শুক্রবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

কবি হওয়ার একটা উন্মাদ বাসনা ছিল

কবি হওয়ার একটা উন্মাদ বাসনা ছিল

ছবি : নেওয়াজ রাহুল

বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবিতা ও গদ্যশিল্পে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন। সম্প্রতি টেলিভিশন চ্যানেল নিউজ টোয়েন্টিফোর-এর জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘যে জলে আগুন জ্বলে’-তে তার একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তার কবি জীবনের নানা প্রসঙ্গ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—সামিয়া রহমান

 

কবি নির্মলেন্দু গুণ। যিনি জীবনে সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন। বাস্তব অর্থে যিনি সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেননি কিন্তু কবিতার প্রেরণায় ছুটে চলেছেন পথ থেকে পথে। তার কবিতায় কখনো পাওয়া যায় যাপিত জীবনের হাহাকার, কখনো প্রেম, কখনো বিদ্রোহ।

 

দাদা কেমন আছেন?

আছি মোটামোটি।

 

আপনার কবিতা লেখার গল্প শুনব, কিন্তু তার আগে আপনার ছোটবেলার গল্প শুনতে চাই। চার বছর বয়সে মা মারা গিয়েছিলেন। নতুন মায়ের কাছে হাতেখড়ি। সেই গল্পগুলো।

খুব ছোটবেলায় আমার মা মারা গিয়েছিলেন। ‘আমার ছেলেবেলার’ যে বইটি আছে ওই বইয়ের শুরুটাই হয়েছে আমার মায়ের মৃত্যুর দৃশ্য দিয়ে। আমার বয়স তখন খুব কম ছিল বলে আমার খুব বেশি মনে নেই। মাকে শুধু বিছানায় শায়িত অবস্থায় দেখেছি। তাকে কখনো দাঁড়ানো অবস্থায় দেখার সুযোগ আমার হয়নি। মা অসুস্থ ছিলেন। বাবা মাথায় জল ঢালছিলেন এবং আমাকে তার পাশে বসতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি তখন একটি ফুটবল নিয়ে ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলাম ফুটবল খেলার জন্য। তখন মৃত্যু জিনিসটা কি সেটা আমার বোধের ভিতরে ছিল না। ফলে মা যে খুবই অসুস্থ সেটাও আমি বুঝতে পারিনি। কিছুক্ষণ পর আমাকে ঘিরে একটু কান্নাকাটির রোল উঠলে অনুমান করি যে, তখন মা মারা গিয়ে থাকবেন। কিন্তু এরপরে মায়ের কোনো স্মৃতি আর আমার মধ্যে কাজ করে না।

 

দাদা, তারপরে তো আপনি নতুন মায়ের কাছে থেকে পড়াশোনা করলেন। আমি যতদূর জানি এসএসসি এবং এইচএসসিতে দুর্দান্ত রেজাল্ট ছিল আপনার। আপনার বাবা চেয়েছিলেন আপনি ডাক্তারি পড়বেন, কিন্তু আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসিতে চান্স পেয়েছিলেন।

হ্যাঁ, ফার্মেসিতে।

 

কিন্তু ফার্মেসিতে আর পড়া হলো না।

পড়া হয়নি। আমি আমাদের কলেজ থেকে একাই প্রথম বিভাগে পাস করেছিলাম। ফলে আমার আশা ছিল যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারব। ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টটা তখন সবে মাত্র ওপেন হয়েছিল। প্রথমবারের মতো। ৩৫ জন ছাত্র সেই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। তার মধ্যে আমার লিখিত পরীক্ষার ফল অনুযায়ী আমার একাদশ স্থান ছিল। কিন্তু ওই সময় ১৯৬৪ সালে ঢাকায় এবং আশপাশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল। যার ফলে আমি জগন্নাথ হল থেকে উঠে আসি। হল বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং আমি গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলাম। পরে সেখান থেকে যখন আবার ফিরে এলাম, এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হতে গিয়ে দেখলাম আমার পরিবর্তে আরেকজনকে স্থান দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

 

আপনি তখন ভর্তি হননি বলে বোধহয় নামটা কাটা গিয়েছিল?

হ্যাঁ। এর জন্যই কাটা গিয়েছিল।

 

আপনি বোধহয় বুয়েটেও লিখিত পরীক্ষায় চান্স পেয়েছিলেন?

১৯৬৫ সালে আমি বুয়েটে চেষ্টা করেছিলাম আর্কিটেকচারে ভর্তি হওয়ার জন্য। লিখিত পরীক্ষা, সেখানেও আমি পাস করেছিলাম। কিন্তু সেখানে ভাইভাতে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, ভারতে আমার কোনো আত্মীয়স্বজন আছে কিনা? ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল এবং ভারতকে পাকিস্তান শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। ফলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের সম্পর্কে ধারণা করা হতো তারা চলে যাবে পাস করে। সে জন্য আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল প্রশ্নটা। আমার এক বড় ভাই তখন ভারতে ছিলেন।

 

আপনি কি উত্তর দিয়েছিলেন?

আমি বলেছিলাম, আমার বড় ভাই আছেন ভারতে। সে কারণে আমার হয়নি আর কি। পরে ভাইভাতে আমাকে ডিসঅ্যালাও করা হয়। এর ফলে আমার পক্ষে আর ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়নি। 

 

আপনি তো প্রাইভেটে বিএ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। আমি যতদূর জানি আপনি সার্টিফিকেটটা পর্যন্ত তুলেননি।

না, তুলিনি। পরবর্তীতে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে এক বছর পড়েছিও। কিন্তু পরে আর পড়াশোনার প্রতি আমার আর আগ্রহ হয়নি।

 

আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন?

হ্যাঁ। পরে তখন ওই কবিতা লিখতে শুরু করি।

আপনার প্রথম কবিতার নাম ছিল নতুন কাণ্ডারি?

নতুন কাণ্ডারি, সেটা কিন্তু অনেক আগে। ১৯৬১ সালে আমি যখন স্কুলে পড়ি। ১৯৬২ সালে আমি ম্যাট্রিক পাস করেছি। যখন স্কুলে পড়ি ক্লাস টেনে তখন নেত্রকোনা থেকে একটা কাগজ বেরিয়েছিল। সেই পত্রিকায় আমার প্রথম কবিতা প্রকাশ হয়। সেই কবিতার নাম হলো নতুন কাণ্ডারি।

 

আপনি খুব রসিক মানুষ। বলা হয় আপনি খুব বোহেমিয়ান জীবনযাপন করেন। ঢাকায় আপনার নির্দিষ্ট কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।

আগে ছিল না। এখন আছে।

 

হোটেল পূর্বাণীতে বোধহয় একটা কবিতার আসর বসেছিল। সেই কবিতার আসরেই...

সেটা ১৯৬৮ সালে। এটাই তরুণ কবিদের প্রথম কবিতা পাঠের একটা অনুষ্ঠান ছিল। সিকান্দার আবু জাফর সেটার সভাপতিত্ব করেছিলেন এবং বড় একটা হোটেলে সেই অনুষ্ঠানটি হয়।

 

দাদা অনেকে বলেন, নিন্দুকেরা বলেন কিনা জানি না। পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশনে এই খবরটা প্রচারিত হওয়ায় পাঠক সমাজে আপনার পরিচিতি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তা কি সত্যি?

তখন তো একটামাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিল। তখন তো আর অন্য কোনো টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। পাকিস্তানের পিটিভি যেটা পাকিস্তান টেলিভিশন, সেটার ডিআইটিতে অফিস ছিল। ফলে সারা দেশের মানুষ একটা টেলিভিশন চ্যানেলই দেখত। ফলে ওই টেলিভিশন চ্যানেলে যখন আমাদের কবিতা পাঠের আসরের সংবাদটি খুব ফলাও করে সচিত্র সংবাদ প্রকাশ করে, তো তার প্রচারটা খুব ব্যাপকভাবে হয়েছিল। মানুষের মধ্যে নতুন কবি যারা, তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।

 

দাদা আপনি কথা বলতে গিয়ে টায়ার্ড না তো?

আমার আসলে হার্টের সমস্যা তো, ফলে একটু টায়ার্ড ফিল করি।

 

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনার লেখা কবিতার কথা জানতে চাই। ১৯৬৭ সালে বোধহয় লিখেছিলেন কবিতাটি, তাই না?

হ্যাঁ, ১৯৬৭ সালে। তিনি তখন কারাগারে ছিলেন। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার ১২ নভেম্ব্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধু সেই কবিতাটি জেলখানায় থেকে পড়েছিলেন।

 

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা আপনার দ্বিতীয় কবিতা হুলিয়া। কবিতার মধ্যেই তো বঙ্গবন্ধুর কথা আবার চলে এসেছিল।

হ্যাঁ, হুলিয়া কবিতার ভিতরে আছে। আরেকটা কবিতা আছে, ৭ জুনের হরতালকে কেন্দ্র করে। যখন আওয়ামী লীগের নেতাদের  সরকার জেলে পুরেছিল, তাদের মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ছিল। সেই হরতালে ১১ জন শহীদ হয়েছিল। তখন আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম, সেই কবিতার মধ্যে একটা অংশ ছিল এরকম— শীতের রোগীর মতো জবুথবু নয়, গঞ্জের জনতার মতো নির্ভীক হতে হবে। রক্তের রঙ দেখে ভয় নেই, স্বাধীন দেশের মুক্ত জনতা উল্লাস করো সবে।

 

বাহ! কি অসাধারণ।

আমার কাছে এই ৭ জুন ১৯৬৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ স্বাধীন।

 

দাদা, আপনার কবিতার বই আপনি বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করেছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তার নামটা কেটে ফেলেন। এই ক্ষোভের কারণটা কি?

আমার আত্মজীবনীতে বিস্তারিত লিখেছি। মার্টিন লুথার কিং, আমেরিকার মানবাধিকার কৃষ্ণাঙ্গ নেতা, মেম্ফিসে আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। এই মানবাধিকার নেতা কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলনের পথিকৃৎ, সারা বিশের পীড়িত জনতার প্রতিই তার সমর্থন ছিল। তার সেই বিখ্যাত ভাষণ, আই হ্যাভ আ ড্রিম। তার স্মরণে আমরা একটা সংকলন প্রকাশ করেছিলাম। সেই সংকলনটির নাম ছিল শ্বেতাঙ্গের স্বরেবৃত্ত। ওই সংকলনটি আমরা বিক্রি করতে চেয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তিনি আমাদের সহপাঠিনী ছিলেন। তিনি ওই সংকলনটি কিনতে রাজি হননি। কিনতে রাজি হননি বলে আমি একটু ক্ষুব্ধ হই।

 

নামটি কেটে ফেলেছিলেন?

নামটি কেটে ফেলেছিলাম। মনে হয়েছিল আমি তোমার বাবাকে নিয়ে কবিতা লিখব আর কিনবে না!  তিনি তো তখন শেখ মুজিব,  তখনো তো শুধু শেখ হাসিনার পিতা ছিলেন, জাতির পিতা হননি। ফলে আমার একটা ক্ষোভ কাজ করেছিল। ফলে ওই নামটা কেটে দেই।

 

শেখ হাসিনার প্রতি আপনার রাগ-অভিমান অনেকবারই আমরা দেখেছি। আপনি নিজেই বলেছেন যে, মেসেজের পর মেসেজ দিয়ে তাকে বিরক্ত করে ছাড়েন। ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে স্বাধীনতা পদক পাওয়ার ব্যাপারটিও কি অনেকটা সে রকম?

না, এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়ার সময় দুই টাকার একটা ধাতব মুদ্রা আমার হাতে গুঁজে দেন। অনেকে সেটা দেখেছেন যে, কিছু একটা তিনি গুঁজে দিয়েছেন, কিন্তু সেটা কি অনেকে তা জানে না। সেই দুই টাকা গুঁজে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, আপনার যে সংকলনটি আমি কিনতে পারিনি, সেই সংকলনের মূল্যটা আমি পরিশোধ করছি। তখন আমি বললাম, আপনি আমাকে এখন মূল্য পরিশোধ করলেও আমি তো আপনাকে সেই সংকলনটি আর দিতে পারব না। সেই ৪৮ বছর আগের কথা। সেই সংকলনটি আর আমার সংগ্রহে নেই। তবুও আমি খুশি তিনি যে স্মরণে রেখেছেন।

 

গুণদা, আপনি নিজেই বলেছেন যে, আপনি এই যে চেয়ে নিয়েছেন আর অন্যরা এমনিতেই পেয়ে যায়, অনায়াসেই পেয়ে যায়। চেয়ে নেওয়ার ফলে এর মূল্যমান অনেক বেড়ে যায়। 

সেটা অনেকেই সমালোচনা করেছেন। অনেকে বলেছেন যে, এটা তারা পছন্দ করেননি। কেন আমি সেই পুরস্কারটি চাইতে যাব। কিন্তু আমি নিজেকে এর যোগ্য মনে করেছি। বিশেষ করে ১৯৬৭ সালেই তো আমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখে গেছি, স্বাধীন দেশের মুক্ত জনতা উল্লাস কর সবে।

 

আপনার আগে কি কেউ লিখেছিলেন?

না, না। কেউ লেখেনি।

 

সুফিয়া কামাল বা জসীমউদ্দীন কি তারপরে লিখেছিলেন? 

জসীমউদ্দীন ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। সুতরাং আমার আগে কেউ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লেখেননি।

 

আপনার অভিমানটা ছিল?

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য জাতিকে যে প্রস্তুত করেছিলেন, আমি তার সহযোগী কবি হিসেবে, তার সহযোগী হিসেবে সবসময় ভূমিকা রেখেছি। পরে যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে, তার পটভূমিতে আমি নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের অবিকৃত স্বাধীনতার ইতিহাস তুলে ধরেছি।

 

কিন্তু দাদা, আপনি আপনার একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, আমাদের দেশে স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে যে বঙ্গবন্ধুর নাম কাটা শুরু করেছে, এর শুরুটা আপনি করলেন।

এটা রসিকতা করে বলেছিলাম বটে। আমি বলেছিলাম যে, উনার নাম ইতিহাস থেকে যারা কেটে বাদ দিবেন, তারা জেনে খুশি হবেন যে, এই কাজ আমিই শুরু করেছিলাম।

 

এই যে বললেন না, আপনি নিজেকে যোগ্য মনে করেন। আমরাও অবশ্যই আপনাকে যোগ্য মনে করি। কিন্তু দাদা আপনি বলেছেন যে, আপনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিরক্ত করেছেন। তেমনি আপনার চিকিৎসার জন্য দেওয়া টাকাটিও আসলে তিনি নিজে থেকে দেন না। তিনি সবাইকে দেন কিন্তু আপনাকে দেন না। আপনাকে চেয়ে নিতে হয়।

না, আমার সঙ্গে তার সম্পর্কটা স্বাভাবিকভাবেই অন্যরকম, সহপাঠী যদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান, তাহলে তার সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হয়। যেমন আমাদের অন্যান্য বান্ধবী, যারা আমরা একসঙ্গে পড়াশোনা করতাম, তাদের মধ্যে পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা যাদের এমপি বানিয়েছিলেন, সেই কাজী রোজী তো এখন এমপি আছেন, তাদের সঙ্গে তো আমার তুমি তুমি সম্পর্ক।

 

আর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে?

কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আপনি আপনি সম্পর্ক। প্রধানমন্ত্রী যখন বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে আমাদের সহপাঠিনী ছিলেন, তখনো কিন্তু তিনি নিজেকে খুব গুটিয়ে রাখতেন। গল্প করতেন না এবং আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। ফলে তার সঙ্গে খুব বেশি ইন্টার‌্যাকশন ছিল না।

 

দাদা আপনি প্রথম কবিতা লিখেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, এখন তো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হাজার হাজার কবিতা লেখা হয়। কি বলবেন?

আমার খুব মজা লাগে এই ভেবে যে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভবিষ্যতে  বাঙালি জাতির প্রতিটি কবি সম্মান জানিয়ে কবিতা লিখবে, এরকম একটা ধারণা আমার মধ্যে ছিল। আমি মনে করেছিলাম আমার বাংলাদেশের মানুষের বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের যে স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, তার কেন্দ্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ছিলেন আমাদের স্বপ্নের নায়ক। আমি যখন তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছি তখন এরকম ভাবিনি যে, এত বেশি কবিতা পরবর্তীকালে তাকে নিয়ে রচিত হবে ।

 

যে আবেগ, ভালোবাসা নিয়ে আপনি কবিতা লিখেছিলেন— আপনি কি মনে করেন সেই সত্যিকারের আবেগ, সেই ভালোবাসা এখন যে হাজার হাজার কবিতা, প্রবন্ধ রচিত হচ্ছে তার মধ্যে আছে?

না, বঙ্গবন্ধু সপরিবারে যে নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলেন। এই ঘটনাটি বাঙালির চেতনার মর্মমূলে খুব বড় একটা আঘাত হেনেছিল। যার ফলে এর পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে লেখা কবিতার সংখ্যা খুব কম, আমরা যদি বিচার করে দেখি। তার মধ্যে সরাসরি কবিতা লিখেছিলেন জসীমউদ্দীন।

 

দাদা আমি শুনব আপনার সেই বিখ্যাত কবিতা, যে কবিতা দিয়ে আপনি শুরু করলেন হুলিয়া কবিতা, তার পেছনের গল্প।

হুলিয়া কবিতাটি আইয়ুব খান গণআন্দোলনের সময়কার। যখন আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়ে নেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। সেদিক থেকে আইয়ুব খান যদিও গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা জনগণের কাছে হস্তান্তর করেননি। যেমন এরশাদের পতনের ঘটনাটি যদি আমরা দেখি, গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটেছিল। কিন্তু তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন তিন জোটের মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে জাস্টিস সাহাবুদ্দীন সাহেবের কাছে। আইয়ুব খান কিন্তু সেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি। তিনি সেই সুযোগও পাননি, কারণ তার কাছ থেকে রাতের অন্ধকারে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করেছিলেন। দুটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন, ফলে আইয়ুব খানের বিদায়ের পটভূমিতে এই কবিতাটি রচিত।

 

আপনার কবিতার প্রশংসা করে শক্তি চট্টোপ্যাধ্যায় কলকাতা থেকে পূর্ববাংলার শ্রেষ্ঠ কবিতায় আর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছিলেন পূর্বদেশ পত্রিকায়। তাই না?

হুমম।

 

আপনি অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন, সাংবাদিকতা করেছেন। ২০০০ সালের পর থেকে বোধহয় আর কোনো কাজ করছেন না?

আমার চাকরি জীবন কিন্তু খুবই বৈচিত্র্যময়। বহু বিচিত্র ধরনের কাজ আমি করেছি। পত্র-পত্রিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক সৃষ্টির আগে আমি ঢাকাতে প্রথম আসি ১৯৬৭ সালে। তখন আমার মাথায় হুলিয়া ছিল। এর কারণেই আমি হুলিয়া কবিতা লিখেছি কিন্তু, অকারণে নয়।

 

আপনার মাথায় তার আগে থেকেই হুলিয়া ছিল?

এটা বানানো কবিতা নয়। এটা আমার জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ।

 

কি কারণে হুলিয়া ছিল দাদা?

দুটো কারণে আমার নামে হুলিয়া ছিল। একটা ছিল আমার সংকলন কবিতার কারণ। সংকলনটি বের করেছিলাম নেত্রকোনা থেকে, সূর্য ফসল নামে। এই সংকলনটি ছিল খুবই বিপ্লবী, রাজদ্রোহিতার অভিযোগে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আমাদের যিনি প্রকাশক ছিলেন, যিনি মুদ্রক ছিলেন তার ছয় মাস জেল হয়েছিল। আর আমি পালিয়ে বেড়িয়েছি। আমাদের এখানে রেলস্টেশনে একটা ডাকাতি হয়েছিল। ওই দুটো কেসে আমাকে জড়িয়ে দেওয়া হয়।

 

এই দুইটা হুলিয়া ছিল আপনার মাথার ওপর?

হ্যাঁ, এর ফলে আমি ঢাকাতে চলে আসি। পুলিশের অত্যাচারে গ্রামে থাকা সম্ভব ছিল না। আমার পরিবার চাইছিল আমি ভারতে চলে যাই, কিন্তু শেখ মুজিব আমাকে ভারতে চলে যেতে দেননি। তিনি আমাকে একটা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। এই পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় থাকবে না। এটি একটি স্বাধীন ভূখণ্ডে পরিণত হবে। এটা আমি বিশ্বাস করতাম। আমি সেই বিশ্বাসের অনুকূলে কবিতা রচনা করেছি এবং তাকে নিয়ে যে আমি সর্বপ্রথম কবিতা রচনা করেছি, এ জন্যই যে, এই বিশ্বাসটা তিনিই আমার ভিতরে প্রথম বুনে দিয়েছিলেন।

 

সে স্বপ্নটা তিনিই বুনে দিয়েছিলেন?

আমার যে আত্মজীবনী মহাজীবনের কাব্য, সাতশ পৃষ্ঠার বই। সেই বইটির উৎসর্গ পত্রে আমি লিখেছি যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, যিনি আমার ভিতরে একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নবীজ বপন করেছিলেন। এই বইটি একসঙ্গে আমার জীবনকথা যেমন, তেমনি পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ হয়ে ওঠা বা শেখ মুজিবুর রহমানের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠার গল্প।

 

আপনি আপনার চাকরি জীবনকে বর্ণাঢ্য বলছিলেন। একের পর এক চাকরি আপনি ছেড়েছেন।

হ্যাঁ, আমার বন্ধু নাট্যকার মামুনুর রশীদ আমাকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছে নিয়ে গেলেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তখন কণ্ঠস্বর পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি তার পত্রিকায় আমাকে একটা কাজ দিলেন। সেটা পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা। প্রথম ঢাকাতে এসে আমার প্রথম যে কাজটি জুটল সেটা হচ্ছে পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা এবং সে সংগৃহীত বিজ্ঞাপনের যে মূল্য তার ২৫% কমিশন আমি পেতাম। কিন্তু তখন তো এখনকার মতো শত শত পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন আসত না। তখন কিছুই ছিল না। বাঙালিদের কোনো শিল্প-কারখানা ছিল না তো, তারা বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রয়োজনই বোধ করত না।

 

আর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন আনা ছিল দুষ্কর।

হ্যাঁ, দুষ্কর। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের যে সব প্রতিষ্ঠান এখানে ছিল, হাবিব ব্যাংক, ইস্টার্ন ইনস্যুরেন্স কোম্পানি— এরকম দুই একটা কোম্পানির বিজ্ঞাপন আমরা সংগ্রহ করতে পারতাম। তাছাড়া বাঙালিদের যে প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল সেগুলো এতই ছোট ছোট ছিল যে, ৫০ টাকা, একশ টাকার বেশি বিজ্ঞাপন তারা দিতে পারত না। কিছুদিন ওখানে কাজ করার পর আমি বইয়ের প্রুফ দেখার কাজ, বাংলাবাজারে যে একাডেমিক বইগুলো আছে সেই বইগুলোর প্রুফ দেখার কাজ পাই।

 

আপনি সাব-এডিটরও তো ছিলেন বোধহয়?

না, সাব-এডিটর তারপরে। তবে প্রুফ রিডার হিসেবে কাজ করেছি। তারপর সেখানে সিনেমার কাগজে অনেক কাজ করেছি। সিনেমার জন্য গানও লিখেছি।

 

গান কি এখনো লিখেন, গুণদা?

এখন লিখি না। তখন মানে একটা সিনেমার জন্য লিখেছিলাম। সেই ছবিটি শেষ পর্যন্ত সামাদ সাহেব করেছিলেন। মোহাম্মদ সামাদ, তিনি চিত্রগ্রাহক ছিলেন। কিন্তু ওই গানটির রেকর্ডও হয়েছিল ওই ইন্দিরা রোডের একটি স্টুডিওতে। যে স্টুডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ড হয়েছিল। পাকিস্তানিরা যখন টের  পেল এই স্টুডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি রেকর্ড হয়ে পশ্চিমবঙ্গে বা কলকাতা হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, তখন তারা মাস্টার কপির সন্ধানে স্টুডিওতে হামলা করে এবং স্টুডিওটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। সেখানে আমার গানটিও কিন্তু পুড়ে যায়। পুড়িয়ে  ফেলা হয়। পুরো স্টুডিওটি ভস্মীভূত হয়। গানটির সুর করেছিলেন সুজেয় শ্যাম, গেয়েছিলেন ফেরদৌসী রহমান। তখন এটি বিখ্যাত গান ছিল।

 

কিন্তু দাদা, ২০০০ সালের পর আপনি আর চাকরি করলেন না?

বলছি। তারপরে আমি ওই পত্রিকার চাকরি করে গেছি। প্রুফ রিডার ছিলাম। সেখানে বাংলাবাজারের বিভিন্ন প্রকাশনীতে আমি প্রুফ রিডিং করে ডেইলি দশ টাকা, পনেরো টাকা, বিশ টাকা  পেতাম। সে টাকা দিয়ে কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে দিন চলত। আমার আত্মজীবনীতে আছে যে, কোনো একসময় আমি একটি  সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, হোটেল থেকে খেয়ে দৌড় দিব।

 

আপনাকে অনেক অর্থকষ্ট সহ্য করতে হয়েছে সারা জীবন?

হ্যাঁ, আমি যে কি পরিমাণ কষ্ট করেছি তার সব প্রমাণ, সব কথা তো লিখিনি। তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যাবে আমার কণ্ঠস্বর বইতে। আমার থাকার কোনো জায়গা ছিল না। তখন ওই সবেমাত্র এখন যে কমলাপুর রেলস্টেশন তৈরি হচ্ছে। কি বায়তুল মোকাররম মসজিদ তৈরি হচ্ছে। আমি আমার বন্ধু কবি আবুল হাসান, আমরা মসজিদে থাকতাম, ওই স্টেশনের যাত্রীদের সঙ্গে ঘুমাতাম। পথের পাশের মানুষের সঙ্গে ঘুমাতাম। কোনো দিন বাস স্টেশনে কিংবা  সেই সদরঘাটের যে লঞ্চ আছে সেখানে থাকতাম। থাকার কোনো জায়গা আমার ছিল না। পরে ১৯৬৯ সালে বিভিন্ন হলে থেকেছি।  এবং ১৯৬৯ সালে আমি প্রথম দৈনিক পত্রিকায় চাকরি পাই।

 

কিন্তু চাকরি পাওয়ার পরও কি আপনার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছিল?

হ্যাঁ, চাকরি পাওয়ার পর খুব পরিবর্তন ঘটেছিল। কারণ হলো আমি  যে চাকরি পেয়েছিলাম তার বেতন ছিল মাসিক আড়াইশ টাকা। পাকিস্তান আমলে আড়াইশ টাকা কিন্তু অনেক টাকা ছিল। সে টাকা দিয়ে আমি প্রথম একটা বালিশ কিনেছিলাম এবং ভাত খাওয়ার জন্য একটা থালা কিনেছিলাম। এই বালিশ এবং থালা যে আমার ছিল না সেটা দুই বছর আমার কখনো মনেও পড়েনি। আমি খুব কষ্ট করেছি।

 

কবি মানুষ আপনি। চাকরি আপনাকে কিছুটা জীবনের নিশ্চয়তা দিয়েছিল। তারপরও চাকরি ছেড়ে দিলেন কেন?

সিক্সটি নাইনে কাগজটা বের হয়েছিল। পিপল পত্রিকা। হামিদুর রহমান সাহেব, রিসেন্টলি উনি মারা গেছেন। তিনি আমাকে খুব  স্নেহ করতেন এবং আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি আমাকে একটা কাজ দিয়েছিলেন এবং আবুল হাসানকেও তিনি তার পত্রিকায় কাজ দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে ওই পত্রিকা আক্রান্ত হয়। আমার রাতের শিফটে ডিউটি ছিল। আমি আমার বন্ধু নজরুল ইসলাম শাহ, তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে চাকরি করতেন। তিনি খবর পেয়েছিলেন যে, রাতে আমাদের পত্রিকা অফিসে আক্রমণ হতে পারে। আইয়ুব, ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার মাঝপথে মানে স্থগিত রেখে সন্ধ্যার দিকে চলে গেছেন। ভুট্টো তখনো ছিলেন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে রাতে তখন ফিরছি, তার সঙ্গে আমার দেখা হয় ঢাকা কলেজের সামনে ।

 

২৫ মার্চ রাতে আপনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, কিন্তু দেখা হয়নি। সেখান থেকে যখন ফিরছিলাম তখন এই বন্ধুর সঙ্গে দেখা। বঙ্গবন্ধু সেদিন কারও সঙ্গে দেখা করেননি। সে বন্ধুটি আমাকে বলল যে, তোদের পত্রিকা অফিসে আজকে আক্রমণ হবে, তুই পত্রিকা অফিসে যাস না।

 

গুণদা, ২০০০ সালে আপনি শেষ চাকরিটি করেছেন।

হ্যাঁ, আমি খুব কম বেতনের চাকরি করেছি। সাংবাদিক শুধু নামে ছিলাম। কারণ আমি প্রথমদিকে ওই দ্য পিপলে কাজ করেছি। তারপর তো দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, আমরা কলকাতায় চলে  গেলাম এবং সেখান থেকে পরে ফিরে এলাম। আমি আসলে কোনো পত্রিকাতেই বেশিদিন থাকতে পারিনি। আমি যত না চাকরি পেয়েছি তারচেয়ে বেশি পেয়েছি টারমিনেশন লেটার। আমার চাকরি ছাড়ার মূল কারণ মালিকপক্ষের সঙ্গে নীতিগত বিরোধ।

 

কিছুটা খামখেয়ালী ছিলেন, বোহেমিয়ান জীবনযাপন করতেন  সেটাও কি কারণ?

কিছু কিছুটা। কিন্তু আইডোলজিক্যাল প্রশ্নেও তাদের সঙ্গে আমার  বিরোধিতা হতো। যার ফলে আমি অনেক কাগজে কাজ করেছি, সংবাদে কাজ করেছি, গণকণ্ঠে কাজ করেছি, কিন্তু কোথাও বেশিদিন নয়।

 

কবি নির্মলেন্দু গুণ এত বড় মাপের কবি। তার আর্থিক অসচ্ছলতা কি এখনো আসলে কেটেছে?

না, সেটা এখন কেটেছে বলা যায়। কারণ এখন আমার একশটার মতো বই আছে। তাই না? এবং আমার বই মোটামুটিভাবে চলে।  সেই বই থেকে যে রয়্যালিটি পাই সে রয়্যালিটি দিয়ে আমি চলতে পারি। সুতরাং এটা ক্রমশ কেটে যাচ্ছে।

 

গুণদা আপনি কি মানুষের ভালোবাসা টের পান?

হ্যাঁ, সেটা আমি শুনেছি, আমি হাসপাতালে থাকা অবস্থাতেই। বেশ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি মন্ত্রী গিয়েছিলেন আমাকে দেখতে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাংবাদিক বন্ধু-বান্ধবরা পাশে থেকেছিলেন। এছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার চিকিৎসার ব্যয় নিজেরাই নির্বাহ করবে এই ঘোষণাও দিয়েছিলেন। তখন আমি শুনতে পেয়েছি যে, প্রচুর  লোক বাইরে অপেক্ষা করছিল, আমাকে রক্ত দেওয়ার জন্য। সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম হাসপাতালে থেকেই।

 

গুণদা, দারুণ এক বর্ণাঢ্যময় আপনার জীবন। জীবনের এই পর্যায়ে এসে আপনার কি মনে হয়, ওই যে কি পেলাম, কি হারালাম মানুষজন বলে না? আপনার কাছে কি মনে হয় আপনি জীবনে যতটুকু পেয়েছেন, আপনি কি আসলে সুখী?

হ্যাঁ, আমি এত আশা করিনি। এতটা পাব এরকম আশা করে তো আর কাব্য চর্চা করতে আসিনি। কাব্য চর্চার মধ্যেও, আমার শুরুতে একটু দ্বিধা ছিল। আমার শুরুর চেষ্টাটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া, চাকরি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। আসলে কবি যে হওয়া যায় এই ধারণাটা কিন্তু সবার থাকে না। মানুষকে কিভাবে কিভাবে যেন শেষ পর্যন্ত তার ভবিতব্য অনিবার্য নিয়তির পথে টেনে নিয়ে যায়। সেই সূত্রে আমার কবি হয়ে ওঠা আর কি। আমি আমার বন্ধু মামুনুর রশীদের কথা বলতে চাই। মামুন আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং একসঙ্গে আমাদের জীবনের অনেক দিন কেটেছে। আমার আত্মজীবনীতে মামুনের একটা দীর্ঘ সময় অবস্থান রয়েছে। মামুনই আমাদের মধ্যে প্রথম চাকরি পায়। এবং সে আমরা আমি এবং হাসান, আবুল কাসেম এরকম কয়েকজন তরুণ কবি মামুনের আশ্রিত ছিলাম। মামুন তখন বিভিন্ন জায়গায় থাকত। সে যেখানেই থাকত আমরা তার পেছনে পেছনে তার সঙ্গে গিয়ে উপস্থিত হতাম। যেমন মামুন ছিল ফিস্কো স্ট্রিটে, এই এলিফ্যান্ট রোডে। আমরা সেখানেও থেকেছি একসঙ্গে।

 

আলমারি কেনার কি যেন একটা গল্প আছে দাদা? 

আলমারি কেনার গল্পটা হচ্ছে, আমাদের লেখাগুলো সংরক্ষণ করার একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। আজকে এইখানে আছি কালকে  সেখানে আছি। যেখানে থাকছি সেখানেই কবিতা লিখছি। অনেক সময় কবিতা হারিয়ে যাচ্ছে। এটা উপলব্ধি করার পর আমি আর আবুল হাসান একবার স্থির করেছিলাম একটা আলমারি কিনব। যার ভিতরে আমাদের কবিতাগুলো থাকবে। আমরা, তখন ঢাকা  স্টেডিয়াম মার্কেটে গেলাম। সেখানে কিছু  আলমারির দোকান ছিল। গিয়ে একটা আলমারি পছন্দ হলো। আড়াইশ টাকা মূল্য স্থির হয়েছিল। শেষে তখন আমি মালিককে, দোকানের যে বিক্রেতা তাকে আমরা একটা প্রস্তাব দেই। যে আমরা এটা কিনব, টাকা দিয়ে যাব। কিন্তু আলমারিটা আমরা নিব না। আলমারিটা আপনার  দোকানেই থাকবে।

 

ওখানে আপনারা কবিতাগুলো রাখবেন? কিন্তু কেন?

ওখানে রাখব। সপ্তাহে একদিন এসে দেখে যাব। কারণ আলমারি রাখার জায়গা আমাদের ছিল না। আমরা নিজেরাই থাকতে পারি না  তো আলমারি রাখব কোত্থেকে। এখন যদি আমাকে কেউ একটা বড় গাড়ি উপহার দেয়, সেই উপহার তো আমি রাখতে পারব না।

 

দোকানদার কি রাজি হয়েছিল?

দোকানদার অনেকক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। তাকিয়ে  থেকে বলল, এরকম কাস্টমার জীবনে পাই নাই। আর ভবিষ্যতে হয়তো পাবও না। না, আলমারি দিলেন না। চা দিলেন।

 

হাফ কাঠা জমিতে একটা বাড়ি বানানোর গল্পও আছে আপনার?

এটা হয়েছে কি, থাঙ্কস টু মাই হার্ট। আমার হৃৎপিণ্ডের যে অসুস্থতা,  যে বাইপাস সার্জারি হলো তাতে আমি সৌভাগ্যবান যে, আমি বেঁচে  গেছি। আমি একজন ভালো সার্জন পেয়েছিলাম। ডাক্তার লুতফর রহমান, আমার বন্ধু ডাক্তার বণিক চক্রবর্তী তারা আমাকে সুস্থ করে তুলেছেন। সরকার থেকে আমাকে ২০ লাখ টাকা চিকিৎসার জন্য  দেওয়া হয়েছে। আমি সেই টাকাটা দুটো ভাগে ভাগ করেছি। এক ভাগে আমি একটা স্কুল করেছি গ্রামে। কাশবন বিদ্যানিকেতন। সেখানে কিন্তু আমার একটা লাইব্রেরি আছে। তারপর একটি গানের স্কুল আছে। একটি সংগ্রহশালা আছে। একটি শহীদ মিনার আছে। আর বঙ্গবন্ধুর, রবীন্দ্রনাথ, তারপর মাইকেল মধুসূদন, নজরুল এবং নিউটন এই পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্য আছে। সেগুলোর  মেইন্টেনেন্স ইত্যাদির জন্য প্রত্যেক মাসেই আমাকে কিছু টাকা সংগ্রহ করতে হয়। ১০ লাখ টাকা আমি আমাদের স্কুলের ফান্ডে ট্র্যান্সফার করে দিয়েছি। আর বাকি ১০ লাখ টাকা দিয়ে আমার স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করেছি। আমার একটা বাড়ি বানানোর স্বপ্ন ছিল। আমার প্রকাশকরা এখানে আমাকে সাহায্য করেছেন। বিশেষ করে আমার যে রচনাসমগ্র প্রকাশিত হচ্ছে কাকলি প্রকাশনী থেকে, তারা সাহায্য করেছে। পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে। তাছাড়া আমার অনেক বন্ধু-বান্ধবী আছেন। যারা এক লাখ, দুই লাখ, পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছেন। এভাবে টাকা সংগ্রহ করে আমি একটা ছোটখাটো বাড়ি  তৈরি করেছি।

 

দাদা আপনি কবিতা লিখেন তো এখন?

কবিতা এখন আগের মতো লেখা হয় না। আগে যেমন কবি হওয়ার একটা উন্মাদ বাসনা ছিল, সেটা এখন কমেছে অনেকটাই। অনেকটাই তৃপ্তবোধ করি। ফলে কবি হওয়ার জন্য যে প্রতিদিন কবিতা লেখা, সেটা এখন আর হয়ে উঠে না। আমার ইতিমধ্যে  প্রায় শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। নিজের কবিতার প্রুফ দেখে নিজেই বিরক্ত বোধ করি। আমি এখন খুব বেশি কবিতা লেখার  প্রয়োজন বা তাগিদ বোধ করি না।

 

আপনি কবিতা লেখার তাগিদ বোধ করছেন না, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি আপনার এখনো অনেক স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্নটা কি?

না, আমি এখন স্বপ্নগুলোকে গুটিয়ে নিয়ে আসছি। কারণ আমি মনে করি আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এখন নতুন করে স্বপ্ন দেখার মানে প্রকৃতির সঙ্গে একটা বিরোধে লিপ্ত হওয়ার মতো। কারণ প্রতিটি প্রাণেরই একটা শেষ আছে, তাই না? সুতরাং আমি একটা নিঃশেষ প্রাণ নিয়ে এসেছি, এরকম ভাবার সঙ্গত কারণ নেই। একই সঙ্গে আমি আমার অতীতের যে স্বপ্নগুলো ছিল, সে স্বপ্নগুলো কিছুটা বাস্তবায়িত করতে পেরেছি। যেমন একপর্যায়ে আমার মনে হয়েছে  যে, আমার টাকা না থাকলেও আমি স্বপ্ন দেখেছি, পূরণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু অনেকের টাকা থাকলেও তারা তো একটা স্কুল করার স্বপ্ন দেখেন না। তারা একটি পাঠাগার তৈরি করার চিন্তা করেন না। তারা হয়তো একটা ভাস্কর্য তৈরি করার কথা ভাবেন না। কিন্তু আমি আমার সীমিত ক্ষমতা নিয়ে, আমার সীমিত সাধ্য নিয়ে সেগুলো  ভেবেছি। আর খুব বড় স্বপ্ন আর নেই। যদি কোনো স্বপ্ন অবশিষ্ট  থেকে যায়, অপূর্ণ থেকে যায় আমি খুব কষ্ট পাব।

 

গুণদা ধন্যবাদ, আমাদের সময় দেওয়ার জন্য। জানি আপনি অসুস্থ, তারপরও কষ্ট করে এতটা সময় দিলেন, আমরা সত্যি কৃতজ্ঞ।

আমারও ভালো লেগেছে। নিউজ টোয়েন্টিফোর চ্যানেল এবং এর সম্প্রচার মানুষের কাছে পৌঁছবে, মানুষের একটি প্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল তৈরি হবে এই প্রত্যাশা আমারও।

 

যদিও গুণদা বলছেন যে, তিনি এখন আর স্বপ্ন দেখতে চান না। কোনো কবিতা লেখার প্রতি তাগিদ বোধ করেন না। প্রকৃতির বিরুদ্ধে চলে যাওয়ার মতো ব্যাপার হবে সেটি। কিন্তু কবি নির্মলেন্দু গুণ আমাদের কাছে চির তরুণ, চির নবীন এবং আমরা সবসময়, আমরা স্বপ্ন দেখি, আমরা জানি আমরা তার কাছ থেকে আরও অসাধারণ সব কবিতা পাব এবং তিনি সবসময় আমাদের কাছে একেবারে তরুণ হয়েই থাকবেন।

অনুলিখন : সামিয়া রহমান ও নওশীন জাহান ইতি।

সর্বশেষ খবর