শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান

অনুকরণীয় এক চিকিৎসক

অনুকরণীয় এক চিকিৎসক

ডা. এম আর খান। জন্ম : ১ আগস্ট, ১৯২৮—মৃত্যু : ৭ নভেম্বর, ২০১৬

জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান উপমহাদেশের খ্যাতিমান চিকিৎসক। একজন শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবাকে মহৎ পেশার মর্যাদা দিয়েছেন তিনি। শিক্ষা, চিকিৎসা, শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা, দুর্গত অসহায় মানুষের সেবাসহ নানাবিধ সমাজকল্যাণমূলক কাজে অসামান্য অবদান রাখায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি, স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বিজ্ঞান একাডেমি স্বর্ণপদক, আন্তর্জাতিক ম্যানিলা অ্যাওয়ার্ডসহ একাধিক সম্মাননা অর্জন করেছেন।  সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন—শেখ মেহেদী হাসান

 

আপনার জন্ম সাতক্ষীরা শহরের রসুলপুরে। কেমন ছিল আপনার ছেলেবেলা।

আমার জন্ম ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট সাতক্ষীরার রসুলপুর। আমার আব্বা আলহাজ আবদুল বারী খান, মা জায়েরা খানম। তাদের চার ছেলের মধ্যে আমি মেজ। মায়ের কাছে আমার পড়াশোনার হাতেখড়ি। ছোটবেলায় সারা দিন থাকতাম খেলা, দৌড়াদৌড়ির ওপর। যখন স্কুল শুরু হলো, রসুলপুর প্রাইমারি স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে গেলাম। মেঝেতে তালপাতার তৈরি আসনে (চাটাই) বসে পড়তাম। ভাই পড়তেন ক্লাস ওয়ানে, বেঞ্চিতে বসতেন। সারাক্ষণ আগ্রহ ছিল কখন বেঞ্চিতে বসব? আমাদের স্কুলটি ছিল বাড়ির পাশে। টিফিনে বাড়ি চলে যেতেন আধা ঘণ্টার জন্য। মাঝে মধ্যে বেঞ্চিতে বসে উপভোগ করতাম বেঞ্চিটা কেমন লাগে! ফুটবল খেলা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। আব্বাও ভালো খেলতেন। বড় টিমের প্লেয়ার ছিলেন। আমাদের মহল্লায় ও স্কুলে খেলার মাঠ ছিল। সে সময় একটি ব্রিটিশ টিম এসে গেল কলকাতায়। নাম ‘সিক্স ফিল্ড ব্রিগেড’। আমরা নাম ঘুরিয়ে তা-ই দিয়ে দিলাম। লোকে হাসত, ‘এই, তোমরা বাঙালি নাম বাদ দিয়ে কী এক সাহেবি নাম দিয়েছ?’ তারপর ওই ছোট টিমটাই চ্যাম্পিয়ন হয়ে সব ট্রফি নিয়ে নিল। ১৩টা ট্রফি পেয়ে গেলাম আমরা। এমন কিছুই না, ছোট্ট শিল্ড বা ছোট্ট কাপ। কিন্তু তখনকার দিনে এটা বিরাট উদ্দীপনা। পেনাল্টি প্রায় মিস হয়ে যেত বলে পেনাল্টি হলে আমার ডাক পড়ত। কিন্তু সব সময় ভালো লাগত না এই কারণে যে, গোল দিলে কোনো কৃতিত্ব নেই। ও তো গোল হবেই। কিন্তু গোল না দিলেই অকৃতিত্ব যত! পেনাল্টি নিয়েও গোল দিতে পারল না! প্রচণ্ড অপমান। আমার ছেলেবেলা ছিল স্বপ্নের মতো। সারা দিন খেলতাম, দৌড়াতাম। এখন যে বাচ্চারা বলে, খিদে লাগে না। মা বলে, কিছুই খায় না বাচ্চা। তখন এ সমস্যা ছিল না। বেশি খাবার খেতাম। সারাক্ষণ ঘুরে এসে মাকে বলতাম, ‘খিদে লেগেছে খাবার দাও।’

 

ছেলেবেলার আর কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?

আমাদের বাড়ির পাশে বড় পুকুর ছিল। খেলার পর ওই পুকুরে সাঁতার কাটতাম। আধা ঘণ্টা, ৪৫ মিনিট সাঁতার কেটে অন্য কাজে মন দিতাম। স্কুল থেকে ঘরে ফিরে বইটই ছুড়ে ফেলে দিয়ে মাঠে চলে যেতাম। খেলাধুলা করে ক্লান্ত থাকতাম। সে জন্য সন্ধ্যায় পড়তে বসে ঘুমিয়ে যেতাম। আর চোখ মেলে তাকানো যেত না। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত মনে পড়ে, আমি কোনো দিন রাতে বই পড়িনি। বাবা থাকতেন শহরে। প্রতিদিন রাত ১০টার সময় ডেকে তুলে খাওয়াতেন। ভোর ৫টায় মা যখন নামাজ পড়তে যেতেন আবার ডেকে দিতেন। তারপর ভোর ৫টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত পড়ে সব পড়া মুখস্থ করে স্কুলে যেতাম।

 

আপনাদের সময় তো তালপাতায় লেখার প্রচলন ছিল। তালপাতায় লিখতে কেমন লাগত?

হ্যাঁ, আমরা তালপাতায় লিখেছি। তাল গাছের পাতা কেটে রোদে শুকিয়ে লেখার উপযোগী করতাম। বাঁশের কঞ্চি সরু করে কেটে ওটা দোয়াতের কালিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে লিখতাম। বেশিক্ষণ থাকত না। সেই সময় তো কাঠের চুলা ছিল। হাঁড়ির কালি আর শিমপাতার রস কিংবা কয়লা দিয়ে বানানো কালিতে  লিখতাম। লিখতে গিয়ে প্রায়শ পোশাক নষ্ট হতো। লেখা শেষে তালপাতা পানিতে ধুয়ে আবার গুছিয়ে যত্ন করে রেখে দিতাম। অনেক পরে স্লেটে লেখা শিখেছিলাম। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো ওগুলো দেখেইনি, বিশ্বাসও করে না।

 

আপনার এমন কোনো শিক্ষক ছিল যিনি আপনাকে উৎসাহিত করতেন।

সাতক্ষীরা পিএন হাই স্কুলের শিক্ষক শ্রী গিরীন্দ্রনাথ ঘোষের কথা মনে পড়ে। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার ছিলেন, মাল্টিফেরিয়াস কোয়ালিটির লোক। এক গিরীন্দ্র স্যার সব পড়াতেন। ইংরেজি, বাংলা, অংক, ভূগোল, ইতিহাস পড়াতেন। পড়ার বাইরের বই পড়তে দিতেন। আউট নলেজে একবার দিলেন ‘চেস্টারফিল্ডস লেটার টু হিজ সান’। আমাদের কোর্সেও নেই। তবু তিনি বলতেন, ‘পড় বাবা, এটার মধ্যে অনেক জিনিস আছে। পড়ে সেগুলো আবিষ্কার কর।’ এসেই বলতেন, ইতিহাস বইতে যা পড়লে ইংরেজিতে আমাকে বল। সুতরাং আমাকে ওটা ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করে বলতে হতো। ইংরেজির সাবসট্যান্স রাইটিং খুব আগ্রহ করে দেখতেন। এই যে এত লিখেছে, চার লাইনে বল তো কী বলতে চায়? ইংরেজি জ্ঞানের পরিপক্বতায় এতে অনেক সাহায্য হয়েছে। ছুটির দরখাস্ত লিখতে হবে ইংরেজি ভাষায়, বাংলা হবে না। ইংরেজিতে যাতে আমরা ব্যুত্পত্তি লাভ করি, এ বিষয়ে তিনি নতুন নতুন কৌশল বের করতেন। পড়াশোনায় কোনো ফাঁকি দেওয়া যেত না। শ্রী গিরীন্দ্রনাথ ঘোষ আমার জীবন বদলে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন মহৎ শিক্ষক। ১৯৪৩ সালে সাতক্ষীরা পিএন হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করি।

 

তারপর কোথায় পড়াশোনা করলেন?

ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর আমাকে কলকাতায় পাঠানো হলো। তখন প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হওয়া খুব ডিফিকাল্ট ছিল। আমরা কোটাতে ভর্তি হলাম। ওই সময় অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক এ কে চন্দ্র। মোটামতো ভদ্রলোক, স্যুট পরে হেলেদুলে চলতেন। পাইপ খেতেন। আস্তে আস্তে কথা বলতেন। অল ইন্ডিয়ার আইসিএস অফিসার, বিরাট ব্যক্তি। তিনি আমাকে ভর্তি করে নিলেন। তারপর পড়াশোনায় মন দিলাম। আমাদের সময় বিখ্যাত সব শিক্ষক ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯৪৫ সালে আইএসসি পাস করলাম প্রথম বিভাগে। তারপর ১৯৪৬ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। অনেক কষ্ট করে ভর্তি হতে হয়েছে। কিছুটা মেরিট, কিছুটা পরিচিতির জোরে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। দ্বিতীয় বর্ষে পেলাম খ্যাতিমান অধ্যাপক ডা. পশুপতি বোসকে। মিটফোর্ডে অ্যানাটমির টিচার ছিলেন। চিকিৎসাবিষয়ক তার উচ্চতর ডিগ্রি তেমন ছিল না। ডিটিপি ছয় মাস। এখান থেকে ওখানে যাওয়ায় লোকেরা তাকে একটু অন্যরকম চোখে দেখত। কিন্তু এমন টিচার খুব কম দেখেছি। বোর্ডে অ্যানাটমির ছবি আঁকতেন ডান হাতে-বাঁ হাতে। তার ক্লাস ছিল এক ঘণ্টা, চলত আড়াই ঘণ্টা-তিন ঘণ্টা। যত ছেলে পোস্টগ্র্যাজুয়েট করতে যেত ব্রিটেনে, পশুপতি বোসের ক্লাসে বসত। গ্যালারিতে ধারণক্ষমতা ছিল ২০০ কিন্তু সেখানে ৩০০-৩৫০ ছেলে বসে দু-আড়াই ঘণ্টা পশুপতি বোসের বক্তৃতা শুনত। হি ওয়াজ অ্যা ভেরি ট্যালেন্টেড জিনিয়াস ম্যান। আবার যখন ক্লিনিক্যাল সাইডে উঠলাম, অধ্যাপ ডা. মণি দে, প্রফেসর মেডিসিন, কলকাতা মেডিকেল কলেজ। বিরাট টিচার, ব্যাপক পাণ্ডিত্য। তার ক্লাসেও একই অবস্থা। যারা পোস্টগ্র্যাজুয়েট করবে, মণি দের ক্লাস করবেই। তার লেকচারও ইন্টারেস্টিং ছিল। একদিন অ্যামিবা সম্পর্কে বলছেন, ‘অ্যামিবা সিঙ্গেল সেল প্রোটোজোয়া; কিন্তু বিরাট তার কার্যক্ষমতা। সে সৃষ্টি করতে পারে না হেন অসুখ। আমি করি কি, একটু বেশি খাবার খাই। অল্প আমার জন্য, অল্প তাদের জন্য।

যাতে অ্যামিবা গোলমাল না করে।’ অসাধারণ লেকচার দিতেন। এখনো মনে আছে, মণি দে যখন চলে গেলেন, সবাই কাঁদছিল। চিকিৎসাবিদ্যায় এমন শিক্ষক পাওয়া বিরল। আমি ভাগ্যবান কলকাতা মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক ডা. পশুপতি ও অধ্যাপক মণি দের মতো শিক্ষক পেয়েছিলাম।

 

 

এমবিবিএস পাসের পরে কী করলেন?

১৯৫৩ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর সাতক্ষীরায় ফিরে আসি। ছয় বছর ভিসা ছাড়াই থাকলাম কলকাতায়। সাতক্ষীরায় আমি প্রথম এমবিবিএস। আর সব এলএমএল, কোয়াকের রাজত্ব। তারা আমাকে খুব ভালো চোখে দেখত না, এসেছে আমাদের উৎপাত করতে! এলাকার কিছু লোক আমাকে ধরল, মিউনিসিপ্যাল ইলেকশন করতে হবে। আমি তো রাজিই না। একপর্যায়ে নির্বাচন করলাম এবং ভোট কারচুপিতে হেরে গেলাম। আমাদের খুব মন খারাপ। নির্বাচন কমিশনের বিপক্ষে মামলা করে দিলাম। কেস গেল ইলেকশন কমিশনে, তারা এসডিও’র কাছে পাঠাল। তিনি বললেন, যে বক্সগুলো আছে সেগুলো পাঠাও। দেখি কারণটি কী? বক্সগুলো তারা পুড়িয়ে ফেলেছে। সুতরাং এসডিও মহাবিপদে পড়লেন। আমার ওপরে রাগ হওয়াতে খেপে আমাকে ১৯৫৪ সালে ফজলুল হক সাহেবের দলের লোক বলে জেলে আটকালেন। এক মাস খুলনা জেলে থাকলাম। দুজন আমার সঙ্গী। জেলে প্রতিদিন খাওয়া নিয়ে গোলমাল হতো। যা খাবার দিত পেট ভরত না। আমি ইয়ংম্যান, একটু কম খেতাম। আমার সঙ্গী দুজন গোলমাল করত। এদিকে এসডিও আমার বাপ-চাচাকে ধরলেন, খানকে কেস তুলে নিতে হবে। না হলে সমস্যা আছে। তারা আমাকে বললেন, কেস তুলে নাও। এসডিও’র সঙ্গে গুঁতাগুঁতি করে এই দেশে থাকা যাবে না। সাবডিভিশন টাউন। সিএসপি এসডিও খুব পাওয়ারফুল লোক। বাপকে বললাম, একদিন সময় দিন দেখি। পরের দিন বললাম যে, বাবা আপনার কথাতে কেস তুলে নিচ্ছি। কিন্তু সাতক্ষীরাতে আমি আর থাকব না। তারপর খুলনায় চলে গেলাম।

 

ব্রিটেনে উচ্চতর পড়াশোনা করতে গেলেন কখন?

খুলনায় এক বছর কাজ করার পর ব্রিটেনে পোস্টগ্র্যাজুয়েট করার সুযোগ পেলাম। চান্স পেলাম ডিটিএম অ্যান্ড এইচ কোর্সে। ১৯৫৬ সালে ব্রিটেন গিয়ে এডিনবার্গ স্কুল অব মেডিসিনে ভর্তি হলাম। বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেছি পাঁচ বছর, কোর্স করেছি এক বছর। ট্রপিক্যাল মেডিসিন কোর্স করলাম, ডিটিএম অ্যান্ড এইচ কোর্স শেষ হলো। ডিসিএইচ পাস হলো। এমআরসিপি ওরিয়েন্টেশন কোর্স এডিনবার্গে ইন ক্লিনিক্যাল মেডিসিন। এমআরসিপি ক্লিনিক্যাল কোর্স করলাম এডিনবার্গে। পরীক্ষা দিলাম, পাস করলাম। তারপর দেশে ফিরে এলাম ১৯৬৩ সালে। বিলেতে আমি যে হাসপাতালে গিয়েছি সবাই আমাকে ভালোবেসেছে এবং আমার যাওয়ার সময় ফেয়ারওয়েল দিত। কোটপিন, টাই, শার্ট, কলম, ডায়েরি দিয়েছে। এটা ও দেশে রেয়ার, কালো চামড়ার লোক, ফেয়ারওয়েল পায়!

 

আপনার বিলেতের জীবনের অভিজ্ঞতা জানতে চাই?

ব্রিটেনের বোলটন হাসপাতালে আমি ইনচার্জ ছিলাম। এক বাচ্চা ভর্তি হলো বিকালে। সাত-আট মাসের বাচ্চা, সিভিয়ার ডায়রিয়া। কেউ তাকে ড্রিপ দিতে পারে না। সিস্টার বলল, ‘মিস্টার খান তুমি কি আসবে একটু? জানি, তোমার ছুটি। এই বাচ্চাটা খুব কাহিল, তুমি একটু ড্রিপ দিয়ে দাও। তাহলে বাচ্চাটা হয়তো বেঁচে যাবে।’ পাজামা পরা ছিল, তার ওপর প্যান্ট লাগিয়ে চলে গেলাম। গিয়ে ড্রিপ দিয়ে এলাম। পরদিন ডিকসন সাহেব এসে বললেন, ডক্টর খান হাউ ইজ ইউর পেশেন্ট? বললাম, স্যার হি ইজ নট মাই পেশেন্ট। হি ইজ ইউর পেশেন্ট। ডিকসন সাহেব খুব খুশি। কদিন পর ডিকসন সাহেব আমাকে বললেন, খান তুমি কি এ দেশে থাকবে? ইউ উইল বি কনসালট্যান্ট লাইক মি। বললাম, আমার কালো চামড়া। কে চাকরি দেবে? ডিকসন বললেন, দেবে। আই শ্যাল সি দ্যাট ইউ গেট দ্য চান্স। না, আমি এ দেশে থাকব না। আমার মতো লোক আপনার দেশে হাজারজন আছে। কিন্তু আমার মতো লোক আমার দেশে খুব কম। ১৯৬২ সালে দেশে চলে এলাম।

 

ঢাকায় এসে কোথায় যোগ দিলেন?

১৯৬৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে মেডিসিন বিভাগে ইব্রাহিম সাহেবের ওয়ার্ডে যোগ দিলাম। তিনি আমাকে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন মিটফোর্ডে। এক-দেড় বছর থাকলাম। পোলাপান খুব খুশি। আমার পেছনে ঘুরত। আমি ডাকতাম, পড়াতাম। পড়া দিতাম, হিস্ট্রি লেখা শেখাতাম। সে সময় আমার কয়েকজন ছাত্র এখন খুব ইম্পর্ট্যান্ট। তাদের মধ্যে একজন মেডিসিনের বিখ্যাত টিচার এম এন আলম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বারডেমের আজাদ খান। আবার ট্রান্সফার হলাম। পেডিয়াট্রিকে লোক নেই। ১৯৬৪ সালে যেতে হলো রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। ১৯৬৪ থেকে ’৬৯ সাল পর্যন্ত রাজশাহীতে ছিলাম। ১৯৬৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে চলে আসি। যুদ্ধের একটু আগে ১৯৭০ সালে পোস্টগ্র্যাজুয়েট প্রফেসর পদে পেডিয়াট্রিকে পোস্ট হলো। অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম সাহেব বললেন, খান সাহেব, আসুন জয়েন করুন। পিজি হাসপাতালে জয়েন করলাম। পেডিয়াট্রিক বিভাগে সেটাই ছিল প্রথম কোনো অধ্যাপক পদ।

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় কোথায় ছিলেন?

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা অনেক বিপত্তির মধ্যে পড়েছি। পাকিস্তানিরা তলে তলে খবর নিচ্ছে কারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে। ডা. রশিদ সাহেব, চোখের ডাক্তার আবদুল আলিম এই দুজন এদের জন্য সংগ্রহ করত টাকা-পয়সা, জামাকাপড়, চুপি চুপি আমাদের থেকে নিয়ে যেত। জানতে পারলে আবার ধরে মেরে ফেলবে। একদিন হলো কী, সন্ধ্যাবেলা এই বাড়িতে দুমদাম গেটে বাড়ি। খুলতে যাব। মিসেস বললেন, ‘তোমার কি মাথা খারাপ?’ ‘কে বিপদে পড়েছে?’ ‘চুপ’। রাত তখন ৮টা-৯টা। কারফিউর মধ্যে অন্ধকার রাতে খাটের নিচে হারিকেনটা নিভু নিভু করে আমি, ম্যান্ডি, ম্যান্ডির মা থাকলাম। একদল লোক গেট পেরিয়ে এলো। বাড়িতে এখানে ধাক্কা মারে, ওখানে ধাক্কা মারে। কেউ নেই, পালিয়েছে বলে চলে গেল। তারা বুদ্ধিজীবী বলে মারতে বা কালেক্ট করতে এসেছিল আলীম চৌধুরীর মতো। পরদিন জাতীয় অধ্যাপক নূরুল ইসলাম সাহেব বললেন, ‘কি, বাড়িতে বসে আছেন খান সাহেব? রোগী এসেছে। দেখার কেউ নেই, চলে আসেন।’ পরদিন, ১৩ ডিসেম্বর চলে গেলাম পিজিতে। একটি ভক্সওয়াগন গাড়ি ছিল, ড্রাইভার তো পালিয়েছে, আমি আর মতি। এই মতি এখনো আমার সঙ্গেই আছে। আমি সামনের সিটে বসা ছিলাম, মতি পাশেই। কাঁটাবন মোড়ের কাছেই দুই আর্মির মধ্যে দুদিক থেকে গোলাগুলি আরম্ভ হয়েছে। পাশ দিয়ে শাঁ শাঁ করে গুলি যাচ্ছে। পিজির গেটে এলাম, নেমেই দেখলাম পেছনে একটা বাচ্চা এসেছে। মাথায় বুলেট ঢুকে গেছে। নিউরোলজির কেস। তখনো পিজিতে নিউরোলজি চালু হয়নি। ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দিলাম। একটু পরে ফোন করে খবর জানলাম। জানাল, চাইল্ড ডাইড। আমাদের পেছনের গাড়িটাতে গুলি করে মেরেছে। এরপর যে কয়দিন এ অবস্থা ছিল থাকলাম পিজিতে। রোগী দেখতাম, ওদের একটা ওয়ার্ডের বিছানায় থাকতাম।

