শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া

আমি বাঁশি বাজাই না, প্রার্থনা করি

আমি বাঁশি বাজাই না, প্রার্থনা করি

পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া (জন্ম : ১ জুলাই ১৯৩৮) উপমহাদেশের খ্যাতিমান বংশীবাদক। ১৫ বছর বয়স থেকে তিনি সুরের জাদুতে মুগ্ধ করে রেখেছেন শ্রোতাদের। ভারত সরকার তাকে পদ্ম-বিভূষণ, পদ্মভূষণ, সংগীত নাটক একাডেমি পদক, নর্থ উড়িষ্যা বিশ্ববিদ্যালয় ও উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে। এই মহান শিল্পীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—শেখ মেহেদী হাসান

 

 

আপনি এক সময় কুস্তিগির ছিলেন; বংশীবাদনে কীভাবে যুক্ত হলেন?

আমার জন্ম ইলাহাবাদে। ছয় বছর বয়সে আমার মা মারা যান। আমার বাবা ছিলেন কুস্তিগির। তিনি চাইতেন আমিও তার মতো কুস্তিগির হই। তিনি নিজেই আমাকে কুস্তির প্রশিক্ষণ দিতেন। অচিরেই আমি দক্ষ কুস্তিগির হয়ে উঠেছিলাম এবং ছেলেবেলায় প্রায় নিয়মিত কুস্তি লড়তাম। তবে কুস্তি আমার ভালো লাগত না। সুর, সংগীত আমাকে নিবিড়ভাবে টানত। পণ্ডিত ভোলানাথ নামে এক ব্যক্তি আমাদেরই প্রতিবেশী, তিনি বাঁশি বাজাতেন। গোপনে তার বাড়িতে হাজির হতাম। তার বাঁশির সুর শুনে নিজে নিজে বাজানোর চেষ্টা করতাম। এক সময় তিনি বললেন— ‘তুমি বাঁশি বাজানো শিখলেই পার। তোমার তো সুর উঠে গেছে।’ আমি রাজি হয়ে গেলাম এবং তার কাছে তালিম নিতে শুরু করলাম। এভাবে তার শিষ্য হলাম। অচিরেই কুস্তি ছেড়ে বংশীবাদনে বুঁদ হলাম। তখন বাঁশিই হয়ে উঠল আমার ধ্যানজ্ঞান। সংগীতের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসার কথা বাবাকে কখনো বলিনি।

 

আপনার বাবা কি গান-বাজনা পছন্দ করতেন?

তিনি গান-বাজনা পছন্দ করতেন বটে কিন্তু এর তো কোনো ভবিষ্যৎ ছিল না। বাবা আমাকে বলতেন— ‘তুমি পড়াশোনা কর, চাকরি কর।’ তখন আমি বাঁশি বাজানোর পাশাপাশি পড়াশোনায় মন দিই। বাবার পরামর্শে টাইপিং শিখি। এরপর ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে একটি প্রতিষ্ঠানে টাইপিস্টের চাকরি পেলাম। মাসে ৮৫ রুপি বেতন। বাবা আমার ওপর ভীষণ খুশি হলেন। তখন আমি পরিকল্পনা করলাম যেহেতু বাবা আমার ওপর খুশি এই সুযোগে মিউজিকে মন দিই। সেই লুকোচুরি খেলা অনেক দিন চলতে থাকল। চলতে  থাকল আমার গভীর অনুশীলন। রাতের পর রাত জেগে আমি চর্চা করি, বিভিন্ন গান ও রাগের অনুশীলন করি। এর মধ্যে আমি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকরি পেলাম।

 

অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকরি পাওয়ায় আপনার বাবা অবাক হননি?

ভীষণ। টাইপিস্টের চাকরি থেকে হঠাৎ অল ইন্ডিয়া রেডিওতে মিউজিশিয়ানের চাকরি! বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘তুমি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে মিউজিক বিভাগে চাকরিতে ঢুকলে?’ তখন বাবাকে বললাম, কুস্তি লড়া, টাইপিস্টের চাকরি আমার ভালো লাগত না। তাই গোপনে পণ্ডিত ভোলানাথ বাবুর কাছে বাঁশি বাজানো শিখতাম। তিনি আমার চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। তিনি ছিলেন উড়িষ্যার মানুষ। আমি মাতৃহীন, সংগীত ভালোবাসি, এ জন্য ভোলানাথ বাবু আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বাবা কিছু না বলে বেতন কত জানতে চাইলেন। আমি বললাম, টাইপিস্টের চাকরির দ্বিগুণ, ১৬০ রুপি। তিনি তো অবাক, বাঁশি বাজিয়ে ১৬০ টাকা বেতন! আমি দেখলাম বাবার চোখে একটু জল। তিনি আমাকে আশীর্বাদ করলেন। এরপর বাবা আর কখনো বাধা দেননি। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকরি পাওয়ার পর আমার চর্চার সুযোগ বেড়ে যায়।

 

বংশীবাদনের জন্য আপনি নাকি বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন?

ছেলেবেলায় আমাদের পরিবার বলতে বাবা আর আমি। তিনি চাইতেন আমি পড়াশোনা শিখে বড় হই। বাবা পড়াশোনার জন্য চাপ দিতেন আর আমি ভালোবাসতাম গান-বাজনা। একদিন বাবাকে বললাম— পড়াশোনা আমার ভালো লাগে না। আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে চলে যাব। আমি এক মাস পর এসে যাব। তিনি বললেন, ‘তোর জন্য আমি আর বিয়ে করিনি। তুই চলে গেলে আর আসবি না।’ তখন বাঁশি বাজানোর নেশায় টাইপিস্টের চাকরি নিয়ে সেই যে উড়িষ্যা গেলাম আর বাবা মারা গেলে ফিরে এসেছিলাম।

 

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল, সে স্মৃতি জানতে চাই।

আমি তখন ছোট। আমার এক সহপাঠী একদিন বললেন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এসেছেন চল দেখা করে আসি। আমি তাকে চিনতাম না। আমার বন্ধু বলল, তিনি অনেক বড় কলাকার। তো হাফ প্যান্ট, হাফ শার্ট পরে গেলাম। তিনি আমাকে দেখেই কাছে ডাকলেন। আমি কাছে গিয়ে তাকে প্রণাম করলাম। ওস্তাদজি বললেন, ‘খাবে কিছু?’ আমি বললাম, না না আপনাকে একটু দর্শন করতে এসেছি। তিনি বললেন, ‘বস, আমি একটু সিগারেট টেনে তারপর তোর সঙ্গে কথা বলব।’ এরপর তিনি বললেন, ‘বাজা।’ আমি তো ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি, কী বাজাব আপনার সামনে। তিনি বললেন, যা পারিস বাজা। আমি একটু ইমন শিখেছিলাম তাকে শোনালাম। তখন তিনি বেহালা বাজিয়ে আমাকে শোনালেন। এ রকম বাদন আজও আমি শুনিনি। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি মিউজিক শিখলে আমার মেয়ের কাছে যাবে।’ 

 

তারপরই কি মুম্বাই গেলেন?

১৯৬০ সালে আমি মুম্বাই চলে আসি এবং হিন্দি চলচ্চিত্রে একটি ওড়িশি নাচের সঙ্গে বাঁশি সংগত করি। একটি চলচ্চিত্রে লতাজির সঙ্গে বাজালাম। আমার বয়স তখন অল্প কিন্তু সবাই আমার বাদন পছন্দ করল। বেশ পরিচিতি পেলাম। তখন কোনো শিল্পীর একক বংশীবাদন রেডিওতে খুব একটা প্রচার হতো না। আমার সেই সুযোগ হলো। মুম্বাইয়ে মাস দুয়েক চাকরি করি, তারপর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকে পড়ি। চলচ্চিত্র পরিচালকরা আমাকে ডাকতে শুরু করলেন। ওই সময় আমি  ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কন্যা সুরবাহারের কিংবদন্তি শিল্পী অন্নপূর্ণা দেবীর সান্নিধ্য লাভ করি। তিনি আমার গুরুমা।

 

 

আপনি কাদের কাছে তালিম নিয়েছেন?

আমি পণ্ডিত রাজা রামের কাছে কণ্ঠসংগীতের তালিম নিয়েছি। তিনি কণ্ঠসংগীতে আমার প্রথম শিক্ষক। তিনিই আমার কান তৈরি করে দিয়েছেন। আমি তো এখনো কণ্ঠসংগীতের অনুশীলন করি আর সেটাই বাঁশিতে বাজিয়ে শ্রোতাদের শুনাই। অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে তালিম নিয়েছি। এখনো প্রতি বছর অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে যাই, তালিম নিই। তিনি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। আমি কীভাবে সুর প্রক্ষেপণ করব, সুরের ওঠানামা, সুরের আবেগ, সুরের কারুকাজ ইত্যাদি আমাকে শিখিয়েছেন। তিনি আমাকে শেখালেন গায়কী (সংগীত পরিবেশনারীতি), গৎকারী (সেতার, সরোদ বাদনের শৃঙ্খলা)। যদি কোনো বংশীবাদক যন্ত্রবাদন, তাল, ছন্দ গভীরভাবে আয়ত্ত করতে না পারে তাহলে সে শিল্পী হতে পারে না। এজন্য ধ্রুপদ স্টাইল শিখতেই হবে। আমার বাদনে দেখবেন সুরের প্রবাহে আমি বিভিন্ন স্টোক উপস্থাপন করি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি গুরুমার কাছে সুরের আবর্তন, প্রক্ষেপণ শিখেছি। তিনি এখনো আমাকে বকা দেন, বলেন— ‘হরি, কোথায় ছিলে এতদিন? দেখা করনি কেন, কী খেয়েছ? তুমি বানরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছ?’ তার মুখে এসব শুনতে আমার ভালো লাগে। আমার জীবনে একটাই ইচ্ছা— পরজন্মে যদি মানুষ হয়ে জন্মাই তাহলে গুরুমার কাছে যাব।

 

নিয়মিত কতক্ষণ অনুশীলন করেন?

আমি সারাক্ষণ অনুশীলনের মধ্যে থাকি। এটা তো আমার সাধনা। বংশীবাদন একটি মেডিটেশন (ধ্যানের শিল্প)। 

 

আপনি ‘সিলসিলা’ চলচ্চিত্রে পণ্ডিত শিবকুমার শর্মার সঙ্গে সন্তুর ও বাঁশির যুগলবন্দী করেছেন।

‘সিলসিলা’ তো বিখ্যাত চলচ্চিত্র। এ ছবিতে অমিতাভজি অভিনয় করেছেন। লতাজি গান গেয়েছেন। আমি ও পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা সন্তুর ও বাঁশির যুগলবন্দী বাজিয়েছি। সেখানে আমরা বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেছি। এটা আমাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। ছবিটি সবাই পছন্দ করেছিল, সেটাই আমাদের আনন্দ।

 

বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী?

অসাধারণ। গতবারও আমি এ উৎসবে অংশগ্রহণ করেছিলাম, তখনো ভালো লেগেছিল। এত বড় আয়োজন, শ্রোতাদের এত আগ্রহ, ভাবাই যায় না।

আমি বার বার আসতে চাই এ উৎসবে। এখন দর্শক-শ্রোতার কাছে আমার অনুরোধ, আগামীবার আমার বাঁশি শোনার সময় যারা বাঁশি বাজান, তারা তো বাঁশি নিয়ে আসবেনই, এমনকি যারা বাঁশি বাজান না, তারাও আসবেন বাঁশি নিয়ে।

 

উপমহাদেশীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের ভবিষ্যৎ কী?

উপমহাদেশের উচ্চাঙ্গসংগীত বহু যুগের সাধনা। এই মাটি বড় বড় কলাকার জন্ম দিয়েছে। তারা বিশ্বজুড়ে উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রসার ঘটিয়েছে, যা আজও অব্যাহত। উচ্চাঙ্গসংগীতের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ব্যাপারটা কি জানেন, জায়গা কখনো খালি থাকে না, জায়গা পূরণ হয়ে যায়।

 

আপনার কয়েকটি ‘গুরুকুল’ আছে তাদের বংশীবাদন শেখান। ঢাকায় এসে কি শেখাবেন?

আমি ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শেখায়। ঢাকার শ্রোতাদের ঊষ্ণ ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তারা সংগীত ভালোবাসে। আপনারা যদি ব্যবস্থা করেন আমি অবশ্যই শেখাব। এ ক্ষেত্রে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন যদি আমাকে আমন্ত্রণ জানায়, আমি সানন্দে আসব।

 

বাঁশি বাজানোর সময় শ্রোতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন কীভাবে?

আমি ঈশ্বরভক্ত মানুষ। আমি যেখানে যাই ছোট্ট একটি মন্দির সঙ্গে নিই। তুমি তো বাক্সভর্তি মন্দিরটি দেখেছ। ঈশ্বরের কাছে নিজেকে নিবেদন করি। তিনিই আমাকে সুর দেন। আমি বাঁশি বাজাই না, প্রার্থনা করি। আমার প্রার্থনা যখন দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করে, তখনই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয় আমার। এটা আত্মিক সম্পর্ক।

 

আপনার জীবনস্মৃতি লিখবেন না?

আমি ক্ষুদ্র মানুষ। আমার কী বা জীবনস্মৃতি! তবে আমার ওপর ‘ডড়ড়ফরিহফং ড়ভ ঈযধহমব’ নামে সুরজিৎ সিং একটি বই লিখেছেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৮ সালে। এ ছাড়া হেনরি টারনিয়ার নামে এক ভদ্রলোক ‘হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া অ্যান্ড দ্য আর্ট অব ইম্প্রভাইজেশন’ নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে আমার সংগীত জীবন ও বাদন সম্পর্কে নানা কথা বলা হয়েছে। 

 

জীবনের কোনো অপ্রাপ্তি আপনাকে কষ্ট দেয়?

আমার জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি নেই। সারা জীবন মানুষের ভালোবাসায় আমি ধন্য হয়েছি। আমার বংশীবাদন মানুষ পছন্দ করে, আমাকে ভালোবাসে, সম্মান করে, আর কী চাই!

সর্বশেষ খবর