শুক্রবার, ২৫ মার্চ, ২০১৬ ০০:০০ টা

গণহত্যা দেশে দেশে

রণক ইকরাম

মানুষের নিষ্ঠুরতার ইতিহাস অনেক পুরনো। সভ্যতার আদি থেকেই মানুষ মানুষের ওপর পশুসুলভ আচরণ করে আসছে। আজ ২৫ মার্চ। ভয়াল কালরাতে বাঙালি জাতির ওপর নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বেদনাদায়ক সেই দিনটিকে সামনে রেখে পৃথিবীর কিছু কুখ্যাত গণহত্যার ঘটনা নিয়ে আমাদের এ আয়োজন।


২৫ মার্চ ১৯৭১

নৃশংস সেই গণহত্যা

২৫ মার্চ মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে সাধারণ বাঙালির ওপর নেমে আসে ভয়ঙ্কর এক অভিশাপ। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে হিংস্রের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে শুরুতেই ধ্বংস করে দেওয়া। সেই রাতে হানাদাররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রোকেয়া হল, শিক্ষকদের বাসা, পিলখানার ইপিআর সদর দফতর, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একযোগে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে হত্যা করে অগণিত নিরস্ত্র দেশপ্রেমিককে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, এই অপারেশনের আসল লক্ষ্য ছিল দেশের নেতৃত্বস্থানীয় শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিঃশ্বেষ করে দেওয়া। এ ছাড়াও সেই রাতে একে একে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেসক্লাবেও অগ্নিসংযোগ, মর্টার শেল ছুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক হানাদাররা। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ কয়জন গণমাধ্যম কর্মীকেও। হানাদার বাহিনী ট্যাংক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখলে নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলি, ট্যাংক-মর্টারের গোলা ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়। পাকিস্তানি হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায়নি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাবির জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চের রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সে রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হয় আরও তিন হাজার লোককে। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শিয়ালের খাবারে পরিণত হলো।

সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’ পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংকট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয় : ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’ ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে নিরীহ বাঙালি বেসামরিক লোকজনের ওপর গণহত্যা শুরু করে। তাদের এ অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীসহ সব সচেতন নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা করা।

এই কালরাত ছিল আসলে পাকবাহিনীর গণহত্যা কার্যক্রমের শুরু। এরপর ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে আবির্ভূত হয় মুক্তিকামী বাঙালি। এই দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম গেছে, প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য নিরীহ বাঙালি। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে এ ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে। এখনো পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বরতম গণহত্যাগুলোর একটি মানা হয় এই ২৫ মার্চকে।

মূলত ২৫ মার্চের এই গণহত্যার মধ্য দিয়েই পাক হানাদার বাহিনী শাসকরূপী শোষক হিসেবে নিজেদের পতনকে ত্বরান্বিত করে। বাঙালি লাভ করে চূড়ান্ত বিজয়।


রাজা লিওপোল্ডের গণহত্যা

বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছেন তার নেতৃত্বে পরিচালিত নৃশংস গণহত্যার জন্য। তিনি ছিলেন বেলজিয়ামের সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের প্রধান। তার গল্পের শুরুটা আফ্রিকার দেশ কঙ্গো কিনে নেওয়ার পর থেকে। কঙ্গো কিনে নিয়ে সে দেশের জনগণকে দাসে পরিণত করেন। লিওপোল্ড ইন্টারন্যাশনাল আফ্রিকান সোসাইটি নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। সেই সংগঠনের বাহ্যিক রূপ ছিল সমাজ সংস্কার। কিন্তু এর আড়ালে চলে দাস ব্যবসা। তিনি কঙ্গোর মানুষদের দিয়েই কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন শুরু করেন। তার একনায়কতন্ত্র কঙ্গোর ওপর চাপিয়ে দিয়ে চলে ভয়াবহ অত্যাচার, অঙ্গচ্ছেদ, মৃত্যুদণ্ড। এসব কিছুই তিনি করতেন তার নিজস্ব সেনাবাহিনী দ্বারা। কঙ্গোতে তার নিজস্ব বাহিনীর নাম ছিল ফোর্স পাবলিক। রাজা লিওপোল্ডের নির্দেশে ফোর্স পাবলিকের অফিসাররা জনপ্রতি আইভরি বা হাতির দাঁত ও রাবার সংগ্রহের কোটা ধার্য করে দিত। নির্দিষ্ট পরিমাণ আইভরি বা রাবার সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। তবে সেনাবাহিনীর অফিসারদের দয়া হলে কুমিরের চামড়ার চাবুক খেয়েই অনেকে বেঁচে যেত। এতে তার নৃশংস হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছিল আফ্রিকার কঙ্গোর প্রায় ১০ মিলিয়নেরও (এক কোটি) বেশি মানুষ। মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার জন্য সেনাবাহিনীর গুলি যাতে অপচয় না হয়, সে জন্য সরকারের নির্দেশে প্রত্যেকটি গুলির বিপরীতে একটি করে মানুষের কাটা কব্জি জমা দিতে হতো। এ ব্যবস্থার সুফল হিসেবে মনে করা হতো হাত কাটার ভয়ে কেউ রাবার সংগ্রহে আলসেমি করবে না। যা অত্যন্ত রোমহর্ষক হলেও তাদের কাছে অযৌক্তিক ছিল না। কিন্তু একটা কুফল দেখা দিয়েছিল, বনের ভিতর থেকে রাবার সংগ্রহের তুলনায় কাটা হাত সংগ্রহ করা অনেকটা সহজ ছিল। ফলে কঙ্গোলিজদের মধ্যে যারা সন্ত্রাসী ছিল, তারা অন্যদের ওপর আক্রমণ করে বিজিত গোত্রের লোকদের হাত কেটে জমা দিত।

রাবার সংগ্রহের পদ্ধতি ছিল রোমহর্ষক ও নিষ্ঠুরতায় ভরা। রাবার সংগ্রহকারীরা রাবার গাছের জঙ্গলে, গাছের পাতায় ও লতায় লম্বা দা দিয়ে আঘাত করত সেই আঘাতে অনেক সময় তরল রাবার ছিটকে এসে তাদের গায়ে আটকে যেত। এসব রাবার পরে দা কিংবা ছুরি দিয়ে শরীর থেকে উঠানো হতো। উঠানোর সময় বেশির ভাগ সময়ই কঙ্গোবাসীর গায়ের চামড়া পশমসহ উঠে আসত। নিগ্রোদের কালো চামড়ার ব্যথা সাদারা গায়ে মাখত না। কারণ রাষ্ট্রীয় দলিলে এভাবেই তাদের দলপতিরা স্বগোত্রীয়দের ভাগ্য নির্ধারণ করে গেছে। আফ্রিকার মহাযুদ্ধ কিংবা রাজা লিওপোল্ডের কুখ্যাত শাসনামলে কত মানুষ মারা গেছে সেটি কখনো কোথাও উচ্চারিত হয় না। দ্বিতীয় কঙ্গোযুদ্ধ যা কিনা আফ্রিকার মহাযুদ্ধ নামেও পরিচিত। তাতে নিহত হয় অসংখ্য মানুষ। এই মহাযুদ্ধে বাম্বেঙ্গা নামে একটি আঞ্চলিক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী দাসে পরিণত হয়েছিল ও নরমাংস ভক্ষণকারীতে রূপান্তরিত হয়েছিল।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্ট

পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ও জঘন্যতম গণহত্যা হচ্ছে হলোকাস্ট। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের ওপর চালানো গণহত্যা। হিটলারের অধীনস্থ জার্মান নািস সামরিক বাহিনী ইউরোপের তদানীন্তন ইহুদি জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি অংশকে বন্দী শিবির ও শ্রম শিবিরে হত্যা করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এডলফ হিটলারের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির পরিচালিত গণহত্যায় তখন আনুমানিক ৬০ লাখ ইহুদি এবং আরও অনেক সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ প্রাণ দিয়েছে। হিটলারের বাহিনী ৬০ লাখ ইহুদি ছাড়াও সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী, কমিউনিস্ট, রোমানি ভাষাগোষ্ঠীর জনগণ, অন্যান্য স্লাবিক ভাষাভাষী জনগণ, প্রতিবন্ধী সমকামী পুরুষ এবং ভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শের মানুষের ওপর এই অমানবিক গণহত্যা পরিচালনা করে। অনেক লেখক অন্য সব জনগোষ্ঠীর নিহত হওয়াকে হলোকাস্টের সংজ্ঞার আওতায় না এনে তারা শুধু ইহুদি গণহত্যাকেই ‘হলোকাস্ট’ নামে অভিহিত করতে চান, যাকে নািসরা নাম দিয়েছে ‘ইহুদি প্রশ্নের চরম উপসংহার’ বলে। নািস অত্যাচারের সব ঘটনা আমলে নিলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৯০ লাখ থেকে এক কোটি দশ লাখের মতো। অত্যাচার ও গণহত্যার এসব ঘটনা বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘটিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই নাগরিক সমাজ থেকে ইহুদিদের উত্খাতের জন্য জার্মানিতে আইন প্রণয়ন করা হয়। জনাকীর্ণ বন্দী    শিবিরে রাজনৈতিক ও যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাসের মতো কাজে লাগাত, যারা পরে অবসন্ন হয়ে রোগভোগের পর মারা যেত।


নানকিং ট্র্যাজেডি

নানকিংয়ের গণহত্যা বা Nanking genocide ১৯৩৭-৩৮ সালের কুখ্যাত এক ট্র্যাজেডি। এই ট্র্যাজেডিতে জাপানিদের নৃশংসতার শিকার হয় চীনের সাধারণ মানুষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে সংঘটিত নানকিংয়ের গণহত্যা জাপানি যুদ্ধাপরাধগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া জাগানো ঘটনা। মার্কো পোলো সেতু ঘটনার পর চীন-জাপান যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর। বহুদিন অবরোধের পর প্রায় দেড় লাখ জাপানি সৈন্য চীনা শহর নানকিংয়ের দখল নেয়। এরপর প্রায় কয়েক সপ্তাহ শহরটিতে এক অবিশ্বাস্য মাত্রার গণহত্যা সংঘটিত হয়। জাপানি সৈন্যরা কখনো পরিকল্পিতভাবে, কখনো কেবল আনন্দের উদ্দেশ্যে অনির্দিষ্টভাবে শহরটির চীনা লোকদের হত্যা ও ধর্ষণ করা শুরু করে। সম্ভবত চার লাখ চীনাকে হত্যা করা হয়। সেই সঙ্গে ধর্ষিত হন নানকিংয়ের হাজার হাজার নারী।

 

আর্মেনীয় গণহত্যা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোমান তুর্কিদের হাতে বহু আর্মেনীয় নিহত হয়। আর্মেনীয়রা একে গণহত্যা আখ্যায়িত করলেও তুরস্ক এ ব্যাপারে বরাবরই তীব্র আপত্তি জানিয়ে আসছে। কয়েক শতাব্দীর পারস্য ও বাইজানটাইনের শাসনের পর ১৯ শতকের মাঝামাঝি রুশ ও তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যে বাস করছিল আর্মেনীয়রা। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের ধারণা অনুযায়ী অটোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয়  প্রদেশগুলোতে ১৭ থেকে ২৩ লাখ আর্মেনীয় বাস করত। ১৯ শতকের শেষের দিকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে অটোমান কর্তৃপক্ষ আনুগত্যের প্রশ্নে আর্মেনীয়দের সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। বিশ্লেষকদের ধারণা, অটোমান শাসক সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের রাজত্বকালে এক থেকে তিন লাখ আর্মেনীয়কে হত্যা করা হয়। ১৯০৫ সালে আর্মেনীয়রা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদকে হত্যার চেষ্টা করে। তিনি অল্পের জন্য বেঁচে যান। ১৯১৪ সালে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের পক্ষ নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয় তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্য। যুদ্ধ চলাকালে অটোমান কর্তৃপক্ষ আর্মেনীয়দের ‘ঘরের শত্রু’ বলে প্রচার চালাতে থাকে। ১৯১৫ সালের ২৪ এপ্রিল অটোমান সরকারের শত্রু বলে সন্দেহে আর্মেনীয় সম্প্রদায়ের  কয়েকশ নেতা ও বুদ্ধিজীবীকে কনস্টান্টিনোপলে (বর্তমান ইস্তাম্বুল) বন্দী করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের বেশির ভাগকেই হত্যা ও নির্বাসিত করা হয়। আর্মেনীয়রা ২৪ এপ্রিল দিনটিকেই গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে।


কম্বোডিয়ায় খেমাররুজ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দেশ কম্বোডিয়া। ভিয়েতনাম যুদ্ধ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন কম্বোডিয়ার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরোদম সিহানুক নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করেন। ১৯৭০ সালে তাকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে উত্খাত করা হয়। এ সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন জেনারেল লন লন। পরবর্তী বছরগুলোতে সেখানে চলে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। তখন যে দেশের লোকসংখ্যা ছিল মাত্র ৭০ লাখ। প্রায় সবাই ছিল বৌদ্ধ। কম্বোডিয়া গণহত্যায় ঠিক কত মানুষ নিহত হয়েছিল, তা সঠিক জানা যায়নি। তবে এই সময় বেঁচে যাওয়া লোকদের মতে, খেমাররুজ সরকারের আগে কম্বোডিয়ায় ৭ লাখ ক্যাম মুসলমানের বসবাস ছিল। এদের মধ্যে প্রায় ৫ লাখ গণহত্যার শিকার হয়েছিল।


রুয়ান্ডার গণহত্যার ১৫ বছর

১৯৯৪ সালের ৭ এপ্রিল গণহত্যা শুরু হয়। যখন রুয়ান্ডার রাস্তায় রাস্তায় মানুষের লাশ পড়ে রয়েছে, তখন বহির্বিশ্ব ছিল নিষ্ক্রিয়। অথচ দেশে তখন আন্তর্জাতিক শান্তি বাহিনী নিযুক্ত ছিল। আজ বোঝা যায়, রুয়ান্ডার গণহত্যা অন্তত আংশিক রোধ করা সম্ভব ছিল।

রুয়ান্ডার গণহত্যা বলতে ১৯৯৪ সালে সে দেশের সংখ্যালঘু টাটিস গোষ্ঠীর মানুষ এবং সংখ্যাগুরু হুটু গোষ্ঠীর মধ্যে উদার ও মধ্যপন্থিদের নির্বিচারে হত্যার ঘটনাকে বোঝায়। ৬ এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই গণহত্যা সংঘটিত হয়। অন্তত ৫ লাখ টাটিস এবং এক হাজারেরও বেশি হুটু নিহত হয়। অধিকাংশ সূত্রমতে মোট নিহতের সংখ্যা ৮ লাখের কাছাকাছি বা ১০ লাখের কাছাকাছি। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা নানান খবরের ভিড়ে এই গণহত্যার সংবাদ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খুব কমই স্থান পেয়েছিল। এই সুযোগেই গণহত্যা বীভৎস রূপ ধারণ করেছিল। সরকারি নির্দেশেই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। এর পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছিল দুটি হুটু স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক দল— এমআরএনডি এবং সিডিআর। রুয়ান্ডার ঔপনিবেশিক যুগের অবসান ও হুটু পাওয়ার সংস্কৃতির উত্থানের পর সেখানে যে গোষ্ঠীগত ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছিল তারই চূড়ান্ত পরিণাম এই গণহত্যা। অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল হুটু সরকার ও নির্বাসনে দণ্ডিত টাটিসদের মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধ।


বসনিয়া গণহত্যা

বসনিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৯২ সালের ৭ এপ্রিল ও শেষ হয় ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে। বসনিয়ার মুসলমানরা ষাট ও সত্তরের দশকের দিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু করেছিল। এ সময় তাদের মধ্যে ইসলামী পুনর্জাগরণও ঘটেছিল। মার্শাল টিটোর জোটনিরপেক্ষ নীতির সুবাদে বসনীয় মুসলমানরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পায়। ফলে তাদের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা বেড়ে যায়। ১৯৭৭ সালে সারায়েভো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ চালু হয়। ১৯৮০ সালে মারা যান টিটো। কিন্তু বসনিয়া ও কোসোভোর মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী বা ইসলামী মনোভাবের বিস্তার-কোনোটাকেই সহ্য করতে পারছিল না। মুসলমানদের নির্মূল করার উদ্দেশে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছিল সার্বরা। ১৯৯৫ সালে এই যুদ্ধে গণহত্যা ও ধর্ষণ এমনকি শিশুকন্যাদের ধর্ষণ ও শিশুদের হত্যা করাকে যুদ্ধ জয়ের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছিল বর্বর সার্বরা। জাতিসংঘ সার্বদের সঙ্গে আপস রফা করার কথা অস্বীকার করে। একই সময়ে শান্তিরক্ষীরা সারায়েভোয় সার্ব-অধিকৃত অঞ্চল থেকে সরে এলে সার্বরা পণবন্দী শান্তিরক্ষীদের ছেড়ে দেয়। এ ছাড়াও সার্বদের জঙ্গি বিমানগুলো বসনিয়ার নিষিদ্ধ অঞ্চলের আকাশে অবাধে টহল দিয়ে বেড়ায়। অবশেষে সার্বরা ১৯৯৫ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের রক্ষীদের কোনো বাধা বা প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সেব্রেনিৎসা ও জেপা শহরটি দখল করে নেয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর