শুক্রবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় মাতৃভূমি

বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় মাতৃভূমি

বাংলাদেশের বন্ধু রজার গোয়েন

খ্যাতিমান ব্রিটিশ আলোকচিত্রশিল্পী ও শিক্ষক রজার গোয়েন প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৬৪ সালে। সেই আগমন তার জীবন পাল্টে দিয়েছিল। ১৯৭১ সালে লন্ডনে বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের জন্য কাজ করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তার ভূমিকা, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎসহ বিভিন্ন বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—শেখ মেহেদী হাসান

 

আপনার জন্ম ব্রিটেনে। কেমন ছিল আপনার ছেলেবেলা?

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলতে চলতে লন্ডনে (১৩ জুলাই ১৯৪১) আমার জন্ম। ছোটবেলা কাটিয়েছিলাম লন্ডন শহরতলিতে। স্কুলের পর্ব শেষ করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে (সামাজিক নৃবিজ্ঞান) নিয়ে ডিগ্রি লাভ করি।

 

কৈশোরে আপনি ঘরছাড়া হয়ে বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরেছিলেন। সে অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

অর্থ সংগ্রহ অথবা উচ্চ পদ দখলের লোভ আমার ছিল না। লোভ ছিল বিশ্ব দেখার ও বিশ্বের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে চাকরির সন্ধান না করেই ইউরোপের বাইরে স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কাজ করার সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। ভাগ্যক্রমে তখন বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব-পাকিস্তানে) কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। নভেম্বর ১৯৬৪ থেকে ডিসেম্বর ১৯৬৫ পর্যন্ত সার্ভিস সিভিল ইন্টারন্যাশনাল নামক প্রতিষ্ঠানের আওতায় কাজ করি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশাল জেলার বিভিন্ন জায়গায়। সে সময় কয়েকজন বাঙালি সহকর্মীর সঙ্গে আমার নিবিড় বন্ধুত্ব স্থাপন হয় এবং বাংলা ভাষা আয়ত্ত করতে শুরু করি। পরবর্তীতে আরও কয়েকবার বাংলাদেশে গিয়েছি ও কালক্রমে বাংলাদেশকে আমি আমার দ্বিতীয় মাতৃভূমি বলে মনে করতে শুরু করেছি।

 

ছেলেবেলায় আপনি কী হতে চেয়েছিলেন?

ছোটবেলা থেকে ফটো তোলার প্রতি আমার খুব আগ্রহ ছিল। আলোকচিত্র বিষয় নিয়ে কোনো দিন পড়াশোনা করিনি, কিন্তু নিজের ক্যামেরা দিয়ে সবসময় ফটো তুলেছি, তুলতে তুলতে কিছু কায়দা শিখেছি। ১৯৬৪-১৯৬৫ আমার সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সফরের সময় বিশেষ চেষ্টা করেছিলাম যতকিছু দেখব তা ফটো আকারে ধরে রাখতে। এভাবে বাংলাদেশের ওপর আমার প্রামাণিক চিত্রের অ্যালবাম শুরু হয়। তবে এ পর্যন্ত এগুলো নিয়ে কোনো প্রদর্শনীর আয়োজন হয়নি। 

 

আপনি তো শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত আমি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনে কাজ করি।  পরবর্তী সময়ে আমি একজন শিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিই। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালে আমি বার্মিংহামে একজন শিক্ষক হিসেবে কাজ করি। তখন আমি একজন বাঙালি জাহাজির বাড়িতেই ভাড়া থাকতাম। এভাবেই বার্মিংহামের বাঙালি সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ গড়ে ওঠে।

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি প্রচুর ছবি তুলেছেন। বিশেষ কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?

১৯৭০ সালে বার্মিংহামে পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট নামের একটি সংগঠন ছিল। তাদের মধ্যে আজিজুল হক ভূইয়া ও মো. ইসমাইল আজাদ ছিলেন অন্যতম। ওই দলের সঙ্গে আমার কিছু যোগাযোগ ছিল এবং আমি তাদের নিউজলেটার পড়তাম। ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া শাসনের বিরুদ্ধে লন্ডনে আন্দোলন শুরু হয়। বার্মিংহামের বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে আমিও যোগ দিই। তাজুল হকের নেতৃত্বে ‘দ্য বাংলাদেশ অ্যাকশন’ কমিটি গড়ে ওঠে বার্মিংহামে। আমি ওই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম শুরু থেকে। জগলুল পাশা, ইসমাইল আজাদ ছিলেন অন্যতম সংগঠক। এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আমি বিভিন্ন মিছিলে যোগ দিই। ১৯৭১-এর গ্রীষ্মকালে আমি চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি (বিডিএসি), বার্মিংহামে দফতর সম্পাদক হিসেবে যোগ দিই। আমার দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং সংগঠনের মিটিং আয়োজন করা। আমি প্লাকার্ড তৈরি করতাম এবং বিভিন্ন মিছিলে অংশগ্রহণ করেছি।

 

আপনি কোন ধরনের প্লাকার্ড বা পোস্টার করতেন?

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠন ও আন্দোলনে তরুণ কর্মীদের সম্পৃক্ত করতে বাংলাদেশ মুকুল ফৌজ নামের একটি যুব সংগঠন গড়ে তুলি। যেটি বার্মিংহামে অ্যাকশন কমিটির সহযোগী হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ মুকুল ফৌজের সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সুজাক আলী, আবদুল মান্নান, জামাল খান, ওয়ালি আহাদ, গিয়াসউদ্দিন ইসলাম, হুসাইন আহমদ, মহিবুর রহমান, একলাস উদ্দিন ও মুকিমুদ্দিন। সেসব ঘটনার আলোকচিত্রও তুলেছিলাম, ইদানীং ঢাকায় প্রদর্শিত সাংবাদিক উজ্জ্বল দাশের ‘লন্ডন ১৯৭১’ প্রদর্শনীতে আমার সেই ফটোগুলোর কয়েকটা ছিল। বিডিএসি ও বাংলাদেশ মুকুল ফৌজের লোগো, পোস্টার, মিছিলের ব্যানার আমাকেই করতে হয়। মহান নেতা শেখ মুজিবের একটি ছবি নিয়ে হাতে লিখে কোলাজ পোস্টার তৈরি করেছিলাম। পোস্টারে লিখি ‘বাঙালির জয় হবেই, ইতিহাস আমাদের অনুকূলে।’ যে কথাটি আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম। অন্যান্য অ্যাকশন কমিটির মতোই বার্মিংহামের বিডিএসি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ ফান্ড’-এর জন্য চাঁদা তুলত। বিডিএসির কর্মীরা বাঙালিদের ঘরে ঘরে যেতেন ও চাঁদা আদায় করতেন। বাংলাদেশ ফান্ডের পয়সাগুলো বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠানো হতো। তখন সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে ছিলেন খলিলুর রহমান, আহসান ইসমাইল ও আমিন উদ্দিন।

 

১৬ ডিসেম্ব্বর ১৯৭১-এর সময় কোথায় ছিলেন। ওই দিনের কথা বলুন?

১৬ ডিসেম্ব্বর ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের জয়লাভের সুখবরটা যখন প্রকাশ পায় তখন আমি বার্মিংহাম সংগ্রাম পরিষদের দফতরে ছিলাম। সকালবেলা ছিল, আমি একাই ছিলাম। রেডিওতে খবরটা শুনে আমি খুশিতে জয়ধ্বনি করতে লেগেছিলাম— জয় বাংলা! জয় বাংলা! কিছুদিন পরে যখন শেখ সাহেব মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশ ফেরার পথে লন্ডনে অবস্থান করছিলেন তখন সংগ্রাম পরিষদের আরও দু-চারজন কর্মীকে নিয়ে লন্ডন ছুটেছিলাম তার সঙ্গে দেখা করার জন্য।

 

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল, কখন। তার কোনো স্মৃতি আছে কিনা, থাকলে বলুন।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যেদিন দেখা হয় ১৯৭২, জানুয়ারির ৯ তারিখ। আমি তখন বার্মিংহামে। শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেয়ে পাকিস্তান থেকে লন্ডন এসেছেন। লন্ডন শহরের নামজাদা ক্লেরিজ হোটেলে উঠেছেন। শোনা যাচ্ছে, তিনি পরের দিন প্লেনে উঠে ঢাকা চলে যাবেন। আমি আর আমার দুজন ছোট ভাই গিয়াস উদ্দীন ইসলাম ও মুহিবুর রহমান (ওরা দুজনই বাংলাদেশ মুকুল ফৌজের সদস্য) হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম— আমরা লন্ডন গিয়ে শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করব। জীবনে এরকম সুযোগ আর পাব না। চল যাই, দেখি কী হয়। বার্মিংহাম থেকে লন্ডনের ট্রেন ধরলাম। মহানগরীতে পৌঁছতে ও ক্লেরিজ হোটেল খুঁজে বের করতে করতে প্রায় সন্ধ্যা হয়েছিল। পৌঁছে দেখলাম হোটেলের সামনে পুলিশ কয়েকজন পাহারা দিচ্ছে। রাস্তার অপর পাশে ত্রিশ-চল্লিশ জন বাঙালি জমা হয়েছে। তারা আমাদের মতো শেখ সাহেবের দেখা পাওয়ার আশায় ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহর থেকে চলে এসেছেন। হোটেলের সামনের দরজা দিয়ে পুলিশের অনুমতি নিয়ে কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি আসা-যাওয়া করছেন— কূটনীতিবিদ, পলিটিশিয়ান, সাংবাদিক। কিন্তু জনসাধারণের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো। এক সময় লেবার পার্টির নেতা হ্যারোল্ড উইলসন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসে হাজির। তাকে সঙ্গে সঙ্গে ঢুকতে দেওয়া হয়। শেখ সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে তিনি কুড়ি মিনিট পরে আবার বেরিয়ে আসেন। তারপরে হঠাৎ রাস্তায় দাঁড়ানো জনগণের কণ্ঠে স্লোগান ওঠে— ‘বঙ্গবন্ধু!’ হোটেলের দোতলার এক জানালা থেকে দেখা যায়, স্বয়ং শেখ সাহেব হাত নেড়ে সালাম দিচ্ছেন ও আমাদেরকে বলছেন— ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, ইনশা-আল্লাহ স্বাধীন থাকবে! জয় বাংলা!’ জয় বাংলার প্রতিধ্বনিতে রাস্তা ভরে গেল। কিছুক্ষণ পরে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির উদ্যোক্তা আজিজুল হক ভূইয়া হোটেল থেকে বেরিয়ে আমাদের কাছে এলেন। শেখ সাহেবের সঙ্গে কে কে দেখা করতে চান, তাড়াতাড়ি নাম বলুন! অন্য অনেকজনের মতো আমরাও তার তালিকায় নাম লিখালাম।

 

 

আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

তারপরে পাঁচ-ছয়জন করে বাইরে জমা জনগণের মধ্য থেকে মানুষ ডেকে হোটেলের ভিতরে নেওয়া শুরু হলো। সবার শেষে আমাদের পালা পড়ল। আজিজুল হকের পিছ ধরে পুলিশের লাইন পেরিয়ে হোটেলে প্রবেশ করলাম। কত দামি হোটেল, সিঁড়িতে গালিচা পাতা, চতুর্দিকে পোশাক পরা নোকর। দোতলায় শেখ সাহেবের জন্য কয়েক কক্ষ নিয়ে বিশাল সুইট রাখা হয়েছে। শেখ সাহেবের বসার ঘরে ঢুকতে দেওয়া হলো আমাদের। মিনিট দু-এক পরে পাশের আর এক রুম থেকে বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এলেন আমাদের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য। লম্বা শক্তিশালী মানুষ, পরনে কুর্তা, নাকে চশমা, অনেক ছবিতে যেরকম দেখেছিলাম ঠিক সেরকমই। হাত মিলিয়ে আমাদের বললেন, ‘শুনেছি তোমরাও আমাদের স্বাধীনতার জন্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছ। ধন্যবাদ তোমাদেরকে।’ দুঃখের বিষয়, ফটো তোলার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মুহিবুর রহমান সাহস করে শেখ সাহেবের দস্তখত চেয়ে নিল এক কাগজে। তারপরে আমাদের চলে আসতে হলো। অনেক রাত হয়ে গেছে, শেখ সাহেব খাওয়া-দাওয়া করবেন, ঘুমাবেন। আমরা দৌড়ে রেল স্টেশনে ছুটলাম, খুশি মনে শেষ ট্রেনে উঠে বার্মিংহাম ফিরলাম বিজয়ী যোদ্ধার মতো। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সঙ্গে একবার হাত মেলাতে পেরেছিলাম এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত।

 

হুমায়ূন আহমেদের জোছনা ও জননীর গল্প অনুবাদ করতে আগ্রহী হলেন কেন?

‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলাম এই আশায় যে, এ দেশে (ইংল্যান্ড) যত বাঙালি মা-বাবার ছেলে ও মেয়ে উত্তরাধিকার সূত্রে বাঙালি হলেও বাংলা ভাষা ভালোমতো জানে না এবং বাংলা বই পড়তে পারে না, তারা এ বইটা ইংরেজিতে পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্বন্ধে অনেক কিছু শিখতে পারবে। ইতিহাসের বই পড়ে যেটুকু বোঝা যাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি বোঝা যাবে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসটি পড়লে— এই ছিল আমার ধারণা। কারণ, জোছনা ও জননীর গল্প ১৯৭১-এর পরিবেশ, সমাজ, ভাব, ঘটনা— সবকিছু মিলিয়ে অতুলনীয় এক জীবন্ত চিত্র। এ দেশের বাঙালি ছেলেমেয়েরা অনেকেই ১৯৭১-এর ঘটনা সম্বন্ধে কিছু জানে না, বাংলাদেশের অবস্থা কেমন ছিল, কত কষ্টে স্বাধীন হয়েছিল, তারা জানে না। তাদের এসব কিছু বোঝানোর আশায় কাজটা করেছি।

 

আপনাকে ধন্যবাদ।

ধন্যবাদ আপনাকে। শুভেচ্ছা বাংলাদেশের ভাই-বোনদের।

সর্বশেষ খবর