শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

রোকেয়ার বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনা: সেকাল একাল

তুহিন ওয়াদুদ

রোকেয়ার বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনা: সেকাল একাল

নারী প্রশ্নে বৈশ্বিক চিন্তা যখন নারী উন্নয়নের ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হয়নি তখন রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন বঙ্গভূমিতে উৎপাদন করেছেন বিজ্ঞানচিন্তার স্থান-কালনিরপেক্ষ সূত্র। কালে কালে পৃথিবী নামক এ গ্রহের সব খণ্ডেই নারীদের পিছিয়ে রাখা হয়েছে। প্রাচীন এবং মধ্যযুগ যেহেতু ধর্ম নির্ভরতায় আচ্ছন্ন ছিল তাই ধর্মীয় বিধিনিষেধের নাম করেই নারীদের সেই শৃঙ্খল পরানো হয়েছিল। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন যখন নারীমুক্তির পথরেখা বিনির্মাণে প্রথাবিরোধী যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থাপন করছিলেন তখনো খোদ ব্রিটেনে নারীদের  ভোটাধিকার ছিল না। ১৯৩০ সালে সেখানে নারীদের ভোটাধিকার চালু হয়। নারীদের পশ্চাত্পদতার নেপথ্যে একক কোনো ধর্মীয় বিধিনিষেধের নাম করা হয়নি। প্রায় সব ধর্মের নামেই সেই চেষ্টা হয়েছে। সে সব চিন্তার অসারতা থেকে নারীদের সমতলে এক রৈখিকতায় আনতে হলে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার কোনো বিকল্প ছিল না। শুধু আবেগ আর ভাবালুতা দ্বারা প্রথাগত অসার চিন্তাজগৎ থেকে নারী-পুরুষ কাউকেই নতুন চিন্তার আঙিনায় আনা সম্ভব হতো না। নারীমুক্তির জন্য রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের লিপিবদ্ধ বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাই রোকেয়ার দর্শন। তার সে দর্শন টেকনোলজি (প্রযুক্তি) অর্থে যে বিজ্ঞানকে আমরা বুঝি সে মানদণ্ডে নয়, সায়েন্স অর্থে যে বিজ্ঞান তা-ই হচ্ছে রোকেয়া চিন্তাঘনিষ্ঠতার ক্যানভাস। সে অর্থেই রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন ছিলেন একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ।

রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনকে বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত আখ্যা দিয়ে তার চিন্তাকে অনেকটাই সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। একটি বিশেষ জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার কথা তিনি বলেছেন, নারী জাতিকে। সেই নারী জাতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তার যে চেষ্টা সেখানে সব ধর্মের, সব রাষ্ট্রের, সব মানুষেরই কল্যাণ নিহিত। নারী-পুরুষ একসঙ্গে চলতে না পারলে সমাজটাই পিছিয়ে যাবে— এ দর্শন যার লেখায় অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে দেখা দেয় তাকে গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখাটাই বরং অবৈজ্ঞানিক। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের ভাষায়— ‘আমি ইতঃপূর্বেও বলিয়াছি যে, ‘নর ও নারী উভয়ে মিলিয়া একই বস্তু হয়। তাই একটিকে ছাড়িয়া অপরটি সম্পূর্ণ উন্নতি লাভ করিতে পারিবে না।’ এখনো তাহাই বলি। এবং আবশ্যক হইলে ঐ কথা শতবার  বলিব’। (বোরকা, মতিচূর প্রথম খণ্ড)

সমাজ আক্ষরিক এবং প্রতীকী উভয় বিবেচনায়ই ছিল কার্যত নারীমুক্তিবিমুখ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিমুখতায় ছিল সমাজ অভ্যস্ত। নারীদের সেই অবরুদ্ধ পর্যায় এক অকল্পনীয় মাত্রায় পৌঁছেছিল। মুসলমান সমাজে নারীদের সামনেও নারীদের চলাফেরা ছিল সীমিত পর্যায়ের। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনও নিজেদের নিকটাত্মীয় নারীদের থেকে আড়ালে আড়ালে থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের মতো অগ্রগামী পরিবারেও নারীদের ছিল অসম্মানজনক অবস্থান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্ত্রী জ্ঞানদা দেবীর সঙ্গে তার বন্ধুর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মতো স্বাভাবিক পরিবেশ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা দেবী নদীতে স্নান করতে চাইলে পালকিসহ নদীর পানিতে ডুবিয়ে তাকে স্নান করতে হয়েছে। নারীদের এমন যাপিত জীবনের অসারতা প্রমাণ সাপেক্ষে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন তাই লিখেছেন— ‘অন্তঃপুরিকাদের পরস্পর দেখা হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুরুষেরা যেমন সব শ্রেণির লোকের সহিত আলাপ করিয়া থাকেন, আমাদেরও তদ্রূপ হওয়া উচিত।’

রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন যে বঙ্গসমাজ দেখে শাণিত লেখায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন সে সমাজে ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতিতে তারা ছিল অবিচল। বিশেষত হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে রেষারেষি-দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূলেও তাদের ছিল প্ররোচনা। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন সেই সমাজ দেখে দেখে বেড়ে উঠেছেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ ক্রমান্বয়ে ভারতবর্ষকে নিয়ে গেছে দ্বিজাতিতত্ত্বের দিকে। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন কোনো বিদ্যালয়ের পাঠ গ্রহণ না করলেও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল সম্পর্কে তার ছিল পরিচ্ছন্ন ধারণা। বিশ্বব্যাপী শাস্ত্রীয় সমাজে নারীদের অবস্থান, নারী সমাজ তথা নারীদের আর্থ-সামজিক মূল্যায়ন সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত ছিলেন। অনেক দেশে নারীদের পূর্ণাঙ্গ মানুষ বলে গণ্যই করা হতো না। অবহেলা-লাঞ্ছনা-পীড়ন-উপেক্ষা-নিগ্রহ ছিল নারীদের অনিবার্য তিলক। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন এসব কলঙ্কতিলক থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। নারীশিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে শুধু লিখেই তার দায়িত্ব পালন শেষ করেননি। নিজেই প্রতিকূল সমাজে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করেছেন। অন্ধকারের চাদরবেষ্টিত কূপমণ্ডূক সমাজে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের এ চেষ্টা এক সাহসী পদক্ষেপ।

রোকেয়া সাখাওয়াতের সমাজ ছিল প্রথাগত ত্রুটিপূর্ণ চিন্তার বাতাবরণে। প্রচলিত সমাজের বিপরীতে যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য উচ্চারিত হলে সামাজিকেরা তার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। রোকেয়া সাখাওয়াৎ সেই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই মুক্তির পতাকাতলে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রসঙ্গে তিনি প্রচলিত সমাজের অসারতা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন। ‘বাস্তবিক অর্থে অলঙ্কার দাসত্বের নিদর্শন ভিন্ন আর কিছুই নয়।’— বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। নারীদের অলঙ্কার কীভাবে নারীদের শৃঙ্খলিত করে তার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণও তিনি দেখিয়েছেন। কারাবাসীদের বেড়ি পরার সঙ্গে তিনি স্বর্ণ-রৌপ্যের মলকে তুলনা করেছেন। হাতের বালার সঙ্গে তুলনা করেছেন হাতকড়ার। জড়োয়া চিকের তুলনা দিয়েছেন কুকুরের গলাবন্ধের। হাতি-ঘোড়াসহ বিভিন্ন পশুর লৌহ শৃঙ্খলের সঙ্গে গলার হারের তুলনা করেছেন। বলদের নাসিকাবিদ্ধ করিয়া নাকদড়ি পরানোর সঙ্গে নাকের নোলকের তুলনা করেছেন। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন মূলত অলঙ্কার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নারীরা যে আনন্দের সন্ধান করে তা যে কতখানি শুভঙ্করের ফাঁকি তাই দেখানোর চেষ্টা করেছেন। প্রচলিত সমাজের বাইরে গেলে সমাজ কটাক্ষ করবে। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন তাই বলেছেন—“এ পোড়া সংসারে কোন কাজটা বিনা ক্লেশে সম্পাদিত হইয়াছে? ‘পৃথিবীর গতি আছে’ এই কথা বলাতে মহাত্মা গ্যালিলিও (ধেষরষবড়) কে বাতুলাগারে যাইতে হইয়াছিল। কোন সাধু লোকটি অনায়াসে নিজ বক্তব্য বলিতে পারিয়াছেন? তাই বলি সমাজের কথায় কর্ণপাত করিবেন না। এ জগতে ভালো কথা ভালো কাজের আদর হয় না।” (স্ত্রী জাতির অবনতি)

রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন নারী-পুরুষে বৈষম্যপূর্ণ সমাজের প্রতি কশাঘাত করতে চেয়েছেন। তিনি যাদের আহ্বান করেছেন জেগে ওঠার জন্য তাদের প্রতি সতর্ক বাণীও উচ্চারণ করেছেন। তিনি মুসলমান-হিন্দু উভয় ধর্মের লোকজন ক্ষুব্ধ হবেন বলেও উল্লেখ করেছেন। তবুও তাদের যে জেগে ওঠার বিকল্প নেই সেটাও লিখেছেন। তার দৃঢ় উচ্চারণ— ‘পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব।’ তিনি আরও বলেন— ‘স্বাধীনতা অর্থে পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থা বুঝিতে হইবে। ‘গৃহ’ প্রবন্ধে তিনি নারীদের কোনো গৃহ নেই বলে মন্তব্য করেছেন। নারীদের অসহায় অবস্থা বোঝানোর জন্য নারীদের গৃহে থেকে কীভাবে গৃহহীন সেই অপ্রিয় সত্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।    

রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন নারীদের দৈনন্দিন যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে তাদের চিন্তার পরিধি নির্ণয়ের চেষ্টায় ব্যাপৃত হয়েছেন। তাদের চেতনার অসারতার স্থানগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করার যৌক্তিক পথনির্দেশ করেছেন। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন নিজের জীবনে দেখেছেন স্বাধীনতা কত কঠিন, আর তার চারদিকের পুরুষদের দেখেছেন স্বাধীনতা কত অনায়াসলভ্য। অথচ নারী-পুরুষ উভয়ই সমান। সেই সমতা প্রতিষ্ঠার বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করেছেন রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। 

রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসন ‘অবরোধবাসিনী’ গ্রন্থে ৪৭টি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। এ ঘটনাগুলোর মধ্যে তৎকালীন নারীজীবনের একটি প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। নারীদের অবরুদ্ধ জীবনের কয়েকটি চিত্র সেখানে রয়েছে। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠেছিল নারীমুক্তির নিরন্তর চেষ্টা। স্বামীর নামে গড়ে তোলা স্কুলের নাম সরকার পরিবর্তন করতে চাইলেও তিনি সেটাতে আপত্তি করেননি। তিনি নিজের স্বামীর নামের কাঙ্গাল নন। মানুষ বুদ্ধি দিয়ে, যুক্তি দিয়ে সত্য গ্রহণে ব্রতী হবে এটাই ছিল রোকেয়ার আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু সেই সমাজ এখনো দূর ভবিতব্যের। এখনো অসার প্রথায় বন্দী মানুষের বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনা। আদিমকালের অনেক ধারণাই এখনো মানুষের চেতনায় গ্রথিত। মাত্র ১০০ বছরের শিক্ষায় হয়তো মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক হতে পারে না। তার জন্য হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে। তবে সেই অপেক্ষা দীর্ঘ হতো না যদি বঙ্গসমাজ রোকেয়া অধ্যয়ন করত। দাসত্বের ঘেরাটোপে বন্দী নারী বিশ্বায়নের যুগে যখন স্বাধীনতার পথে পা বাড়িয়েছে ঠিক তখনই পুঁজিবাদী সমাজ তাকে পণ্যে পরিণত করার চেষ্টা করেছে। বিজ্ঞাপন চিত্রে এখন নারীর কদর। ফলে খোলনলচে পাল্টে গেলেও নারীর অন্তর্দাহ সমাজের ভিতরকাঠামোয় অভিন্ন থেকে গেছে।

রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন শত বছর আগে সমাজের ব্যাধি দূরীকরণের লক্ষ্যে যে দাওয়াই দিয়ে গেছেন সেই দাওয়াই এখনো জরুরি। সমাজ এখনো পুরোপুরি ব্যাধিমুক্ত নয়। এখনো রাষ্ট্র নারীদের সমমর্যাদায় উন্নীত করতে পারেনি। রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন যতটুকু মুক্তির কথা বলেছেন, নারীরা এখনো ততখানি মুক্তির উঠানে আসতে পারেনি। এখনো বঙ্গনারীরা অলঙ্কারে বন্দী থাকতে ভালোবাসে। এখনো স্বামীর অধীনে থাকাটাকে অনেকেই আনন্দের জ্ঞান করে। নানা যুক্তিতে এখনো সমাজে বাল্যবিয়ে আইনি অধিকার বলে বিবেচিত হচ্ছে। সতুরাং রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের সেই উক্তিই এখনো আমাদের পথচলার নির্দেশনা— ‘অতএব জাগ, জাগ গো ভগিনি!’

সর্বশেষ খবর