শিরোনাম
শুক্রবার, ২৭ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা
শ্রদ্ধাঞ্জলি

কিংবদন্তি নূরজাহান বেগমের শেষ সাক্ষাৎকার

কিংবদন্তি নূরজাহান বেগমের শেষ সাক্ষাৎকার

নূরজাহান বেগম [জন্ম : ৪ জুন ১৯২৫—মৃত্যু ২৩ মে ২০১৬] ছবি : জয়ীতা রায়

সদ্য প্রয়াত উপমহাদেশের নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ নূরজাহান বেগম। দুই বাংলার নারীদের প্রথম পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘বেগম’-এর সম্পাদক। এ পত্রিকা বাঙালি নারীদের সৃজনশীল লেখালেখি ও নারী শিক্ষার সূচনা করেছিল। কিংবদন্তি নূরজাহান বেগম নিরলস পরিশ্রম ও একনিষ্ঠভাবে অর্ধশত বছরের অধিক সময় ‘বেগম’ সম্পাদনা করেছেন। তার অনুপ্রেরণা ছিলেন বাবা ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। মহীয়সী এই নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শেখ মেহেদী হাসান। সাক্ষাৎকারটি ২ জানুয়ারি ২০১৫-এ বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপা হয়; সেটি পুনর্মুদ্রিত হলো।

 

আপনার শৈশবের কথা জানাবেন।

আমার জন্ম চাঁদপুরের চালিতাতলি গ্রামে। সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত আমি গ্রামেই ছিলাম। মনে পড়ে, শৈশবে একবার আমি পুকুরে পড়ে যাই। তখন বাবা বলেছিলেন ওদের কলকাতায় নিয়ে যাই, কেননা বাচ্চা এভাবে পানিতে পড়ে গেলে একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। ওই সময় আত্মীয়স্বজন আমাদের কলকাতায় যেতে দেয়নি। এরপর আবারও আমি খালে পড়ে গিয়ে পানিতে হাবুডুবু খেয়ে বেঁচে যাই। পর পর বড় দুটো দুর্ঘটনা ঘটার পর আব্বা বড় মামাকে চিঠি লিখলেন যে, ‘অমুক তারিখে কলকাতার শিয়ালদহ ইস্টিশনে আমি অপেক্ষা করব। আপনি আপনার বোন এবং আমার মেয়েকে নিয়ে চলে আসবেন।’ আব্বা কোনো বাধা মানলেন না। সেই সাড়ে তিন বছর বয়সে আমরা কলকাতায় চলে গেলাম। শৈশবের আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে, আমার জন্মের পর সবাই আমাকে আদর করে ডাকত নূরী। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় আব্বা আমার নাম রাখেন নুরুন্নাহার। একবার নানী আমাদের কলকাতার বাড়িতে বেড়াতে এসে আমার নাম রাখেন নূরজাহান বেগম।

আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে কলকাতায়। সেখানেই আপনি পড়াশোনা করেছেন। কলকাতার স্মৃতি মনে পড়ে?

কলকাতায় আমাদের বাড়ি ছিল ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটে। আমাদের দোতলা বাড়ির একদিকে ছিল আমার আব্বা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রিকার অফিস। নিচতলায় ছিল প্রেস ‘ক্যালকাটা আর্ট প্রিন্টার্স’, পাশে ছিল থাকা-খাওয়ার ঘর। আমার আব্বার সঙ্গে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের খুব পরিচয় ছিল। তিনি আব্বাকে বললেন, আপনার মেয়ের স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়েছে, ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। আব্বা বললেন, এখন তো নূরী ছোট, ওর মা রাজি হবে না। এই কথা মাকে জানানো মাত্রই তিনি ক্ষেপে গেলেন। যাই হোক, এক পর্যায়ে আমি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হই। ওই স্কুলে শিশু শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করি। তারপর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি অন্য স্কুলে পড়ে আবার ওই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হই। ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল থেকে আমি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করি। এরপর ভর্তি হই কলকাতার বিখ্যাত লেডি ব্রেবোন কলেজে। ওই সময় গুটিকয়েক বাঙালি মুসলিম মেয়ে লেডি ব্রেবোনে পড়ত। বাঙালি মুসলমানদের বিভিন্ন কাজে সামাজিক বাধা ছিল। মেয়েরা নাচতে পারবে না, গাইতে পারবে না, শব্দ করে কথা বলতে পারবে না, তরুণদের সঙ্গে মিশতে পারবে না। আমরা সহপাঠীরা [সাবেরা আহসান, রোকেয়া রহমান কবির, সেবতি সরকার, জ্যোত্স্না দাশগুপ্ত, বিজলি নাগ, কামেলা খান মজলিশ, হোসনে আরা রশীদ, হাজেরা মাহমুদ, জাহানারা ইমাম] মিলে একটি সাংস্কৃতিক দল তৈরি করি। এ দল থেকে আমরা কবিতা আবৃত্তি, নাট্যাভিনয় শুরু করেছিলাম। আমি ব্যাডমিন্টন খেলতাম। ১৯৪৪ সালে আইএ পাস করে একই কলেজে বিএ ভর্তি হই। ১৯৪৬ সালে স্নাতক হই।

কিশোর বয়সে আপনি সওগাত পত্রিকার নানা কাজে সাহায্য করতেন।

‘সওগাত’ পত্রিকায় নানা রকমের কাজ ছিল। তখন হ্যান্ড কম্পোজ হতো। ব্লকে প্রিন্ট হতো। আমি পড়াশোনার ফাঁকে আব্বাকে সহযোগিতা করতাম। তার কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতাম। ফাইলিংয়ের কাজ করতাম। আব্বার এডিটিং রুমে বসে দেখতাম কীভাবে লেখা সম্পাদনা করা হয়। আব্বার এডিটিংয়ের হাত ছিল চমৎকার। তিনি সম্পাদনার সময় পাণ্ডুলিপির সবটা পড়ে লম্বা করে দাগ দিতেন। প্রয়োজনে লেখকদের সঙ্গে কথা বলতেন। মনে পড়ে, আব্বা একবার কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বলেছিলেন, ‘এটা কবিতা হয়েছে, কাজী তুমি এ জায়গাটা পড়ে দেখ, এটা ছন্দপাত না বজ্রপাত?’ কাজী সাহেবের সঙ্গে আব্বার বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

সচিত্র সওগাত প্রকাশের পর ওই সময় বেশ সমালোচনাও হয়েছিল।

আমার আব্বা প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। তিনি আধুনিক মানসিকতা পোষণ করতেন। অবশ্যই সে সময়ে ছবি ছাপানোটা দোষের ছিল। বিশেষ করে মুসলিম সমাজে এটাকে ভালো চোখে দেখা হতো না। ফলে সর্বপ্রথম সচিত্র ‘সওগাত’ প্রকাশের পর সম্পাদক হিসেবে তিনি অনেক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। সওগাত পড়ে ফুরফুরার এক পীর সাহেব আব্বাকে চিঠি লিখলেন— ‘নাসির সাহেব আপনার সওগাত পড়ে ভালোই লাগল, তবে আমার অনুরোধ ছবিটা যদি না ছাপেন তাহলে ভালো হয়।’ তখন আব্বা চিঠির উত্তরে লিখলেন, ‘মৌলনা সাহেব, শুনে খুশি হলাম, সওগাত আপনার ভালো লেগেছে। তবে আপনাকে একটি প্রশ্ন করি, আপনি যখন নামাজ পড়েন তখন বিদেশি সাহেবের ছবিযুক্ত কয়েন যদি আপনার পকেটে থাকতে পারে তাহলে পত্রিকায় ছবি ছাপতে দোষের কী!’ এ রকমের বিভিন্ন সমালোচনা আব্বা নীরবে সহ্য করেছিলেন।

সওগাতে কারা লিখতেন। উল্লেখযোগ্য কারও কথা মনে পড়ে?

ওই সময় বাঙালি এবং মুসলিম লেখক খুব কম ছিল। কবি কাজী নজরুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মঈদুদ্দীন, কবি গোলাম মোস্তফা, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, হবীবুল্লাহ বাহার, ইব্রাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন, আহসান হাবীবের কথা মনে আছে। আব্বা সবাইকে উৎসাহিত করতেন। কাজী নজরুলের নেতৃত্বে ‘সওগাত’ অফিসে জমজমাট আসর বসত। বড় বড় কবি-সাহিত্যিকরা আসতেন, বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সবাই আসতেন। তারা সাহিত্য নিয়ে নানা রকম আলোচনা করতেন। সমাজ সংস্কার বিষয়ে কথা বলতেন, নারী স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতেন।

