শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঋত্বিক ঘটক : চলচ্চিত্রের ধ্রুবতারা

সুমন বণিক

ঋত্বিক ঘটক : চলচ্চিত্রের ধ্রুবতারা

ঋত্বিক ঘটক (জন্ম : ৪ নভেম্বর, ১৯২৫— মৃত্যু : ৬  ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬) খ্যাতিমান বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক। তার জন্ম পূর্ববঙ্গের ঢাকার ঋষিকেশ দাশ লেনে। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পরে তার পরিবার কলকাতায় চলে যায়। ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে তিনি যেমন প্রশংসিত ছিলেন; ঠিক তেমনি বিতর্কিত ভূমিকাও রেখেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তার নাম বহুল উচ্চারিত। তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র নাগরিক, অযান্ত্রিক, বাড়ি থেকে পালিয়ে, মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, সুবর্ণ রেখা, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো, তিতাস একটি নদীর নাম। এছাড়া একাধিক শর্ট ফ্লিম ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তিনি পদ্মশ্রী অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।

 

ঋত্বিক ঘটক বাংলা চলচ্চিত্রের এক অনন্য পথিকৃৎ। উল্কার মতো জ্বলে ওঠা এবং হঠাৎ করে নিভে যাওয়া এক ক্ষ্যাপা শিল্পস্রষ্টা, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মত্ত ছিলেন তিনি। ঋত্বিক কুমার ঘটক এ দেশের চলচ্চিত্রে নতুন মাত্রার যোগ করেন। চলচ্চিত্রকে বস্তুনিষ্ঠ ও জীবনঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্রের ফ্রেমে বাঁধতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ঘটিয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, টানাপড়েন, জ্বালাময় বেদনাবিধুর জীবন প্রণালীকে আত্মস্থ করেছেন। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে চলচ্চিত্রকে আঁকড়ে ধরে এ জগতে পদার্পণ করেছেন। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার ঋষিকেশ দাশ লেনের বাসায় জন্মগ্রহণ করেন ঋত্বিক কুমার ঘটক। তার বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হলেও কবিতা ও নাটক লিখতেন। মা ইন্দুবালা দেবী। বাবা-মায়ের এগারোতম এবং কনিষ্ঠ সন্তান তিনি। রাজশাহী কলেজ থেকে আইএ এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এমএ কোর্স শেষ করে পরীক্ষা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। তার বড় ভাই ওই সময়ের খ্যাতিমান এবং ভিন্ন ধারার লেখক মনীশ ঘটক ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক এবং সমাজকর্মী। আইপিটিএ থিয়েটার মুভমেন্ট এবং তেভাগা আন্দোলনে মনীশ ঘটক সম্পৃক্ত ছিলেন। মনীশ ঘটকের কন্যা মহাশ্বেতা দেবী সমাজচিন্তক। যিনি পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হয়েছিলেন।

একটি সমাজসচেতন ও সংস্কৃতিমনা পরিবারের আবহে বেড়ে উঠেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। শৈশব থেকেই তার মননে কর্ষিত হয়েছে শোষিতের দুঃখ-ক্লিষ্ট, যন্ত্রণা। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগের মর্মবেদনা নিয়ে শরণার্থী হয়ে কলকাতায় চলে যাওয়া— এসব ঘটনা প্রবাহ ঋত্বিকের জীবন দর্শন নির্মাণে প্রভাবিত করে। যা পরবর্তীকালে তার শিল্প সৃষ্টির মধ্যে ফুটে ওঠে। গল্প-কবিতা লিখে সাহিত্যচর্চায় হাত পাকান ঋত্বিক ঘটক। দেশভাগ তাকে আলোড়িত করেছিল, এই সময়টাতেই কলকাতায় ভারতীয় নাট্য সংঘ আইপিটিএ তে জড়িয়ে পড়েন। রাজনীতিতে দীক্ষা নেন— কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই তে যোগদান করেন।

১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম নাটক লিখেন কালো সায়র। মঞ্চ নাটককে তিনি প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নেন। অসংখ্য নাটকে নির্দেশনা দেন, অভিনয় করেন, রচনা করেন। যেমন চন্দ্রগুপ্ত, অচলায়তন, কলঙ্ক, দলিল, কত ধানে কত চাল, অফিসার, ইস্পাত, জাগরণ, জলন্ত, জ্বালা, ডাকঘর নবান্ন, ঢেউ, সাঁকো, হযবরল, বিসর্জন ইত্যাদি। তিনি ব্রেশট-এর কিছু নাটক বাংলায় রূপান্তরিত করেন এবং মঞ্চস্থ করেন। সিনেমার সঙ্গে ঋত্বিকের সংশ্লিষ্টতা থিয়েটারের প্রায় সমসাময়িক। ফিল্ম নাটকের থেকেও শক্তিশালী মাধ্যম, আরও বেশি দর্শকনন্দিত। এর মাধ্যমে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। ঋত্বিকের এই বার বার শিল্প মাধ্যম পরিবর্তনকে প্রশ্রয় দিয়েছেন সচেতনভাবেই। তাই তো তাকে বলতে শুনি— ‘ছবি লোকে দেখে। ছবি দেখানোর সুযোগ যতদিন খোলা থাকবে, ততদিন মানুষকে দেখাতে আর নিজের পেটের ভাতের জন্য ছবি করে যাব। প্রতিবাদ করা শিল্পীর প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। শিল্প ফাজলামি নয়। যারা প্রতিবাদ করছে না তারা অন্যায় করছে। শিল্প দায়িত্ব। আমার অধিকার নেই সে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার। শিল্পী সমাজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। সে সমাজের দাস। এই দাসত্ব স্বীকার করে তবে সে ছবি করবে।’ এরকম একটি সুতীক্ষ ধারণা ধারণ করে চলচ্চিত্রে এসেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। ১৯৫২ সালে তার প্রথম চলচ্চিত্রের ‘নাগরিক’ নির্মাণ করেন। খুব সম্ভবত এটিই ছিল বাংলা আর্ট ফিল্মের প্রথম পরিচয়। ১৯৫০ সালে নিমাই ঘোষের ছিন্নমূল চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক ও অভিনেতা হিসেবে অভিষেক ঘটে ঋত্বিকের। তাই তার প্রথম সিনেমা ‘নাগরিক’-এর গল্প ও কাহিনী বিন্যাসে ছিন্নমূলের একটা প্রভাব আমরা দেখতে পাই।

দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা একটি শরণার্থী পরিবারের জীবন যুদ্ধই-‘নাগরিক’। দুর্ভাগ্যবশত ছবিটি মুক্তি পায় চব্বিশ বছর পরে, ততদিনে ঋত্বিক পৃথিবী থেকে মুক্তি নিয়েছেন। ১৯৫৫ সালে ঋত্বিক তিনটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘অযান্ত্রিক’ ১৯৫৮ সালে রিলিজ হয়। এজন্য মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে সৃষ্ট সম্পর্ক নিয়ে ছবির কাহিনী এগিয়েছে। এটি একটি ভিন্নধর্মী ছবি। সুবোধ ঘোষের ছোট গল্পকে রুপালি পর্দায় এনে তিনি তাক লাগালেন। একই বছর শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প নিয়ে ছবি বানালেন—‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’। ১৯৬০ সালে দেশভাগের বিড়ম্বনায় এক রিফিউজি পরিবারের জীবন সংগ্রাম ফুটে ওঠে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে। এটিই তার প্রথম ব্যবসাসফল ছবি। শক্তিপদ রাজগুরুর মূল কাহিনীতে চিত্রনাট্য লেখেন মৃণাল সেন। এরপর ঋত্বিক শরণার্থীদের নিয়ে তার ট্রিলজি নির্মাণ করেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ১৯৬০ সালে, কোমল গান্ধার ১৯৬১ ও সুবর্ণ রেখা ১৯৬২।

তার ‘মেঘে ঢাকা তারা’ যেন অসীম নিকষ কালো অন্ধকারে আলোর পথ দেখায়। ‘কোমল গান্ধার’ ছবিতেও ওঠে এসেছে জীবনের জয়গান, দুই বাংলা মিলনের সুর। ‘সুবর্ণ রেখা’য় ফুটে উঠেছে দেশভাগের কুফলসমূহ। এই তিনটি ছবিকে একত্রে পার্টিশন ট্রিলজি বা দেশভাগত্রয়ী বলা হয়ে থাকে। তিনটি ছবিতেই রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার ছবির গভীরতাকে গভীরতর এবং প্রাণবন্ত করেছে। সমাজ যাকে দেশভাগের মাধ্যমে বলি দিয়ে দিয়েছে ঋত্বিক সেখানে স্বপ্ন দেখান এক নতুন আরম্ভের। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র শেষ দৃশ্যে নতুনের আবাহন আমরা দেখতে পাই। ঋত্বিক ঘটক বলেন—‘মানুষের অবক্ষয় আমাকে আকর্ষণ করে। তার কারণ এর মধ্যদিয়ে আমি দেখি জীবনের গতিকে, স্বাস্থ্যকে। আমি বিশ্বাস করি জীবনের প্রবহমানতায়। আমার ছবির চরিত্ররা চিৎকার করে বলে আমাকে বাঁচতে দাও। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সে বাঁচতে চায়—এ তো মৃত্যু নয়, জীবনেরই জয় ঘোষণা।’

১৯৬৫ সালে সুবর্ণ রেখা মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৬৬-৬৭ সাল কিছুদিন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউশনের অধ্যক্ষ ছিলেন। মুম্বাইতে হিন্দি ছবিতে চিত্রনাট্য রচনার কাজ করেছেন ঋত্বিক। ১৯৭২ সালে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মাণ করেন বিখ্যাত ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। ব্রাত্যজন মালোদের জীবন বৃত্তান্ত, মাটি ঘেঁষা মানুষের জীবন সংগ্রাম। ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে তিতাসপাড়ের মৎস্যজীবীদের জীবনের সংগ্রাম, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিচ্ছবি সেলুলয়েডের ফিতায় জীবন্ত করেছেন ঋত্বিক ঘটক। ঋত্বিক ঘটক এই উপন্যাসের চিত্ররূপ দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেন অন্য তিতাসকে। তিনি অদ্বৈত বাবুর স্বপ্নকে প্রসারিত করেন, স্বপ্নের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আলোকসম্পাত ঘটান। ঋত্বিক বাবু বলেন— ‘অদ্বৈত বাবু যে সময় তিতাস নদী দেখেছেন, তখন তিতাস ও তার তীরবর্তী গ্রামীণ সভ্যতা মরতে বসেছে। বইয়ে তিতাস একটি নদীর নাম। তিনি এর পরের পুনঃজীবনটা দেখতে যাননি। আমি দেখতে চাই যে, মৃত্যুর পরেও এই পুনঃজীবন হচ্ছে। তিতাস এখন আবার যৌবনবতী। আমার ছবিতে গ্রাম নায়ক, তিতাস নায়িকা।’ এই পুনঃজীবন ধারণের মাধ্যমেই ঋত্বিক ঘটক জীবনের জয়গান গেয়েছেন, স্বপ্নের পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছেন। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিটি মৌলিক শিল্পকর্ম হিসেবে আজও সমাদৃত।

১৯৭৪ সালে ঋত্বিক নির্মাণ করেন ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। তার জীবন দর্শনের প্রতিফলন এই ছবিতে ফুটে ওঠে। এটি তার আত্মজীবনীমূলক ছবি। দেশভাগ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল বাড়ি আন্দোলন এসবের প্রেক্ষাপটে নির্মিত ছবিতে কোনো রাজনৈতিক ভাবাদর্শকে তুষ্ট করার ইচ্ছা না থাকলেও জীবনের টানাপড়েন, দুঃখ-ক্লিষ্টকে ফুটিয়ে তুলেছেন সযত্নে।

ঋত্বিক ছিলেন সিনেমার বিপ্লবী। তাই তিনি বলেন— ‘আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বুঝাব যে, ইট ইজ নট এন ইমেজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে হাতুড়ি মেরে বুঝাব যে, যা দেখছেন তা একটি কল্পিত ঘটনা কিন্তু এর মধ্যে যেটা বুঝাতে চাইছি আমার সেই থিসিসটা বুঝুন। যেটা সম্পূর্ণ সত্যি সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমি আপনাকে এলিয়েন্ট করব প্রতি মুহূর্তে। যদি আপনি সচেতন হয়ে উঠেন, ছবি দেখে বাইরের সেই সামাজিক বাধা, দুর্নীতি বদলের কাজে লিপ্ত হয়ে উঠেন, আমার প্রচেষ্টাকে যদি আপনার মধ্যে চাপিয়ে দিতে পারি তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা।’ সিনেমা বানানো তার কাছে শুধু শিল্প ছিল না বরং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। তার সিনেমার বিষয়বস্তু ছিল দুঃখ-বেদনা-ক্লিষ্ট গণমানুষকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখানো। ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫০ বছর বয়সে না ফেরার রাজ্যে চলে যান ঋত্বিক। তার শিল্পকর্ম বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এক দীপশিখা জ্বালিয়ে দিয়েছে যার আলোয় এদেশের প্রান্তজনেরা আজো পথ দেখে, জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে চায়। বাংলা চলচ্চিত্রের এক ধ্রুবতারা— ঋত্বিক ঘটক আজো দীপ্তিমান।

সর্বশেষ খবর