শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

জলরঙ হলো কবিতা তেলরঙ উপন্যাস

মনিরুল ইসলাম

জলরঙ হলো কবিতা তেলরঙ উপন্যাস

আমি যে চিত্রশিল্পী হব তার কোনো ধারণা ছিল না। ছবি আঁকতে ভালো লাগত। কিন্তু কোনো ফর্মুলা জানতাম না। কোন ম্যাথডে আঁকলে পরে একটা ছবি শিল্পকর্ম হয় তাও জানতাম না। এসব জেনেছি আর্ট কলেজে এসে, সেখানে প্রথম জানতে পারি ব্রিটিশ ম্যাথডে ছবি আঁকা হয়। অনেক বাধা অতিক্রম করেছি। অনেকেই বলত, শিল্পীরা বহিমিয়ান, ইনডিসিপ্লিন, তারা অর্থকষ্টে থাকে। আমি কোনো কিছু না ভেবে কেবল ছবি আঁকতাম, পড়তাম না। এমনও হয়েছে যে, পরীক্ষার আগের রাতে থিয়েটার দলের উয়িংস করেছি। আমি তিনবার ম্যাট্রিক ফেল করে চতুর্থবারে পাস করি। সুতরাং এতবার ফেল করা পুত্রের প্রতি পরিবার আস্থা হারিয়ে ফেলে। আব্বা ভেবেছিলেন আমার দ্বারা কিছু হবে না। ১৯৬১-তে আর্ট কলেজে ভর্তি হলাম। এখানে এসে নিয়মিত ছবি আঁকতাম। আমার জীবন বদলে গেল। আর্ট কলেজে সবকিছু ভালোভাবে চলছিল। পাঁচ বছরের কোর্স শেষে ফাইনাল পরীক্ষার আগে আমার বাবা মারা গেলেন। সেই মৃত্যুশোকে আমার ছবি আঁকায় সাময়িক ছেদ পড়ল, পড়াশোনায় ক্ষতি হলো। তারপরও আমি ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিলাম। রেজাল্ট ভালো হবে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। পরীক্ষার ফল বেরোনোর পর দেখা গেল আমি সেকেন্ড হয়েছি। ফার্স্ট হয়েছে আবদুল নাসের। তখন আমার শিক্ষকরা বসে মিটিং করলেন। আমার পাঁচ বছরের রেকর্ড দেখা হলো। কারণ আমি প্রচুর আঁকতাম। তা ছাড়া পরীক্ষার আগে বাবার মৃত্যুর বিষয়টি বিবেচনা করা হলো। তারপর আমাদের দুজনকেই যৌথভাবে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট ঘোষণা করা হলো।

শিল্পী কাজী আবদুল বাসেতকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি আর্ট কলেজে প্রথম বর্ষে। দ্বিতীয় বছরে পেলাম শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারকে। ইয়াং টিচার, জলি ম্যান, কথাবার্তা সবার চেয়ে আলাদা, ছাত্রদের সঙ্গে তিনি খোলাখুলিভাবে মিশতেন, প্রায় বন্ধুসুলভ ছিল সম্পর্ক। এটাকে অনেক শিক্ষকই উদার মনে গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি ছবি আঁকা শেখানোর পাশাপাশি অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলতেন। এ কথার ভিতর দিয়েও তিনি আর্ট সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন। যেমন তিনি বলেছিলেন—‘জলরঙ হচ্ছে কবিতা আর তেলরঙ হচ্ছে উপন্যাস’। কবিতা যেমন অল্প কথায় লেখা হয়, জলরঙও অল্প ছোঁয়ায় অল্প রঙে আঁকতে হয়। আর তেলরঙ ততই সমৃদ্ধ হবে যত বেশি তাতে যোগ করা হবে, দুটো দুই ধরনের আঙ্গিক, দুটোর ধর্ম দুই রকম। আমাদের আরেক শিক্ষক আনোয়ারুল হকের ছিল ভিন্ন মত। দুজনের মত-ই আমাদের শুনতে হতো। দুজনের ভিতরকার দ্বন্দ্বও আমাদের কাছে অস্পষ্ট থাকত না। দুজনের বক্তব্যের গভীর থেকে সারবস্তুগুলো আমরা ঠিকই শনাক্ত করতে পারতাম এবং সে অনুযায়ী ছবি আঁকতাম। মুস্তাফা মনোয়ারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠ হতে থাকল। আমি তার বাসায় যেতাম, তার কাছ থেকে জলরঙের নানা রকম কৌশল শিখতাম। তার জলরঙের কাজ আমার খুব ভালো লাগত। তার কথাও আমাকে খুবই আকর্ষণ করত। আমাদের সময়ে থিওরি পড়তে হতো না। ক্লাসে থিওরি পড়তেই হবে এমন কোনো কথা নেই। কারণ একজন শিল্পী তার নিজের প্রয়োজনেই থিওরি পড়বে, শিল্পকলার ইতিহাস জানবে। আর একজন শিল্পী তা বই পড়ার থেকেও মূল্যবান। নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী তার পড়াশোনা করার অবকাশ তো আছেই। বাধ্যবাধকতা থাকা ঠিক না।

আমার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর থেকে আর্ট কলেজে এসেছিলেন আরেকজন— তিনি শিল্পী হাশেম খান। আমিও ভর্তি হলাম, তিনিও পাস করে বেরোলেন। আমাকে তিনি নানাভাবে কৃতজ্ঞ করেছেন। একবার হাশেম ভাই আর আমি ছবি আঁকতে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে ১৫ দিনের জন্য। খুবই সফল সফর ছিল সেটা। রাঙামাটিতে গিয়ে উপজাতীয়দের ছবি এঁকেছিলাম। ওদের জীবন-যাপন ও সংস্কৃতি আমার ভালো লেগেছিল। শিল্পী রফিকুন নবী আমার দুই বছরের সিনিয়র। আর্ট কলেজে সিনিয়র-জুনিয়রদের ভিতর চমৎকার সম্পর্ক ছিল। সিনিয়রদের আমরা খুবই শ্রদ্ধা করতাম। একবার সিলেটের চা বাগানে সাত দিন থেকে ছবি এঁকেছি। ওই এক সপ্তাহ আমরা গোসল করিনি। সেখানে আদিবাসী সরল জীবন আমাকে মুগ্ধ করে।

লেখক : স্পেন প্রবাসী চিত্রশিল্পী

সর্বশেষ খবর