখা হতো মমি আর তার পাশের কতগুলো খুপরি খালি পড়ে আছে, কিছুই নেই, সেখানে রাখা হতো মূল্যবান রাজকীয় তৈজসপত্র, সবই সোনা, মণি, মুক্তার তৈরি। কিন্তু এখন তো কিছুই নেই। কি দেখব? যা দেখলাম তার যে একটা ছবি তুলে আনব সে সুযোগ নেই। ক্লান্তি অবসাদ হলে আবার আরেক পথে ফেরত আসি। নামতে কষ্ট কম। আমরা ঢালু বেয়ে সহজে নেমে আসি। বাইরের গেটের কাছে আমার অপর তিন সহপর্যটক দাঁড়িয়ে। এনায়েত ভাইয়ের কৌত‚হল সবচেয়ে বেশি। তিনি অত্যন্ত কৌত‚হলের সঙ্গে বলেন, কি রে কি দেখলি?  আমি বলি দিল্লিতে গেছেন না? গেছি তো। লাড্ডু খাইছিলেন?

আমার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে হাহাহা করে হেসে ওঠেন সবাই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর