নোবেল পুরস্কার জয়ী ক্যারিবীয় কবি ও নাট্যকার ডেরেক ওয়ালকট আর নেই। দীর্ঘ অসুস্থতার পর সেন্ট লুসিয়া দ্বীপের নিজ বাড়িতে ১৭ মার্চ শুক্রবার ৮৭ বছর বয়সে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। মহান এই লেখকের জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৯৩০ ক্যাস্ট্রিজ, সেন্ট লুসিয়ায়। ১৯৯২ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯০ সালে হোমারীয় মহাকাব্য ওমেরজ নিয়ে কাজ করেন যা তার গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে বিবেচিত। দি ওয়াশিংটন পোস্ট বইটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে এবং দ্য নিউইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউ থেকে ১৯৯০ সালের সেরা বইরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
কবি ডেরেক ওয়ালকট একজন মৌলিক বহুমাত্রিক কবি, যার কবিতা নির্মাণের কৌশল এবং অপার নান্দনিক সৌকর্য আমাদের টেনে নিয়ে যায় অন্য এক ভালো লাগার জগতে। তিনি জীবন ও শিল্পের আন্তরসম্পর্কের মৌল দিগন্তের সন্ধান পেয়েছিলেন তার কৈশোর বয়সে। জীবনকে তিনি কতভাবেই না চেনেন! এই চিনতে পারার ক্ষমতা সব শিল্পীর সমান থাকে না। বড়মাপের শিল্পী হতে নিজের ভিতরের অর্জন থাকতে হয়। সমুদ্রের মতো স্বপ্ন থাকতে হয়। ডেরেক ওয়ালকটের চোখ দুটো ছিল বিস্তীর্ণ সমুদ্রের মতো অতলান্তিক। একজন শিল্পী যেসব গুণের কারণে স্পর্শ করেন আকাশের নীল কিংবা চারপাশের অনন্ত তিমির, সেসব গুণের অধিকারী ওয়ালকটের কবিতায় দেখা যায় বিশ্ববিক্ষণের বহুবর্ণিল গুঞ্জন। সময় ও শব্দ কখনো-কখনো এক হয়ে জেগে ওঠে তার কবিতা কিংবা নাটকে। তার সম্পর্কে রবার্ট গ্রেভস লিখেছিলেন যে, কাছাকাছি ও নিবিড়ভাবে কাব্যকে ইংরেজি ভাষায় বুঝতে কেউ অসমর্থ হলে সমসাময়িককালে একমাত্র তিনিই এর অভ্যন্তরীণ মাহাত্ম্য বুঝতে সক্ষম। ২০১১ সালে ‘হুয়াইট ইগ্রেটস’ কাব্যগ্রন্থের জন্য টি. এস. ইলিয়ট পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
ডেরেক অলটন ওয়ালকট জন্মেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের একটি ছোট্ট দ্বীপ সেইন্ট লুসিয়ার ক্যাস্ট্রিজ শহরে, ১৯৩০ সালে। সেখানেই তার শৈশবকাল কাটে। তার এক যমজ ভাই ও পামেলা ওয়ালকট নামে এক বোন ছিল। পরিবারটি ছিল শঙ্কর গোত্রীয় এবং নৃবৈজ্ঞানিকভাবে ভিন্ন। তার দুই শ্বেতাঙ্গ দাদা এবং দুই কৃষ্ণাঙ্গ দাদী ছিল। তার মাও ছিল শিক্ষক। তার বাবা-মা দুজনই কবিতা ও শিল্পকলা ভালোবাসতেন। বাবা চিত্রকর ছিলেন ও কবিতা লিখতেন।ডেরেক ওয়ালকট ছাত্র জীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। বৃত্তিধারী হয়ে তিনি জ্যামাইকার কিংস্টনে অবস্থিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ১৯৫৩ সালে ওয়ালকট ত্রিনিদাদে ফিরে আসেন। ওই সময় পেশা হিসেবে সমালোচক, শিক্ষক এবং সাংবাদিক জীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৫৯ সালে ওয়ালকট ত্রিনিদাদ থিয়েটার ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা করেন। তরুণ ওয়ালকট হ্যারল্ড সিমন্স নামে এক পেশাদার চিত্রশিল্পীর কাছে ছবি আঁকার প্রশিক্ষণ নিয়ে চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। এমনকি ফরাসি চিত্রশিল্পী পল সেজান এবং গিওর্গিওনের শিল্পকর্ম থেকেও চিত্রকলায় ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। কৈশোর বয়সে তিনি কবি টিএস ইলিয়ট এবং এজরা পাউন্ডের কবিতায় তিনি প্রভাবিত হয়ে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত তার কাব্য সঙ্কলন ‘ইন এ গ্রিন নাইট : পয়েমস ১৯৪৮-১৯৬০’-এ তুলে ধরেন। এর ফলে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সংশ্লিষ্ট সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেন।
১৯৬২ সালে ‘ইন আ গ্রিন নাইট : পোয়েমস ১৯৪৮-১৯৬০’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলে কবি হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত লিখিত কবিতাগুলোই এই কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। ক্যারিবীয় ভূদৃশ্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে তার সৃজনী প্রতিভার মৌলিকত্ব দেখা যায়। ১৯৭০ সালে ‘ড্রিম অন মাঙ্কি মাউন্টেইন’ শিরোনামের নাটক রচনা করেন। পরবর্তীতে ওই বছরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি-টিভিতে তার নাটক প্রদর্শিত হয়। ১৯৭১ সালে বছরের সেরা নাটকরূপে এটি ওবি পুরস্কার জয় করে। ১৯৭২ সালে ওয়ালকট তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ওবিই পুরস্কার পায়।
১৯৯২ সালে প্রথম ক্যারিবীয় লেখক হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেন। নোবেল কমিটি পদক প্রদানের সময় ব্যক্ত করে যে, ‘তিনি কবিতাকে আলোকোজ্জ্বল, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণে বিবৃত করেছেন, বহুসংস্কৃতিকে মেলে ধরেছেন।’ ওয়ালকটের সবচেয়ে প্রশংসিত এপিকধর্মী কবিতা ‘Omeros’ (১৯৯০)। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির প্রাক্কালে সুইডিশ একাডেমি উল্লেখ করেছিল, এটি মূলত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ইতিহাসের মধ্যে পরিভ্রমণ, একধরনের তীর্থযাত্রা। হোমারের ওডেসির সমান্তরালে ক্ল্যাসিক্যাল চরিত্র একিলিস, হেলেন এবং হেক্টরের বিপরীতে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান জেলে, বেশ্যা এবং জমিদারদের চরিত্র হিসেবে এনেছেন। ওয়ালকট মূলত সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আবিস্কারে ব্রতী হয়েছেন এখানে এবং বর্তমান ক্যারিবীয় জনগণের আইডেন্টিটিতে এদের কতখানি প্রভাব রয়েছে তা সন্ধান করেছেন। ২০০৯ সালে তিন বছর মেয়াদে অ্যালবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোশিফ লাভ করেন। ২০১০ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত হন। ক্যারিবীয় অঞ্চলের অন্যতম সেরা কবি ওয়ালকটের রচনার মধ্যে ‘ইন আ গ্রিন নাইট : পোয়েমস ১৯৪৮-১৯৬০’ এবং তার মহাকাব্য ‘ওমেরস’ উল্লেখযোগ্য।
সদ্য প্রয়াত এই কবিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সেন্ট লুসিয়ার কালচারাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন বলেছে, বিশ্ব সাহিত্যে একজন পুরোধা ব্যক্তিত্বকে হারাল। এই দ্বীপের সাহিত্য, সংস্কৃৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা এবং প্রসারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ।