শিরোনাম
শুক্রবার, ৬ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

ভাবতাম ছবি আঁকা জাদুকরী ব্যাপার

ভাবতাম ছবি আঁকা জাদুকরী ব্যাপার

ছবি : জয়ীতা রায়

সৈয়দ জাহাঙ্গীর বাংলাদেশের খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী। ঊনবিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে তার সৃজন অভিযাত্রা। বৈচিত্র্যে এবং বিপুলতায় তার সৃষ্টি বাংলাদেশের চিত্রকলা প্রয়াসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বাংলাদেশের চারুশিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রসারে তিনি নিরলস পরিশ্রম করেছেন। একুশে পদকে সম্মানিত এই শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ মেহেদী হাসান

 

আপনি একটি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য।

ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে আমার দাদা মৌলানা সৈয়দ আলম শাহ সাতক্ষীরার তেঁতুলিয়ায় এসেছিলেন। তিনি তেঁতুলিয়া গ্রামের জমিদার কাজী মিন্নাত উল্লাহ প্রতিষ্ঠিত মসজিদে ইমামতি করতেন। আমার চাচা সৈয়দ জালালউদ্দীন হাশেমী অবিভক্ত বাংলার এমএলএ ছিলেন। তিনি ছিলেন কলকাতা সিটি করপোরেশনের মুসলিম মেয়র। বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকারের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। শুনেছি তিনিই প্রথম অ্যাসেম্বলির কার্যক্রম বাংলায় লেখা শুরু করেন। তিনি শের-ই বাংলা, পণ্ডিত নেহরু, ডা. বিধান চন্দ্র রায়দের সঙ্গে ব্রিটিশ বিরোধী রাজনীতি করতেন। তাদের সঙ্গে একাধিকবার জেল খেটেছেন। আমার আব্বা সৈয়দ মঈনউদ্দীন হাশেমী, মা যাহেদা খানম। আমার বড় ভাই কবি সিকান্দার আবু জাফর। যিনি ‘সমকাল’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। জাফর ভাই আমার চেয়ে পনেরো বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ।  সৈয়দ কোহিনূর আকবর ছিলেন আমার চেয়ে ছয় বছরের বড়। পরবর্তীকালে আমাদের পরিবারে সৈয়দ কামাল বখ্ত, সৈয়দ দিদার বখ্ত রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমার জন্ম ১৯৩২ সালের নভেম্বরে। সেই প্রত্যন্ত গ্রামে অতিবাহিত হয়েছে আমাদের ছেলেবেলা।  

মনে পড়ে, আপনার শৈশব-কৈশোরের কথা।

আমি ছিলাম পরিবারের ছোট ছেলে। মা অবসরে আমাকে পাশে বসিয়ে নকশিকাঁথা সেলাই করতেন। আমিও মায়ের সঙ্গে সেলাই করতাম। তার কাজ আমাকে অবাক করত। তখন গ্রামে ছিল মাটির ঘর, শনের ছাউনি। দেয়ালে মাটি লেপে দেওয়ার নিয়ম ছিল। আমি কাঠ কয়লা দিয়ে সেখানে এটা-ওটা আঁকতাম। ঘুড়ি এঁকে লম্বা লেজ বের করে দিতাম। এ কারণে আব্বার কাছে অনেক বকা খেয়েছি। সম্ভবত ১৯৩৬ সালে আমি প্রথম স্কুলে যাওয়া শুরু করি। তখন গ্রামের পরিবেশ ছিল খুব সুন্দর। মেঠো পথ। বর্ষার সময় কাদা হতো। শুকনোর সময় ধুলো উড়ত। দুই মাইল পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম। আমার কচি পা-দুটো ধুলোয় ভরে যেত। তিন মাইল হেঁটে ফুটবল খেলতে যেতাম। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমার গণিত শিক্ষক ছিলেন হরেন বাবু। তার ছোটভাই গগনবাবু একদিন আমাকে শ্লেটে একটা প্রোফাইল ড্রয়িং করে দেখায়। একেবারে একটানে কপাল-নাক-ঠোঁট এঁকে ফেলল। তার ড্রয়িং দেখে আমি তো অবাক। তারপর থেকে আমি নিয়মিত শ্লেটে ছবি আঁকতে শুরু করলাম। নিয়মিত খেলাধুলা করতাম। খেলাধুলার ফাঁকে ছবি আঁকা আমার নেশা হয়ে দাঁড়াল।

তাহলে শৈশবেই আপনার ছবি আঁকার শুরু।

হ্যাঁ, শৈশবেই বলতে পারেন। আমার চাচা রাজনীতিবিদ সৈয়দ জালালউদ্দীন হাশেমী অফিসের কাজে লাল-নীল পেন্সিল ব্যবহার করতেন। তার টেবিলে সব সময় লাল-নীল পেন্সিল থাকত। লাল-নীলের আঁকিবুকি আমার কচি মনে বিস্ময়ের স্মৃতি করত। চাচার এক আর্দালি ছিল। ব্রিটিশ আমলে আর্দালিরা বিশেষ পোশাক পরতো, লাল ব্লেজার। চাচা গ্রামে এলে দেখতাম, ওই আর্দালি কলম দিয়ে প্যাডে সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকত। তখন একটা কলম ছিল, দু-দিকে দুরকম কালি। ওই কলম দিয়ে তিনি ঘোড়া, পরী ইত্যাদি আঁকতেন। তার কাছে আমি ছবি আঁকা শিখেছি। আমাদের বাড়িতে চাচার একটা পোর্ট্রেট ছিল, তেলরঙে আঁকা। ছবিটি যিনি এঁকেছিলেন তিনি থাকতেন কলকাতায়। তিনি একবার আমাদের গ্রামের বাড়িতে এলেন। এর আগে আমি ভাবতাম ছবি আঁকা জাদুকরি কোনো ব্যাপার। তখন তিনি বললেন, জাদুটাদু নয়, তোমাকে শিখতে হবে ছবি আঁকা। এই ছিল ছোটবেলার ছবি আঁকার কাহিনী। আরেকটি কথা মনে পড়ছে, আমার বড় ভাই কবি সিকান্দার আবু জাফর তখন কলকাতায় থাকতেন। একবার তার বাসায় গেলে তিনি আমাকে এক জোড়া জুতো কিনে দিলেন। সেই জুতোর বাক্সে আমি অনেক ছবি এঁকেছিলাম। তা দেখে জাফর ভাই বললেন, তুই তো ভালো আঁকিস! পরে জাফর ভাই ঢাকা চলে এলেন দেশ বিভাগের পর। ১৯৫০ সালে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট হলো। জাফর ভাই বললেন— ‘তোকে আর্ট কলেজে ভর্তি হতে হবে। শিল্পী জয়নুল আবেদিন আমার বন্ধু। তিনি ঢাকায় আর্ট কলেজ তৈরি করেছেন। আমি তাকে বলে দিচ্ছি।’ জাফর ভাই তখন তরুণ কবি হিসেবে বেশ বিখ্যাত।

১৯৫০ সালেই আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন? 

১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। জাফর ভাইয়ের পরামর্শে আমি আর্ট কলেজে ভর্তির উদ্দেশে গেলাম। তখন আর্ট কলেজ ছিল সদরঘাটের কাছে ন্যাশনাল মেডিকেলের দুটো কামরায়। আমি জয়নুল আবেদিন স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম। আমাকে দেখে বললেন— ‘তুমিই জাফরের ভাই! আসো, আসো।’ তিনি অন্য একজন শিক্ষককে বললেন— ‘আনোয়ার, ওর ইন্টারভিউ নেন।’ তখন আমাকে কলসি আঁকতে বলা হলো। আঁকলাম। যদিও তখন ইন্টারভিউটা ছিল নামেমাত্র। তখন আজকের মতো এত কম্পিটিশন ছিল না। ভর্তি হলাম। পরে আর্ট কলেজ চলে এলো সেগুনবাগিচায়। আমি ছিলাম থার্ড ব্যাচের ছাত্র। ফার্স্ট ব্যাচে ছিল আমিনুল ইসলাম, হামিদুর রহমান। সেকেন্ড ব্যাচে কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, আবদুর রাজ্জাক, রশীদ চৌধুরী ছিল। আমার ব্যাচে মমিনুল, সবুর, কামাল এরা ছিল। আমিনুল ইসলাম, মুর্তজা বশীর সবাই একসঙ্গে ক্লাস করতাম একটা বড় হলরুমে। তখন আর্ট কলেজে ছাত্রসংখ্যা কম থাকায় আমাদের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। আমি পাস করলাম ১৯৫৫ সালে। আর ১৯৫৬ সালে নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হলো আর্ট কলেজে, বর্তমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। আর্ট কলেজে তখন তো ইন্টারমিডিয়েট করতে হতো। দু-বছর সব ক্লাস একসঙ্গে হতো। স্টিল লাইফ করতে হতো, পারসপেক্টিভ করতে হতো। ড্রয়িং হতো ফার্স্ট ইয়ারে, সেকেন্ড ইয়ারে জলরং, থার্ড ইয়ারে তেলরঙে কাজ হতো। কপি করতে হতো, স্টিল লাইফ ছিল, মেমোরি থেকে কিছু কাজ করতে হতো। আর লাইন শেখানো হতো। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দীন আহমেদ আমাদের নানাভাবে উৎসাহিত করতেন। তারা যে কেবল একজন শিল্পী হওয়ার শিক্ষা দিতেন তা নয়— সব সময় ভালো মানুষ হওয়ার প্রেরণা দিতেন। তারা প্রত্যেকেই ছিল মহৎ, উদার মনের অধিকারী।    

মহান ভাষা আন্দোলনে আর্ট কলেজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

আমার স্মৃতিতে ভাষা আন্দোলন আজও উজ্জ্বল। বায়ান্নর আন্দোলনে আর্ট কলেজের ছাত্ররা নানাভাবে সম্পৃক্ত ছিল। তখন পুরান ঢাকার জাদুঘরে আমাদের একটা শিল্পকর্ম প্রদর্শনী হওয়ার কথা। লেডি ভিকারুন্নিসা নূন প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন। শিল্পী কামরুল হাসান আমাদের লিডার। তার নির্দেশে আমরা দু-তিনজন মিলে পাথর সরিয়ে একটি স্পেস তৈরি করছিলাম। মুর্তজা বশীর বাইরে গেল আজকে ১৪৪ ধারা বলবৎ আছে কিনা জানতে। সে ফিরে এলো একটা রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে। বলল, ওখানে গুলি চলেছে, ছাত্ররা মারা গেছে। আমি বিকেলবেলা গেলাম মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে। বারান্দায় দেখলাম, একটা লাশ পড়ে আছে। খুলি নেই, কিছু চুল ঝুলছে। পরে আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, সবুর, দেবদাস চক্রবর্তী, বিজন চৌধুরীসহ আমরা সবাই মিলে প্রতিবাদ কর্মসূচির জন্য সারা রাত জেগে ব্যানার ফেস্টুন তৈরি করলাম। বিজন বিশাল ব্যানার তৈরি করল। পরে আমরা ওই ব্যানার নিয়ে মিছিল বের করি। আসলে মহান ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে।

আপনার পেশাগত জীবন শুরু হয় কীভাবে?

আর্ট কলেজ থেকে পাস করার পর সহপাঠীরা বিভিন্ন জায়গায় চাকরি নিয়ে নিল। কেউ আর্ট কলেজে ঢুকল। নওয়াবপুর হাইস্কুলে ঢুকল শিল্পী মুহম্মদ কিবরিয়া। কাজী আবদুল বাসেত, দেবদাস চক্রবর্তী চাকরি নিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। শিল্পী আমিনুল ইসলাম চলে গেলেন ইতালি। আমিনুলের উৎসাহে মুর্তজা বশীরও ইতালি গেল। আমি নিজের মতো ছবি আঁকা শুরু করলাম। তারপর একটানা ২২ বছর পেশাদার শিল্পী হিসেবে ছবি এঁকেছি।

প্রথম শিল্পকর্ম প্রদর্শনী করলেন কবে?

১৯৫৭ সালে ঢাকায়। ব্রিটিশ কাউন্সিলে। তখন ব্রিটিশ কাউন্সিলের ডিরেক্টর জেফেরি হেডলি আমার কাজের ব্যাপারে বেশ উৎসাহী ও আন্তরিক ছিলেন। মূলত তারই আন্তরিক উদ্যোগে আমার একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। অনেক ছবি বিক্রি হয়েছিল ওই প্রদর্শনীতে। এরপর চট্টগ্রাম ক্লাবে একক শিল্পকর্ম করেছিলাম। আমার প্রথম ছবি বিক্রি হয়েছিল ৫০ টাকায়। তখন আবেদিন স্যারের ছবি বিক্রি হতো ১০০ টাকায়। আমি ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলাম। 

আপনি নিজেও তো সমকাল পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকাকে কেন্দ্র করে পঞ্চাশের দশকে আমাদের নতুন ধারার সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শামসুর রাহমান, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, শওকত আলীসহ অনেকেই এ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। হাসান হাফিজুর রহমান ও দেবদাস চক্রবর্তী একদিন জাফর ভাইকে বললেন, সমকাল পত্রিকাটি বের করতে পারছেন না পয়সার অভাবে। এটি কি সমকাল মুদ্রণ থেকে প্রকাশ করা যায় কিনা। জাফর ভাই রাজি হলেন। সমকাল প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন। আমাকে প্রচ্ছদ করার দায়িত্ব দিলেন। আমি নিজে প্রচ্ছদ করতাম। এরপর পরিকল্পনা করলাম বারোজন শিল্পীকে দিয়ে বারোটি প্রচ্ছদ করব। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, রশীদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, বিজন চৌধুরী এঁরা প্রচ্ছদ করেছিলেন। 

আপনি তো আমেরিকায় একটি ফেলোশিপ পেয়েছিলেন।

ইউএসআইএস-এর একটি ফেলোশিপ নিয়ে আমি ১৯৫৮ সালে তিন মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। আমিই প্রথম আর্টিস্ট হিসেবে এই ফেলোশিপ পেয়েছিলাম। এটি সাধারণত মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা পেতেন। তিন মাসে ২২টা স্টেট ঘুরে ঘুরে দেখলাম। মাঝে মাঝে উপমহাদেশ ও আমাদের চারুকলা নিয়ে বক্তৃতাও দিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রে দুটি শিল্পকর্ম প্রদর্শনী করি। আমি অনেক টাকা পেয়েছিলাম ফেলোশিপ থেকে। সেই টাকা দিয়ে মোট নয় মাস সেখানে ছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পেয়েছিলাম; কিন্তু আমার ভালো লাগেনি। এরপর ঢাকায় চলে এলাম। তখন শিল্পকর্মের কোনো বাজার ঢাকায় গড়ে ওঠেনি। পরে ছবি বিক্রির আশায় ১৯৬০ সালে আমি চলে গেলাম পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি।

বিয়ে করলেন কবে?

আমার স্ত্রী আনিস জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৫৯ সালে ঢাকায়। ঢাকায় এক শিল্পমেলায় পশ্চিম পাকিস্তানের স্টলের ডিজাইন করেছিল মাজহারুল ইসলাম। আর ইন্টেরিয়র ডিজাইন করেছিলাম আমি আর আমিনুল ইসলাম। স্টলের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে এসেছিল আনিস। সেখানেই পরিচয়। পরে তিনি আমার স্টুডিও পরিদর্শন করে খুশী হয়ে বলেন, পাকিস্তান আসো না কেন তুমি? লাহোরে আমি তোমার শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দেব। আমি গেলাম লাহোরে। ১৯৬৩-এর নভেম্বরে সিদ্ধান্ত নিলাম বিয়ে করব। জাফর ভাইকে জানালাম কথাটা আর বিয়ের একটা শাড়ি পাঠানোর অনুরোধ করলাম। তিনি সিল্কের কাতান শাড়ি পাঠিয়েছিলেন লাল রঙের, ভারি সুন্দর। বিয়ের অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন আমার বন্ধু নাট্যকার সাঈদ আহমেদ, কর্নেল নাজির, ডা. শফিক রেহমান। কবি সৈয়দ শামসুল হকও কীভাবে যেন উপস্থিত হয়েছিলেন। আর এসেছিলেন সাংবাদিক জিরার্ড বুস্কে। সবাইকে পেয়ে আমরা অসম্ভব খুশি হয়েছিলাম।

আবেদিন স্যার বহুবার তো আপনার অতিথি হয়েছেন।

আমি রাওয়ালপিন্ডিতে একটি ভাড়া বাসায় থাকতাম। আবেদিন স্যার বিভিন্ন কাজে পশ্চিম পাকিস্তানে আসতেন। স্যার পিন্ডিতে এসে হোটেল ইন্টারকনে নাম লিখিয়ে কামরায় গিয়েই আমাকে ফোন করতেন, ‘এই জাহাঙ্গীর আমাকে আইসা নিয়া যাও। তোমার বাসায় গিয়ে গেঞ্জি গায়ে দিয়া মাঠের মধ্যে না বসতে পারলে কি আর মজা লাগে! নাম লেখা থাউক ইন্টারকন্টিনেন্টালে।’ প্রত্যেকবারই তিনি এসে আমাদের বাসায় থাকতেন। আমাদের ওই ছোট্ট ঘরে গান শোনার ব্যবস্থাও ছিল। বেটোফেন, বাখ, মোজার্ট—সব আমার সংগ্রহ ছিল। তিনি শুনতে পছন্দ করতেন ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকসহ বিভিন্ন সুর। শিল্পী আমিনুল ইসলাম তার প্রথম স্ত্রী রুমিকে নিয়ে আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন। মুর্তজা বশীরও সস্ত্রীক এসে বেশ কিছুকাল থেকেছিলেন আমাদের সঙ্গে। ওর একটা চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিল আমার স্ত্রী। শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর বিয়ে হয়েছিল আমার বাড়িতে। আমরা পরস্পর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। এ ছাড়া সিএসপি সাবের রেজা করিম, এ এম এ মুহিত, সাইদুজ্জামান, রব চৌধুরী, আসাফউদ্দোলাসহ অনেকেই আসতেন।  আজও সবার কথা মনে পড়ে। বার বার মনে পড়ে। 

পাকিস্তানে আপনার নিজস্ব একটি আর্ট গ্যালারি ছিল।

১৯৬৪ সালে আমি একটা আর্ট গ্যালারি তৈরি করি। আমার স্ত্রী পাকিস্তান সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বেশ পরিচিত ছিলেন। তিনি সরকারের একটা হ্যান্ডিক্রাফট শপ চালাতেন। তার সরকারি চাকরির সুবাদে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। অনেকে আমার বাসায় আসতেন ছবি কিনতে। আমার স্ত্রী কিছু শিল্পকর্ম তার শপে রেখেছিলেন। বুস্কে নামে পরিচিত এক ফরাসি সাংবাদিক ছিল। তাকে একদিন বললাম, একটা আর্ট গ্যালারি করলে কেমন হয়? সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন। পরে আমরা একটি ঘর ভাড়া করে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে গ্যালারি তৈরি করলাম। সেখানে রফিকুন নবী, আনোয়ার, কাইয়ুম চৌধুরী, হাশেম খানের শিল্পকর্ম নিয়ে যেতাম। গ্যালারিটি অল্প সময়ে বেশ পরিচিতি পেয়েছিল। চারটা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে প্রচুর জলরঙের ছবি বিক্রি করেছিলাম। এ ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকেই শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতেন।

১৯৭০ সালের সাইক্লোনের সময় আপনি বাংলাদেশের দুর্গত এলাকায় কাজ করেছিলেন। কেমন ছিল সে অভিজ্ঞতা?

১৯৭০ সালে যখন সাইক্লোন হলো, তার তিনদিন পর আমি ঢাকায় এলাম সাইক্লোন-পরবর্তী সেবামূলক কাজ করতে। চট্টগ্রামে ফজলে হাসান আবেদের  (ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ) বাড়িতে একটা ক্যাম্প করা হয়েছিল। আমি সেখানে গেলাম। আবেদ আমার পূর্ব পরিচিত ছিল। আবেদ বলল, তুমি এক্ষুনি এয়ারপোর্টে যাও। ওখানে দেখ মওদুদ (ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ) যাচ্ছে, তুমি মওদুদের সঙ্গে চলে যাও জার্মান এয়ার ক্রাফটে। দ্রুত এয়ারপোর্টে গেলাম। ঠিক তখন হেলিকপ্টার মাটি থেকে জাস্ট উপরে উঠেছে, আমরা প্রায় লাফ দিয়ে উঠে গেলাম। প্রথমে গেলাম ভোলার মনপুরা দ্বীপে। পরদিন গেলাম চর ওসমান। পুরো এলাকা পানিতে ভরা। মানুষের কষ্ট দেখে চোখে পানি রাখা যায় না। সেখানে একটা ক্যাম্প করে দু-তিন দিন ছিলাম। বহু মানুষ রিলিফ নিতে আসত। লাশ ভেসে থাকত পানিতে। এত বীভৎস ছিল! এখনো চোখের সামনে ভাসে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন?

আমি তখন পাকিস্তানে। সেখানে টেলিভিশনে খবর পড়তাম। গোপনে বাংলাদেশের জন্য কাজ করছিলাম। এ নিয়ে ওদের গোয়েন্দাদের নজরদারিতে পড়ে যাই। একদিন পরিচিত এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা রাতে তার বাসায় আমন্ত্রণ জানালেন। তার বাসায় গিয়ে দেখলাম আমার বিরুদ্ধে তৈরি করা বিশাল গোয়েন্দা ফাইল। তিনি আমাকে সতর্ক করলেন। ১৯৭১ এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা পরিবারসহ আটকা পড়লাম। দেশে ফিরে এসেছিলাম ১৯৭৩ সালে। হিন্দুকুশ পাহাড়, আফগানিস্তান পার হয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চলে আসি ঢাকায়।

আপনি তো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন?

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আমি দুই বছরের জন্য জয়েন করেছিলাম। পরে তো ১৪ বছর চাকরি করলাম। এশিয়া-বিয়েনেল করেছি। আমার সঙ্গে ছিল শিল্পী সুবীর চৌধুরী, সাইমন পেরেরা, নাসিম আহমেদ নাদভি, খোরশেদ সেলিম। এশিয়া-বিয়েনেল এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। চারুশিল্পকে সাধারণ মানুষের দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য দেশব্যাপী ভ্রাম্যমাণ চারুকলা প্রদর্শনীর আয়োজন করি। শিল্পবোধ বিষয়ক একটি অ্যাপ্রেসিয়েশন কোর্স চালু করি। চারুকলা বিষয়ক বিভিন্ন বই প্রকাশ করি। এ ধারা এখনো অব্যাহত আছে। কিন্তু পরবর্তীকালে শিল্পকলা একাডেমির নীতিমালা ভেঙে সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাকে এ বিভাগে পরিচালক বানানো হয়েছে। বিষয়টি দুঃখজনক। এমনকি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক, পরিচালক যেই হবেন, তাকে নাট্যকলা-চারুকলা-সংগীত-নৃত্য সব বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখতে হবে। শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশে শিল্পকলা একাডেমির উজ্জ্বল ভূমিকাই বাংলাদেশের সম্মান বয়ে আনবে।

আপনার সন্তানদের কথা জানতে চাই।

আমাদের নিজের কোনো সন্তান নেই। আমার ভাই সৈয়দ কোহিনূর আকবরের সাত সন্তান। তার সাত কন্যা ও তিন পুত্রকে আমরা পালন করেছি। ওরাই আমার দেখাশোনা করে। আমার স্ত্রী গত হয়েছেন।

অবসরে কী করেন?

আমার অবসর বলে কিছু নেই। এখন বয়স হয়েছে। তারপরও নিয়মিত ছবি আঁকি। গান শুনি। লেখালেখির চেষ্টা করি।

সর্বশেষ খবর