শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধ আমার শিল্পকর্মের প্রেরণা

বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিনের ‘শান্তি’ শীর্ষক একক প্রদর্শনী চলছে কলকাতার গ্যাঞ্জেস আর্ট গ্যালারিতে। প্যারিস প্রবাসী এই শিল্পী সম্প্রতি ফরাসি সরকারের ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। তার প্রদর্শনী ও শিল্পচর্চা নিয়ে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে। তার চুম্বকাংশ এখানে তুলে ধরা হলো।

মুক্তিযুদ্ধ আমার শিল্পকর্মের প্রেরণা

নিজের স্টুডিওতে ছবি আঁকায় মগ্ন শিল্পী শাহাবুদ্দিন ছবি : জয়ীতা রায়

• এই প্রথম কোনো রাষ্ট্রপতি একজন চিত্রশিল্পীর শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর উদ্বোধন করলেন; আপনার অনুভূতি কী?

ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি আমার শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর উদ্বোধন করায় আমি আনন্দিত। পৃথিবীতে ইতিপূর্বে জীবিত চিত্রশিল্পীর কোনো প্রদর্শনী কোনো রাষ্ট্রপতি উদ্বোধন করেননি। আজ বাঙালি জাতির জন্য একটি নতুন ইতিহাস রচিত হলো। আমার বিশ্বাস আজকের এ ঘটনার মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি এবং বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও মজবুত হবে।

• আপনার প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘শান্তি’ দিলেন কেন?

সম্প্রতি ফ্রান্সে জঙ্গি হামলা হয়েছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য! কোনো মানুষ এ দৃশ্য দেখে স্বাভাবিক থাকতে পারেন না। সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। স্কুলে বোমা হামলা হচ্ছে। পৃথিবী অশান্ত। আমি মনে করি পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের একমাত্র উপায় অস্ত্র ত্যাগ করা। চিত্রকলাই পারে পৃথিবী থেকে অশান্তি দূর করে শান্তি স্থাপন করতে। এ জন্য আমার প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘শান্তি’। বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মানুষের জীবনে শান্তির বার্তা পৌঁছে দিতে এই প্রদর্শনী। 

• ভারতে আপনার দ্বিতীয় প্রদর্শনী।

ইতিপূর্বে গ্যাঞ্জেস গ্যালারি আমার শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। সেটা ২২ বছর আগের কথা। এরপর আমার শিল্পকর্মে নানাবিধ পরিবর্তন এসেছে। নতুন ভাবনা যোগ হয়েছে। বর্তমান প্রদর্শনীতে নতুন সব ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে। এবার মহান বিজয়ের মাসে আমার প্রদর্শনী হচ্ছে। এটা শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। আমি বিশ্বাস করি, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা।  

• শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে আপনার মূল প্রেরণা কী?

মানুষ পৃথিবীতে পিপীলিকা হয়ে থাকার জন্য আসেনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের জন্য, একটি পতাকার জন্য আমিও সেদিন অস্ত্র হাতে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের প্রচণ্ড শক্তি আমার শিল্পকর্মে আমি বহন করে চলেছি। সব সময় নতুন চেতনা নিয়ে নতুন আলো ফেলে মুক্তিযোদ্ধার বলিষ্ঠ চিত্র আমি এঁকে চলেছি। আমার সব প্রেরণা পেয়েছি মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে।  

• মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলেছিলেন কখন?

১৯৭১ সালে আমার ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার কথা। ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেই আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলাম। রাজনীতি ছিল আমার পারিবারিক উত্তরাধিকার। আমার বাবা ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা। ছাত্রলীগের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পোস্টার-ফেস্টুন লেখার কাজ করতাম। ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিই। ক্যাম্পে যোগ দিই পয়লা মে। আগরতলায় ছিল আমাদের সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। আমাদের ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। অসাধারণ মানুষ। খালেদ মোশাররফ ও কাপ্টেন হায়দার এই দুজনের জন্যই আমরা ট্রেনিং নিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পেরেছি। তারা দুজনই আমাকে আদর করতেন।

• প্রশিক্ষণ শিবিরে বসেও নাকি আপনি ছবি আঁকতেন?

আগরতলায় প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের বেকার সময় কাটছিল। আমি মাঝে-মধ্যে আঁকিবুঁকি করতাম। একদিন জঙ্গলে বসে বঙ্গবন্ধুর পোট্রেট আঁকছিলাম। ছবি আঁকার খবর অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। খবরটি শওকত ভাইয়ের কানে যায়। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে ২২ রুপি হাতে দিয়ে বললেন— ‘যাও, আগরতলা গিয়ে রংতুলি নিয়ে আসো। তুমি আঁকা থামিয়ে দিও না।’ আমি ছুটি নিয়ে আগরতলায় গিয়ে পুরনো গণেশ ক্যালেন্ডার, দুর্গা ক্যালেন্ডার, চোখে দেওয়ার কাজল, আইভ্রু পেনসিল, আলতা এসব কিনে আনলাম। কিছু ছবিও আঁকলাম। একদিন শওকত ভাই বললেন, আমাদের ক্যাম্পে একটা বনভোজন হবে, তোমার ছবিগুলো দেখানো যায় কীভাবে?

• আপনার ছবিগুলো নিয়ে কি প্রদর্শনী হয়েছিল?

আমি তখন মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী আজম খানের সঙ্গে কথা বললাম। ও ছিল ১৩ নম্বর প্লাটুনে, আমি ১৭ নম্বর প্লাটুন কমান্ডার। আমি আর আজম ঠিক করলাম একই সঙ্গে ছবি প্রদর্শনী ও গানের অনুষ্ঠান করব। পরে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফকে বিষয়টি জানাতেই উনি খুশি মনে অনুমতি দিলেন। জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন গাছে রশি বেঁধে ঘরের মতো জায়গা তৈরি করলাম। জাম্বুুরা গাছের কাঁটা দিয়ে তার ওয়ালে টানানো হলো ১২টি ছবি। দুটো ২০০ পাওয়ারের টর্চলাইট আনা হলো ভারতীয় আর্মির কাছ থেকে। আগরতলা থেকে হারমোনিয়াম আনা হলো। আজম গাইল ‘ধন ধান্যে পুষ্প ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা’ গানটি। এভাবে প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। সেদিন বিশ্রামগড়সহ অন্যান্য ক্যাম্পের যোদ্ধাদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। আমরা সবাই মিলে খিচুড়ি খেয়েছিলাম। ওই প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান, সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার, সুলতানা কামাল, সাইদা কামাল প্রমুখ।

 

 

• আপনার নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সালদা নদীসহ অত্র এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধ হয়েছিল।

আমরা ২১ দিনের গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় তিন সপ্তাহ বেকার বসে থেকে মানসিকভাবে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ল। অন্য কোথাও যেতেও পারছিলাম না। আমাদের ট্রেনিং নেওয়া, সার্বিকভাবে প্রস্তুত। শুধু আর্মস, ওইপেনসের জন্য আমাদের ফ্রন্টে পাঠানো হচ্ছে না। আমরা কখনো-সখনো উত্তেজিত হয়ে বলি, আর্মস দেন না কেন? মেজর খালেদ মোশাররফ একদিন ডেকে বললেন— ফুর্তি বাহিনী যাও, সালদা নদীতে গিয়ে যুদ্ধ করে দেখিয়ে দাও। আমরা গানবাজনা আঁকিবুঁকি করতাম, এ জন্য তিনি আমাদের ফুর্তি বাহিনী বলে ডাকতেন। আমাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে ১৪ আগস্ট পাঠালেন। ওই দিন ছিল পাকিস্তান দিবস। পাকবাহিনী মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সালদা নদী রেলস্টেশনে ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘাঁটি। আমাদের জানানো হয়েছিল, পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের লোকজন আছে। লাকসাম, কসবা আর সালদা নদী তিনটাই আমার দায়িত্বে ছিল। আর সীমান্তের ওপারে ভারতীয় বাহিনী। আমাদের মনে কিছুটা ভয় ছিল কী হয় না হয়? আবার মনে মনে চিন্তা করলাম, মরবই যখন বাংলাদেশেই গিয়ে মরি। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে নদী সাঁতরে আমরা পজিশন নিয়ে রাত আড়াইটায় পাকিস্তানি বাহিনীকে অ্যাটাক করি এবং অত্র এলাকা দখলে নিই। আমরা ১৪ দিন খেয়ে না খেয়ে যুদ্ধ করেছিলাম।

• প্রথমবারের মতো আপনিই শাহবাগ রেডিও অফিসে পতাকা তুলেছিলেন।

১৬ ডিসেম্বর সকালে আমরা সহযোদ্ধারা মিলে শাহবাগ রেডিও অফিস দখল করি। রেডিও অফিসে পাকিস্তানের পতাকা খুলে মফিকের হাত থেকে আমাদের পতাকা নিয়ে উড়িয়ে দিই। ওই মুহূর্তে রেডিও অফিস ও পাশের ঢাকা ক্লাবের ভিতর প্রায় সাড়ে ৩০০ সেনাসদস্য লুকিয়ে ছিল। ওই সময় পিজি হাসপাতালের ছাদ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ে। তাতে মফিকসহ ১৩ জন নিহত হয়। আমরা তখনো জানতাম না বিকালে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর হবে। তারপর বিকালে আমরা দলিল স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দিই।

• প্যারিসে যাওয়ার পর আপনার শিল্পকর্মের আঙ্গিক ও উপস্থাপনার ব্যাপক উত্কর্ষ লাভ করেছে।

১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে এক প্রদর্শনীতে ২৭ হাজার টাকার ছবি বিক্রি করি। ওই টাকা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই। বঙ্গবন্ধু বললেন— ‘ওই টাকা তোর বাপকে দে।’ তিনি আমাকে তার অফিসে ডাকেন। বঙ্গবন্ধু আমাকে প্যারিস পাঠালেন। বিমানবন্দরে আমাকে সিআপ করতে গিয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, ড. কামাল হোসেন, মেজর জিয়াউর রহমান এবং আব্বা। প্যারিসে গিয়ে প্রথম দিকে আমার বেশ কষ্ট হয়েছে। নিজ হাতে দেশ স্বাধীন করলাম। সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনায়। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে আমি বেশ মুষড়ে পড়েছিলাম। তারপর আবার ছবি আঁকায় মন দিলাম। ওই সময় আমি নিজস্ব একটি আঙ্গিক তৈরির চেষ্টা করছিলাম। তা ছাড়া প্যারিসে না থাকলে পেইন্টিংয়ের নতুন নতুন সব কলাকৌশলগুলো জানতে পারতাম না। মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ আমার শিল্পকর্মের মূল প্রেরণা।

• ছবি আঁকায় আপনার পরিবার আপনাকে কতখানি সহযোগিতা করে?

আমি খুব ভাগ্যবান। আমার স্ত্রী আনা ইসলাম ও কন্যা চর্যা ও চিত্র আমাকে দারুণভাবে সহযোগিতা করে। আমার স্ত্রীর চিত্রকলা এবং বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার ভীষণ দুর্বলতা। আমার প্রদর্শনীর আয়োজন সবকিছুই সেই করে। সন্তানরাও আমার চিত্রকলাকে সম্মান করে।

সর্বশেষ খবর