শুক্রবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা
কামরুল হাসান

পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী

সুলতানা জামান

পথিকৃৎ চিত্রশিল্পী

পটুয়া কামরুল হাসানের (১৯২১-১৯৮৮) জন্ম কলকাতায়। পৈতৃকনিবাস পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার নারেঙ্গা গ্রামে। পিতা মোহাম্মদ হাশিম ছিলেন তিলজলা গোরস্থানের সুপারিনটেন্ডেন্ট। তিনি কলকাতার মডেল এম ই স্কুল (১৯৩০-৩৫) এবং কলকাতা মাদ্রাসায় (১৯৩৬-৩৭) প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হন এবং ১৯৪৭ সালে চিত্রকলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ধার্মিক বাবা পুত্রের শিল্পশিক্ষায় কোনো সমর্থন না দেওয়ায় কঠোর পরিশ্রমে নিজ উপার্জনে কলকাতায় আর্টস্কুলে পড়াশোনা করেন তিনি।

ছাত্রজীবনে চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি তিনি বয়েজ-স্কাউট, শরীরচর্চা,  ব্রতচারী আন্দোলন, শিশু সংগঠন মণিমেলা, মুকুল ফৌজ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৫ সালে শরীরচর্চা প্রতিযোগিতায় তিনি বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কামরুল হাসান নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’-এ যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর কামরুল হাসান ঢাকা চলে আসেন এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঢাকায় একটি আর্টস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন (১৯৪৮)। ১৯৫০ সালে আর্ট ইনস্টিটিউটের বাইরে শিল্প আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন ‘ঢাকা আর্ট গ্রুপ’। জয়নুল আবেদিন এই গ্রুপের সভাপতি এবং কামরুল হাসান সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোতে তিনি  ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’-এর সদস্য হিসেবে এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ঢাকা শহরে বৈশাখী মেলা আয়োজনেরও অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে তিনি ছিলেন পুরোপুরিভাবে সক্রিয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের পর সর্বত্র প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। ঢাকায় হাতিরপুল এলাকার প্রতিরোধ কমিটির চেয়ারম্যান হন শিল্পী কামরুল হাসান।

১৯৬০ সালে তিনি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের নকশা কেন্দ্রের প্রধান নকশাবিদ নিযুক্ত হন এবং ১৯৭৮ সালে ওই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

কামরুল হাসান বাংলাদেশের স্বাধিকার ও অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন (১৯৬৯-৭০) এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার দফতরের শিল্প বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। এ সময় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের রক্তপায়ী, হিংস্র মুখমণ্ডল সংবলিত একটি পোস্টার এঁকে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পোস্টারটির শিরোনাম : ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে।’ তিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ঢাকা চারুকলা ইনস্টিটিউটে (চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) শিক্ষকতা করেন।  ১৯৬০ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের নকশা কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার বিভাগের শিল্প বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার চিত্রকলার প্রধান উপাদান নর-নারী (বিশেষত রমণীর শরীর), পশুপাখি (প্রধানত গরু ও শৃগাল), সাপ ও প্রকৃতি। এসবের মধ্য দিয়ে তিনি আবহমান বাংলার গ্রামীণ সমাজের সামগ্রিক রূপ, বাংলার নিসর্গ, স্বৈরশাসকদের অত্যাচার, বাংলাদেশের  মুক্তিযুদ্ধ এবং হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চিত্র চমত্কারভাবে তুলে ধরেন। তার অঙ্কিত চিত্রকলা ষাটের দশকে বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের আন্দোলনে, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জনসাধারণকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছে। তার উল্লেখযোগ্য কাজ— বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার চূড়ান্ত নকশা অঙ্কন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারি প্রতীক, বাংলাদেশ বিমান, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন ও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতীক অঙ্কন। বাংলাদেশের সংবিধানের কভার ডিজাইনেরও রূপকার তিনি। তার চিত্রকলায় লৌকিক ও আধুনিক রীতির মিশ্রণ ঘটায় তিনি ‘পটুয়া কামরুল হাসান’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। দেশে-বিদেশে তার চিত্রকলার অনেক একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেমন— ঢাকা (১৯৫৫, ১৯৬৪, ১৯৭৩, ১৯৭৫, ১৯৯১, ১৯৯৫), রেঙ্গুন (১৯৭৫), রাওয়ালপিন্ডি (১৯৬৯) ও লন্ডনে (১৯৭৯)। এ ছাড়া বহু যৌথ প্রদর্শনীতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। চিত্রকলায় অসাধারণ অবদানের জন্য কামরুল হাসান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন। সে সবের মধ্যে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৫), কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৭৯), চারুশিল্পী সংসদ সম্মান (১৯৮৪), বাংলা একাডেমির ফেলো (১৯৮৫) এবং কাজী মাহবুবউল্লাহ ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৫) উল্লেখযোগ্য। তার ‘তিনকন্যা’ ও ‘নাইওর’ চিত্রকর্ম অবলম্ব্বনে যথাক্রমে যুগোশ্লাভীয়া সরকার (১৯৮৫) ও বাংলাদেশ সরকার (১৯৮৬) দুটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে।

কামরুল হাসান ১৯৫৯ সালে মরিয়ম বেগমকে বিয়ে করেন। তাদের একমাত্র কন্যা সুমনা হাসান। এই মহান শিল্পী  ১৯৮৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জাতীয় কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে সভাপতির আসনে বসা অবস্থায় তিনি হূদরোগে আক্রান্ত হন এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগে তিনি ‘দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে’ শীর্ষক একটি স্কেচ আঁকেন। তার চিত্রকর্মের মধ্য দিয়ে  নিজের রাজনৈতিক সচেতনতা, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে নির্ভীক প্রতিবাদী মানসিকতা, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সমাজসচেতনতাই প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর