শুক্রবার, ১২ আগস্ট, ২০১৬ ০০:০০ টা

হামিদুজ্জামানের কাজ তার কর্মজীবনীর অংশ

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

হামিদুজ্জামানের কাজ তার কর্মজীবনীর অংশ

সংশপ্তক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

হামিদুজ্জামান পেইন্টিং থেকে ভাস্কর্যে এসেছেন। তার পেইন্টিং এবং ভাস্কর্য রিয়ালিটির মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত। হামিদুজ্জামান অসাধারণ এক রিয়ালিস্টিক পেইন্টার ও ভাস্কর। তার কাজ রক্ত ধোয়া স্মৃতি, এই স্মৃতি হামিদ অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করেছেন। সে জন্য তার কাজ এক ধরনের আত্মজীবনীর অংশ। হামিদের চোখ শিল্পীর চোখ, এই চোখ খুলে হামিদ পৃথিবীকে দেখেছেন, বাংলাদেশকে দেখেছেন। হামিদ কি তার পেইন্টিং দিয়ে, পরবর্তীতে তার ভাস্কর্য দিয়ে বাংলাদেশকে অথবা ঢাকা শহরকে বদলে দিয়েছেন? বরং তার বদলে দেওয়ার ধরন হচ্ছে ঢাকা কিংবা বাংলাদেশকে নিজের ধ্যানে দেখা, ঢাকার মানুষজন কিংবা বাংলাদেশকে কিংবা শিল্পকে দেখা। হামিদ আমাদের বুঝিয়েছেন একটা বিশেষ ধরনের সুন্দর আছে বাংলাদেশে, নিজেরা নিজেদের সাহায্যে এখানে পৌঁছতে পারব না। কারও সাহায্য দরকার, কারও সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের পাখি, ডালপালা, মানুষজন বোঝা যায় না, বোঝানোর জন্য দরকার নিজেদের দিকে ফিরে তাকানো। তার কাজগুলো গানের মধ্যে, ডালপালার মধ্যে, পানির মধ্যে, আমাদের ঘিরে আছে। শিল্প মরে যেতে শুরু করে, যদি শিল্প একাডেমির মধ্যে থেকে যায়। হামিদ শিল্পকে রাস্তায় নিয়ে এসেছেন, একাডেমি থেকে উদ্ধার করেছেন। বাড়িঘরের সামনে, রাস্তার মোড়ে, বিশাল আকারের ভবনের মধ্যে কিংবা আমার নিজের সংগ্রহে যে চারটি কাজ আছে; সে সবে। ১৯২০-এ পিকাশো ও মাতিস যে লাইন ড্রইং কল্পনা করেছেন, সে সবই তার কাজের ভাস্কর্যের লাইন ড্রইংয়ে রূপান্তরিত করেছেন। আমরা দেখি, আমাদের দেখা শেষ হয় না। হামিদ এভাবে, ভাস্কর্যের একটি পারসোনালাইজড স্টাইল তৈরি করেছেন।

লাইন ড্রইংয়ের মধ্যে কাজ, হামিদের কাছে সতত একটা যোগসূত্রের প্রতীক। যোগসূত্রটা হচ্ছে বক্তব্যের সঙ্গে স্পেসের সম্পর্ক। বক্তব্য হামিদ যত আঁকড়ে ধরেছেন, ততই হামিদের চারপাশে স্পেস জীবন্ত হয়ে উঠেছে। স্পেসে উড়ছে পাখি কিংবা গাছের ডালপালা, এসব কিছু কনক্রিট, আশার প্রকাশ। ক্যানভাসে বাস্তব না ধরে, হামিদ স্পেসে বাস্তব ধরতে চেয়েছেন। সে জন্য তার প্রকাশ ভিন্ন। এই বাস্তব ভাস্কর্যের বাস্তব, ক্যানভাসের বাস্তব না।