আপনার বাবার উদ্যোগেই তো সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

আব্বা নারীদের ছবি ও লেখা দিয়ে প্রথম নারীসংখ্যা ‘সওগাত’ প্রকাশ করেন ১৯৩০ সালে। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মহিলাদের ছবি সংবলিত সওগাত নারীসংখ্যা প্রকাশিত হয়। ১৯৪৬ সালে আব্বা নানা রকমের পরিকল্পনা করেন। কীভাবে নারীদের আরও এগিয়ে নেওয়া যায় সে বিষয়ে ভাবতেন। তখন কলকাতায় নানা রকমের দাঙ্গা হচ্ছিল, রাজনৈতিক সংকট চলছিল। তার মধ্য থেকে আব্বা একদিন সুফিয়া এন হোসেনকে [কবি সুফিয়া কামাল] ডাকলেন। আমাদের বাড়ির কাছেই পার্ক সার্কাসে থাকতেন তিনি। বাবা বললেন, সুফিয়া বছরে একবার করে নারীদের লেখা ছেপে লাভ নেই। তোমাদের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা দরকার, তাতে নারীদের দ্রুত এগিয়ে নেওয়া যাবে। আমি তোমাকেই সেই পত্রিকার সম্পাদক করতে চাই। তখন খালাম্মা বললেন, ঠিক আছে আমি যতটা পারি করব। তারপর ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই সাপ্তাহিক ‘বেগম’-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ‘বেগম’ উপমহাদেশে বাঙালি নারীদের প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক। ওই সময় মহিলাদের সাপ্তাহিক বের করা আজকের মতো সহজ ছিল না। অনেক রকমের বাধা-বিপত্তি ছিল। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত ভাগ হয়ে যায়। সুফিয়া কামাল কয়েক মাস ‘বেগম’-এর সম্পাদক থাকার পর স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। তখন সম্পাদকের দায়িত্বভার আমাকে নিতে হয়। ১৯৪৮ সালে প্রথমবারের মতো মেয়েদের ছবিসহ ঈদসংখ্যা প্রকাশ করি। এরপর ১৯৪৯ সালে মেয়েদের ধর্মীয় জ্ঞান বিতরণের জন্য ‘বিশ্বনবী’ বেগমসংখ্যা বের করা হয়। দুই বাংলাতেই ‘বেগম’ নারীসমাজের মুখপত্র হিসেবে কাজ করেছিল।

বেগম পত্রিকার উদ্দেশ্য কী ছিল। বেগমে কারা লিখতেন।

নারীদের সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল বেগমের উদ্দেশ্য। ‘বেগম’ পত্রিকায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, আলোচনা, পল্লী উন্নয়ন, মাতৃমঙ্গল, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্যচর্চা, শিশুমঙ্গল, সেলাই, চিঠিপত্র, ছায়াছবির কথা ইত্যাদি বিষয়ে লেখা ছাপা হতো। ওই সময় নারী লেখকদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। লেখা সংগ্রহ করতে কষ্ট হতো। বিভিন্ন ইংরেজি পত্রিকা থেকে লেখা সংগ্রহ করে আমরা তা অনুবাদ করে দিতাম। ‘সওগাত’ নারীসংখ্যা করার জন্য নারীদের যে ছবি সংগ্রহ করা হয়েছিল, আমরা সেগুলো ব্যবহার করতাম। ব্লক করে ছবি ছাপাতে হতো। বেগমে লিখতেন কবি সুফিয়া কামাল, শামসুন নাহার মাহমুদ, কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, হামিদা খানম, মহসীনা আলী, সাঈদা খানম, হোসনে আরা মোদাব্বের, হুসনা বানু খানম, লুলু বিলকিস বানু, মালেকা পারভীন বানু, মাজেদা খাতুন, সারা খাতুন, জাহানারা আরজু, লায়লা সামাদ, নূরজাহান মুর্শিদ, মাফরুহা চৌধুরী প্রমুখ।

আপনারা স্থায়ীভাবে ঢাকায় এলেন কবে।

১৯৫০ সালে আমরা ঢাকায় আসি। আমরা ঢাকার বিজয়া প্রেসের সঙ্গে আমাদের সওগাত প্রেস এক্সচেঞ্জ করি। ওই সময় ছিল টাইপের যুগ। ঢাকায় এসে দেখি টাইপ ভোঁতা, ব্লক নেই, সব ঘর টিনের। এগুলো আস্তে আস্তে ঠিক করে কাজ শুরু করি। ১৯৫০ সালে ‘বেগম’ প্রকাশিত হতে থাকে ঢাকার ৬৬ নম্বর পাটুয়াটুলী ‘বেগম’ কার্যালয় থেকে। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নারীদের জন্য অন্য কোনো সাপ্তাহিক ছিল না। সে জন্য বাইরে থেকে যারা আসতেন তারা ‘বেগম’ কার্যালয়ের কাজ দেখতে চাইতেন। একদিন সরকারি তথ্য বিভাগ আমাদের জানালেন, আমেরিকা থেকে একজন নারী সাংবাদিক ঢাকায় এসেছেন। তিনি ‘বেগম’ কার্যালয় দেখতে চান। সাংবাদিক মিসেস আইডা আলসেথ তখন বেগম কার্যালয় পরিদর্শন করলেন। তিনি বেগম পত্রিকার বিভাগগুলো দেখে বলেছিলেন, তোমরা এত রিডিং ম্যাটারিয়াল কীভাবে দাও! তিনি ‘বেগম’ পত্রিকার কর্মকাণ্ড দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।

বেগম ক্লাব প্রতিষ্ঠা করলেন কত সালে।

আব্বা [মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন] উদ্যোগী হয়ে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ ও কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে ক্লাব গঠন নিয়ে আলোচনায় বসেন। এরপর ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বেগম ক্লাব’। এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ এবং সেক্রেটারি হয়েছিলাম আমি আর খালাম্মা [বেগম সুফিয়া কামাল] ছিলেন এর অন্যতম উপদেষ্টা। বেগম ক্লাবের কোনো কার্যনির্বাহী সদস্য করা হয়নি, কারণ আব্বা নিজেই অনুষ্ঠানের সব খরচ বহন করেছিলেন।

দাদা ভাই [সাংবাদিক ও সংগঠক রোকনুজ্জামান খান]-এর সঙ্গে পরিচয় কীভাবে?

রোকনুজ্জামান সাহেবের সঙ্গে সওগাত প্রেসেই আমাদের পরিচয়। তিনি তখন শিশু সওগাতের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। তার সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা, দায়িত্বশীলতা ও নম্র ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমার আব্বার কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। আমি একমাত্র সন্তান। তাই ভাবলাম বেগম ও সওগাত প্রেস দুটোর দায়িত্বই আমাকে এক সময় পালন করতে হবে। আমার মনে হয়েছিল এ দায়িত্ব পালন করার জন্য দাদা ভাই-ই আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারেন। আমার মনে হতো আমি চলে গেলে ‘বেগম’ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ‘দাদা ভাই’ও সাংবাদিক হওয়ার কারণে সে ভয় ছিল না। ১৯৫২ সালে আমরা বিয়ে করি। বিয়ের প্রস্তাব এনেছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। আমাদের বিয়েতে বাবা প্রথমে রাজি ছিলেন না। পরে ফজলুল হক সাহেব তাকে রাজি করিয়েছিলেন। প্রতিটি বাঙালি মেয়ের জীবনেই দুটো দিক থাকে। বাবা-মার বাড়িতে তারা খুব আদর-যত্নে বড় হয়, এখানে তাদের নিজস্ব প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থাকে। কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে অনেক মেয়েকেই তার নাচ-গানসহ বহু পছন্দের বিষয় ছাড়তে হয়। দাদা ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কারণে আমাকে ‘বেগম’ ছাড়তে হয়নি। তার উৎসাহেই নিজের পছন্দমতো কাজ করতে পেরেছি। পত্রিকা চালাতে গিয়ে কোনো সমস্যা হলে তিনি আমাকে সব সময়ই সাহায্য করেছেন। জীবনসঙ্গী হিসেবে দাদা ভাই ছিলেন খুব ভালো বন্ধু।

পারিবারিকভাবে আপনি কতটুকু সহযোগিতা পেয়েছেন।

আমার পারিবারিক জীবন বেশ সুখের ও আনন্দময়। শৈশবে প্রগতিশীল, উদারচেতা, সংস্কারমুক্ত আব্বার স্নেহের ছায়ায় বেড়ে উঠি। অন্যদিকে মা ফাতেমা খাতুনের নিত্য সাহচার্য ও জীবনবোধ আমার জীবনকে আলোকিত করেছে। বিবাহিত জীবনে এবং কর্মক্ষেত্রে আমার স্বামী রোকনুজ্জামান খান উদারভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমার দুই সন্তান। বড় কন্যা ফ্লোরা নাসরীন খান ও ছোট মেয়ে রীনা ইয়াসমিন খানও আমাকে অকুণ্ঠ সহযোগিতা করেছে। বড় মেয়ে বেগমের দায়িত্ব নেওয়ায় আমি অবসর পেয়েছি। ও সফলভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করছে।

বাংলাদেশের নারীরা সামাজিকভাবে কতখানি এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

আমাদের দেশের সার্বিক উন্নতি হলেও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও নারীরা বেশ পিছিয়ে রয়েছে। শহর এগিয়ে গেলেও দেশের বহু গ্রামে আজও ভালো রাস্তাঘাট নেই, শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। গ্রামীণ নারীদের শিক্ষার হার বাড়েনি। ধর্মীয় বাধা, মোল্লাদের ভয়-ভীতি রয়েছে। আমাদের মেয়েরা সারা জীবন শ্বশুরবাড়ি থাকে। তারপরও তারা নিজেদের জীবনে উন্নতি করতে চায়। আমি ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বে বহু পরিবর্তন দেখেছি। নারীরা এখন নতুন নতুন পেশায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। তবুও দেশের উন্নয়নে নারীর ভূমিকাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। নারীদের ন্যায্য সম্মান দিতে হবে। তাদের কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে।

জাতীয় জাদুঘরে আপনার বাবার নামে একটি কর্নার চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

বাঙালি মুসলমানদের শিল্প-সাহিত্যে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার বাবা বিশেষ অবদান রেখেছিলেন। তার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য বেশ কিছু উপকরণ আমরা জাতীয় জাদুঘরে জমা দিয়েছিলাম। কথা ছিল মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের নামে একটি স্থায়ী কর্নার গড়ে তোলা হবে। কিন্তু এখনো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। তিনি তো রাজনীতি করেননি, সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করে গেছেন। আমি জানি না, উদ্যোগটি কেন বাস্তবায়ন হলো না।

 

এক নজরে বেগম

 

বেগম প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ বেগম প্রকাশিত হতো কলকাতা থেকে। এরপর এখন পর্যন্ত ঢাকা থেকে।

♦ প্রথম সম্পাদক সুফিয়া কামাল

 

 বেগম-এর প্রথম সংখ্যা

 

♦  বর্তমান সম্পাদক নূরজাহান বেগম

♦  প্রথম সংখ্যা বেগম ছাপা হয়েছিল ৫০০ কপি।

♦  প্রথম সংখ্যা বেগম-এর দাম চার আনা।

♦  প্রথম বেগম ঈদসংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে।

 

 

 বেগম-এর প্রথম সংখ্যা

 

♦  প্রথম বেগম ঈদসংখ্যার মূল্য ২ টাকা।

বেগম-এর প্রথম সংখ্যায় যারা লিখেছিলেন—

♦  রাবেয়া মাহমুদ— প্রবন্ধ

♦  সেলিনা পন্নী— গল্প

♦  ওয়াহিদা আজিজ— সুচিশিল্প

♦  সম্পাদকীয়— সুফিয়া কামাল ও নূরজাহান বেগম

বেগম-এ যারা (১৯৪৭-১৯৫০) লিখতেন

রাজিয়া খাতুন, শামসুন নাহার মাহমুদ, হোসনে আরা, রিজিয়া বেগম, সেলিনা পন্নী, জাহানারা আরজু, আনোয়ারা খাতুন, আনোয়ারা বেগম, হাসিরাশি দেবী, সুপ্রভা দেবী, প্রতিভা গাঙ্গুলী, প্রভাবতী দেবী, সরস্বতী, নূরুন নাহার, কাজী আমিনা বেগম, হুসনা বানু, হোসনে আরা মোদাব্বের, রাজিয়া মজিদ, কল্যাণী রায়, বেগম আফসারুন্নেসা, হোসনে আরা রশীদ, তাফিকুন্নেসা, হোসনে আরা খানম, নূরজাহান আহমেদ, সুরুচি বালা সেনগুপ্ত, বেগম মফিজউদ্দিন খান, সাহেরা সরকার, প্রশান্তি দেবী, নুরুন্নাহার রুচি, জোহরা করিম, হাজেরা মাহমুদ প্রমুখ।

 

নারিন্দায় নিজ বাড়িতে বাবা-মা, স্বামী  ও বড় মেয়ের সঙ্গে

 

নারিন্দায় ৩৮ শরত্গুপ্ত রোডে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন স্মৃতি ভবন

সর্বশেষ খবর