শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

অস্ট্রেলিয়ায় সাহিত্য আড্ডা

নাসরীন জাহান

অস্ট্রেলিয়ায় সাহিত্য আড্ডা

আট মাস আগে হঠাৎ আমন্ত্রণ আসে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন থেকে। বছরান্তে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ থেকে একজনকে সভাপ্রধান করে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালিরা। ওদের সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন ছিল কিন্তু আমি নিজেই ছিলাম হাসপাতালে। আমি বলেছিলাম বিকল্প কাউকে ভাবতে। দুই মাস পার হওয়ার পর জানতে পারি আমার ব্যাপারে তারা অনড়। অবশেষে ১১ আগস্ট ২০১৬ তারিখে উড়াল দিলাম মেলবোর্নের উদ্দেশে। অধ্যাপক নাহিদ খান  ও অধ্যাপক মনির খানসহ আয়োজকরা দল বেঁধে আমাকে রিসিভ করে এয়ারপোর্ট থেকে। সেই উষ্ণ অভ্যর্থনা আরও আন্তরিকতাপূর্ণ হয়েছিল। দুই দিন শহরের নানা স্থানে ঘুরে বেড়াই। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল এত সুন্দর প্রকৃতি, সব কিছু সাজানো-গোছানো আর মানুষগুলো যেন আরও আপন। অনুষ্ঠানের শিরোনাম ‘নাসরীন জাহান সাহিত্য আড্ডা’ অর্থাৎ সমগ্র অনুষ্ঠানটি আমাকে ঘিরে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সভাস্থলে আমাকে অভ্যর্থনা জানানো হলো। আমার ছোটগল্প ‘শঙ্খনাদ’ থেকে পাঠ হলো। মঞ্চনাটক ‘রূপবতী’ প্রদর্শিত হলো। তারপর আমাকে তাজ্জব বানিয়ে শ্রুতিনাটক মঞ্চস্থ হলো বহুলপঠিত ‘উড়ুক্কু’ উপন্যাস। যেন চমকের পর চমক। অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার আগে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমাকে বলেছিলেন—ওদের অনুষ্ঠানের কোনো তুলনা নেই। তোমার কিন্তু ভালো লাগবে। তার কথার প্রমাণ পেয়েছি প্রতি মুহূর্তে। আড্ডায় এক ঘণ্টাব্যাপী আমার সাহিত্যজীবন নিয়ে আলোচনা করলাম। তারপর প্রশ্নোত্তর পর্ব। এত প্রাণবন্ত অনুষ্ঠান আমার জীবনে আগে আসেনি। অনুষ্ঠানের শেষলগ্নে আমার হাতে তুলে দিল বুমেরাং ক্রেস্ট। এই স্মৃতি নিয়ে সেদিন ঘরে ফিরেছি, তারপর আমার নিমন্ত্রণ হলো আয়োজকদের বাড়িতে বাড়িতে।

শর্মিষ্ঠা গুপ্ত ও রঞ্জন গুপ্তের বাড়ির আড্ডা শেষ না হতেই লুত্ফুর রহমান খান ও লুলু খান দম্পতি, শিল্পী দে ও তুহিন দে, অদিতি ও নারায়ণ ব্যনার্জি, ছন্দসী ও প্রতীষ বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ ভট্টাচার্য, খাদিজা বীথি ও নিখিল সমদ্দার, দিলরুবা শাহানা ও মঞ্জুর চৌধুরী, মঞ্জুরী ও অরিন্দম চৌধুরী, নাহিদ খান ও মনির খান দম্পতির বাসায় প্রাণবন্ত আড্ডা, সংগীতাসর আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল।

নাহিদ খানের স্বামী মনির ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন পাহাড় আর সমুদ্র দেখাতে। আমার এত শরীর খারাপ তার কোনো পাত্তা নেই যেন স্বপ্নের দেশে ঘুরছি। সবাই খুব মজার মানুষ, পণ্ডিত, সহমর্মী। হঠাৎ দিলরুবাকে আবিষ্কার করা গেল আমার লেখার বিশেষ পাঠক হিসেবে। সে সংবাদে আমার লেখা ধারাবাহিক ‘যখন চার পাশের বাতিগুলো নিভে আসছে’ পড়ত। এ ছাড়া বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস সে ডিটেল পাঠ করেছে তার প্রমাণ তুলে ধরল। আমি অবাক, বিস্মিত, মুগ্ধ। মেলবোর্ন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত সব পড়িত জায়গা। আমার কেবলই ঢাকা শহরের কথা মনে হচ্ছিল, জ্যাম, ঘনবসতি।  

এর মাঝে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। লুত্ফুর ভাই দ্রুত  ডাক্তার আনিয়ে পিতৃছায়ায় আমাকে সুস্থ করে তুলল। সিডনিতে ইমরান ও দীপা দম্পতি আমাকে সঙ্গ দিয়েছে। তারা আমাকে দেখাল সিডনি অপেরা, ক্রিকেট স্টেডিয়ামসহ নানা স্থান। এ আড্ডা, উৎসবের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরার এক অনন্য মাধ্যম। লেখককে প্রবাসী পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, সাহিত্য অনুবাদের সুযোগ তৈরি, সর্বোপরি চিন্তার লেনদেনের সুযোগ ঘটে। সেক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীদের এই মহতী উদ্যোগের সফলতা কামনা করি। সবাই বিদায় জানিয়ে যখন দেশে ফিরছিলাম তখন মনটা খুব বিষণ্ন হয়ে উঠেছিল। একটা স্বপ্নময় মোহগ্রস্ত থেকে আমি ঘরে ফিরছি, পেছনে কত ভালোবাসা, শ্রদ্ধায় ছায়া। আমি আজও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি, শর্মিষ্ঠার কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত।

সর্বশেষ খবর