শুক্রবার, ২৯ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

মুসলিম দেশগুলো তখন এখন

তানভীর আহমেদ

মুসলিম দেশগুলো তখন এখন

ইরাক : সাদ্দাম হোসেন

 

 

 

 

তখন

স্বৈরশাসনেও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা

সাদ্দাম হোসেন ১৯৫৭ সালে নিষিদ্ধ বাথ পার্টিতে যোগ দেন। এরপর ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে তিনি ইরাকের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নই ছিল তার প্রধান চ্যালেঞ্জ। স্বৈরশাসনের কলঙ্ক থাকলেও ধারাবাহিক উন্নয়ন ছিল দেশে। সাদ্দামের শাসনামলে ইরাকের রাস্তাঘাট নির্মাণে উন্নয়নের ছাপ স্পষ্ট হয়। জ্বালানি ও আর্থিক উন্নয়নেও দেশবাসী সুফল ভোগ করছিল। তবে গণতন্ত্র নেই এই সমালোচনায় বারবার বিদ্ধ হন সাদ্দাম। দেশের ভিতরে চাপা উত্তেজনাও ছিল। অবশ্য এসব ঢাকা পড়েছিল তার ধারাবাহিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। ইরাকের জনগণ অন্তত সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করছিল।

 

এখন

চলছে আইএসের ধ্বংসযজ্ঞ

সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে স্বৈরশাসন ও একনায়ক সরকার ব্যবস্থায় জনরোষ রয়েছে— এই দুইয়ের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের মদদ ও অভিযোগ। সামরিক আক্রমণের মাধ্যমে ইরাকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নামে মার্কিন সামরিক বাহিনী। এরপর সাদ্দাম হোসেনের পতন ঘটে। অন্যদিকে উত্থান ঘটে আইএসের। ইরাক পেরিয়ে যে আইএস এখন বিশ্বের জন্য হুমকি। ইরাককে নরকে পরিণত করতে লড়াই শুরু হয়। সন্ত্রাসী হামলায় কাবু হয়ে পড়ে ইরাক। এখনো সেই লড়াই থেমে নেই। প্রতিদিনই বোমা আর হামলায় রক্তপাত ইরাককে একটি অস্থির রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। মানুষের জীবনের নিরাপত্তা তো নেই-ই, উল্টো ইরাকের সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নের সূচক তলানিতে এসে ঠেকেছে।

 

লিবিয়া : গাদ্দাফি

 

 

 

 

তখন

গাদ্দাফির আমলে শীর্ষ ধনী

আফ্রিকা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্র লিবিয়া। দেশটির বড় অংশজুড়েই সাহারা মরুভূমি। তবে ১৯৫০-এর দশকে খনিজ তেল আবিষ্কারের পর লিবিয়ার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে থাকে। সেখানে পাওয়া যায় পেট্রোলিয়ামের বিরাট মজুদ। এই খনিজ সম্পদে সুষ্ঠু ব্যবহার করে লিবিয়া হয়ে ওঠে আফ্রিকা অঞ্চলের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্র। রাস্তাঘাট আর উঁচু দালানে সেজে ওঠে পুরো শহর। ইউরোপের ধনী শহরগুলোও ছিল লিবিয়ার কাছে নস্যি। এর পেছনে ছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি। ১৯৬৯ সালে তরুণ সামরিক অফিসার মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি ক্ষমতা দখল করেন। তাকেও একনায়ক হিসেবে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ করে পশ্চিমা বিশ্ব।

 

এখন

ব্যর্থ রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি

মুয়াম্মার গাদ্দাফির লিবিয়া শাসন ছিল প্রায় ৪০ বছর। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতন আমেরিকার টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর সব হিসাব পাল্টে যায়। গাদ্দাফির মৃত্যুর পর ২০১১ সালে ন্যাটোর হস্তক্ষেপে লিবিয়া এখন একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র। বিপর্যস্ত অবস্থায় পরিণত হয়েছে অর্থনীতি। তেল উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। লিবিয়ায় আগে থেকেই মিলিশিয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা ছিল, সেটি এখন প্রকট হয়েছে। গাদ্দাফি প্রশাসনের পতনের পর লিবিয়ার সর্বত্র বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো তাদের দূতাবাস গুছিয়ে নিয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল পরিণত হয়েছে সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্যে। আর উত্তরাঞ্চল হয়েছে মানব পাচারের সিল্করুট। সন্ত্রাসী হামলা ও দুঃশাসনে লিবিয়া এখন ব্যর্থ রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি।

 

মিসর : হোসনি মোবারক

তখন

স্বৈরশাসনের সমালোচনা ছাপিয়ে চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে লড়াই

মিসর গোটা আরব বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্রায় ৪০ বছর মিসরে ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। ১৯৫২ সালে জামাল আবদেল নাসেরের নেতৃত্বে একদল সামরিক অফিসার রাজতন্ত্র উত্খাত করে প্রজাতন্ত্র হিসেবে মিসর প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৮১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর মিসরের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন হোসনি মোবারক। তার আমলের বড় অংশজুড়েই ছিল ইসলামী চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে লড়াই। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে সেনা প্রেরণের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেন। ২০০০ সাল-পরবর্তী সময়েও তিনি ইসলামী চরমপন্থি ও কার্যকর বিরোধী দলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন। আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলার পর সন্ত্রাসবাদে নতুন মাত্রা যোগ হয়। টালমাটাল হয়ে ওঠে হোসনি মোবারকের অবস্থান।

 

এখন

ক্ষণে ক্ষণে বিপ্লবের আগুনে জ্বলছে রাজপথ

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণআন্দোলন ও আরব বসন্তের জোয়ারে ক্ষমতাচ্যুত হন তিন দশকের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক। ২০১১ সালের আরব বসন্তের সুবাদে পুরো মিসর জেগে উঠেছিল। তাহরির স্কয়ারে  নেমেছিল জনতার ঢল। লক্ষ্য ছিল স্বৈরাচারের পতন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার।   বিক্ষোভে উত্তাল সেই দিনগুলোতে তাহরির স্কয়ার লাখো মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছিল। পুরো মিসরবাসী এক কাতারে জমা হয়েছিল। বিপ্লব সফল হয়েছিল। কারণ তখন মিসরীয়দের মাঝে কোনো ভেদাভেদ ছিল না। মোবারকের পতন হলো। কিন্তু মিসরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো না। বিশ্লেষকরা বলছেন, মিসরের প্রশাসন, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম— সর্বত্রই একনায়কের প্রভাব পরিষ্কার হচ্ছে। আরব বসন্তের রেশ তাই কাটেনি। বিপ্লবীরা প্রায়শই রাজপথে নেমে এসে জ্বালাচ্ছেন বিপ্লবের আগুন।

 

আফগানিস্তান :  বোরহানউদ্দিন রব্বানি

 

তখন

সন্ত্রাস সামলিয়ে উন্নয়নের ঠিকানা খুঁজছিল দেশ

আফগানিস্তান কয়েক দশক ধরেই রাজনৈতিকভাবে অস্থির ছিল। ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রজাতন্ত্র গঠন হয় সেখানে। তবে ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে আফগানিস্তানে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। সেটা থামাতে আফগানিস্তানে নামে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েতরা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। বোরহানউদ্দিন রব্বানি আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সামাজিক উন্নয়নের দিকে নজর দেন। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর চরমপন্থি সংগঠন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যার ফলাফল আবারও দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে তালেবান নামের একটি মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠী কাবুলের দখল নেয়। ফলে উন্নয়নের সব ধারা রুদ্ধ হয় আফগানিস্তানের।

 

এখন

যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর সন্ত্রাসী হামলার আতঙ্ক তাড়া করে নগরবাসীকে

তালেবান সন্ত্রাসবাদী দল আল-কায়েদাকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দেয়। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে এবং ২০০১-এর শেষে তালেবানদের উত্খাত করে। ২০০৪ সালে আফগানিস্তানের সংবিধান নতুন করে লেখা হয় এবং একটি রাষ্ট্রপতি-ভিত্তিক গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়। তবে কার্যত শান্তি আর প্রতিষ্ঠা পায়নি। এখনো যুদ্ধ নিত্যসঙ্গী আফগানিস্তানের। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আর ফিরে আসেনি। সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর সঙ্গে এখনো যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। শহর-বন্দরে বোমা হামলায় সামরিক-বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি থেমে নেই। মার্কিন ও জার্মান সেনারা এখনো আফগানিস্তান ছেড়ে যায়নি। শান্তি প্রক্রিয়ায় সব পথে হেঁটে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সাধারণ জনগণ যুদ্ধের মাঝেই প্রতিটি দিন জীবনযুদ্ধের লড়াই করে যাচ্ছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর