শুক্রবার, ২৪ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা
আমজাদ হোসেন

জীবন থেকে নেওয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল

জীবন থেকে নেওয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল

গত শতাব্দীতে তার নামটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়েছে। তিনি একাধারে প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গীতিকার ও গল্পকার। আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিতে আমজাদ হোসেন নামটি অত্যন্ত শ্রদ্ধায় উচ্চারণ হয়। সম্প্রতি নিউজ টোয়েন্টিফোরে তার এক সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। এখানে উঠে এসেছে তার শিল্পী ও ব্যক্তি জীবনের নানা কথা। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—সামিয়া রহমান

 

আপনার পুরো জীবনটা শুনতে চাই। সেই ছোটবেলা থেকে। বাড়িটি আপনার দাদা তৈরি করেছিলেন।

আমি যে ঘরে জন্মাই সেই ঘরে আমার দাদাকে আমি দেখিনি। উনার বড় বড় চটি জুতো দেখেছি যেগুলো ছোটবেলায় পায়ে দিয়ে থপর থপর করে হেঁটেছি। সবাই বারণ করত। কিন্তু আমি বলতাম এটা দাদুর চটি। এই নিয়ে হাসাহাসি হতো বাড়িতে প্রচুর। দোতলা একটা টিনের ঘর করেছিল যেটা শহর থেকে দেখা যেত এবং এই ঘরটি নির্মাণ করার পরপর তিনি মারা যান। তারপর ওই ঘরটায় কেউ যেতে চায় না। আমার বাবা প্রথম গিয়েছিলেন বিয়ে করে, তাদের প্রথম সন্তান হয়েছিল আমার আগে একটি মেয়ে, তিনি মারা যান।

 

আপনার সাত ভাইবোন মারা গিয়েছিল!

ওই বোনটা মারা যায় তারপরে বাবা ওই ঘরটা ছেড়ে দেয়। তারপর আমার মার কী হয়েছিল আমি জানি না। সাত ভাই আমার পরে তারা মারা গেছে একের পর এক। দশ দিন পনের দিন, আঁতুড়ঘরে এরকম অবস্থা। তারপরে আমার এক ভাই জন্ম নিয়েছে, তারপরে তিন বোন। এই হলো আমাদের সংসারের পরিচয়। আমাদের বাড়ি জামালপুর টাউনে। জামালপুর টাউনের উত্তরপাশে মানে মেঘালয়ের ওদিকে। বিরাট ব্রহ্মপুত্র। আর বামদিকে, দক্ষিণ দিকে প্রান্তরের মাঠ গোলাকারের মতো আর মাঝখান থেকে বিরাট রেললাইন গেছে। আমরা ঈদের চাঁদ দেখতে যেতাম ওই রেললাইনে। অনেকসময় খেলতেও যেতাম, পাথরে পাথরে ঠোকাঠুকি খেলা। আমি ওই আকাশ, ব্রহ্মপুত্র নদ, কোন গাছে কি ফুল ফুটল, কি পাখি বসল এই নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম দিনরাত।

 

আমি শুনেছি যখন আপনি কলেজে পড়তেন তখন আপনার কবিতা দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।

হ্যাঁ, সে অনেক পরের ব্যাপার। দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তখন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ভুলে গেছি। আমি তখন বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এদের নিয়ে ব্যস্ত। সেভাবে আমি একটা কবিতা লিখে পাঠালাম খুব গোপনে। তখন ফার্স্ট/সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমাদের বাড়িতে দেশ পত্রিকা আসত। হঠাৎ দেখলাম পনের-বিশ দিন পরে একটা পোস্টকার্ড এসেছে। সম্পাদক সাগরময় ঘোষের চিঠি। তিনি লিখেছেন—কল্যাণেয়ীসু, পূর্ব পাকিস্তানে তুমি কি অবস্থায় আছ আমি জানি না। তুমি আমার পত্র পাওয়া মাত্রই কলকাতায় চলে আস। তোমার খাওয়া দাওয়া, লেখাপড়া সব কিছুর দায়ভার আমার ওপরে, শুভেচ্ছান্তে সাগরময় ঘোষ। দুঃখটা হলো যে আমি দেশ পত্রিকাতেই যেতে পারিনি।

 

ভাগ্য ভালো যাননি। আমরা না হলে আপনাকে হারাতাম।  আচ্ছা নাটক লেখা শুরু হলো কীভাবে?

নাটক তো ক্লাস নাইন টেনে থাকতেই। বড়রা আমাদের নাটকে নিয়ে যেত। তারও আগে আমি তখন ফোর-ফাইভে পড়ি, তখন ভাষা আন্দোলন হয়। তখন আমরা ছোট। ওই আমাদের বড়রা এসে বলল যে তোমরা স্কুল থেকে বের হও। আমরা বের হলাম। আমাদের রাস্তাটা ছিল সিমেন্ট কংক্রিটের করা। আমাদের সবাই বসতে বলল। বসে বলল খবরদার, কোনো সার্কেল অফিসার যেন যেতে না পারে। তোমরা বস এবং প্রত্যেকের হাতেই চক মাটি দিয়ে দিল।

 

অ, আ, ক, খ লেখার জন্য?

হ্যাঁ, আমরা সব সিমেন্টের রাস্তায় অ, আ, ক, খ এসব সারা দিন লিখছি। এটুকু মনে আছে। তারপর থেকেই লেখালেখির প্রতি আমার আগ্রহটা অনেক বেড়ে যায়। তার পর পরই আমি একটা কবিতা লিখলাম। যা তখনকার দিনের আজাদ পত্রিকায় মুকুলের মহফিলে হয়। একটা কবিতাও যে পপুলার হয়, আর মফস্বল টাউনে সবাই জানতে চাইল কে লিখেছে, কার ছেলে লিখেছে, কোন বাড়িতে থাকে, কোন পাড়ায়? সবাই দেখতে এলো বাড়িতে।

 

মফস্বল টাউনে আপনি হিরো হয়ে গিয়েছিলেন একেবারে?

আমি হিরো হয়ে গেলাম। সেই ছোটবেলা থেকেই হিরো হয়েছিলাম। এইরকম ভাগ্য আমার।

 

সেই জনপ্রিয়তা পেয়েই অভিনয়ে আসার ইচ্ছা হলো?

অভিনয়, ফিল্মে আসার ইচ্ছা আমার কোনোদিনও ছিল না। লেখালেখি করার ইচ্ছা ছিল। তখনকার দিনে যারা কবি ছিলেন প্রত্যেকেই ইংরেজিতে পড়াশোনা করেছেন। আমারও ওরকম একটা চিন্তা ছিল। কিন্তু আমাদের পরিবার তখন এতই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ল যে আমাকে টিউশনি করে বাড়িতে টাকা দিতে হতো। তা ছাড়া পারিবারিক একটি মামলায় আমাদের দোতলা টিনের ঘরটা বিক্রি করতে হলো। ওই দুঃখটা আমার মনে আছে। আমি কেঁদেছিলাম খুব। বাবাকে ধরে বলেছিলাম যে ঘরটা বেঁচ না, বেঁচ না বাবা। বাবা আমার দিকে তাকায়নি। কারণ বাবা জানে আমার দিকে তাকালেই বাবাও কেঁদে ফেলবে। বাবা আমাকে জীবনে চড়ও মারেননি। সেই দুঃখ আছে। সব দুঃখ মনে নিয়েই বসবাস করছি। এই যে চলচ্চিত্রে এসেছি সেটাও বিপদে পড়ে এসেছি। চলচ্চিত্রে আসার কথা না। আমি একটা নাটক করেছিলাম। নাটক করার অভ্যাস আগেরই ছিল। আবৃত্তি করার অভ্যাসও আগেরই ছিল। তারপরে ঢাকায় এসে নাটক করতে করতে ভাবলাম খালি পশ্চিমবঙ্গের নাট্যকারদের নাটক করছি। তখন তিনজন মাত্র নাট্যকার আমাদের দেশে—আসকার ইবনে শাইখ, মুনীর চৌধুরী এবং নুরুল মোমেন। মনে হলো আমিও তো একটা নাটক লিখে দিতে পারি। আমি নাটক লিখলাম। ইউনিভার্সিটির ছেলেদের নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে মঞ্চস্থ করলাম। ওই নাটক নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেল। সৈয়দ শামসুল হক চিত্রালীর দুই পৃষ্ঠাজুড়ে প্রশংসা করলেন আমার। ভাগ্যের একটা দরজা খুলে গেল। তখন চলচ্চিত্রকার সালাউদ্দীন সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, যে আপনার ধারাপাত নাটকটি আমি ছবি করতে চাই। এভাবে আমি চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হই।

ধারাপাতে তো আপনি অভিনয়ও করেছেন?

হ্যাঁ, অভিনয়ও করেছি। গানও লিখেছি। তারপর বেহুলাতে করেছি, অনেক ছবিতেই করেছি। পরে যখন আমি ‘আমজাদ হোসেন চলচ্চিত্র’ শুরু করেছি তখন আর আমি অভিনয় করিনি বিশেষ করে নিজের কোনো চলচ্চিত্রে। আসলে আমি অভিনয় করলে টোটাল ইউনিটকে কন্ট্রোলে রাখা মুশকিল হয়ে যাবে। মেকআপ নিয়ে আড্ডা দেওয়া পরিচালকের জন্য সমীচীন নয়। এজন্য আমি অভিনয় করা থেকে বিরত থেকেছি।

একটা ইন্টারভিউতে পড়েছিলাম আপনি জহির রায়হানের অনেক স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু আপনার নাম কোথাও ছিল না বলে আপনি অভিমানবশত সরে দাঁড়িয়েছিলেন?

না, গুরুদের সঙ্গে অভিমান করা যায় না। মনে হয়তো দুঃখ থাকে, অভিমান তো করতেই পারি না। কারণ জহির রায়হানকে আমি অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। তখন ইন্ডাস্ট্রি কেবল গড়ে উঠছে। আমরা সবাই স্ট্রাগল করছিলাম। মানুষের মন তো, বন্ধুবান্ধব হলে, একসঙ্গে সকাল-বিকাল থাকলে অভিমান হতেই পারে। সেরকম হয়তো অভিমান এক-দুবার হয়েছিল। কিন্তু তিনি তো নমস্য ব্যক্তি।

 

‘জীবন থেকে নেওয়া’ সিনেমার স্ট্রিপ্ট আপনার লেখা। আপনি জহির রায়হানের সঙ্গে কাজ করেছেন। এর পেছনের গল্পটা জানতে চাই।

‘জীবন থেকে নেওয়া’ আমাদের দেশের ছবি, আমার মনে হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল। জহির রায়হান বেশি দিন বেঁচে ছিলেন না, কিন্তু তার ‘জীবন থেকে নেওয়া’ আমার মনে হয় হাজার বছর বাংলাদেশের জন্য টিকে থাকবে। জহির রায়হান লাহোরে চলে গিয়েছিলেন মাঝখানে, আমাকে দুবার টিকিট পাঠিয়েছিলেন। পারিবারিক কারণেই আমি যেতে পারিনি। তারপর তিনি ফিরে আসলেন। প্রায়ই  তিনি আমার বাসায় আসতেন। তার গাড়িতে চড়ে একদিন হঠাৎ আরিচা ঘাটে গিয়ে সিগারেট টানতে টানতে বললেন, আমজাদ, আমাকে একটা গল্প লিখে দেন। আমি বলি, কি গল্প লিখে দেব? তিনি বললেন, এক বোন সহোদর বোনকে বিষ খাওয়াচ্ছে। তার আইডিয়া শুনলাম। পরের দিন বললেন, আমার বাসায় আসবেন। তার মানে তার বাসায় বসে আমাকে লিখতে হবে। একদিন সন্ধ্যায় সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে জহির রায়হান ঢুকলেন। বললেন, কি লিখেছেন? তখন প্রথম সিকোয়েন্সটা কেবল লিখেছি। প্রথম সিকোয়েন্সে এক বোন অন্য বোনকে দুধভাত খাওয়াচ্ছে। জহির ভাই বললেন, প্রথমেই দুধ খাওয়ালেন? আমি বললাম, দুধভাত না খাওয়ালে বিষ খাওয়াব কি করে? এই নিয়ে হাসাহাসি হলো। হক ভাই হাতে তালি দিলেন। বললেন, না ঠিক আছে।

 

কিন্তু যতদূর শুনেছি আসাদ মারা যাওয়ার পর, তাকে নিয়ে মওলানা ভাসানী এ রকম কিছু করতে বলেছিলেন...

হ্যাঁ। সেটা জহির রায়হানের সঙ্গে নয়। আমি ভাবছিলাম কীভাবে লিখব। তখন গণঅভ্যুত্থানের সময়; দেশে হৈচৈ, আসাদ, মতিউর মারা গেছে। মওলানা ভাসানী আসাদের লাশ ঘাড়ে নিয়ে ঢাকা শহর ঘোরার পর যখন তার লাশ দাফন হলো  তখন মোনাজাত শেষে খুব ইমোশনাল হয়ে আমাকে বললেন, আমজাদ তুমিই পারবা। আমি বলি, কি, বলেন হুজুর?

 

শহীদ আসাদের উপরে ডকুমেন্টারি করার কথা বলেছিলেন?

হ্যাঁ। বললেন, টাকা পয়সা আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমি লিখলাম। লিখে কুমিল্লায় কাজী জাফরের বাড়িতে আমরা মহড়া অনুষ্ঠান করলাম। মওলানা ভাসানীর উপরে ক্যামেরা চালালাম। বক্তৃতা দিচ্ছেন হাজার হাজার লোকের মাঝখানে। এসব করার পর সন্ধ্যায় আমি কোথায় যেন ঘুরতে গিয়েছিলাম, আসার পরে দেখলাম মওলানার চোখে জল। আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বললাম, কি হলো হুজুর? বলে, তুমি তো ছবি করতে পারছ না। কারণ আসাদের পরিবার থেকে মানা করে দিয়েছে তার ওপর কোনো রকম ছবি করা যাবে না। আমার মনের ভিতর দুঃখটা রইল, গল্পটা রইল, সব রইল। যখন জহির রায়হানের বাসায় বসে জীবন থেকে নেওয়া লিখছি তখন আস্তে আস্তে ওই কৌটা খুলে দৃশ্যগুলো বের হচ্ছে আর বের হচ্ছে। একদিন গভীর রাতে জহির রায়হান এসে বললেন, আমজাদ, কি লিখলা? আমি পড়ে শুনালাম যে এই পর্যন্ত লিখেছি। তিনি মন দিয়ে শুনে বললেন, আমি তো নাম পেয়ে গেছি। আমি বলি, কি নাম পেয়েছেন? বললেন ‘জীবন থেকে নেওয়া’। আমি তো বলি, খুব ভালো নাম, সুন্দর নাম। এভাবে হলো জীবন থেকে নেওয়া ছবি।

 

আপনি অসাধারণ সব গান লিখেছেন।

অনেক গানের কথা আমি ভুলেও গেছি। জীবনে প্রথম ছবি ধারাপাতে গান লিখেছি, সেটি ছিল—‘এতো কাছে চাঁদ বুঝি কখনো আসেনি’। তারপর ‘আছেন আমার মুক্তার’, ‘হায়রে কপাল মন্দ’, ‘কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিল না’সহ প্রচুর গান লিখেছি। চলচ্চিত্রে এসে এত ব্যস্ত হয়ে গেলাম যে, গান লেখার অতটা ইচ্ছা আর ছিল না, কবিতাও ছেড়ে দিয়েছিলাম তখন।  

 

আপনার চলচ্চিত্র জীবনের স্মরণীয় ঘটনার কথা জানতে চাই।  ‘ভাত দে’ ছবিতে, শাবানার বাবা আনোয়ার হোসেন লুঙ্গি টুঙ্গি খুলে রাস্তায় উলঙ্গ অবস্থায় মরে পড়ে আছে। এক দোকানে সে চাল চেয়েছিল। দুদিন ধরে না খেয়ে আছে সে। দোকানি তাকে লুঙ্গির মধ্যে চাল দিয়েছিল ইচ্ছে করে, আস্তে আস্তে অন্ধ লোকটির লুঙ্গি খুলে চাল পড়ে যায়। আমি শাবানাকে বললাম, আপনি আর কিছুই করবেন না, দৌড়ে এসে বাবার ডেডবডির ওপর পড়ে আপনি বলবেন যে, আমার বাবা মরেনি, চারটে ভাত দিন আমার বাবা বেঁচে যাবে। শাবানা তাই করল। শাবানা সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিল ওই ছবিতে। কিন্তু অসুবিধা যেটা হলো, সিকোয়েন্সটা হয়ে যাওয়ার পরে শাবানার আর কান্না থামাতে পারছি না। সিকোয়েন্সটা হয়েছে ১১টার সময়। বিকাল তিনটা পর্যন্ত আমি শাবানাকে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছি। নদীর পাড় দিয়ে হাঁটছি। এই রকম অনেক দৃশ্য আছে। ববিতাকে নিয়ে দৃশ্য আছে ট্রেনের মধ্যে। যখন সে ‘হায়রে কপাল মন্দ’ গান গাওয়ার আগে পালায়, তখন তো প্রথম প্রথম ববিতাকে কেউ চিনতে পারেনি। একটা গ্রামের মেয়ের মেকআপ করা হয়েছিল তার। যখন তাকে চিনে ফেলল সব মানুষ ভিড় করেছে। ওই দিন তো শুটিং করাই বিপদ হয়ে গিয়েছিল। এরকম অজস্র ঘটনা ঘটেছে।

 

অনেক পুরস্কার পেয়েছেন জীবনে। নিজেকে কি সফল মনে হয়?

শাবানা প্রথম পুরস্কার পেয়েছে আমার এখান থেকেই। ‘দুই পয়সার আলতা’য় ‘নয়ন মনি’ ইত্যাদি ছবির জন্য ববিতা, রোজিনা, আনোয়ারা, আনোয়ার হোসেন একাধিকবার পুরস্কার পেয়েছে। গানে সাবিনা ইয়াসমিন, সৈয়দ আবদুল হাদী একাধিকবার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছে।

 

আপনি চলচ্চিত্রের পাশাপাশি টেলিভিশনে প্রবল আধিপত্য বজায় রেখেছিলেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওতো ঐতিহাসিক ব্যাপার। ১৯৭৪ সালে আমাকে একদিন আমার বন্ধু মোস্তাফিজুর রহমান বলল আমরা একটা নাটক করব ঈদে। আমি বললাম কখনো তো ঈদের নাটক হয় না। তারপর আধাঘণ্টা পর মোস্তফা মনোয়ার এসে বলল, নাটক লিখতে হবে আমজাদ। আমরা ঈদের দিন মানুষকে বিনোদন দিতে চাচ্ছি। আপনি একটা ভালো নাটক লিখে দেন। তারপর ‘জব্বার আলী’ নাটক লিখলাম। নাটকের পরে তো সবাই হৈচৈ। বহু নাটক লিখেছি টেলিভিশনে।

 

চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, রেডিও নাটক ও গানে আপনি সফল, তারপরও কেন আপনি নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন?

সরিয়ে ঠিক রাখিনি, কারণ লেখালেখি চলছে। চলচ্চিত্র বানানোর কোনো উপায় নেই। সেই এফডিসি আর নেই। থার্টি ফাইভে চলচ্চিত্র হবে না। নেগেটিভের দাম অনেক বেড়ে গেছে, এফডিসির যন্ত্রপাতি সব নষ্ট হয়ে গেছে। চাইনিজ নেগেটিভের দাম কম, যদি কেউ সেটা দিয়েও চলচ্চিত্র বানাতে চায়, তাহলে তাকে ভারতে বা ব্যাংককে গিয়ে কাজ করতে হবে। একদম প্রথম থেকে ডাবিং, এডিটিং থেকে সবকিছুতে আরও কস্ট বাড়বে। 

 

নতুন যারা কাজ করছেন তাদের নিয়ে কিছু বলবেন?

লোকসংখ্যা বেশি কাজ তো হবেই, কাজ তো করছেই। প্রেক্ষাগৃহ নেই, ছবি রিলিজ দিলে টাকাটা অন্তত ফেরত আসবে সে ব্যবস্থাও নেই। এখন প্রেক্ষাগৃহের জন্য শহরে এবং জেলা টাউনগুলোতে নতুন করে ভাবতে হবে। সংকট অর্থের অভাব আছে, নিজস্ব প্রস্তুতি, প্রেক্ষাগৃহ, প্রযোজকের অভাব আছে।

 

আপনার সময় যারা অভিনয় করেছেন তাদের মধ্যে আপনার প্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রী কে ছিলেন? ববিতা আপা আপনার  বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন।

হ্যাঁ, ববিতা ছিল, শাবানাও ছিল পরবর্তী পর্যায়ে। আনোয়ারা  তো সব ছবিতেই ছিল। ফারুকও ছিলই, ফারুকের সঙ্গে আমার তো খুব আবেগের একটা বন্ধন।

 

অভিনেতা ফারুক ভাই আমার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমজাদ হোসেন নিজেই একটা ইন্ডাস্ট্রি।

ও বলে, অনেকেই অনেক কিছু বলে। তবে হ্যাঁ, ফারুক আমার কাছে সবচেয়ে বেশি সিনসিয়ার ছিল। ‘সুন্দরী’ থেকে আমি কাঞ্চনকে নিলাম, সেও কন্টিনিউ করল না। করলে ওরা অভিনয় জীবনে আরও ভূমিকা রাখতে পারত।

 

সেই গোলাপি এখন ট্রেনে থেকে শুরু করে জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। আপনার মনে কোনো ক্ষোভ আছে? আপনার কি মনে হয় আমরা আমজাদ হোসেনকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করতে পেরেছি?

মানুষের আকাঙ্ক্ষা তো অনেক থাকে। যেমন টেলিভিশনেও প্রথম নাট্যকার হিসেবে আমাকেই পুরস্কার দিয়েছিল। বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছি, একুশে পদক পেয়েছি। সবচাইতে বড় ব্যাপার হলো, মানুষের ভালোবাসা। মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত আমি। দেশের মানুষ আমাকে সম্মান করে ভালোবাসে, আর ক্ষোভ আমার নেই।

 

অনুলিখক : সামিয়া রহমান ও নওশীন জাহান ইতি

সর্বশেষ খবর