 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তো আপনার চেনা জানা ছিল।

শেখ সাহেব ও তার পরিবারকে দেখার দায়িত্ব ছিল অধ্যাপক নূরুল ইসলাম সাহেবের। শেখ সাহেব প্রায়ই আসতেন পিজি হাসপাতালে বাবা, আম্মাকে দেখতে। আমরা তার সঙ্গে ঘুরতাম। একদিন শেখ সাহেব এসে হাজির সন্ধ্যাবেলা। তিন তলার সিঁড়ি থেকে উঠেই পশ্চিম দিকে যাচ্ছেন। জহুর আহমদ চৌধুরী তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। যাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর ডান পাশে আমি, বাঁ পাশে ইসলাম সাহেব। আলী আফজাল খান তখন ইএনটির অধ্যাপক। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘নাক, গলা, কান/আলী আফজাল খান।’ আমি পরের লাইন যোগ করে দিলাম, ‘বঙ্গবন্ধুর কবিতা/বলে গেলাম আমি সেথা।’ আমার কথা শুনে সবাই হাসল। একদিন বঙ্গবন্ধু বললেন, খান সাহেব, আপনার টেলিভিশনে কথাটা বেশ ভালো লেগেছে। আমি বললাম, কোন কথাটা স্যার? তিনি বললেন, ওই যে বাচ্চাদের খাবার নিয়ে বলছিলেন তালা-চাবি লাগিয়ে রাখতে। মায়ের ওষুধ, বাবার ওষুধ সব একসঙ্গে রাখলে বাচ্চারা খেয়ে নেয়, আমি বলেছিলাম তালা-চাবি দিয়ে রাখতে। বঙ্গবন্ধু যতক্ষণ পিজিতে থাকতেন আমি আর ইসলাম সাহেব ততক্ষণ তার সঙ্গেই থাকতাম। তিনি মহৎ মানুষ। তার মতো সুদর্শন, সজ্জন, দেশপ্রেমী মানুষ আর দেখিনি।

 

আপনাকে বলা হয় ‘ফাদার অব পেডিয়াট্রিক ইন বাংলাদেশ’।

১৯৮৮ সালে নিয়মিত চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার আগে চিন্তা করছিলাম করব কী? সবাই বলল, এক্সটেনশন নিন। আমি এক্সটেশন না নিয়ে পরীবাগে একটা ঘর ভাড়া নিলাম ৬০০ টাকায়। সেটি এখন মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং। সেখানে রোগী দেখতাম। ‘শিশুস্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন’ নামে একটা অর্গানাইজেশন ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে শুরু করেছিলাম। সে ফাউন্ডেশন এখন অনেক বড়। মিরপুর, যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গার হালদি ও টাঙ্গাইলের নুলুয়াতে শাখা আছে। আট-১০টা ব্রাঞ্চ আছে। এরপর সেন্ট্রাল হাসপাতাল করলাম। এটি প্রতিষ্ঠার পেছনে ইন্টারেস্টিং ঘটনা আছে। কী করব চিন্তা করছি— এ সময় আমার মিসেসের সহপাঠী, ‘লিলি’ বাথরুমে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তখন আমাদের এখানে নিউরোলজি শুরু হয়নি। পরে লিলি মারা গেল। লিলির হাজব্যান্ড একদিন দুঃখ করে বললেন— দেখুন খান সাহেব, মানুষ মারা যাবে আফসোস নেই। কিন্তু চিকিৎসা দিতে পারলাম না। মনে অশান্তি রয়ে গেল! তার কথা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। আমি আমার তিন কমরেড ডা. কাশেম, ডা. রফিক, ডা. সিদ্দিককে ডেকে বললাম চল, আমরা হাসপাতাল বানাই। ব্যস, সবাই মিলেই এই সেন্ট্রাল হাসপাতালের সূত্রপাত ঘটালাম। নিবেদিতা নামে একটি নার্সিং হোম প্রতিষ্ঠা করেছিলাম।

 

আপনার পরিবারের কথা জানতে চাই।

সাতক্ষীরা রসুলপুর গ্রামের আনোয়ারা বেগম আনুর সঙ্গে আমার বিয়ে হয় ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি। আমাদের একমাত্র মেয়ে দৌলতুন্নেসা (ম্যান্ডি)।

 

আপনি তো একটি কল্যাণ ট্রাস্ট করেছিলেন।

চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর পেনশনের টাকা দিয়ে এম আর খান-আনোয়ারা ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করি।  এ ট্রাস্ট থেকে শিশু স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় অনুদান, হাসপাতাল ও স্কুল প্রতিষ্ঠা, মেধাবী ও গরিব শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে ভালো অবদানের জন্য স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।

 

আপনার শেষ ইচ্ছা কী?

আমৃত্যু মানুষকে সেবা করব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর