শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ (অব.) বীরউত্তম

অস্ত্র ছাড়া আমার মৃত্যু কবুল কর না

অস্ত্র ছাড়া আমার মৃত্যু কবুল কর না

মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ও এস ফোর্সের প্রধান, সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান, রাষ্ট্রদূত ও সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ (জন্ম : ২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪)। তিনি একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে বীরোচিতভাবে অংশ নিয়ে সুনাম অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরউত্তম উপাধি দেয়। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—শেখ মেহেদী হাসান

 

কেমন ছিল আপনার ছেলেবেলা?

আমার জন্ম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪, নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে। আব্বা কাজী আযষুল হামিদ ছিলেন শিক্ষক ও ম্যারেজ রেজিস্ট্রার, মা রজ্জব বানু গৃহিণী। তিন ভাই ছয় বোনের মধ্যে আমার অবস্থান ষষ্ঠ। আমার শৈশব-কৈশোরের দুরন্ত সময়গুলো কেটেছে রূপগঞ্জে। খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিল। পড়াশোনায়ও ভালো ছিলাম। মুড়াপাড়া হাইস্কুল থেকে ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করি। আব্বার সঙ্গে একবার মুন্সীগঞ্জ বেড়াতে গিয়ে হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্পাস দেখে আমার ভালো লাগে। কলেজের সামনে সুন্দর খেলার মাঠ, বড় পুকুর দেখে আব্বাকে বলে রেখেছিলাম ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে আমি এই কলেজে পড়ব। ম্যাট্রিকুলেশনে প্রথম বিভাগ পাওয়ায় আমার পছন্দানুযায়ী আব্বা মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে ভর্তি করে দিলেন। কলেজের মাঠে আমরা বন্ধুরা মিলে খেলা করতাম। পুকুরে সাঁতার দিতাম। খুব আনন্দময় ছিল সেসব দিন।

 

আপনার বাবা তো খেলাফত আন্দোলনের কর্মী ছিলেন।

আব্বা খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা শেষ করে তিনি রিপন কলেজের শিক্ষক হয়েছিলেন। মসজিদে ইমামতিও করতেন। খুতবায় ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়ার নাম বলতে রাজি না হওয়ায় তাকে শাস্তিমূলকভাবে অবিভক্ত বাংলা থেকে বার্মায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরে ভারত ফিরলে তাকে আবারও পাঠানো হয় ইরানে। সেখানে তিনি ফার্সি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। দেশে ফিরে পেশা হিসেবে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে বেছে নেন।

 

আপনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন কবে?

মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েই তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পরীক্ষা দিই। আমি চাঞ্চ পেলাম। এর মধ্যে এইচএসসি রেজাল্ট বেরোল। তারপর চলে গেলাম পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায়। সেখানে ছয় মাসের কোর্স শেষে কাকুলে ১২ পিএমএ আড়াই বছরের কোর্স সম্পন্ন করি। কমিশন লাভ করি ১৯৫৫ সালে। ১৯৬৮ সালে স্টাফ কলেজ থেকে পিএসসি কোর্স করি। তারপর স্কুল অব ইনফেন্ট্রিতে ইন্সট্রাকটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ১৯৭০ সালে পদোন্নতি পেয়ে পুনরায় ব্যাটালিয়নে ফিরে আসি। আই ওয়াজ নান এজ ওয়ান আফ দ্য স্মার্টেস্ট অফিসার অব পাকিস্তান আর্মি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পাক সেনা অফিসাররা বাঙালি অফিসারদের আনফিট এবং কমজোরি বলে মন্তব্য করত। তখন মনের জেদে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতায় ভালো করে ওদের এসব মন্তব্যের জবাব দিতাম। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানের কোয়েটায় ৯ জেএসপিসিটিএস ক্যাডেট কলেজে ‘বেস্ট বক্সার অব দি ইয়ার’ হয়েছিলাম। ১৯৬১ সালে শুটিং প্রতিযোগিতায় প্রথম ১০ জনের মধ্যে আমি অন্যতম।

 

১৯৭১-এ আপনি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পুরো বাংলাদেশ প্রচণ্ড উত্তাল। বাঙালি জাতি স্বাধীনতার প্রস্তুতি প্রায় নিয়েই ফেলেছে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও বাঙালি সেনাদের নিয়ে নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাচ্ছে। ইয়াহিয়া সরকার গোলটেবিল বৈঠকের নামে সময়ক্ষেপণ করছিল আর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসছিল সেনাদের। তারা অস্ত্রশস্ত্র এনে গোপনে বাঙালিদের ওপর চূড়ান্ত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছিল। বাঙালি সৈনিকরা যেন জনগণের পাশে এসে না দাঁড়াতে পারে, সে কৌশল আঁটতে থাকে তারা। একপর্যায়ে তারা বাঙালি সামরিক সদস্যদের কাছ থেকে অস্ত্র ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছিল। আমরা যাতে শক্তিশালী না থাকতে পারি এজন্য বাঙালি সৈন্যদের নিয়ে গঠিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। যাতে আক্রমণ করলে বাঙালি সেনারা ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে না পারে। ১৯ মার্চ ঢাকা ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব জয়দেবপুরে আসে। সম্ভবত তার উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করা। দিনটি ছিল শুক্রবার। জয়দেবপুরের হাটের দিন। তিনি আমাদের প্রস্তুতি দেখে বিস্ময়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন—হোয়াই সেস প্রিপেরিশন? আমি তাকে উত্তর দিয়েছিলাম—উই মে বি মুভড এনি টাইম। আমি তাকে  বোঝাতে চেয়েছিলাম—তার মনে যদি অন্য কিছু থাকে তাহলে যেন সাবধান হয়। তারা বাঙালি সৈন্যদের প্রস্তুতি দেখে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

 

আপনি বিদ্রোহ করলেন কখন?

আমার ট্রুুপস ঢাকা আক্রমণের জন্য আমার ওপর চাপ দিচ্ছিল। আমি তাদের বললাম—বঙ্গবন্ধু এখন একটি আলোচনায় আছে। এই মুহূর্তে আমরা কিছু করলে বঙ্গবন্ধু অসন্তুষ্ট না হলেও তিনি হয়তো বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে মানুষের কাছে উপস্থাপিত হবেন। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর আক্রমণ করে কিনা সেজন্য। ২৫ মার্চ রাত একটার দিকে আমি একটি মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করি। ব্রিগেড কমান্ডার যে সৈন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরণ করেছেন সেই কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। মেজেসটিতে ব্রিগেড কমান্ডার কত জনকে হত্যা করা হয়েছে জানতে চাচ্ছিলেন। প্রতি উত্তরে ওই ব্যাটালিয়ন কমান্ডার বলেন—অলরেডি তিনশ জনকে হত্যা করা হয়েছে। তারপর তো তাদের সঙ্গে থাকার কোনো কারণ থাকে না।

 

এরপর আপনার পরিকল্পনা কী ছিল?

১৮ মার্চের আগেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সৈন্যদের কাছে একটি কোর্ডওয়ার্ক পাঠাব। কোর্ডওয়ার্ক পেয়ে তারা যেন ময়মনসিংহ রেস্ট হাউসে চলে আসে। এই মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করার পর আমরা সবাইকে জানিয়ে দেই। ওই রাতেই ময়মনসিংহ ইপিআর হেডকোয়ার্টারে আমার ও পাকিস্তানি সৈন্যদের গোলাগুলি হয়। কয়েকজন মারা যায়। বেশ কয়েকজন পাক অফিসারকে আটক করে ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠানো হয়। ২৯ মার্চ আমি ময়মনসিংহ রেস্ট হাউসে পৌঁছি। সেখানে ২ বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ, আনসার, ইপিআর সদস্যরা একত্রিত হয়েছিল। ওই দিন একটি শপথ নিয়েছিলাম। শপথটি ছিল—‘আমরা সবাই বাংলাদেশি সৈনিক। পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছে তা প্রতিহত করতে আমরা যুদ্ধ করে যাব। এবং সে যুদ্ধ চলবে যতদিন না আমরা তাদের বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করতে পারি।’ ওই দিনই আমি উপলব্ধি করি যে আমরা এই সৈন্যদের নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বেশিদিন বাংলাদেশের মাটিতে অবস্থান করতে পারব না। একপর্যায়ে আমাকে হয়তো বর্ডার ক্রস করতে হবে। তখন ভারত বাধা দিলে আমরা কী করব? সুতরাং একজন জুনিয়র অফিসারকে আমি হালুয়াঘাট পাঠালাম। সে বিএসএফ অফিসার বালজিৎ সিংয়ের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি আমাদের স্বাগত জানানোর প্রতিশ্রুতি দেন। যা আমাদের মনে শক্তি যুগিয়েছিল।

ঢাকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন কখন?

২৯ মার্চ ঢাকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেই। কোন দিক থেকে আক্রমণ করব তা নিয়ে নিজেই একটা অ্যাপ্রিশিয়েশন করি। ঢাকায় যারা ছিল তারা ধারণা করেছিল আমরা সাভার অথবা টঙ্গীর দিক থেকে আক্রমণ করব। আমি সেটা না করে পূর্ব দিক থেকে ঢাকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিই। ঢাকা যাওয়ার ট্রেন জোগাড় করি। ট্রেনেই ভৈরব, নরসিংদী অগ্রসর হতে থাকি। আমার সৈন্যরা ৩০ তারিখ পর্যন্ত নরসিংদীর পাঁচদোনায় পৌঁছে যায়। তখন খালেদ মোশাররফ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে একজন অফিসারকে আমার কাছে পাঠায়। সে আমাকে বলে আমি যেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দিকে না যাই। অল্প সৈন্য নিয়ে ঢাকা আক্রমণ করলে ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানের বিশাল সেনাবাহিনীর সামনে টিকতে পারব না। প্রয়োজনে একসঙ্গে আক্রমণ করব। আমি ১ এপ্রিল ভৈরব থেকে তেলিয়াপাড়া চলে যাই। সেখানে আমার হেডকোয়ার্টার তৈরি করি। তখন বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার ছাত্র জনতা আমার সঙ্গে যুক্ত হয়। আমি তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি।     

 

আপনার নেতৃত্বে সিলেটসহ বিরাট একটি অংশ মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠেছিল।

আমি প্রথমে সিলেটসহ বিরাট একটি অংশ মুক্তাঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলি। একদিকে সিলেট আর একদিকে আশুগঞ্জ, ভৈরব, লালপুর, আজবপুর, সরাইল, শাহবাজপুর, মাধবপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর শত্রুমুক্ত করি। যুদ্ধের সময় একাধিকবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। অনেক সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মুক্তিযোদ্ধা দৌলা মিয়া তেলিয়াপাড়া থেকে মুকসুদপুর পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করতে ২১ দিন যুদ্ধ করেছিল। যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধাহত দৌলা মিয়া তার রক্তমাখা শার্ট আমাকে দিয়ে বলেন, ‘স্যার, আমি মরে গেলে এটি বঙ্গবন্ধুকে দেবেন।’ আমি তাকে আগরতলা হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করি এবং তিনি সুস্থ হয়ে যান। ২৯ নভেম্ব্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত শত্রুসেনাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হয়। ৬ ডিসেম্বরের কিছুদিন পূর্বে আমরা শত্রুসেনাদের কাছ থেকে আখাউড়া দখল করি।

 

যুদ্ধের বিশেষ কোনো স্মৃতির কথা বলবেন; যা আপনার মনকে এখনো আলোড়িত করে।

৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পরের দিনই আমাদের জয়েন্ট কমান্ড ফোর্স তৈরি হয়। আমার ব্রিগেড ভারতের ৪৭ মাউন্টেন ডিভিশনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ৬ ডিসেম্বর সিদ্ধান্ত হয় আমরা ঢাকা দখল করব। এই উদ্দেশ্যে আখাউড়া থেকে তিনটি ব্রিগেড আশুগঞ্জের দিকে রওনা দেয়। দুটি ভারতের একটি আমার। ভারতীয় দুটি উজানেশ্বরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে আশুগঞ্জ, অন্যটি আখাউড়া হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মাধবপুর সরাইল হয়ে আশুগঞ্জ। ৫ ডিসেম্বর ভারতীয় সৈন্য আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ৬ ডিসেম্ব্বর আমরা তেলিয়াপাড়া থেকে আশুগঞ্জ যাচ্ছি। মাধবপুর আর চান্দুরার মাঝে একটি ব্রিজের ওপরে ব্লক পজিশনে ছিল আমাদের কিছু সৈন্য। তাদের কাজ ছিল ‘পথে কোনো বিপদ নেই’ এ ধরনের সংকেত আমাকে দেবে এবং সংকেত পেয়েই আমরা রওনা হব। পথে ইসলামপুরে একটি গাড়ি আমাদের দিকে আসে। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এটিকে ব্যাটালিয়ন এমোনিশন গাড়ি মনে করে। কিন্তু পাশে আসতেই বুঝতে পারি এটি এমোনিশন গাড়ি না। শত্রুসেনাদের গাড়ি। গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বসা একজন জেসিও লাফিয়ে নেমে আমাকে জাপটে ধরে। আমার রানারের কাছে স্টেনগান ছিল। আর জেসিওর কাছে ছিল একটি রাইফেল। আমাদের দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি চলছিল বলে রানার গুলি করতেও পারছিল না। গুলি করলে আমার গায়েও লাগতে পারে। একপর্যায়ে আমি হাঁটু দিয়ে ওই জেসিওর শরীরের বিশেষ স্থানে আঘাত করলে তার বাঁধন শিথিল হয়ে যায়। আমি ঘুষি দিলে সে পড়ে যায়। জেসিও উঠে দাঁড়িয়ে আমার রানারকে শিল্ড হিসেবে (পেছন থেকে জাপটে ধরে) তার স্টেনগানের ট্রিগার চাপে। কিন্তু গুলি আমার কোমরে থাকা পিস্তলে লাগে। আমি রানারের কাছ থেকে রাইফেল নিয়ে জেসিওর মাথায় পর পর কয়েকবার আঘাত করি। একপর্যায়ে জেসিও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। মাটিতে পড়ে থাকা রানারের রাইফেল উঠিয়ে দেখি রাইফেল ভাঙা। আমি ঘুরে দাঁড়াতেই পাশে একটি বাস থামে। ঝাঁকে ঝাঁকে শত্রুসেনা নামছে। রাইফেলটি হাতে নিয়ে তাদের লক্ষ্য করে গুলি করতে গিয়ে দেখি রাইফেল ভাঙা! তখন কোমরে থাকা পিস্তল ধরতেই দেখি সেটি গুলি লেগে ভেঙে গেছে। ওই মুহূর্তে পাশের খালে লাফিয়ে পড়ি। আমার গলায় একটা ছোট কোরআন শরিফ ছিল। আমি দোয়া করছিলাম—‘আল্লাহ অস্ত্র ছাড়া আমার মৃত্যু কবুল কর না।’ কাদাপানিতে ডুবে থাকার কারণে আমার পোশাকের রং ওদের পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল আর সে কারণে ওরা আমাকে সন্দেহ করেনি। সেদিন রাতে ওই এলাকাতেই ছিলাম। পরদিন হেডকোয়ার্টারে বন্দী অবস্থায় আহত এক পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে নিয়ে আসে আমার সৈন্যরা এবং তিনি চিনতে পারেন আমাকে।

 

তিনি আপনাকে চিনতে পেরেছিলেন!

হ্যাঁ। এই সেনা অফিসারটির সঙ্গে আগের দিন আমার সংঘর্ষ হয়েছিল। সে আমাকে গুলি করেছিল আর আমি তাকে রাইফেল দিয়ে বাড়ি মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, আমার আঘাতে সে মারা গেছে। সে আমার কাছে জানতে চায়, আগের দিন আমাকে গুলি করার শোধ আজ আমি নেব কি না? উত্তরে আমি বলি নিরস্ত্র লোকের ওপর হামলা করা কোনো মুসলমানের ধর্ম নয়, যা ২৫ মার্চে পাকিস্তানিরা নিরস্ত্র বাঙালিদের সঙ্গে করেছে। আমি তাকে চিকিৎসা করার জন্য হাসপাতালে পাঠাতে চাইলে সে হতবাক হয়ে যায়। বিস্মিত হয়ে জানতে চায়, আমি মুসলমান কি না? তারপর তিনি বলেন—আমাকে তো বলা হয়েছিল এখানে কোনো মুসলমান নেই, তুমি আমার মাথার আঘাত নিয়ে দুশ্চিন্তা কর না, আমাকে তোমাদের সঙ্গে রাখ, আমি তোমাদের হয়ে যুদ্ধ করব। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় এভাবেই একজন পাকিস্তানি সৈন্য তার অনুভূতি জানিয়েছিলেন। পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে বাঙালিদের যৌক্তিক লড়াইয়ের সঙ্গে এভাবেই একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এমনি আরও অভিজ্ঞতা রয়েছে।

 

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের ঘটনা কি ১৫ আগস্টের প্রতিক্রিয়া ছিল বলে মনে করেন?

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমদ ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতা দখলের জন্য কতিপয় জুনিয়র সেনা কর্মকর্তাকে ব্যবহার করেন। এ ঘটনায় সার্বিকভাবে সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকা ছিল না। ১৫ আগস্টের ঘটনার পর সেনাবাহিনীর মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছিল। সেনাবাহিনীর বেইস অব কমান্ড ভেঙে পড়েছিল। সবার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছিল। সেই উদ্বেগ থেকেই সম্ভবত তৎকালীন চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়েত জামিলসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। সে সময় আমি আর সেনাপ্রধানের পদে ছিলাম না। ২৪ আগস্ট আমাকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করে সেনাপ্রধানের বাসভবনেই অন্তরীণ রাখা হয়।

 

তার পদক্ষেপ সফল না হওয়ার কারণ কী?

অনেকেই বলেন, সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফের সমর্থন ছিল না। এই প্রচারণা সত্য নয়। আমার ধারণা, অভ্যুত্থানের পর নিজের হাতে তার ক্ষমতা নেওয়া উচিত ছিল। তিনি সেটি নেননি। তা ছাড়া সিদ্ধান্ত নিতেও দেরি করেছিলেন। ফলে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি পাল্টা আঘাত হানার সুযোগ পায়। খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেছিলেন। কিন্তু তাকে সেনানিবাসের ভিতরে রাখা ঠিক হয়নি। সেনানিবাসের বাইরে থাকলে ৭ নভেম্বরের প্রতিবিপ্লবীরা জিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ পেতেন না। জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে শাফায়েত জামিল, কর্নেল হায়দার, কর্নেল হুদা, কর্নেল নুরুজ্জামান প্রমুখের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল এবং তিনি তাদের কাজেও লাগিয়েছিলেন। খালেদকে আরও দ্রুতগতিতে সবকিছু করা উচিত ছিল।

 

৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের ভূমিকা কী ছিল?

৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের অনুসারীরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে, এটা ঠিক। তারা চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমানকে দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সফল করবেন। তাহেরের অনুসারীরা প্রচলিত সেনাবাহিনী ভেঙে দিয়ে বিপ্লবী ধারায় একটি বাহিনী গঠন করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধীরাও জিয়াকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। জিয়া শেষ পর্যন্ত তাদের ফাঁদেই পা দিলেন। জিয়াউর রহমানের পরবর্তী মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম দেখলেই এটা স্পষ্ট। নিজের ক্ষমতা সুদৃঢ় করতেই তিনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষ নিতেও দ্বিধা করেননি।

 

১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আনুষ্ঠানিকতায় আপনি উপস্থিত ছিলেন।

৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় আসে। দেশ স্বাধীন হয়। রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ওই অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম। তারপর প্রায় ৯৯ হাজার সৈন্য নিয়ে সেনাবাহিনীতে ফিরে যাই।

 

বঙ্গবন্ধু আপনাকে সেনাপ্রধাদের দায়িত্ব দেন। আপনি নাকি দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। ওই দিন আমি তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার ব্রিগেডের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেওয়া দেওয়া হয়। ওই গার্ড অব অনার গার্ড পরিদর্শনের সময় আমি তার পাশে ছিলাম। সেদিন জনতার ঢল নেমেছিল। সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীসহ দেশের সব নিয়মিত বাহিনী পুনর্গঠনে মনোযোগ দেন। ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিতে বলেন। আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিতে হয়। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করি।

 

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় আপনার কর্মতৎপরতা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন।

আমি সেনাপ্রধান থাকা অবস্থায় ১৫ আগস্ট কিছু বিপথগামী এবং উচ্ছৃঙ্খল সেনা অফিসারের হাতে সপরিবারে শহীদ হন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা আমাকে সারাজীবন পীড়া দিয়েছে এবং যতদিন বেঁচে থাকব ততদিনই এই ঘটনা আমাকে কষ্ট দেবে। যে অবিসংবাদিত নেতার জন্ম না হলে এ জাতি মুক্ত হতো না, যার ডাকে জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম তাকেই মেরে ফেলা হলো নির্মমভাবে। আত্মস্বীকৃত খুনিরা দম্ভ করে বলে, আমরাই হত্যা করেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মানুষকে সোচ্চার করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও রায় কার্যকর হয়েছে। কিছু প্রক্রিয়াধীন।

 

আপনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন; কেমন ছিল সে অভিজ্ঞতা?

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরই খন্দকার মোশতাক আমাকে ডেকে বললেন, দেশের জন্য তো আপনি অনেক কিছু করেছেন। এবার দেশের বাইরে আপনার সেবা চাই। আপনার ও আপনার পরিবারের নিরাপত্তার জন্যই আপনার বাইরে যাওয়া উচিত বলে মনে করি। আমি তার কথায় রাজি হইনি। এরপর জেনারেল ওসমানীও বললেন, ‘তুমি সরকারের প্রস্তাব নাকচ কর না। তাতে তোমার ক্ষতি হবে।’ ওসমানী ছিলেন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর প্রধান। তিনি একাধিকবার আমাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে আমি রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিই। ১৬ বছর মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইডেন, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ১৯৯২ সালে স্বেচ্ছায় অবসর নিই।

 

১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দিই। অতঃপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হই।

 

সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের বর্তমান কার্যক্রম কী?

আমরা পুরো বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছি। নতুন প্রজন্মকে জানিয়েছি কার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের প্রধান বক্তব্য ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বর্তমান সরকার আমাদের সঙ্গে একমত হয়ে বিচার কার্য সম্পন্ন করেছে। কিছু প্রক্রিয়াধীন।

 

আপনার পরিবার, সন্তানদের কথা জানতে চাই।

১৯৬০ সালে সাঈদা আক্তারের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন সাঈদা। আমাদের চার সন্তান। ফারহানা রীমা, ফারজানা শোমা, তাহসিনা লোপা, ছেলে কাজী ওয়াকার আহমেদ (পিংকু)। সংসারে আমার স্ত্রীর একনিষ্ঠ সহযোগিতা রয়েছে। আমার বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের পাশেও থাকেন তিনি।

 

আপনার অবসর কাটে কীভাবে?

টেলিভিশন দেখি। পড়াশোনা করি। আমার আত্মজীবনী লিখছি। প্রায় শেষের দিকে।

সর্বশেষ খবর