শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বঙ্গবিদ্যা সম্মেলন ও বাংলা সাহিত্য

আশিক মুস্তাফা

বঙ্গবিদ্যা সম্মেলন ও বাংলা সাহিত্য

টোকিওতে আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম

আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা সমাজের উদ্যোগে চতুর্থ আন্তর্জাতিক বঙ্গবিদ্যা সম্মেলনে আমন্ত্রণ পাই জাপানের টোকিওতে। আয়োজন ছিল দুইদিনের ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর। আগেই সম্মেলনে পাঠের জন্য গবেষণাপত্রের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের উদ্যোগে আয়োজিত এ সম্মেলনে দেশি-বিদেশি গবেষকদের বৃহত্তম মিলনমেলায় পরিণত হয়। ১১ ডিসেম্বর ঠিক সন্ধ্যার আগে টোকিওর আকাশ ভেঙে নামে মালয়েশিয়ান এয়ারওয়েজের বি-৭৩৭ সিরিয়ালের ৮০০ ভার্সনের বিমান। টোকিওর নারিতা এয়ারপোর্টে হাই তুলতে তুলতে বিমান থেকে নামেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, শাসমুজ্জামান খান, সেলিনা হোসেনরা। এয়ারপোর্টের ব্যস্ততা শেষে দল বেঁধে পা বাড়াতেই হাস্যোজ্জ্বল এক তরুণ বঙ্গবিদ্যা সম্মেলনের স্টিকার নিয়ে এগিয়ে এলো। অভ্যর্থনা শেষে তরুণতুর্কি আমাদের নিয়ে যায় লিমুজিন সার্ভিসের নির্ধারিত স্থানে।

বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪২ জন লেখক-গবেষক এতে যোগ দিলেও মালয়েশিয়ান এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ছিলাম আমরা ১১ জন। লিমুজিনে বসে ক্লান্ত শরীরে সবাই গভীরভাবে উপলব্ধি করছিল টোকিওর রাস্তায় পড়ে থাকা ঝরাপাতা। দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে সবকিছুতে আমার আগ্রহ ছিল। আলোকজ্জ্বল টোকিও নগরী। গাড়ি ছুটছে আপন গতিতে। প্রতিটি গাড়ির আলাদা লেন। যে যার লেনে। লিমুজিন চলছে নদীর গা-ঘেঁষে। নদীর ওপরে বৃষ্টিধোয়া সন্ধ্যার আকাশ। অন্যরকম একটা মায়া কাজ করে। যেই মায়ায় ধরা পড়ে রবীন্দ্রনাথ। জাপানের আলো-বাতাসে মিশে আছেন তিনি। মনে পড়ল অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথাও। তাদের কথা ভাবতে ভাবতেই রাত কাটিয়ে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমিটরির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভোরের আলোয় চোখ রাখি। সূর্য না উঠেই পুব আকাশ থেকে আলো বিলানো শুরু করেছে। আলোমাখা সকালটাকে বড়ই আপন মনে হলো। একান্ত ব্যক্তিগত পৃথিবী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি টোকিও শহরের মাঝখানে। অনন্ত পথের যাত্রী হয়ে রং লাগাই ভাবনার ডানায়। সামনে খোলা মাঠ। জাপানি তরুণরা বেসবলে বুদ। কুয়াশার শরীর ধরে ডুবসাঁতার খেলতে খেলতে সূর্য তার আলোমাখা রাজ্যে স্বাগত জানায়।

১২ ডিসেম্বরের সকাল। একটু পরেই আগোরা গ্লোবালে শুরু হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। পরিপাটি হয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক বর্তমানে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি শিক্ষক অমিতাভ চক্রবর্তীর সঙ্গে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেই। জমজমাট আয়োজন। মিলনায়তন ভর্তি দর্শক। জাপানসহ সারাবিশ্ব থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খ্যাতিমান গবেষকরা এসেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই উত্সবের উদ্বোধন করেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ভাষা বিভাগের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এম হিরোতাকা তাতেইশি। মঞ্চে ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, পবিত্র সরকার, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, বঙ্গবিদ্যা সম্মেলনের জাপান কমিটির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মাসায়ুকি ইউসুদা। সাবেক প্রেসিডেন্ট দং ইউ ছেন। অধ্যাপক শিনকুচি তানিগুচি। ছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের রাষ্ট্রদূতরাও।

উদ্বোধনের পরেই চোখে পড়ে প্রদর্শনী। ক্যাম্পাসজুড়ে ছিল বাংলা হস্তশিল্পের নানা উপাদান। শাড়ি-গয়নার দোকান। বাংলা ভাষার ওপর নানা গবেষণাধর্মী বইয়ের দোকান। খুব অগ্রহ নিয়ে এসব দেখছে সবাই। ভাবি, এরা যদি গভীর আগ্রহ নিয়ে আমার প্রেজেনটেশনটা শুনে তবেই এখানে আসাটা পরিপূর্ণতা পাবে। সবাই গল্পগুজবে ব্যস্ত। বয়সের কারণে আমি কারও সঙ্গে তেমন মিশতে পারছিলাম না। তাছাড়া একটু পরেই আমার সেশন। ‘পপুলার কালচার অ্যান্ড লিটারেচার’ এই হচ্ছে আমার প্যানেল টাইটেল। আর আমার গবেষণাপত্রের শিরোনাম, ‘ইমাজিনেশন অ্যান্ড রিয়ালিটি অব আওয়ার চাইল্ড লিটারেচার।’ আমার সঙ্গে একই সেশনে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করবেন আরও চারজন। সেখানেও সবার আগে আমার নাম। কিছুটা ভয়ও কাজ করছিল। তবু বসে না থেকে খোলা আকাশের নিচেই প্রস্তুতি শুরু করি। তার আগে ১১২ নম্বর রুম; যেই রুমে হবে সেশন। সেই রুমটা ভালো করে দেখে নেই। এতে ভয় ও শঙ্কা কিছুটা কমে আসে। বাংলাদেশ থেকে আসার পথে মালয়েশিয়ায় যাত্রাবিরতিতে জাহাঙ্গরীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বলছিলেন, ‘আশিক, তোমার বিষয়টা ভালো। জান, আমি এখনো কার্টুন দেখি, কমিকস পড়ি। ছোটদের বইও খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। তোমার সেশনে আমি থাকবই!’ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আমি ১১২ নম্বর রুমে হাজির হয়ে দেখি ড. ফারজানা ইসলাম কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আরেক অধ্যাপককে নিয়ে বসে আছেন। রুমে ঢুকতেই তিনি হাসিমুখে সাহস জোগালেন। বিকাল ৩টায় শুরু হয় সেশন। লেখক-গবেষকরা জড়ো হয়েছেন। জাপান ও বাংলাদেশের পাশাপাশি আমেরিকা, লন্ডন, তুরস্ক, কানাডা এবং ভারত থেকে এসেছেন এদের অনেকেই। তবে খুব ভালো লেগেছে জাপানি তরুণদের দেখে। পরে তাদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তারা সবাই টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজে বাংলা ভাষা শিখছে। মনটা ভরে গেল। বাংলা ভাষার প্রতি তাদের অগ্রহের কথা জানতে চাওয়ার পর কোযুয়ে কাতো নামের এক ছাত্রী বলেন, ‘বাংলা ভাষার অক্ষর আমাকে খুব টানে। চার বছর ধরে আমি বাংলা শিখছি। ঢাকায় এক বছর বাংলা ভাষা শিখে জাপানে ফিরে আসি। এ বছর একটি চাকরি পেয়েছি। আমার কাজ হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে জাপানে আসা বাঙালিদের সাহায্য করা। এ কাজটি বাংলা জানার ফলেই পেয়েছি।’

২০১২ সালে টোকিও ইউনিভার্সিটিতে বাংলা ভাষায় গ্রাজুয়েশন প্রোগ্রাম খোলা হয়। এখন বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩২ জন শিক্ষার্থী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা শিখছে। সেই দলে আছেন মিকাকো ওমাতা, তাকুইয়া তাদো, ইয়ুকি ইয়ামাগুচিরা। তবে শিহো ওনোযাওয়া নামের এক শিক্ষার্থী বলে, ‘জাপানিদের আমি জানাতে চাই, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপানের সম্পর্কের কথা। বলতে চাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কীভাবে তেনমিন কোকুরা আর তাইকান ইয়োকোইয়ামার সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ গড়ে গিয়েছিলেন।’ সাহিত্য আলোচনায় এমন তুখোড় দর্শক-শ্রোতা পেলে কার খারাপ লাগবে! তবে সম্মেলন ঘুরে বুঝা গেল, বঙ্গবিদ্যা সম্মেলন শুধুই সাহিত্যের জন্য নয়, এটি নানা শিল্প মাধ্যমের উত্সব। গান-নাটক-নৃত্য-সিনেমাসহ সবই উঠে এসেছে তাতে। প্রথম দিন আমার সেশন শেষ হয়ে গেলেও দ্বিতীয় দিন বিভিন্ন সেশনে গিয়ে শুনেছি আলোচনা। এর ভিতর অবাক হয়ে শুনেছি তমিউ মিজোকামির কথা। তার বক্তব্যের সারাংশ এমন— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈনিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহারের পাশাপাশি তাদের মনস্তাত্ত্বিক ভাব পরিবর্তন ও রণক্ষেত্রে নিরুত্সাহিত করতে আকাশ থেকে প্রচারপত্র নিক্ষেপ করা হতো। মনস্তাত্ত্বিক এ যুদ্ধকে কাগজের যুদ্ধও বলা হতো। কাগজের এমন প্রচারপত্রকে জাপানিরা বলে, ‘দেন্তান’। ইংরেজিতে যা আমাদের কাছে ‘প্রপাগান্ডা লিফলেট’ নামে খ্যাত। আজকাল নেটে এমন যুদ্ধ প্রায়ই দেখি। যাকে আমরা সাইবার টেরর কিংবা সাইবার অ্যাটাক বলি। জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক তমিউ মিজোকামি এমন কিছু দেন্তানের আঁতুড়ঘর খুঁজে পেয়েছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সৈন্যদের জন্য আকাশ থেকে ছুুড়ে ফেলা এসব দেন্তানে দেখা মিলে বাংলা ভাষার। যেসব দেন্তান গোপনে মুদ্রিত হতো

গুপ্তচর বিভাগ থেকে। অনেক বিখ্যাত লেখক, চিত্রকর ও অনুবাদক দেন্তান লেখায় যুক্ত ছিলেন। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুও ছিলেন সেই দলে। এমন অসংখ্য বিষয় তুলে এনেছেন গবেষকরা।

উত্সবে আলোচনা হয় বাংলা সাহিত্যের সেরা সৃষ্টিগুলো পর্যায়ক্রমে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার নানা উপায় নিয়েও। বঙ্গ সম্মেলনের এ বিশাল আয়োজনে যোগ দেওয়া সবাই উত্সবের আনন্দ উপভোগ করছে। দূর বিদেশে এমন একটা সম্মেলনে কত কি উঠে এসেছে! তবে তাদের এ উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে এবং পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন হলে সত্যিই প্রত্যাশার একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে। এরপর জাপান মুগ্ধতা শুরু! যা দেখি তাতেই কৌতূহল সুর। অভিভূত না হয়ে পালানোর উপায় নেই। জাপানে ভালোবাসা বিলায় কিউপিড। তীর হাতে সে ঘুর ঘুর করে। একটা তীর বুকে এসে লাগলেই হয়। আমৃত্যু জাপান আপনাকে আয় আয় ডাকবে। কাছে পেতে চাইবেন আপনি। ঠিক একান্ত প্রিয় আর ব্যক্তিগত মানুষটার মতো করে!

সর্বশেষ খবর