ভাস্কর্যের বাস্তব তাহলে কি? মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে কিংবা বসুন্ধরার গ্রামীণফোন ভবনে হামিদ স্পেস নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। একটা সতেজ সজীব বৃক্ষ ও একটা শুকনো বৃক্ষের ডালপালার মধ্যে তফাৎ কি। এই তফাত্টাকে ধরতে চেয়েছেন ও বুঝতে চেয়েছেন হামিদ, ভাস্কর্যের বাস্তব এলান থেকে তৈরি হয়েছে। শুকনো, ফাটা কাঠ এবং ভাঙাচোরা ডালপালার পতন, পচন ও মৃত্যুর ইঙ্গিতবহ, অন্যটিকে বিশাল বৃক্ষের সবুজ ডালপালা জীবন ও যৌবনের ইঙ্গিতবহ। হামিদের বৃক্ষ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পশ্চাত্পদ এখানেই, শুকনো ডালপালা এভাবে সবুজ ডালপালায় বদলে যায়। হামিদ বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে এই বোধে উপনীত হয়েছেন। আমিও তার সঙ্গে এই বোধে উপনীত হয়েছি।

পেইন্টার হামিদুজ্জামান ও ভাস্কর হামিদুজ্জামানের কোথাও একটা মিল আছে। দুক্ষেত্রে, পেইন্টিং ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে, একটা গতি জড়ানো, একটা গতির বিস্ফোরণ পেইন্টিং ও ভাস্কর্যকে উন্মথিত করে রেখেছে। যদি বলি একজন সভ্য মানুষ ছুড়ে ফেলেছে নিজকে ঢেকে রাখার বর্ম, তাহলে হয় তো ভুল বলা হবে না। নিজেকে উন্মোচিত করার, নিজেকে উন্মিলিত করার, নিজেকে মেলে ধরার দ্বৈত মাধ্যম হামিদুজ্জামান খুঁজে পেয়েছেন। প্রকৃতি কিংবা নিসর্গ কিংবা সত্যের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। এই অগ্রসর হওয়াটাই তার কাজের অন্তঃসার। নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতা, তার কাজ, তার পেইন্টিং ও ভাস্কর্যকে বিভিন্ন মটিফ দিয়েছে, যিনি চিৎকার করে বলেছেন— দেখ দেখ, এখানেই আমার কাজের স্পষ্টতা ও নিষ্ঠুরতা, এখানেই আমি যুক্ত করে দিয়েছি আলোক ও রং এবং বাতাসের শব্দ। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, চন্দ্র উঠেছে, বাতাস চঞ্চল করে, আর আমি হামিদুজ্জামানের অনুভূতিতে, অনিঃশেষ বাতাসের চিৎকার শুনেছি— এই হচ্ছে আমার ভাস্কর্য। বাতাস জড়িয়ে ধরেছে বৃক্ষ, বৃক্ষ জড়িয়ে ধরেছে পাখি, পাখি জড়িয়ে ধরেছে জনস্রোত, স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে শিল্পীর চোখ। এই শিল্পী আমি, হামিদুজ্জামান, আর কেউ নয়। ইউরোপের তুষার ও ঢাকার বৃষ্টির মধ্যে আমি হামিদুজ্জামানকে এভাবেই ভিন্নভাবে বুঝতে শিখেছি।

এভাবে তিনি তার শিল্পের একটা ব্যক্তিগত ভিত্তির দিকে অগ্রসর হয়েছেন। তিনি তৈরি করেছেন একটা প্রাইভেট প্রতীক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে। তিনি সাহসের সঙ্গে মেলে ধরেছেন তার জীবনের সমস্যা। কোনো এক সময় তিনি যে উন্মাদ হয়েছেন সেই সমস্যা। তিনি নিজেকে করুণা করেননি, সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন অস্তিত্বের সমস্যা। এ হচ্ছে মানুষের অস্তিত্বিক অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাই তার ভাস্কর্যের এবস্ট্রাক্টিভ বিভিন্ন ফিগার, কিংবা বলা যেতে পারে আধুনিক মানুষের অস্তিত্বের বিভিন্ন দিক। এ হচ্ছে এক্সপ্রেসনিজম, হামিদুজ্জামান যেভাবে বুঝেছেন, তার কাজের সাবজেকটিভ দিক তার কাজের মধ্যে এভাবে থেকেছে কিছু পরিমাণ মৌলিকত্ব।

তার উন্মত্ততা যখন তাকে ভেঙে ফেলেছে কিংবা ভেঙে ফেলতে পারেনি, অস্তিত্বের এই সমস্যা তাকে বারবার ড্রইংয়ের কাছে নিয়ে গেছে, পেইন্টিংয়ের ক্ষেত্রে ড্রইং কিংবা ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে ড্রইং তাকে ইমোশনাল করেছে। তিনি বুঝেছেন, মানুষের ইমোশন এবং লাইন, ফর্ম এবং রঙের মধ্যে সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক তিনি খুঁজেছেন ভাস্কর্যের জটিল তরঙ্গ ও শিকড়ের মতো বিভিন্ন ফর্মের মধ্যে। তিনি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠেন, তিনি বুঝতে পারেন উন্মত্ততা তাকে ভাঙতে পারবে না, তার ক্ষমতা উন্মত্ততার চেয়েও শক্তিশালী, পেইন্টিং ও ভাস্কর্য তার আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস, বিধাতা তাকে তিনটি জিনিস দিয়েছেন, আঁকা, আঁকা, আঁকা; তার ভাস্কর্য ও পেইন্টিংয়ে থাকে অসংখ্য লাইনের সমাহার।

ভ্যান গঘ উন্মাদ ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের পেইন্টিং প্রমাণ, রবীন্দ্রনাথ স্বাভাবিক ছিলেন না; হামিদুজ্জামান কখনো কখনো উন্মাদের চোখে পৃথিবীকে দেখেছেন, এই দেখাই তার ভাস্কর্যকে, পেইন্টিংকে ভিন্ন জগতে ভ্রমণ করতে সাহায্য করেছে। তার জীবনের প্রথমদিকে উন্মত্ততা তাকে ঘিরে ধরেছে, কিন্তু কাজ দিয়ে তিনি উন্মত্তাকে হটিয়ে দিয়েছেন। এখানেই হামিদুজ্জামানের জয়।

তার ভাস্কর্য ফিজিক্যালি অন্তরঙ্গ। প্রকৃতি, নিসর্গ, জলস্রোত, সব তার প্রিয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজটা কিংবা বঙ্গভবনের কাজটা কিংবা মিরপুর ১০ নম্বর গোল সার্কেলের কাজটা কিংবা গ্রামীণফোন ভবনের কাজটা তার এবং আমাদের সবার প্রিয়। প্রিয় বলেই এসব কাজ আমাদের মনে এবং চোখে আবেগ জাগিয়ে তোলে। এই আবেগ ভালোবাসার। এসব কাজ ভালোবাসার স্মৃতি আমরা ভুলতে পারি না। কি করে আমরা ভুলে যাব জলস্রোত, পাখ-পাখালি, প্রকৃতি এবং নিসর্গ। আমরা তাকাই, একটা আনন্দ আমাদের, চোখ ঘিরে ধরে, সীমান্তের চোখ ভর করে। একটা যাত্রান্দিত সময়ের স্মৃতি আমরা ভুলতে পারি না। এসব কাজ গানের মতো, আমাদের চতুর্দিকে জেগে ওঠে। ভাস্কর্যের চেয়েও অধিক এসব কাজ। গৃহের অভ্যন্তর পাগল করে বোলে, ভবনের বাইরে স্পেস মায়াজাল শুয়ে বোলে।

হামিদুজ্জামান এখানে পৌঁছেছেন কি করে?

ভাস্কর্যের কাজ শেখা ও দেখার জন্য হামিদুজ্জামান ১৯৫৯ সালে ইংল্যান্ড পাড়ি দেন। ঢাকার আর্ট কলেজে তখন পর্যন্ত ভাস্কর্য পঠনীয় ছিল না। হামিদুজ্জামান বিদেশে গিয়ে হেনরি মুর, নিয়স্কমতি, হুসেনের কাজ থেকে ভাস্কর্যের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এই অর্জন হচ্ছে তার শ্রেষ্ঠতম অভিজ্ঞতা। তিনি শিখেছেন, ভাস্কর্য হচ্ছে এক ফর্ম, পর্বত এবং মানুষী ও পাখির ইমাজেরি। তিনি মিলিয়েছেন মানুষী ফিগার ও পাখির ফিগারের সঙ্গে ল্যান্ডস্কেপের। উন্মুক্ত প্রকৃতি ও ল্যান্ডস্কেপের রাউন্ডেড ফর্মের সঙ্গে মানুষকে মিলিয়েছেন; মানুষী ফিগার হচ্ছে ল্যান্ডস্কেপ; কার্ভিংয়ে পড়ল ফিগারটিভ উপাদান, যেন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত মানুষী ফিগারের রেফারেন্স। ল্যান্ডস্কেপ হয়ে ওঠে মানুষী শরীর অথবা পাখির শরীর অথবা গাছপালার শরীর। সব ফর্ম সরল ও সহজ, একটা ভাস্কর্য সম্বন্ধে যতটুকু জানা দরকার, সবই এখানে আছে, যেন একটা জার্নি, একটা একক ফর্ম ফিরে প্রদক্ষিণ করা। হামিদুজ্জামান আমাদের নিয়ে এই কাজটা করেছেন, ভাস্কর্য নির্মাণ করে করে তিনি আমাদের জার্নি করতে শিখিয়েছেন।

সংগীত এবং পেইন্টিং, সংগীত এবং ভাস্কর্যের মধ্যে কোথাও একটা মিল আছে। ভাস্কর্য হচ্ছে স্পেসের মধ্যে ফর্ম, এই ফর্মের ভিত্তি ও এই ফর্ম সংগীতের খুব কাছাকাছি। অন্যদিকে এই ফর্মের উৎস কিউবিস্ট পেইন্টিং। কিউবিস্ট পেইন্টিংয়ের মধ্যে যে কনস্ট্রাকশন-স্কালপাচারের দ্যোতনা আছে, তাকে হামিদুজ্জামান ব্যবহার করেছেন রৈখিকতা ও রৈখিক সূক্ষ্মতার মধ্যে। পেইন্টিংয়ের মতো তার কাজ উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ, মনে হয় ভারহীন। তিনি প্রকাশ করেছেন ব্লেড কিংবা সিটের মতো ফর্মের মধ্য দিয়ে। এখানে স্পেস আছে আকার দেওয়া, ভাগ করা, আবদ্ধ করার জন্য, স্পেসকে ভর্তি করার জন্য নয়। হামিদুজ্জামানের ভাস্কর্য মনে হয়, পাথর, ব্রোঞ্জ এবং কাদামাটি বাদ দিয়েছে, হাত গড়িয়েছে লোহা, স্টিল, প্লাস্টিক, সেলুলয়েডের দিকে; তার মিল বরং গ্লাস, তামার, ওয়েন্ডার, কাঠমিস্ত্রির যন্ত্রপাতি ব্যবহারের দিকে। সে জন্য পেইটিং বাস্তব ব্যাখ্যা করে তার ভাস্কর্য, বাস্তব দখল করে। ভাস্কর্য এবং পেইন্টিং প্রতিযোগী শিল্প নয়, বরং মূলত ভিন্ন ভিন্ন শিল্প। হামিদুজ্জামান এই কূটশিল্পের স্বরূপ প্রথম থেকেই বুঝেছেন।

হামিদুজ্জামান অনেক শিখেছেন গিয়াকমেডির কাছ থেকে। গিয়াকমেডি একজন স্পেস থেকে মানুষ তৈরি করেছেন। একটা সামগ্রিক বক্তব্যের মধ্যে যিনি গতি সঞ্চার করেছেন অসীম বহুমুখীদের মধ্যে তিনি ঐক্যের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। হামিদ গিয়াকমেডির অনুসরণে স্পেসের ভিতর মানুষের ছাপ মেরেছেন কিংবা লোহা স্টিল রড যেভাবে মানুষের স্বপ্ন দেখে, সেখানে ঘুরেছেন। গিয়াকমেডি যেভাবে মানুষ এবং মানুষের ভিড় তার দিকে অগ্রসর হতে দেখেছেন, একইভাবে হামিদ রড এবং রডের ভিড়কে তার দিকে হাঁটতে শিখিয়েছেন। এই হাঁটতে শেখানো হচ্ছে তার কাজ, তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা। স্পেসের অভিজ্ঞতা অর্জন করা। সবকিছুর জন্য একটা সময় দরকার, হামিদুজ্জামানের কাছে এই সময়টা হচ্ছে ভাস্কর্য তৈরি করার জন্য বেঁচে থাকা। বাংলাদেশে তার পূর্বসূরিরা ভাস্কর্য বানাতে গিয়ে পরাজিত হয়েছেন ভাবনার দিক থেকে এবং উপাদানের দিক থেকে। তারা যুদ্ধ না করে পালিয়েছেন, হামিদুজ্জামান পালাননি। তিনি ভাস্কর্যের বিভিন্ন উপাদানের কাছে নিজেকে মেলে ধরেছেন, তার বিভিন্ন উপাদান রাজকীয়ভাবে নিজেদের মেলে ধরেছেন তার আইডিয়ার কাছে।

সর্বশেষ খবর