শুক্রবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

গরটিকানিয়া এবং অন্যান্য গল্প

[A temporary sojourn and other stories] এর নেপথ্য এবং গল্পের কথন

নাসরীন জাহান

গরটিকানিয়া এবং অন্যান্য গল্প

ছড়া নিয়ে অতি শৈশবমুখর থাকলেও ক্লাস সিক্সে কোনো এক কারণে একটা গল্প লেখা হয়ে যায় এবং রাজধানীর নামি পত্রিকায় প্রকাশ হয়। চাঁদের হাট এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে লিটিল ম্যাগ করা একঝাঁক তুখোড় পড়ুয়া ছেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আড্ডায় পুরুষদের জগৎ জানা। পৃথিবীর সমৃদ্ধ অনূদিত বই কেন্দ্রের লাইব্রেরি থেকেই নিয়ে আমার লেখায় এ দেশের শিকড় মানুষকে ভিত্তি করেই ঢুকে যেতে থাকে সুররিয়ালিজম, ম্যাজিক-রিয়ালিজম যা এখনো কোনো না কোনো লেখায় কমবেশি থাকে এবং আমার লেখার সবচেয়ে শক্তির জায়গা (বোদ্ধা, পাঠকদের কাছে নিয়মিত শোনা) যে কোনো সাধারণ কাহিনীই আমার মনস্তত্ত¡ এবং দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সম্পূর্ণ নতুন এক রূপ নেয়। ফলে গরটিকানিয়া A temporary sojourn and other stories গ্রন্থে যুক্ত পনেরোটি গল্পের কাহিনী ক্লিশে শোনাতে পারে। তবুও কিছুটা ঝুঁকি নিচ্ছি।

নিয়াজ জামানের অনুবাদ এবং আকাক্সক্ষার ভালোবাসায় বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে গল্প নির্বাচনে আমার হাজব্যান্ড কবি আশরাফ আহমদের পরামর্শক্রমে আলোচিত পনেরোটির মধ্যে মনস্তত্ত্বের বিস্তারে বিন্যাস্ত হওয়া রিয়েলিস্টিক লেখাগুলোকে এখানে প্রাধান্য দিয়েছি। নিয়াজ জামানের আন্তরিক সম্পাদনা শেষে ইউপিএলের মহিউদ্দিন আহমেদের কাছে পাণ্ডুলিপি জমা দিই। তাঁদের সম্পাদনা পরিষদও যখন সম্পাদনা করছে তখন মারুক মহিউদ্দিনের সঙ্গে কথোপকথনে, তাঁর অসাধারণ, অক্লান্ত ও আন্তরিক পরিশ্রমে এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বইটা ঢাকা আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে (Dhaka Lit Fest) আলোর মুখ দেখে। একটু বলে রাখি, শৈশব-কৈশোরে ঠাকুরমার ঝুলি, আরব্য রজনীগুলো পড়েই আমার অস্তিত্বে, মজ্জায় সুররিয়ালিজম ঢুকে গেছে। ওসব পড়তে পড়তেই আমার আবিষ্কার। মারুককে ধন্যবাদ। এ বইয়ে আমার লেখা বাংলা ভূমিকাটি ইংরেজিতে নান্দনিকভাবে রূপান্তর ও নানা পরামর্শ দিয়ে রেবেকা হক পরম কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করেছেন।

বাংলা সাহিত্যের অনুবাদের দৈন্য আমাকে নিরন্তর পোড়াত। আমার অপরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব যখন আমার গল্প কখনো নিজে কখনো অন্যকে দিয়ে অনুবাদ করিয়ে সমৃদ্ধ বিভিন্ন গ্রন্থে যুক্ত করতে থাকলেন, বিস্মিত আর রোমাঞ্চিত আনন্দে সেই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় ঘটে, যার নাম নিয়াজ জামান। এরপর অনুবাদক কায়সার হক আমার উপন্যাস (উড়ুক্কু)’র তুখোড় অনুবাদ করে নিজ দায়িত্বে পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশ করলে অন্তত নিজের অনুবাদ নিয়ে দৈন্যকষ্ট অনেকটা কমতে থাকে। এই গন্থের প্রথম গল্প ‘বালিকা রমণী’ (Girl Becomes Woman)। এক ফুটপাথে একটি বালিকা একদিনের চারবেলার রাস্তার জীবনে নানা রকম জীবনযুদ্ধের মধ্যে অবশ ঘুমে কে তাকে রেপ করল, কার কী তাচ্ছিল্য সব ব্যাপারে উদাসীন থেকে সন্ধ্যায় ক্ষুধার্ত বিবর্যতার মুখে নিজেকে সম্পূর্ণ বিবর্তিত হিসেবে আবিষ্কার করল।

পরের গল্প পুরুষ (Manhood) বিকলাঙ্গ ছেঁচরে চলা এই ছেলেটি, যার নাম বুলু, নিজের বোধেও তার অসহায়ত্বকে মানতে চায় না। তার সামনে তার পিতারই আরেক কন্যা শেলী পাজামার নেড়ি খোলে, প্রেমিককে চুমু খায়...। বুলু নিরন্তর ক্ষিপ্ত ক্রুদ্ধ এবং প্রতিবাদী। শেলীকে কেন্দ্র করে তার প্রতিবাদ পাঠকদের মতে, গা রিরি করার মতো। একটি দীর্ঘ সাক্ষ্যের ডালপালা (A sing in Moonlit Mist) গল্পে এক যুবক বন্ধু বিচ্ছিন্ন হয়ে ঘোরগ্রস্ত পূর্ণিমার টানে আচ্ছন্ন হয়ে এক বিকলাঙ্গ আজব বৃদ্ধের দেখা পায়। নবজাতক সে খুন করার পর সেই বালক পড়ে থাকা এই বৃদ্ধ নানা মনস্তত্ত্বের জটিল পাকে স্তব্ধ রাত্রিকে আচ্ছন্ন করে খুলে দিতে থাকে, যেন কোনো দার্শনিক, এই বর্ণনায় তার দেশে আসা জীবন কখন এ গল্পের ভাঁজে ভাঁজে এবং সবশেষে ম্যাজিক রিয়ালিজমের প্রয়োগ চমক অবচেতনভাবে গাঁথা।

ঈর্ষা (Envy) গল্পটিতে গ্রামের গর্ভবতী বিধবা মা এসেছে বাঁশি বাজানো সংসারে উদাসীন যুবকের স্ত্রী তারই মতো গর্ভবতী কন্যার সেবায় মেয়েকে বলে... ‘খালি ওর মধ্যে মরদ খুঁজস। করদী আমার মাতা মরদের ঘর দেখতি...।’ সেই মা-ই কন্যার সন্তান প্রসবে কী হয় ইত্যাকার অনুভূতি এই গল্পে যুক্ত। 

অন্যরম (Different) গল্পে মা-কন্যার তর্ক-বিতর্ক দর্শন মনস্তত্ত্বকে কেন্দ্র করে আবর্তিত ...। মার একটি পা ছোট আরেকটি পা বড়। এইটা মা শৈশব থেকে জীবনের এই পর্যায় পর্যন্ত কোনোদিনও মানতে পারেনি। আলাদা হতে যে, ইলেকট্রিসিটির বদলে হারিকেন জ্বালাতে চায়, দুঃস্বপ্ন ভালো এসব বোধ দিয়ে কন্যাকে নানা যুক্তির প্যাঁচ কষে। কন্যা তর্ক করে কিন্তু তার সঙ্গ ছাড়ে না। সেই কন্যারই কোনো এক... তার বোধে কী ঘটে... তার কোনো মীমাংসা মেলে না।

