শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা
ফেরদৌসী মজুমদার

দর্শক ছাড়া নাটক অকল্পনীয়

দর্শক ছাড়া নাটক অকল্পনীয়

ফেরদৌসী মজুমদার (জন্ম : ১৮ জুন ১৯৪৩) বাংলা নাটকের খ্যাতিমান অভিনেত্রী। মঞ্চ, টেলিভিশন ও বেতার নাটকে সমান সফলতার সঙ্গে অভিনয় করে আসছেন। তিনি দীর্ঘদিন আজিমপুর অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়, হলিক্রস কলেজ, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন; বর্তমানে থিয়েটার স্কুল, সানবিম স্কুলে শিক্ষকতা করেন। অভিনয়ের জন্য তিনি একুশে পদক (১৯৯৮), ভারতে উইলিয়াম কেরি পদকসহ (১৯৯৮) একাধিক সম্মাননা লাভ করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন—শেখ মেহেদী হাসান

 

 

 

আপনার বাবা একটু রক্ষণশীল ছিলেন। সন্তানদের কড়া শাসনে রাখতেন তিনি। কেমন ছিল আপনার শৈশব-কৈশোর?

আমাদের পরিবার অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিল। আমার বাবার নাম আবদুল হালিম চৌধুরী। তিনি ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি কথা বলতেন নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায়। লেখাপড়া আর নামাজ পড়া ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। আমরা চৌদ্দ ভাই-বোনের লেখাপড়া ছাড়া কারও স্থান তার কাছে ছিল না। ভাইদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি পড়াশোনা করতে চাইতেন না। স্কুলে যাওয়ার পথে গাছের নিচে বই মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে থাকতেন এবং বিকালে বাড়ি ফিরতেন। বাবা তো বুঝতে পারতেন না, পরে দেখা গেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাসায় এসে হাজির। সব জেনে বাবা বললেন ওর কোনো ভরণ-পোষণ আমি দেব না। মা তো কান্নাকাটি শুরু করলেন। মা ছিলেন খুবই সরল মানুষ। বাবার প্রিয় মারের বস্তু ছিল জুতা। গালাগালি করতেন আর জুতা খুলে মারতেন। মনে পড়ে, আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমবর্ষের ছাত্রী, তখনো জুতার বাড়ি খেয়েছি। আর ওই যে বললাম আমার এক ভাইকে তিনি ভরণ-পোষণ করাবেন না বলেছেন, ওর নাম রুশো, আসল নাম শামসের চৌধুরী। আমার বড় আপার নাম ছিল নাদেরা বেগম, তিনি থাকতেন করাচি। তিনি বললেন যে, আমি রুশোকে নিয়ে যাই। নিয়ে গেলেন, সেখানেই রুশো এমএ পাস করল, তারপর বিয়ে করল।

বাবা আমাদের স্কুলের পড়া সব পরীক্ষা করতেন। এবং তার কাছে আমাদের পড়া দিতে হতো। সব বিষয়ের ওপরই তিনি পরীক্ষা নিতেন। বলতেন—গড়গড় করে পড়ে গেলে হবে না, আবার পড়ার মধ্যে চার-পাঁচবার দম নিলেও হবে না। তিনি দমের ওপর পরীক্ষা নিতেন। ১-২-৩ গুনতে বলতেন, কে কত পর্যন্ত স্পষ্টভাবে বলতে পারে তার জন্য নম্ব্বর দিতেন। আমার মনে হয় আমার সংলাপে স্পষ্টতা, দ্রুততা এসে গেছে ওখান থেকেই। ভাই-বোনদের দশ জন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, ফার্স্ট ইয়ারে, মুনীর ভাই (শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী) তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক। মানিক ভাই (জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী) বোধহয় তখন বরিশাল বি.এম কলেজে। কবীর ভাইয়ের চেয়ে মুনীর ভাইকে আমরা কাছে পেয়েছি বেশি। কারণ, কবীর ভাই চাকরিসূত্রেই বাইরে বাইরে থেকেছেন। মুনীর ভাইয়ের হাঁটা, চলা, কাপড় পরা, কথা বলা... সব কিছুই ছিল অনুকরণীয়। তার ভাষাটা ছিল উচ্চমার্গীয়, শব্দচয়ন, শব্দ প্রয়োগ এগুলো আমাদের মুগ্ধ করত।

 

অভিনয় করাটা শিখলেন কীভাবে?

বাবার কাছ থেকে। আমার ধারণা বাবা অনেক কিছুই অ্যাক্টিং করতেন। মাঝেমাঝে এমন ভাব নিতেন যেন তিনি ভীষণ রেগে গেছেন। আমরা সেটা পরে বুঝতাম। তাই বলছি যে, আমার অ্যাক্টিংয়ের ব্যাপারটি আসলে ওই ঘটনা থেকে আসতে পারে। আমার সব সময় মনে পড়ে যে, কোনো কারণে মা কষ্ট পেয়েছেন আর লম্ব্বা ঘোমটা টেনে নীরবে কাঁদছেন। কোনো শব্দ নেই। কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে যেত তারপরও কোনো শব্দ নেই। আমরা ভাই-বোন সবাই ব্যাপারটা এনজয় করতাম। আমাদের চৌদ্দজনের মধ্যে আট ভাই ছয় বোন। ভাইদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল, যেগুলো আমাদের মুগ্ধ করত। যেমন জহুর ভাইয়ের সাহস, মুনীর ভাইয়ের রসবোধ, মানিক ভাইয়ের নিয়মানুবর্তিতা। মানিক ভাই কিন্তু একেবারে ছোটবেলা থেকেই খুব গোছালো ছিলেন।

নাটকে অভিনয় করলেন কখন?

আমি তখন ইডেন কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ি, মুনীর ভাই আমাকে বললেন, ‘তোকে অভিনয় করতে হবে।’ আমি অভিনয় শব্দটাই ভালো করে জানি না। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম, কী, কিসের অভিনয়, কী সেটা? মুনীর ভাই বললেন, ‘আরে গাধা, অত বুঝতে হবে না তোকে, অ্যাক্টিং করবি, ওই যে অভিনয়, অভিনয়। তুই তো সবাইকে নকল করে আমাদের দেখাস... সেটাই করবি।’ মানে হলো আমার আবার ছোটবেলা থেকেই একটা ঝোঁক ছিল বাসায় যে আসত তার কিছু না কিছু নকল করতাম। এমনকি আমাদের বাসারও সবার কিছু না কিছু নকল করতে পারতাম। বাবা কীভাবে বকা দেন, কীভাবে মারেন... এসব আর কি! মুনীর ভাইয়ের প্রস্তাবে একটি নাটকে রোবটের চরিত্রে অভিনয় করি। শওকত ওসমানের লেখা নাটকটির নাম ‘ডাক্তার আব্দুল্লার কারখানা’। মঞ্চস্থ হয়েছিল ইকবাল হলে যা এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হলাম ১৯৬১ সালে। ভর্তির পর ‘দণ্ড ও দণ্ডধর’ নাটকে অভিনয় করি আমার শিক্ষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের বিপরীতে। নাটকটি মঞ্চস্থ হয় পাবলিক লাইব্রেরিতে। তারপর ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠী থেকে মুনীর ভাইরা একটি নাটক করলেন। তিনি চোরের অভিনয় করছেন, সবাই বলছে অসাধারণ! কিন্তু আমার আবার নিজের ভাই তো অতটা মনে করতাম না। আবার সবাই যখন বলছে তখন ভাবলাম তার ‘কবর’ নাটকটা পড়ি। পড়ে তো ভয় লাগল যে, কবর থেকে উঠে আসছে—মানে এভাবে নাটক হয়! পরে ফাইনাল ইয়ারে গিয়ে বুঝলাম যে এটা কী মানের নাটক! আমি পরিবারের কোনো সমর্থন পাইনি। কারণ বাবা অসম্ভব রাগী ছিলেন। তিনি এসব পছন্দ করতেন না। ভাইরা নাটক করতেন তাকে লুকিয়ে।

 

টেলিভিশনে প্রচারিত প্রথম নাটকে আপনি অভিনয় করেছিলেন, কেমন ছিল সে অভিজ্ঞতা?

১৯৬৪-তে যখন টেলিভিশন চালু হলো তখন প্রথম নাটকেই আমি অভিনয় করেছিলাম। মুনীর চৌধুরীর ‘একতলা দোতলা’। শিল্পী কলিম শরাফী ছিলেন টেলিভিশনের অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ। তিনিই যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি মুনীর ভাইকে বলেছিলেন যে—আপনি তো নাটক লিখেন, নাটক করেন, আপনি ইউনিভার্সিটির ছেলে-মেয়ে নিয়েই এখানে কাজ করুন। আমাদের বাসায় তখন টেলিভিশন ছিল না। তবে পরে বাবা ব্যাপারটি জেনেছিলেন। আমার স্বামী (রামেন্দু মজুমদার) ছিলেন তখন হিরো। আমাদের তখন বিয়ে হয়নি। এক মাস মহড়া হয়েছিল। আজকাল মঞ্চনাটকেও অতদিন রিহার্সাল হয় না। টেলিভিশনে তো হয়ই না। কিন্তু আমি মনে করি মহড়ার কোনো বিকল্প নেই। যত মহড়া হবে ততই অভিনয় শুদ্ধতা লাভ করে। ‘একতলা দোতলা’ নাটকের প্রযোজক ছিলেন মুনিরুল আলম। এরপর তো ‘বরফ গলা নদী’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘এখনো ক্রীতদাস’সহ বহু নাটকে অভিনয় করেছি। ‘সংশপ্তক’ নাটকের হুরমতি চরিত্রটি আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।

 

কর্মজীবনে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিলেন কেন?

আমাদের পরিবারে অনেকেই শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল। শিক্ষকতা আমার ভালো লাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় (১৯৬৫) ও আরবিতে (১৯৬৭) এমএ পাস করে ১৯৬৭ সালে আজিমপুর অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। ১৯৭১ সালে দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ফেলো হিসেবে কাজ করেছি। স্বাধীনতার পর হলিক্রস কলেজের প্রভাষক, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক (১৯৮১-২০০০), থিয়েটার স্কুল ও সানবিম স্কুলে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম।

 

আপনারা বিয়ের পর তো করাচি চলে গিয়েছিলেন।

আমাদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৭০ সালে। বিয়ের একমাস পরেই আমার বাবা মারা গেলেন। তারপর আমরা করাচি চলে যাই, যেন কেউ কোনো কিছু না বলতে পারে। করাচি টিভিতে একটা অনুষ্ঠান হতো, বাংলা শিক্ষার আসর... নওয়াজেশ আলী খান প্রযোজনা করতেন, সেখানে আমরা কয়েকটা অনুষ্ঠান করেছিলাম। আর কেবল একটা মঞ্চনাটক করেছিলাম—‘জমা খরচ ইজা’ প্রয়াত মুজিবর রহমান খান ছিলেন নাটকটির নির্দেশক।

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় তো কলকাতায় ছিলেন?

৯ মার্চ ১৯৭১ করাচি থেকে ঢাকায় এলাম আমরা। তখন চারদিকে প্রবল উত্তেজনা। কিন্তু আমি কখনোই ভাবতে পারিনি এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে দেশে। ২৫ মার্চ রাতে যখন ভীষণ রকম শব্দ হচ্ছে তখন আমি ভেবেছি এটা বাজির শব্দ, কোথাও বিয়ে-টিয়ে হচ্ছে বুঝি। এটা যে এমন ভয়াবহ সেটা আমার ধারণারই বাইরে ছিল। আমরা সবাই জেগে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছি, দেখি আশপাশের সব বাড়ির ছাদেই মানুষ। এবং চারদিকে কেবল আগুনের গোলা। কী ভয়ঙ্কর! তারপর তো সবই শুনলাম, দেখলাম। মার্চ, এপ্রিল, মে একেকটা রাত যায় আর বুঝতে পারি যে, বেঁচে আছি। বাসার সবাই চিন্তিত। হ্যাঁ, রামেন্দু যেতে চায়নি। বাসার সবাই ইনসিকিউড ফিল করছিল। তা ছাড়া বিয়ের পর ওর বাবা-মার সঙ্গেও দেখা হয়নি। তাই জোর করেই ওকে নিয়ে গেলাম। মা, তার বোরখা, ৯০০ টাকা আর ছ’টা চুড়ি দিলেন। খুব ভোরে আমরা রওনা হয়েছিলাম। পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কিছু কবিতা আবৃত্তি করেছি। তারপর আমি দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ফেলোশিপ পেলাম। সেখানে এক ফ্রেঞ্চ ভদ্রলোক ছিলেন যিনি মুনীর ভাইয়ের বেশ পরিচিত, আমাদের বাসায় আসতেনও, তিনিই সাহায্য করেছিলেন ফেলোশিপের ব্যাপারে। দিল্লিতে তার বাসায় থাকতাম।

 

মঞ্চে নিয়মিত নাটক করলেন কবে থেকে?

মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় শুরু করি থিয়েটারের প্রযোজনা ‘সুবচন নির্বাসনে’-এর মাধ্যমে। নাটকটি আব্দুল্লাহ আল মামুনের লেখা ও নিদের্শনায় মঞ্চস্থ হয়। তখন মঞ্চে নারী অভিনেত্রী তেমন কেউ ছিল না। আমি যে এসেছি তাতেই অনেকের চক্ষু চড়কগাছ। তারপর থেকে আজও মঞ্চে অভিনয় করছি।

 

পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

এই প্রথম বোধহয় একটি চরিত্র পেলাম যেটিকে কিছুতেই দাঁড় করাতে পারছিলাম না। কাব্যনাটক তো আগে করিনি, পড়িওনি। ছন্দ মেলাতে গিয়ে ছড়া বলার মতো হয়ে যাচ্ছিল। আমি এই প্রথমবারের মতো মামুন ভাইকে বললাম যে—আমাকে ছেড়ে দিন, আমি পারব না। অন্য কাউকে দিয়ে করান। মামুন ভাই বললেন—‘আপনার কী মনে হয়, আপনি পারবেন না আর অন্য কেউ পারবে?’ তিনি রেগে বললেন—‘পারছেন না, কিন্তু পারতে হবে। ছন্দ ভুলে যান, সংলাপ মনে করে পড়ুন।’ পরে বাসায় এসে আবার শুরু করলাম, আস্তে আস্তে মজা পেয়ে গেলাম।              

 

ওথেলো নাটকে আপনার অভিনয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

আমরা দেশের আবদুল্লাহ আল মামুনের নাটক করেছি, রবীন্দ্রনাথ, সৈয়দ শামসুল হকের নাটক করেছি। তারপরই ধরলাম ‘ওথেলো’। এই নাটকে প্রথমে আমি এমিলিয়া করেছি, ডেসডিমোনা করেছিল তারানা হালিম। পরে সে পরীক্ষা সংক্রান্ত কারণে আর করতে পারেনি, আমি ডেসডিমোনা করেছি। যেহেতু এটা অন্য পটভূমি, অন্য সমাজ নিয়ে লেখা। পোশাক থেকে শুরু করে সবই অন্যরকম। আমার সংলাপ নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না। চিন্তায় পড়লাম ‘ওথেলো’ নাটকের ড্রেস নিয়ে। ম্যাট্রিক পাসের পর থেকে আমি শাড়ি পরি কিন্তু ‘ওথেলো’ নাটকের ড্রেস আমি কীভাবে পরব! বা আমাকে মানাবে কিনা। বরাবরই তো আমার বাঙালি চেহারা। তো পরে দেখা গেল তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি।

 

কোকিলারা স্ক্রিপ্টটা কীভাবে পেলেন?

একদিন মামুন ভাই আমাকে বললেন যে—‘আপনি দুই ঘণ্টা স্টেজে থাকতে পারবেন?’ আমি বললাম—কেন? বললেন যে—‘না আমি একটা নাটক লিখব, আপনাকে একা করতে হবে, কিন্তু চরিত্র অনেক।’ আমি বললাম লেখেন। আমি ভাবতে পারিনি যে, তিনি লিখে ফেলবেন। লিখে যখন পড়ে শোনালেন, আমি বললাম—এটাতো অসম্ভব। তিনটি এপিসোড দুই ঘণ্টা স্টেজে থাকতে হবে, এটা কীভাবে সম্ভব! তিনি বললেন—‘আপনাকে পারতে হবে, আপনি না পারলে কে পারবে? যতদিন লাগুক পারতে হবে।’ ব্যস, তারপর শুরু হলো স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করা। বাসার কাজের লোকজন তো ভাবতো আমি পাগল হয়ে গেছি। তা না হলে সারাক্ষণ বিড়বিড় করব কেন? তারপর নাটকটি এক সময় মঞ্চে এলো। সবাই-তো ভালোই বলল, কলকাতাতেও ভালো রিভিউ হয়েছিল। অসাধারণ! আমার এখনো একা অভিনয় করতে ইচ্ছা করে। জার্মান নাটক অনুসরণে মামুন ভাইয়ের একটা অসাধারণ স্ক্রিপ্ট, এটাতে কোনো সংলাপ ছিল না। আমাকে মুভমেন্ট মুখস্থ করতে হতো। মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে একেকটা মুহূর্ত তৈরি করা... খুব কঠিন কাজ। শেষটাতে মেয়েটা আত্মহত্যা করে। আমাদের কেউ কেউ বলেছিল যে—শেষটা কিন্তু আশাব্যঞ্জক হলো না। এতে করে আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়তে পারে। চার-পাঁচটা শো-এর পর আমরা আলাপ করে ঠিক করলাম... নাটকের শেষে বাউ করে আমি বলে দিতাম—জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া কিন্তু সমাধান না, মৃত্যু কোনো সমাধান না। কোকিলারা। ঢাকার মঞ্চে আলোচিত একক নাটক। আবদুল্লাহ আল মামুনের রচনা ও নির্দেশনায় নাটকটির প্রায় ৭৮টি প্রদর্শনী হয়েছে।

 

মেরাজ ফকিরের মা’—নাটকে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

এটা আসলে মামুন ভাই লিখেছিলেন অন্য একটি সংগঠনের জন্য। তো সেই সংগঠন চাইল যে, মেরাজ ফকিরের মা যেহেতু হিন্দু, এই ইস্যুটা বাদ দিতে। মামুন ভাই রাজি হলেন না, কারণ, এটা বাদ দিলে তো আর নাটক থাকে না। পরে আমাকে পড়তে দিলেন। আমি আবার নাটক পড়ার আগে পাতা উল্টিয়ে দেখি যে আমার কোনো চরিত্র আছে কিনা। পড়ে তো আমি খুবই ইমপ্রেসড। বললাম এই নাটক কাউকে দেওয়া যাবে না। আমরাই করব। দর্শকও কিন্তু এই নাটকটা ভালোভাবে নিয়েছিল।

 

আপনি অভিনয় করতে গিয়ে দর্শকের কথা কতটুকু মাথায় রাখেন?

নাটক ও দর্শক অবিচ্ছেদ্য। দর্শক ছাড়া নাটক অকল্পনীয়। যে কোনো অভিনেতা অভিনেত্রীর মাথায়, তার অবচেতন মনে দর্শকের একটা বিরাট ভূমিকা থাকে। দর্শকের জন্যই তো আমি অভিনয় করি। তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্যই আমার আপ্রাণ চেষ্টা থাকে।

 

নাটকের দল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে আপনি যুক্ত আছেন। থিয়েটারের অধিকাংশ নাটকে আপনি অভিনয় করেছেন।

১৯৭২ সালে ‘থিয়েটার’ গঠন করা হয়। কবীর ভাই, আবদুল্লাহ আল মামুন, রামেন্দু মজুমদারসহ আমরা অনেকেই এর সঙ্গে যুক্ত। থিয়েটার প্রযোজিত প্রায় ৩০টি নাটকের ১১০০-রও বেশি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাটক ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘এখনো ক্রীতদাস’, ‘মেরাজ ফকিরের মা’, ‘কোকিলারা’, ‘দুই বোন’, ‘একা’, ‘চিঠি’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘তাহারা তখন’, ‘মেহেরজান আরেকবার’, ‘ওথেলো’ ইত্যাদি নাটকে অভিনয় করেছি। দেশের বাইরে দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা, দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি, অস্ট্রেলিয়া, সিংগাপুর প্রভৃতি স্থানে অভিনয় করেছি।

 

 প্রায় পাঁচ দশক আপনি অভিনয় করছেন, কোন চরিত্রটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে?

থিয়েটার নাট্যদলের ‘একা’ নামে একটি নাটক প্রযোজনা করেছিল। নাটকটি ছিল সংলাপহীন। ওই নাটকটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে।

 

আপনাকে ধন্যবাদ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর