শুক্রবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

টি এস ইলিয়ট লেখক হওয়ার গল্প

মেহেরুন্নেসা খাতুন

টি এস ইলিয়ট লেখক হওয়ার গল্প

টি এস এলিয়টের পূর্ণ নাম টমাস স্টার্নস এলিয়ট। মূলত কবি হিসেবেই বিশ্বে তার পরিচিতি। তবে প্রাবন্ধিক, প্রকাশক, নাট্যকার, সাহিত্য ও সমাজ-সমালোচক হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পচনশীল, ফাটল-ধরা সমাজের প্রতিচ্ছবি উঠে আসে টি এস এলিয়ট নামের সঙ্গে। নিজস্ব সাহিত্যকর্ম, বিশেষত কবিতায় তৎকালীন মানুষ ও সমাজের বাস্তব চিত্র পূর্ণাঙ্গরূপে তুলে ধরতে  পেরেছিলেন বলেই তার নাম একটি যুগের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

 

বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোচিত কবি ও লেখক টি এস ইলিয়টের জন্ম ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মিশৌরির সেন্ট লুইসে। ইংরেজি ভাষার একজন কবি, নাট্যকার সাহিত্য সমালোচক। বিংশ শতকের অন্যতম প্রতিভাবান কবি। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ১৯১৪ সালে তিনি ইংল্যান্ডে চলে যান। ১৯২৭ সালে ৩৯ বছর বয়সে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন।

১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর। তবে রেখে গিয়েছিল এক বিভীষিকাময় সমাজ। বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বোমা ও অস্ত্র কেবল প্রতিপক্ষের দুর্গকেই চুর্ণবিচুর্ণ করেনি, ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, আস্থা, ভালোবাসা ও বন্ধনকেও। মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল এক ভয়াবহ রোগে—বিচ্ছিন্নতাবোধ, যা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ থেকে দেশান্তরে।

একটি নবজাতকের মায়ের সঙ্গে তার নাড়ি অবিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকে। জন্মের পরই সেই নাড়ি কেটে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এক রূপান্তরিত পৃথিবীতে মানুষের মাঝে এক বোধের জন্ম হয়। পরিবর্তিত সমাজের এসব বোধ বা চিত্র ইলিয়ট তুলে এনেছেন ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’, ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড, দ্য হলৌ মেন’সহ তার বিভিন্ন কাব্যে।

হার্ভার্ডের ছাত্রাবস্থা-থেকেই ইলিয়ট কবিতা লিখতে শুরু করেন। প্রথম থেকেই তার কবিতা ইংরেজি কবিতার পুরাতন ধারা ত্যাগ করে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে এবং নবতর আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়। তার কবিতায় অ-পূর্বত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়ে নতুন এক আঙ্গিকের দিক-নির্দেশনা দিয়েছিল। তিনি সব বাধা অতিক্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শেষ-পর্যন্ত কবি এজরা পাউন্ডের সহায়তায় ইলিয়ট তার আধুনিক কবিতাগুলো প্রকাশ করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও যখন জর্জিয়ান কবিতার রোমান্টিকতার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তেই ১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয় ইলিয়টের অমর কবিতা ‘দ্য লাভ সং অবে জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’। এ কবিতায় রোমান্টিকতার অনুষঙ্গকে ‘হাসপাতালের টেবিলে শায়িত অচেতন রোগীর’ সঙ্গে তুলনা ছিল পুরোপুরি আঁতকে ওঠার মতো, অনেকের জন্য আপত্তিকরও। কবিতায় একজন মানুষের বিরামহীন  চৈতন্যপ্রসূ অভিজ্ঞতা, শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জড়তা, জীবনে সুযোগ হাতছাড়া করার মর্মবেদনা তাকে লেখক হতে প্রেরণা জোগায়। তিনি ওই সময় অসম্ভব সংগ্রাম করেছেন। তার প্রথম জীবন বেশ কষ্টময় ছিল।

১৯১৫ সালে রচিত ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’ কবিতার মাধ্যমে তার নাম সাহিত্যজগতে ছড়িয়ে পড়ে। কবিতাটি আধুনিকতা আন্দোলনে মাস্টারপিস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। পরবর্তী সময়ে একে একে রচনা করেন ‘দ্য ওয়েইস্ট ল্যান্ড’ (১৯২২), ‘দ্য হলৌ মেন’ (১৯২৫), ‘অ্যাশ ওয়েডনেসডে’ (১৯৩০), ‘ফোর কোয়ার্টেটস’ (১৯৪৫), ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথেড্রল’-এর মতো কালজয়ী সব কাব্য। এসব কাব্য রচনার মাধ্যমে তিনি ধ্রুপদী সাহিত্যে নিজের নাম যুক্ত করে নেন। ১৯২২-এ প্রকাশিত ইলিয়টের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কাব্য ‘The Waste land’।

 

 

কবির সমকালীন ইউরোপীয় পরিবেশ ও তার ব্যক্তি জীবনের দাম্পত্য অশান্তি আলোচ্য কাব্য রচনার প্রেরণারূপে কাজ করেছে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। চারদিকে বিপুল ধ্বংসের অবশেষ। লন্ডন শহর যেন এক পোড়ো জমি। ১৯২২-এর অক্টোবরে ইলিয়ট সম্পাদিত The Criterion পত্রিকায় ‘The Waste land’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ঐ বছরেই গ্রন্থাকারেও প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির শিল্পরূপ অনেকাংশে Fisher-King-এর উপকথার সমধর্মী। The Waste Land প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী ইউরোপ ছিল এক বন্ধ্যা জমি। বন্ধ্যা জমি উর্বর হওয়ার অপেক্ষায়। সেই কালে ইলিয়ট কবিতা দিয়ে সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিলেন।

১৯৩০-এর সমসাময়িক কালে সারা ইউরোপীয় সাহিত্যে তার প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল। তার সংক্রমণকে সমালোচকরা ঈর্ষাকাতর হয়েছিল। কারণ ত্রিশের প্রজন্মের কাছে একমাত্র আদর্শ ছিল টি এস ইলিয়ট। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ইলিয়টের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন, প্রশংসা করেছিলেন। কারণ ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রচলিত ধারাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন প্রবলভাবে। তার লেখক জীবনের এই সফলতা ইউরোপ থেকে বিস্তৃত হয়েছিল আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, অফ্রিকা এমনকি এশিয়াজুড়ে।

তার ভক্ত অনুরাগীও কম ছিল না। অল্পসংখ্যক যেসব ইংরেজ কবি ইংরেজি কবিতার যুগান্তর প্রতীকপুরুষ রূপে গৃহীত, ইলিয়টের স্থান তাদেরই মধ্যে। নব্য-আধুনিক বাঙালি কবিদের একটি বড় অংশও দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে তাকে অনুকরণ, অনুসরণ করেছেন।

ইলিয়ট চিরাচরিত ইংরেজি সাহিত্যের সম্পূর্ণ বিরোধী। এই বিরোধ কাব্যের বিষয়বস্তু, আঙ্গিক ও আত্মপ্রকাশ-ভঙ্গিতে। কবিতার বিষয়বস্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর যুগের অপরিসীম ক্লান্তি, যান্ত্রিকতা ও শূন্যতা। কবি অনুভব করেছেন, শিল্পবিপ্লব থেকে উত্থিত সামাজিক পরিবর্তন পুরাতন সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছেন।

 

সেই সংস্কৃতি ছিল কৃষিনির্ভর, সেখানে ধনী-দরিদ্র উভয়ই একই ভিত্তি-সংলগ্ন এবং ধর্ম ও রাষ্ট্র জীবন্ত সম্পর্ক অন্বিত। সেই ভিত্তি ধসে গেছে, নীতিবোধের অবক্ষয় হয়েছে, শিক্ষার ভিত্তিও পরিবর্তিত।

 তা ক্রমশ বিজ্ঞানমুখী ও বস্তুবাদী। এই বিজ্ঞানমুখী ও বস্তুবাদী চিন্তা প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার নাটক ও প্রবন্ধসাহিত্যে।

তিনি চেয়েছিলেন আধুনিক কবিতায় নতুন একটি জেনর সৃষ্টি বা শিল্পভাষা সৃষ্টি করতে। এবং সেটি তিনি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর সে কারণেই

তৎকালীন কাব্যধারায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৪৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন এই কিংবদন্তি লেখক।

১৯৬৫ সালের ৫ জানুয়ারি এই মহান কবির মহাপ্রয়াণ ঘটে। ১৯৬৫-তে তার মৃত্যুর পর বিচ্ছিন্নভাবে একাধিক পত্রিকায় তার সম্বন্ধে প্রবন্ধ ও তার কিছু কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এই সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ পি লাল সম্পাদিত নিবন্ধ সঙ্কলন T.S. Eliot : Homage from India (Writers Workshop). পঞ্চান্নটি প্রবন্ধ ও শতাধিক-কবিতার এই সঙ্কলনে বেশ কয়েকজন বাঙালি লেখকের রচনা স্থান পেয়েছে।

সর্বশেষ খবর