পরপুরুষ (The stranges) গল্পে এক মরদরূপী পুরুষের অবলা স্ত্রীর দাম্পত্যের টানাপড়েনে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয়... নারীটি ভুতুড়ে আচ্ছন্নতার মধ্যে নানা রকম স্বপ্ন, দুঃস্বপ্নের মাঝে জীবন বিলিয়নে বিলড়নে বিস্ফোরণের মাঝে অকস্মাৎ তালাকপ্রাপ্ত হয়। অনুতপ্ত স্বামী স্ত্রীকে ফেরত চায়। শরীর না দেয় এসব প্রবণতায় গল্পের চূড়ান্তে গিয়ে বাঁক বদল ঘটে। হত্যাকারী (The killer)  গল্পটি প্রচুর তৎসম শব্দে ভাষা... ম্যাজিক এবং সুররিয়ালিজমের ঘূর্ণিপাকে আবর্তিত। পাঁচশ বছর পর কবর ফুঁড়ে ওঠা এক আজব বৃদ্ধা। তার অবর্ণনীয় সুন্দরী নারী, যাকে সে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসত। সেই স্ত্রীর খুনির সন্ধানে রক্তপানের নেশায় সারা গ্রামকে বিস্মিত, তোলপাড় করে প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মাদ হয়ে ওঠে। আজব সেই মানুষ মহুয়ার ঘ্রাণে আচ্ছন্ন হয়ে এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ায়। প্রতিপক্ষ শকুনেরা (Vultures) গল্পের ভাঁজে ভাঁজে অন্যান্য গল্পের চেয়ে মনস্তত্ত্বের বিস্তার কম কিন্তু রক্তপাত... দহন প্রবল। এক ঘূর্ণায়মান চার মরা গরুর চামড়া খুলে নিতে আসা এক যুবকের শত শত শকুনের পাল্লায় পড়ে লড়াই অসহায়ত্ব... এসব দ্বারা আক্রান্ত এই গল্পটিকে অন্য ধাঁচের লেখার চেষ্টায় পরতে পরতে চক্করের প্রচেষ্টা করেছি।

বিশ্বাস খুনি (The Flute Player) গল্পটিতে তুমুল মুক্তিযুদ্ধের আবহে ওসমান নামের এক লড়াকু যোদ্ধা... তালপাতার বাঁশি বাজায় এমন এক উদাসীন ছেলের মমতায় আচ্ছন্ন হয়ে সবার প্রতিরোধ উপেক্ষা করে তাকে ক্যাম্পে রাখে। একদিকে যোদ্ধা আরেক দিকে ফেলে আসা অতীত ওসমানকে কখনো বিহ্বল করে... কখনো লড়াকু করে... এসব বিষয় ভাষা বিন্যাসের মধ্যে গল্পে তুমুল বাকবদল ঘটে। আমার জন্ম (My Brith) গল্পটিতে... গল্পটি কন্যাসন্তানের জন্মের কারণে স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণে ডুবাতে ডুবাতে... চতুর্থ কন্যা জন্মের পর স্বামী নিরুদ্দেশ হয়... সে যখন ফেরে স্ত্রী তখন বিষের বাটি সাজিয়ে সবে বসেছে। এক কন্যার ক্রমাগত বলে যাওয়া কথনে গল্পটিতে তার মধ্যে বেদনা, তার অনুভব ক্রন্দন প্রতিবাদের মধ্যেও প্রচলিত গল্প মনে হলেও বিন্যাস দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতায় এটাকে অন্য ধাঁচের করার প্রয়াসের কারণে গল্পটিকে এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছি।

‘গরটিকানিয়া’ (A Temporary Sojourn) এই বইটির শিরোনাম গল্প। নিটোল ভঙ্গিমায় মাটি দিয়ে মূর্তি বানাত এবং নারী... তার প্রেমে উন্মুক্ত হয়ে গ্রামের ধর্ম পরোয়াহীন এক যুবক সেই নারীকে বিয়ে করে তাকে ইসলাম কোরআন শিখিয়ে নিজেও স্তর মতো মুসলি­ হয়ে ওঠে। নারীটিও অশিক্ষিত চেতন সত্তায় প্রাণেমনে মুসলমান হয়ে ওঠে। সংকট তৈরি হয় পুত্র জন্মের পর তার বাড়ন্ত সময় থেকে... গল্পের শুরুতেই... কাদের আলী রক্তাক্ত ছুরি হাতে নদীর দিকে ধাওয়া করে... ধাঁই ধাঁই শকুন মরিয়া হয়ে তার পিছু নেয়।

‘আমাকে আসলে কেমন দেখায়’ (How Do I look, Really) উত্তম পুরুষে লেখা এই গল্পটি প্রচুর আলোচিত। বাসযাত্রী এক নারী তাকে চোর সন্দেহে যখন নেকড়ের মতো তার দিকে তাক করে থাকে আরেক যাত্রী তার অপ্রাপ্তি পরিবার ঐতিহ্য অসহায়ত্ব দারিদ্র্যের মধ্যেও ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে সচেতন এ নারীর ভাবনার নানারকম ক্ষরণ স্বপ্নের মধ্যে এক সময় এক নিকট সত্যের মুখোমুখি তাকে দাঁড় করায়। কালো বিড়াল (The Black Cat) এলানপো আক্রান্ত... আমার একটি বই-ই আছে ‘এলানপোর বিড়াল নামে’। পঁচিশটি ছোট-বড় গল্পের শেষ লাইন একটাই- একটি রক্তাক্ত কালো বিড়াল মরে পড়ে আছে। এটিও ভুতুড়ে আছন্নতায় সম্পূর্ণ অন্য জগতে চলে যাওয়া স্বামী বিতাড়িত এক নারীর গল্প। ঠাকুরমার ঝুলির মতো চরিত্রের এক দাবির আশ্রয় নেয়... যে ক্রমাগত একটি কবর ক্ষরণে লিপ্ত থাকে প্রতিশোধ স্পৃহায়... এ গল্পেরও শেষ লাইনও...। ছেলেটি যে মেয়ে, মেয়েটি তা জানত না (She didn’t Know he was a Woman) গল্পটিতেও পুরুষ দ্বারা বিপর্যস্ত নারী অক‚ল দরিয়ায় অন্য সব দয়াল পুরুষের কাছে আশ্রয় নেয়। এখানেও গল্পের দুভাগে ডানাওয়ালা ঘোড়ার রূপকথা। এ ঘরের যুক্ততার মূর্ততা আছে। এর মাঝে নারীটি স্বপ্ন, স্বপ্ন ভঙ্গের মাঝ দিয়েই এগিয়ে গেছে। সমকামিতার বিষয়টি সংক্ষিপ্ত কিন্তু জোরালোভাবে আনার চেষ্টা করেছি। সান্ধ্য মুখোশ (The Evening Mask) গল্পে বদলি হয়ে পরিবার রেখে আসা এক বিচ্ছিন্ন একাকী অধ্যাপক। তাঁর বাড়িতে দুর্লভ মুখোশ পাওয়া এক বিহ্বল বালিকা সেই মুখোশ পরেই ঘরের কাজকর্মে লিপ্ত হয়... ইডিপাস নিয়ে রচিত এক গ্রন্থে অধ্যাপক ডুবে যান। তিনি এই কাহিনীকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিতে মানসিকভাবে বিন্যস্ত করতে করতে টুকটাক কথোপকথন বালিকার সাথে করলেও... কখন যে সেই গল্প অধ্যাপককে সেই চরিত্র বানিয়ে ফেলে এবং যে মর্মান্তিক হয়ে ওঠে নিজের বোধেও তা তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। এই বইটির বেশির ভাগ গল্প অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত আমার বই ‘নির্বাচিত গল্প’ থেকে নেওয়া। এই গ্রন্থের বোদ্ধা অনুবাদকগণ- আঞ্জুমান আরা, ইসরাত জাহান বাকী, রিমি বি চট্টোপাধ্যায়, প্রণীত দত্তগুপ্তা, মো. জামাল হোসাইন, সিতারা জাবিন, জাকিয়া কবির, নূজহাত আমিন মান্না, মাসরুফা আয়েশা নূসরাত, রেবেকা হক, নিয়াজ জামান...। তারা দুর্দান্ত শৈল্পিক বোধ এবং আমার ভাষা বিষয়কে প্রায় কব্জা করে আত্মস্ততার মধ্য দিয়ে গল্পগুলো অনুবাদ না করলে এই গ্রন্থটি সমৃদ্ধ হতোই না। তাদের কাছে আমার ঋণের সীমা নেই। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন এবং কবি, অনুবাদক কায়সার হককে। মহিউদ্দিন আহমেদ আর নিয়াজ জামানের কাছে আমার ঋণ-অপরিশোধ্য।

তাজ্জব যে- আমার বই সম্পর্কে আমাকেই পুখানুপুঙ্খ শেখার এবং আমার হাজার প্রতিবাদেও এ শুক্রবারই লেখার জন্য যে আন্তরিক চাপ দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের শেখ মেহেদী, এ আমার জীবনে প্রত্যাশার বাইরে। নিশ্চয়ই প্রচ্ছন্ন ভূমিকায় আছেন আরেক পরম সুহৃদ নঈম নিজাম। দুজনকেই অসংখ্য ধন্যবাদ। কত যে কঠিন আমার প্রায় কাহিনীবর্জিত গল্পের একটি বাক্য লেখা, তা হাড়ে হাড়ে জীবনের প্রথম অনুভব করেছি। ভালো করলাম না গল্পের লেখার বারোটা বাজালাম এই টেনশন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য পাঠক প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলাম।

সর্বশেষ খবর