শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা
ওস্তাদ আমজাদ আলী খান

সংগীত আমার এক জনমের সাধনা

সংগীত আমার এক জনমের সাধনা

ওস্তাদ আমজাদ আলী খান (জন্ম : ৯ অক্টোবর ১৯৪৫) উপমহাদেশের খ্যাতিমান সরোদবাদক। গোয়ালিয়র ঘরানার জগত্খ্যাত ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁর সুযোগ্য সন্তান আমজাদ আলী ইতিমধ্যে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায়

বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। সংগীতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত সরকারের পদ্মবিভূষণ (২০১১), সংগীত ও নাটক একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৯) ও ফেলোশিপ (২০০১), ফুকোয়া এশিয়ান কালচারাল অ্যাওয়ার্ড (২০০৪), পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বঙ্গবিভূষণ (২০১১) অর্জন করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন— শেখ মেহেদী হাসান

 

 

আপনার জন্ম তো গোয়ালিয়রে, যেখানে সুরস্রষ্টা মিয়া তানসেনের জন্ম। শৈশবের কথা মনে পড়ে?

বিলকুল মনে পড়ে। শৈশব কি ভোলা যায়? বসে বসে ভাবি শৈশবের গোয়ালিয়রের কথা। আমি সৌভাগ্যবান যে আমার জন্ম গোয়ালিয়রে। গোয়ালিয়র সংগীতের পুণ্যভূমি। তা না হলে, সেখানে মিয়া তানসেনের জন্ম হবে কেন? তার কল্যাণেই চার পুরুষ আগে আফগানিস্তান থেকে আসা আমাদের পরিবার এখনো সংগীতসাধনা করে যাচ্ছে। আমার পূর্বপুরুষরা ছিলেন গোয়ালিয়রের মহারাজার কোর্ট-মিউজিসিয়ান। মহারাজা সিন্ধিয়ার সভা সংগীতকার। মাধবরাও সিন্ধিয়া এখন রেলমন্ত্রী। আমি ভাবি আর আমার মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতি আসে, গোয়ালিয়রে তানসেন জন্মেছিলেন। তানসেনের পুণ্যভূমিতে আমার জন্ম। তানসেনের সমাধির কথা ভাবি। কি অবহেলায় পড়ে আছে! আমরা তানসেনের কথা বলি। সিনেমা হয়। সেই ছবি লোকে ভিড় করে দেখতে ছোটে, অথচ সেই শ্রেষ্ঠ কলাকারের সমাধির কি শোচনীয়  হাল। সরকারকে কত বার বলেছি, আজও একটা উপযুক্ত স্মৃতিসৌধ তৈরি হলো না। গোয়ালিয়র থেকে দিল্লি। এখন যেখানে কামানী হল, রবীন্দ্রভবন, ওখানেই ছিল ফিরোজ শাহ হাটমেন্ট। ওইখানেই আমার ছাত্র জীবনের শুরু। বড়াখাম্বা রোডে মডার্ন স্কুল। সাইকেলে চেপে স্কুলে যেতাম। সে ১৯৫৭ সালের কথা। ল্যান্ড অব তানসেন থেকে দিল্লির ফিরোজ শা। হাটমেন্টসে। কেন যে ওরা তানসেনের সুন্দর একটা স্মৃতি সমাধি করছে না। সম্রাট শাজাহানকে আমরা সাড়ম্বরে আজও স্মরণ করি, তানসেন বিস্মৃত। কেন যে আমরা এই রকম!

 

কত বছর বয়সে সরোদ শিখতে শুরু করেছেন?

পাঁচ কি ছয় বছর বয়েস থেকে সরোদে তালিম নিতে শুরু করি। দশ কি এগারো বছর বয়সে আমি প্রথম মঞ্চে বাজাই। সেই শুরু, আজও চলছে।

 

বয়সে ছোট হলেও ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খান, পণ্ডিত রবিশঙ্করদের প্রতাপের যুগে আপনাকে বাজাতে হয়েছে। কেমন বোধ করতেন?

ওস্তাদ বিলায়েত খাঁ, ওস্তাদ আলী আকবর খান, পণ্ডিত রবিশঙ্কর—তিনজন ছিলেন সমসাময়িক। তাদের তুলনায় আমি তরুণ ছিলাম। তারা যখন দাপটের সঙ্গে বাজিয়েছেন, তখন আমিও বাজিয়েছি। সেটা খুব চ্যালেঞ্জিং টাইম ছিল। তবে তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই আন্তরিক ছিল। আমি তাদের ‘দাদা’ বলে ডাকতাম। আজকাল তো সেই রাগদারি তবিয়তদারি দুটোই আমরা হারিয়েছি। একবার আমার পিতা ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁ কলকাতায় বাজালেন রাগ তিলক কামোদ। তার বাজনার পর মঞ্চে এলেন ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ। তিনি বললেন, ‘আজ হাফিজের দিন! সে তিলক কামোদ এতটাই ভালো বাজিয়েছে যে, সেটা আমার মাথায় ঢুকে গেছে। সুতরাং আমি আজ আর অন্য সুরে ঢুকব না। আমি গাইব না। কাল গাইব।’ কী বিস্ময়কর শ্রদ্ধাবোধ! এই সম্মানবোধ আমাকে আলোড়িত করেছিল।

 

ওস্তাদজি, আপনার কী মনে হয় শ্রদ্ধাবোধ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে?

অনেকটা তাই। আগে গুরু নিজগৃহে বসে শিষ্যকে সন্তান স্নেহে শেখাতেন। নিজের ভাণ্ডার উজাড় করে দিতেন। এখন গুরুকে শিষ্যের বাড়ি বাড়ি দৌড়াতে হয়। এটা তাকে করতে হয় জীবিকার তাগিদে। শিষ্য চাইছে, প্রতিদিন বেশি বেশি শিখে কত দ্রুত গুরুকে তাড়ানো যায়। আর বাড়তি আয়ের জন্য গুরু চাইছেন, অল্প অল্প শিখিয়ে শিষ্যকে বেশিদিন ধরে রাখতে। পারস্পরিক এই অবিশ্বাসই সংগীতের ক্ষতি করছে।

 

আপনি ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিবারের সদস্য। আপনার পরিবার পরম্পরার কথা জানাবেন?

আমি আমার পিতামহ, পিতার আশীর্বাদ পেয়েছি। আর আমার সন্তান যেকালে জন্মেছে, বড় সাংঘাতিক কাল। মূল্যবোধ পাল্টেছে, হু হু করে ঘটছে সামাজিক পরিবর্তন। আমার কাল আর আমার সন্তানদের সময় আকাশ-পাতাল তফাৎ। আমার শৈশব-কৈশরের জীবন খুব সহজ, সরল ছিল। যা পেয়েছি তাই পরেছি, যা জুটেছে তাই খেয়েছি। আমাদের সামনে আমাদের বাবা একটা আদর্শ, একটা মূল্যবোধ রাখতে পেরেছিলেন। আমরা যে শাসনে মানুষ হয়েছি আমার সন্তান সে শাসনের সঙ্গে পরিচিত নয়। আমার পিতাজির কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স ছিল না। যা পেতেন, সব খরচ করে ফেলতেন। সঞ্চয় কাকে বলে, এ কালের মানুষের মতো জানতেন না। ভবিষ্যতের কথা কোনো দিন ভাবতেন না। উপার্জনের সবটাই চলে যেত দানধ্যানে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দিতেন। দরিদ্রদের দিতেন। শিষ্যদের দিতেন। তখনকার প্রায় সব ওস্তাদেরই এই ধরনের মন ছিল। আর একটা জিনিস ছিল, বিরল গুণ, তারা যা পেতেন, যতটুকু পেতেন, তাতেই মহা সন্তুষ্ট—মনে করতেন জীবনের সব পাওনা হয়ে গেছে।

 

আপনার বাবা ওস্তাদ হাফিজ আলী খানকে বাবা হিসেবে, নাকি গুরু হিসেবে বেশি পেয়েছেন?

পিতাজির সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য এত বেশি ছিল যে, তিনি অনায়াসে আমার ঠাকুর-দাদা হতে পারতেন। সম্ভবত এ কারণে তিনি না ডাকলে, আমি কাছে ভিড়তাম না। তবু তাকে জেনেছি। তার কাছে শিখেছি। বাবার দর্শন ছিল একজন মানুষ এক জীবনে একটিই কাজ করবে। বহু ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে নেই। বাবার কাছে সংগীতই ছিল ধ্যানজ্ঞান। ওস্তাদ হাফিজ আলী খানের কোনো বিলাসিতা ছিল না। ১৯৬০ সালে তিনি পদ্মভূষণ পদক নিতে গেলেন, সঙ্গে আমি। ওই অনুষ্ঠানে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু উপস্থিত ছিলেন। তার রসবোধ ছিল প্রখর। তিনি বাবাকে বললেন, ‘সবাইকে তো শেখাচ্ছেন। নিজের ছেলের জন্য নিশ্চয় আসল গুরুমন্ত্র লুকিয়ে রেখেছেন।’ জবাবে বাবা হাসলেন।

 

প্রেসিডেন্ট রাজেন্দ্রপ্রসাদ আপনার বাবাকে একবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ঘটনাটি আপনার মনে পড়ে?

প্রেসিডেন্ট ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ বাবাকে মোগল গার্ডেনে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমিও সঙ্গে গিয়েছিলাম। শুনছি দুজনের কথা। এরপর রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ এসে বাবার কাছে জানতে চাইলেন, ‘দিনকাল কেমন চলছে? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’ তিনি রাষ্ট্রপতিকে বললেন, ‘দয়া করে দরবারি রাগকে রক্ষা করুন। দরবারি, সুরস্রষ্টা মিয়া তানসেনের সৃষ্টি। এখন এই রাগটিকে যে যার মতো করে গাইছে। এভাবে চললে, দরবারির আসল রূপ ভারত থেকে হারিয়ে যাবে।’ প্রেসিডেন্ট বুঝতে পারছেন না, ওস্তাদজি কার কথা বলছেন। রাগ দরবারি কোন চিজ। প্রেসিডেন্ট বাবাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন—‘নেহি নেহি খাঁ সাহেব, আপ ঘাবড়াইয়ে নেহি। হাম জরুর কুছ করেঙ্গে।’ অ্যাজ ইফ হি উইল পাস এ রেজলিউশান ইন দ্য পারলামেন্ট, যে দরবারি এই সি রহ চাহিয়ে, এই সি বাজানা চাহিয়ে। তখন রাজেন্দ্রপ্রসাদ বললেন, ‘অওর কুছ বলিয়ে।’ পিতাজি বললেন, ‘অওর নেহি সব ঠিক হ্যায়, খুদাকা আশীর্বাদ হ্যায় আদাব।’ বাড়ি ফিরে আসার সময় মনে হয়েছিল, পিতাজি প্রেসিডেন্টের কাছে কত কি চাইতে পারতেন, টাকা, জমিজায়গা, গাড়ি বাড়ি। তার তো কিছুই ছিল না, কিচ্ছু না। সংগীতেই তিনি মগ্ন  ছিলেন। রাগ-রাগিনীই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। যেমন ভালো গাইতে পারতেন, তেমনি ভালো বাজাতে পারতেন। সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন তিনি। এমন হয়েছে, পিতাজির কাছে কেউ হয়তো এসেছেন অন্য কাজে। পিতাজি তাকে গান শোনাচ্ছেন। ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরি। দুই ঘণ্টা হয়ে গেছে। বেচারা চুপ করে বসে আছেন। কিছুই বলতে পারছেন না। গানের পর গান চলেছে। তখন আমি সাহস করে পিতাজির কানের কাছে বললাম, ‘সাব, ইনকে ভি বাত তো শুন লিজিয়ে, কিস লিয়ে আয়ে।’ তখন পিতাজির খেয়াল হলো। গান বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাঁ হাঁ বলিয়ে ভাই, সাব কিস লিয়ে আয়ে?’ তখন সেই ভদ্রলোক হয় তো বললেন, আমার ছেলে, কি মেয়ের বিয়ে। ‘কার্ড দেনে আয়ি।’ এটাই ছিল শিল্পীর চরিত্র। সব সময় সংগীতের ভিতরে ডুবে থাকতেন। বাইরে আসতে কষ্ট হতো। এখনকার কালে মানুষ কাজের কথা ছাড়া, একটাও অন্য কথা বলতে চান না। বরং বলবেন, কাজের কথা বল। বলে চলে যাও। সময় নষ্ট কর না।

 

আপনার বাবার কোন গুণটি আপনাকে সবচেয়ে প্রভাবিত করেছে?

আমার পিতাজির কথা আজকাল কেবলই মনে পড়ে। কি অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি। আমি তার উত্তরপুরুষ। সংগীতের যে সম্পদ তিনি আমার কাছে রেখে গেছেন, যে আশীর্বাদ, তার কাছে টাকা পয়সা, জুড়িসুড়ি, ধন-দৌলত কিছুই লাগে না। এই উত্তরাধিকারই আমার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে পথ চলেছি। ওস্তাদ হাফিজ আলী খাঁর আশীর্বাদেই সেই কোন শৈশবেই আমি উপার্জনে নেমেছি। আমার পিতাজির মতোই অর্থে আমার কোনো আসক্তি নেই। আমি প্রকৃত অর্থে শিল্পী হতে চাই। ভালো, ভালো, আরও ভালো হতে চাই। আমার পিতাজি বলতেন, ‘সংগীতে কোনো শেষ কথা নেই। কেউ দাবি করতে পারেন না, আমি গ্রেটেস্ট, সবচেয়ে বড়। ইট ইজ দ্য টাইম, সময় বড় বলবান। সময় সবকিছুর বিচার করে।’ আজ যার সভায় পঞ্চাশ হাজার শ্রোতা, বিশ বছর পরে দেখা গেল, তার আর সে আকর্ষণ নেই। তার পাশে কেউ নেই। সেই পঞ্চাশ হাজার শ্রোতার আসরে অন্য কোনো শিল্পী তালি পাচ্ছেন। আজ আমি, কাল আর কেউ, পরের দিন আর কেউ। আসর খালি যায় না, যেতে পারে না। সময়ই বসায়, সময়ই তুলে ফেলে দেয়।

 

ভারতবর্ষের কোন শহরে বাজিয়ে আপনি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পান?

কলকাতা। কলকাতার সঙ্গে আমার পরিচয় সেই ছেলেবেলা থেকে। তা ছাড়া কলকাতার মানুষ কত সমঝদার। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের এমন কান আর কোনো প্রদেশে আছে! শিল্পীকে সম্মান নিতে জানেন। তারা শিল্পীর হাজার দফা, দুই হাজার দফা শোনার ধৈর্য রাখেন। মালকোষ যেভাবে, যত ভাবেই হোক, কলকাতার শ্রোতার শোনার কান তৈরি। সব চেয়ে বেশি আসর তো কলকাতাতেই করেছি, কলকাতার পর মহারাষ্ট্র। পুনে, শোলাপুর, কোলাপুর, কর্ণটিক, হুবলী, ধারোয়ার। দক্ষিণ ভারতে বাজিয়েও আমি আনন্দ পাই। পশ্চিমবাংলা, মহারাষ্ট্র আর দক্ষিণ ভারতে সংগীতের কত বড় পরম্পরা তৈরি হয়ে আছে। আরও অনেক ঝকঝকে শহর তো আছে; কিন্তু ক্লাসিক্যাল মিউজিকের  ট্রাডিশন নেই। গোয়ালিয়ার এক সময় ছিল উচ্চাঙ্গ সংগীতের পীঠস্থান। বড় বড় কলাকার সেখানে জন্মেছেন। সম্রাট আকবরের আমলে মিঞা তানসেন থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত। গোয়ালিয়ারের সঙ্গে তুলনা করা যায় অস্ট্রিয়ার। অস্ট্রিয়া আর জার্মানির আশপাশ অঞ্চলে কত ক্লাসিক্যাল কম্পোজার জন্মেছেন। বাত, বেঠোফেন, ওয়াগনার, মোত্জার্ট। একে বলে মাটির গুণ। সেই গুণ গোয়ালিয়ারে ছিল। গোয়ালিয়ারের মাটি মার্গ সংগীতের প্রতিভা বিকাশের অনুকূল ছিল। কিন্তু রাজনীতি, আমাদের সরকারি প্লানিং এক অদ্ভুত ব্যাপার। গোয়ালিয়ারকে সংস্কৃতির দিক থেকে একেবারে পিষে ফেলা হলো। কোটি কোটি টাকা ঢেলে তৈরি হলো ভুপাল। যার কোনো কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। অন্যদিকে গোয়ালিয়ার কানা হয়ে গেল। সংস্কৃতির ওপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হলো বুলডোজার। তানসেন থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের বিখ্যাত কবি, লেখক, কলাকার, চিত্রকর, গাইয়ে, বাজিয়ে, নৃত্যশিল্পীদের স্মৃতি রক্ষার জন্য ভারত সরকারের আরও  উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

 

ওস্তাদজি, প্রাচীন গুরু-শিষ্য প্রথাকে আপনি কতখানি গুরুত্ব দেন?

বিলকুল ঠিক। আমি নিজে গুরু-শিষ্য প্রথায় বিশ্বাসী। যে সংগীতের জন্যে জীবন উৎসর্গ করতে চায় আমি তাকেই শিষ্য করি। তাকেই আমি শিখাই। আমার সব অর্জিত জ্ঞান-বিদ্যা তাকে সাধ্যমতো দেওয়ার চেষ্টা করি। আমার নিজের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। আমার পিতা, পিতামহের ধারাই আমি অনুসরণ করে চলেছি। আমার বাবা বলতেন, জ্ঞান নিজের কাছে ধরে রাখতে নেই, ভাগ করে নিতে হয়। আমার পিতা, আমার গুরু যেমন আমার হাতে তাদের বিদ্যা দিয়ে গেছেন, আমিও সেই রকম তুলে দিয়ে যাব আমার উত্তরপুরুষের হাতে। আমি আমার জ্ঞান বিক্রি করব না। আমার পিতার ওই আদর্শই আমি অনুসরণ করে চলেছি। একজন, দুজন প্রকৃতই যারা নিষ্ঠাবান, সংগীতে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে চায়, আমি তাদেরকেই নির্বাচন করে তালিম দিয়ে থাকি। আমি কখনো তাদের কাছে কোনো পরিশ্রমিক চাই না। এ আমার রীতিবিরুদ্ধ।

 

আপনি কাদের শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন।

যাদের ট্যালেন্ট ও ডেডিকেশান আছে। আমি ডিভোটেড ছাত্রদের বিনা পারিশ্রমিকে শেখাই। শিষ্যদের কাছ থেকে আমি অর্থ গ্রহণ করি না। আমি নিজে সাধনায় বিশ্বাসী। নিজেকে উৎসর্গ করতে পারলে সব হয়। আমি নিজে, ব্যক্তিগতভাবে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি। তার কৃপায় সবই হয়। ‘তব কৃপা হি... কেয়া হ্যায় ও’ শ্লোক। খোদার কৃপায় সব সম্ভব। আমি নিজে আমার পাশে ঈশ্বরের উপস্থিতি টের পাই।

 

আপনার কী মনে হয় এখনকার শিক্ষার্থীদের ধৈর্য কমে গেছে। তারা তো রাতারাতি শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়।

তারা দ্রুত ফলাফল চায়। কুইক রিটার্ন চায়। এখন গান বাজনার চেয়ে নাচের দিকেই বেশি ঝুঁকছে। ভরতনাট্যম, কত্থক। সে আবার কি রকম, গুরুজির ওপর চাপ, কত তাড়াতাড়ি গুরুজি শিষ্য-শিষ্যকে স্টেজে নিয়ে যেতে পারেন। কি আশ্চর্য ব্যাপার! তা ছাড়া বড় বড় কলাকার সম্পর্কে অনেকেই জানে না। এজন্য সরকারি উদ্যোগে কলাকারদের বাসস্থান সংরক্ষণ, তাদের জীবনী রচনা প্রয়োজন। ১০০ বছর পরে ইতিহাসটাই বিকৃত হয়ে যাবে। লোকে ভাববে, যার নামে বই আছে তিনিই কলাকার— বাকি যাদের কোনো প্রচার ছিল না তারা কেউ না। একজন শিল্পীকে দিনের পর দিন দেখুন, জীবন অনুসন্ধান করুন, তারপর তাকে নিয়ে লিখুন। দেশে এত মিউজিকোলস্টিক রয়েছেন, রিসার্চ স্কলার রয়েছেন, আর পরিকল্পনার অভাবে এত বড় একটা কাজ হবে না! সংগীতের ইতিহাস অবহেলায় হারিয়ে যাবে! শিল্পীদের জীবন, জীবন ভাবনা নিয়ে গবেষণা না করলে কেমন করে জানা যাবে মার্গসংগীতের বিবর্তন, সংগীত সাধনার বিবর্তন। অতীতে কি ছিল, এখন কি হয়েছে? যার প্রচার আছে তিনিই ইতিহাস হবেন আর যার নেই তিনি ভেসে যাবেন, এ কেমন কথা! আমার জীবনদর্শন হলো—লিভ অ্যান্ড লেট লিভ।

 

উচ্চাঙ্গ সংগীত রাজা মহারাজার জলসাগর থেকে জনতার দরবারে স্থান পেয়েছে; বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?

ভালো অবশ্যই হয়েছে, তবে সমস্যাও আছে। সব কালো মেঘেই যেমন সিলভার লাইনিং থাকে, সে রকম সব রুপোলি মেঘেই থাকে ব্ল্যাক লাইনিং। আগেই বলেছি, কোনো কলাকারই নিজেকে গ্রেটেস্ট বলতে পারেন না, সেই রকম সব কলাকারই নিজ নিজ ক্ষেত্রে গ্রেট। রাজা মহারাজার সভায় সব গুণীরই কদর ছিল। জনতার সভায় কদর পাওয়ার শর্ত, জনতার মন ভরাতে হবে। সব রুচিকে সন্তুষ্ট করতে হবে। বিচারের মাপকাঠিটা বড় বিপজ্জনক, জনতা যাকে গ্রহণ করবে সেই শিল্পী, তারই বাজার, যাকে খারিজ করে দেবে তার আর নিজস্ব সাধনা করা ছাড়া অন্য কোনো পথ থাকবে না, পরিচিতির আত্মপ্রকাশের।

 

তার মানে বাণিজ্যিক হতে হবে।

বাণিজ্যিক না হলেও মনে রাখতে হবে, আমি শোনাতে এসেছি। যাদের শোনাতে এসেছি তারা যেন শোনেন। আসর পাণ্ডিত্য প্রকাশের জায়গা নয়। গ্রেটেস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই, আর্টিস্ট হলেই হবে। শিল্পীকে দেখতে হবে শ্রোতা যেন আবার তার অনুষ্ঠানে আসেন। ইয়ে না হো কি ও উনকি জিন্দেগিকো আখরি পারফরমেনস হো। এমন না হয় যে শিল্পীর আসরে ধরে-বেঁদে শ্রোতা আনতে হচ্ছে।

 

আপনি ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় সরোদ বাজিয়েছেন, সেখানকার অভিজ্ঞতা কেমন?

বিশ্বব্যাপী এখনো সরোদের চেয়ে সেতার বেশি জনপ্রিয়। আমি যখন বাইরে বাজাতে যাই, তখন অনেকেই প্রশ্ন করেন, ইজ ইট সিটার (এটা কি সেতার)? আমি বলি, ‘সরোদ’। আসলে পণ্ডিত রবিশঙ্করজির কল্যাণে সেতার এখন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। তবে আমেরিকায় সরোদ জনপ্রিয় করেছেন ওস্তাদ আলী আকবর খান। ভারতবর্ষের মহান শিল্পীদের নাম আমিও উজ্জ্বল করার চেষ্টা করেছি। আমি আমেরিকায় প্রথম পারফরমেন্স করি ১৯৬৩ সালে। এখনো বাজাচ্ছি। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব মেক্সিকোর অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছি।

 

বেঙ্গল সংগীত-উৎসব সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

আমি ভীষণ উপভোগ করেছি। এখানকার শ্রোতাদের সংগীতপ্রীতি আমাকে আনন্দ দিয়েছে।

 

এই বয়সে আপনি কতক্ষণ অনুশীলন করেন।

আমি সারাক্ষণ অনুশীলনের মধ্যে থাকি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রাকৃতিক কাজ শেষে কিছুটা মেডিটেশন করি তারপর দুপুর পর্যন্ত অনুশীলন করি। এ সময় কারও সঙ্গে কথা বলি না। তাতে সাধনায় ব্যাঘাত ঘটে। সংগীত তো এক জনমের সাধনা। আমি এখন অনুষ্ঠান কমিয়ে দিয়েছি। কারণ আমি নতুনদের সুযোগ করে দিতে চাই।  

 

আপনার দুই ছেলে আমান ও আয়ান এ সময়ের বেশ জনপ্রিয় সরোদ বাদক; তাদের সাফল্য কীভাবে দেখেন?

আমান ও আয়ন এখনো শিখছে। ওরা বাজাচ্ছে বিভিন্ন সংগীত উৎসবে, দেশে-বিদেশে। দুজনের হাত মোটামুটি ভালো। ওরা নিশ্চয় আমাদের পূর্ব-পুরুষের পরম্পরা টিকিয়ে রাখবে। 

 

আপনার খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জানতে চাই।

আমি নিজেকে খুব সিজনড করে নিয়েছি। যা পাই তাই খাই। এই নয় যে এটা হলে চলবে না, ওটা হতেই হবে। সব খাদ্য উপাদানের নিজস্ব স্বাদ আছে। বিরিয়ানি, কোর্মার এক স্বাদ, আবার লুচি, ভাজির আরেক স্বাদ। আমি নিজেকে একটা নিয়মে ফেলে দিয়েছি—আমার যা ইচ্ছে করে আমি তার উল্টোটা করি। আমাকে যা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে, আমি তার থেকে দূরে চলে যাই। আমি কোনো কিছুর দাস হতে চাই না। আমি বাঁচার জন্যে খাই, খাবার জন্যে বাঁচতে চাই না।

ওস্তাদজি আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকুন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর