শিরোনাম
শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

জয়নুল আবেদিন ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

হাশেম খান

জয়নুল আবেদিন ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ

সুমনদের পাশের বাড়িই মেহের লিলুদের। পুরো নাম লাভলী মেহের লিলু। সুমন ডাকে লিলু বুবু। লিলু চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। অবশ্য তার পঞ্চম শ্রেণিতে থাকার কথা। কিন্তু সেই যে যুদ্ধ হলো— নয় মাস যুদ্ধ, তাতে বছর পিছিয়ে গেল। অবশ্য ওদের স্কুলের সবাইকেই এক শ্রেণিতে ওপরে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে। কিন্তু লিলু বুবু নেয়নি। সে যুদ্ধের আগে যে শ্রেণিতে ছিল সে শ্রেণিতেই রয়ে গেছে। এ জন্যই লিলু বুবুকে ভালো লাগে সুমনের। সুমনকেও উত্তীর্ণ করে দিয়েছিল চতুর্থ শ্রেণিতে। লিলুর দেখাদেখি সেও পরীক্ষা না দিয়ে ফলাফল নেয়নি। মাকে বলতেই মা রাজি, সুমনের সিদ্ধান্তে খুশি। থেকে গেল শ্রেণি তৃতীয়তে। লিলু বুবুকে সুমনের ভালো লাগে আরও অনেক কারণে। সুমনকে লিলু অনেক গল্প বলে, বই পড়তে দেয়, ছবি আঁকতে দেয়। আর একটা ব্যাপারে লিলু বুবু আর সুমনের পরিবারের মিল আছে। মাত্র কয়েক মাস আগে যে যুদ্ধ শেষ হলো— মুক্তিযুদ্ধ, তাতে লিলুর ভাই শহীদ হয়েছেন, আর সুমনের বাবাকেও দেশ স্বাধীন হওয়ার দুদিন আগে চোখ বেঁধে জোর করে ধরে নিয়ে যায়। বাবা আর ফিরে আসেননি। অনেক খোঁজ করা হয়েছে বাবাকে। কিন্তু তার আর সন্ধান পাওয়া গেল না। পরে মার কাছে শুনেছে, তার বাবাকে রাজাকার ও আলবদররা ধরে নিয়ে গেছে। সেদিন ছিল ১৪ ডিসেম্বর ১০৭১ সাল।

এই রাজাকার ও আলবদররা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে পাকসেনাদের সঙ্গে থেকে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, বহু নারীকে ধর্ষণ করেছে। অনেক জ্ঞানী-গুণী, সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক, ডাক্তার আর দেশদরদীকে স্বাধীনতা লাভের মাত্র দুদিন আগে আলবদর ও  রাজাকাররা ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের অনেকেরই লাশ পাওয়া গেছে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে, মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে। কিন্তু চাচার সঙ্গে, মায়ের সঙ্গে সব জায়গায় ঘুরে দেখেছে সুমন— বাবার কোনো হদিসই পাওয়া যায়নি। বাবার ছবি আঁকল সুমন— এঁকেছে আরও অনেক ছবি। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস ও অনেক ঘটনা দেখেছে— অনেক ঘটনা শুনেছে বাবার কাছে। ওরা কত জায়গায় যে পালিয়ে বেড়িয়েছে তার ঠিক নেই।

বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে জিঞ্জিরায় যখন পাকসেনারা আগুন লাগিয়ে হাজার হাজার মানুষকে গুলি করতে করতে ধেয়ে চলেছে— কী ভয়াবহ অবস্থায় যে সুমনরা পড়েছিল সেদিন— আজ ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। মার কোলে সুমনের এক বছরের বোন আলেয়া। সুমনের হাত ধরেছে বাবা।  সঙ্গে আছে বাবার পরিচিত লোক। সবাই ছুটছে প্রাণপণে। গুলি করতে করতে পাকসেনারাও ধেয়ে আসছে। তাদের চেলাচামুণ্ডারা আশপাশে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। কতবার যে সুমন হোঁচট খেয়েছে, পড়ে গিয়ে ডান পা হাঁটুর কাছে কেটে গেছে, বাবা তাড়াতাড়ি রুমাল দিয়ে বেঁধে দিয়েছেন। রক্ত বন্ধ হলো কিনা দেখার ফুরসত নেই। কেবল ছুটে চলা— যত জোরে পারা যায়। হঠাত্ ডানপাশে তাকিয়ে সুমন চমকে ওঠে। সুঠামদেহী এক ভদ্রলোক, সঙ্গে আরও দুজন, তাদের পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে। বাবার হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে অস্ফুট স্বরে সুমন বলে ওঠে ‘বাবা, জয়নুল আবেদিন’। সুমনের বাবা পাশের ভদ্রলোকের দিকে তাকান। দেখেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। ভদ্রলোকও সুমনের কথা শুনেছেন, নিজের নাম শুনেই তিনি চমকে ওঠেন। সুমনের বাবা বলে ওঠেন— স্যার আপনি? হ্যাঁ, আমাদের সবারই তো এখন একই অবস্থা। শুধু ছুটতে হচ্ছে, পালাতে হচ্ছে। আর না হয় মরতে হচ্ছে। কথাগুলো বলে তিনি সুমনের চুলগুলো হাত দিয়ে নেড়ে আদর করে আবার বললেন, আহারে!

এমন সময় পেছনে প্রচণ্ড আওয়াজ হলো মর্টারের। তিনি বললেন, থামবেন না। পালান-দৌড়ান— ওরা খুব কাছে এসে গেছে। আর কত ছুটতে হবে, ব্যথায় পা টন টন করছে। সুমনের পা আর চলছে না। সুমনের মাও ক্লান্ত। মেয়েকে কোলে নিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে ছুটে চলেছেন। সঙ্গের অন্য সবাই অনেক এগিয়ে  গেছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনও এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সুমনের দিকে তাকিয়ে মনে হয় গতি একটু কমিয়ে দিলেন, হাঁটার গতিও একটু বাড়াতে বললেন, পেছনের গুলি-গোলার আওয়াজ যেন অনেক কাছে এসে গেল। বাবা উত্কণ্ঠিত হয়ে উঠলেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে সুমন ভালো করে চেনে। সুমন ছবি আঁকে। কচি-কাঁচার মেলার ছবি আঁকার স্কুল ‘শিল্প বিতানে’ ছবি আঁকতে যায়। একবার ছোটদের ছবির প্রদর্শনীতে সুমন পুরস্কার পেয়েছিল। শিল্পাচার্যের হাত থেকে সে পুরস্কার নিয়েছে। সেই ছবি কাগজেও ছাপা হয়েছিল।

সুমনরা অনেক পিছিয়ে রয়েছে। আর সবাই এগিয়ে গেছে অনেক দূর। কেবল শিল্পাচার্য ও তার দুবন্ধু সুমনদের পাশে পাশে যাচ্ছেন। এমন সময় সাঁই-সাঁই করে মনে হলো কয়েকটা গুলি কানের পাশ দিয়ে ছুটে গেল। শিল্পাচার্য সবাইকে বললেন— সাবধান! নিচু হয়ে চলুন। আবার বললেন, না— এভাবে ছুটলে মরতে হবে। এক কাজ করুন— আমার সঙ্গে আসুন— বলে তিনি সবাইকে নিয়ে রাস্তার কাছেই একটি গোয়ালঘরে ঢুকে পড়লেন। গোয়ালঘরটা ছিল গাছপালার আড়ালে। রাস্তা থেকে দেখাই যায় না। কিন্তু গোয়ালঘরে একদম জায়গা নেই। একপাল ছাগল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। খুব কাছেই প্রচণ্ড আওয়াজ হলো। সবাই ভয়ে কেঁপে উঠল কিন্তু আশ্চর্য— ছাগলগুলো একদম চুপ নড়ন-চড়ন নেই। মনে হয় পাথরের তৈরি। এক মুহূর্ত কী ভাবলেন শিল্পাচার্য। সবাইকে বললেন— বসে পড়ুন, শুয়ে পড়ুন ছাগলের ফাঁকে ফাঁকে— যেন রাস্তা থেকে আমাদের দেখা না যায়। ওরা এসে গেছে। আমাদের দেখলেই গুলি করবে।

পাকসেনারা সত্যি সত্যি এসে গেল। গোয়ালঘরের দিকে তাকাল, সবার মনের অবস্থা— এই বুঝি গুলি ছুড়ল। এবং সত্যি সত্যি প্রচুর গোলাগুলি ছুড়ল ওরা। চোখ-কান-নাক বন্ধ করে ছাগলের ফাঁকে ফাঁকে নিজেদের আড়াল করে রেখেছে সবাই। কিন্তু না, কারও গায়ে গুলি লাগল না। এদিক-সেদিক ওরা প্রচুর গোলাগুলি ছুড়েছে কিন্তু গোয়ালঘরের দিকে ছোড়েনি। গোয়ালঘরটা গাছপালার আড়ালে। রাস্তা থেকে দেখা যায় না। ছাগলের গায়ের গন্ধ মলমূত্রের গন্ধের সঙ্গে মিশে একটা বোটকা গন্ধে প্রায় বমি আসার অবস্থা। সবচেয়ে আশ্চর্য, ছাগলগুলো ছিল একদম নীরব। এত তীব্র গোলাগুলির শব্দে মনে হয় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিংবা মানুষের বিপদ বুঝেই তারা একচুলও নড়েনি। পাকসেনারা সামনের দিকে এগিয়ে গেলে কিছুক্ষণ পর সুমনরা মাথা তুলল। এতক্ষণ পর ছাগলগুলোও একটু নড়েচড়ে গা-ঝাড়া দিয়ে দাঁড়াল। এরপর শিল্পাচার্য সবাইকে নিয়ে অন্যপথ ধরে ধলেশ্বরী পার হয়ে এক গ্রামে আশ্রয় নিলেন। মাত্র চার মাস আগে যে যুদ্ধ শেষ হলো তার কথা এত তাড়াতাড়ি ভোলা যায় না। সুমনের মনে অনেক স্মৃতি ভিড় করে আছে। কাগজ-রং-তুলি নিয়ে বসে। গত তিন দিন ধরে সুমন পর পর কয়েকটি ছবি এঁকেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের, পাকসেনাদের অত্যাচারের, মুক্তিসেনাদের বীরত্বের। খবরটা এনে দিয়েছিল লিলু বুবু। কচি-কাঁচার মেলা থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর ছবি আঁকার ক্লাস বসছে। কচি-কাঁচার ছেলেমেয়েরা অনেক ছবি এঁকেছে যুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে। লিলু বুবুর সঙ্গে গিয়ে সুমন তার আঁকা চারটি ছবি দিয়ে এলো দাদাভাইকে।

ছোটদের আঁকা তিনশ ছবি নিয়ে প্রদর্শনী হলো কচি-কাঁচার মেলার নতুন কার্যালয়ে। উদ্বোধন করলেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের প্রধানমন্ত্রী। তিনি দায়িত্বে থেকে ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকে সুসংহতভাবে পরিচালনা করেছিলেন। বাংলাদেশের শিশুরা স্বাধীনতা যুদ্ধকে যেভাবে দেখেছে, উপলব্ধি করেছে, যেসব ঘটনা শিশুদের মনে দাগ কেটেছে, তাদের সহজ-সরল মনকে আন্দোলিত করেছে, তারই ছবি। গ্রামের পর গ্রাম, শহর-বন্দর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করার দৃশ্য, নিরীহ মানুষকে ধরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারার ছবি, যুবক ছেলেদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করার ছবি, আবার অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণের ছবি, পাকসেনাদের সঙ্গে সামনা সামনি যুদ্ধের দৃশ্য, শত্রু বাহিনীকে নাজেহালের দৃশ্য, তাদের আত্মসমর্পণের দৃশ্য। শিশুরা এখানে ক্ষান্ত হয়নি, আরও আছে যুদ্ধ শেষের ছবি, বধ্যভূমির ছবি, কঙ্কালের স্তূপের ছবি। বিজয়ীর বেশে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরছে— সেই ছবিও নানাভাবে এঁকেছে। দেশ নতুনভাবে এগিয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর প্রথম ঘরে ফিলরেন, ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে এলেন, এমন সব ছবি আঁকা হয়েছে।

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। স্বাধীনতার পর নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলার নতুন অফিস ভবন জয়কালী মন্দির রোডে। যুদ্ধকালীন সময়ে পুরনো অফিস ছিল ইত্তেফাক ভবনে। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে ইত্তেফাক ভবনের সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় মেলার অফিস লাইব্রেরি, নথিপত্র ও বহু মূল্যবান সরঞ্জাম পুড়ে ছাই হয়ে যায়। নতুন ভবনে ছবি আঁকার স্কুল ‘শিল্পবিতান’ ও গানের স্কুল সুবিতানে, নবরূপে ক্লাস শুরু হয়েছে। শিশু-কিশোরদের মনে প্রচুর উত্সাহ। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নতুন দেশ বাংলাদেশের নাগরিক এখন তারা। নতুন ভবনে একদিন কচি-কাঁচার কেন্দ্রীয় মেলার সভা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন কেন্দ্রীয় মেলার উপদেষ্টা। সভায় যোগ দিতে এলেন তিনি। সভা চলার অবসরে তিনি শিল্পবিতনের কামরায় ঢুকে ছোটদের ছবি দেখেন ঘুরে ঘুরে। অবাক হয়ে যান, প্রায় প্রতিটি শিশুই আঁকছে প্রিয় দেশ মাতৃভূমির ছবি-স্বাধীনতা যুদ্ধের ছবি। পুরো নয় মাসের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে এদের সব ছবি। কচি-কাঁচাদের দেশের প্রতি ভালোবাসা তাদের সহজ-সরল মনের সত্য প্রকাশ তাকে আবেগে আপ্লুত করে। প্রতিটি শিশুকে তিনি সেদিন আদর করেন আর সংকল্প নন— এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে দেশের বাইরে। বিশ্বকে জানাতে হবে আমাদের শিশুরা যে দেশপ্রেমিক-আর স্বাধীনতার জন্য তারা অন্যায় আর অবিচারের বিরুদ্ধে কেমন করে লড়ে। শিল্পাচার্য শিশুদের ভালোবাসতেন আর মনে করতেন এদের নিয়েই কাজ করতে হবে— এরা দেশের ভবিষ্যত্। এদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারলেই সমাজ সুন্দর হবে রুচির দুর্ভিক্ষ দূর হবে। আর তাই তিনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন কচি-কাঁচার মেলার সঙ্গে।

তিনশ ছবি থেকে নিজ হাতে সত্তরটি বাছাই করবেন। নিয়ে যাবেন লন্ডনে। সেই সময় শিল্পাচার্য শারীরিকভাবে অসুস্থ হন। ধীরে ধীরে তার অসুস্থতা জটিল হতে শুরু করে। তার মুখের একটা দিক অবশ হয়ে যায়। সদ্যমুক্ত স্বদেশে চিকিত্সার অনেক অসুবিধা। তার আশু চিকিত্সার প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের গর্ব স্বনামধন্য শিল্পীর সুচিকিত্সার জন্য তাকে লন্ডন পাঠানোর সবরকম ব্যবস্থা তিনি করলেন। লন্ডনে চিকিত্সার জন্য যাওয়ার সময়ই শিল্পাচার্য কচি-কাঁচার মেলা আয়োজিত যুদ্ধের অভিজ্ঞতাভিত্তিক বাংলাদেশের শিশুদের আঁকা নির্বাচিত সত্তরটি ছবি সঙ্গে নিয়ে যান।  ১৯৭২ সালের ২২ জুন। লন্ডনের কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউট ভেঙে পড়ল। বাংলাদেশের শিশুদের আঁকা ছবির খবর ছড়িয়ে পড়ল লন্ডনে। শুধু লন্ডনেই নয়, অন্যান্য দেশেও। লন্ডন হচ্ছে এমন একটা শহর, যেখানে বিশ্বের প্রায় সব দেশের লোকের যাতায়াত। খবর বের হলো বাংলাদেশের সব কাগজে, এমনকি ভারতের প্রধান প্রধান কাগজেও। লন্ডনের কাগজগুলো এই প্রদর্শনীকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে তাদের কাগজে খবর পরিবেশন করল। যুদ্ধের ঘটনাবহুল অনেক ছবি তাদের কাগজে ছেপে বের হলো। শিশুরা সরল ও সহজ। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও পাকসেনাদের অত্যাচার তাদের কোমল হূদয়ে যেরূপ গভীরভাবে রেখাপাত করে, তারই প্রতিভাস হলো ছবিগুলো। শিশুমনের সারল্য দিয়ে খুব সহজ ভঙ্গিতে আঁকা ছবিগুলো। প্রতিটি ছবির বিষয় থেকে বাংলাদেশের বাইরের জগতের লোকরা জানতে পারল বাংলাদেশের ওপর হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের প্রকৃত রূপটি কত ভয়াবহ ছিল।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন অসুস্থ শরীরে তার ভালোবাসার আধার কচি-কাঁচার মেলার এই সত্তরটি ছবি নিয়ে লন্ডনে হাজির হন ১৯৭২ সালের এপ্রিলে। চিকিত্সার জন্য চলে যান হাসপাতালে। ছবিগুলোর একটি প্রদর্শনীর আয়োজনের জন্য তিনি শিল্পী আবদুর রউফকে উদ্যোগ নিতে বলেন। শিল্পী আবদুর রউফ তখন লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে কর্মরত। তার চেষ্টা এবং বিবিসির সিরাজুর রহমানের সহযোগিতায় প্রদর্শনীটির ব্যবস্থা হলো কমনওয়েথ ইনস্টিটিউটে। প্রদর্শনীকে সার্থক করে তোলার জন্য আরও অনেক সাহায্য ও উত্সাহ যুগিয়েছিলেন। বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগও ছিল এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য। প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের তত্কালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। প্রদর্শনী উপলক্ষে উদ্যোক্তারা শিশুশিল্পী ‘দিনার’ একটি ছবি দিয়ে একটি সুন্দর পোস্টার প্রকাশ করেন। পোস্টারটি চার পেনি মূল্যে সর্বসাধারণের কাছে বিক্রি করে সে অর্থ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য তহবিলে দান করা হয়। অসংখ্য মানুষ পোস্টার চিত্রটি সংগ্রহ করে। পরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে প্রদর্শনীটি এডিনবরায় ও কানাডায় অনুষ্ঠিত হয়।

সর্বশেষ খবর