শুক্রবার, ৫ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে ভূমিকা রাখছে নারী

শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে ভূমিকা রাখছে নারী

ছবি : রোহেত রাজীব

বাংলাদেশের কৃতী সমাজ ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাঞ্জেলা গোমেজ। জন্ম : ১৬ জুলাই ১৯৫২। গ্রামীণ ও অসহায় নারীর কর্মসংস্থান, নারীর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। ‘বাঁচতে শেখা’ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নারী উন্নয়নে

অবদান রাখায় তিনি র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, ডা. এম আর খান ও আনোয়ারা ট্রাস্ট স্বর্ণপদক, বেগম রোকেয়া পদক ও বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্মাননা লাভ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন— শেখ মেহেদী হাসান

 

 

আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে গাজীপুর। কেমন ছিল সে সময়?

আমার জন্ম কালীগঞ্জ থানার নাগরী ইউনিয়নের নিভৃত মাল্লা গ্রামে। ৯ ভাইবোনের মধ্যে আমি সপ্তম। বাবা অগাস্টিন গোমেজ এবং মার নাম ইসাবেলা। দাদা (ঠাকুরদা) ভিনসেন্ট গোমেজের পূর্ব-পুরুষের কারও নাম আমি জানি না। শৈশবে সবাই আমাকে ‘টারজান’ বলে ডাকত। আমি একটু দুরন্ত প্রকৃতির ছিলাম। আমাদের কাঁচা ঘর, বাঁশের বেড়া, ছোট্ট একটি নিকানো উঠানে ছিল স্বর্গের শান্তি। সন্ধ্যা রাতে মা উঠানে বসে পিঠা বানাতেন। ফিলিস পিঠা, বিবিখানা পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা। আমরা উঠানে খেলা করতাম। মায়ের হাতে তৈরি সেই পিঠার স্বাদ স্বর্গের ফলের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। মায়ের দুটি গাভী ছিল, বুধি আর মঙ্গলা। মা প্রতিদিন গাভী দুটির জন্য ঘাস কেটে আনতেন। খুব আদর করতেন। মাল্লা গ্রামের শৈশবকাল লতাপাতায় ধূলিকণায় মায়া-মমতায় জড়িয়ে রয়েছে। শৈশবের সেই স্মৃতি আমাকে আজো আবেগতাড়িত করে।

 

আপনার জীবন বেশ সংগ্রামমুখর। একাধিক মিশনে আপনি পড়াশোনা করেছেন। সে অভিজ্ঞতা জানতে চাই?

পড়াশোর হাতেখড়ি হয় আমার মায়ের কাছে। মা আমাকে স্বরে অ-স্বরে আ পড়তে শিখিয়েছেন। ‘আদর্শলিপি’ হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। অক্ষর চিনতে শিখলে বাবা অগাস্টিন গোমেজ বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে মঠবাড়ী মিশন স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। এই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক আলফ্রেড, অ্যারোন মাস্টার, শিক্ষিকা আরজিনা আমাকে ভীষণ আদর করতেন। এরপর ঢাকা হলিক্রস কলেজের টিচার্স ট্রেনিংয়ের শর্ট কোর্সে ভর্তি হই। প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে মঠবাড়ী মিশন স্কুলে পুনরায় শিক্ষকতা শুরু করি। এরই মধ্যে মাদার পিরিনা বদলি হয়ে যশোর চলে গেলে আমি খুব নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। তখন মাদারকে একটি চিঠি লিখেছিলাম। মাদার আমাকে যশোর চলে আসতে বলেন।

যশোর চলে আসার পর মাদার পিরিনা সেক্রেট হার্ট স্কুলের বোর্ডিংয়ে আমার থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। ওই সময় আমি কেবল অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়েছি। মাদার আমাকে সেক্রেট হার্ট স্কুলের অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। সেখানে কেজি ও নার্সারির বাচ্চাদের পড়াতাম। সারা দিন ক্লাস নিয়ে রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে গোপনে পড়াশোনা করতাম। এরপর যশোর শহরের সেবাসংঘ স্কুলে ভর্তি হই এবং ওই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করি। তারপর যশোর মহিলা কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে এইচএসসি এবং ১৯৭৪ সালে বিএ পাস করি। পড়াশোনার খরচ চালাতে আমাকে অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়েছে। সেই সংগ্রাম আর কষ্টের দিনগুলো ভোলার নয়।

আপনি এক সময় শিক্ষকতা করতেন, পরে যোগ দিলেন সমাজসেবা এবং নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে। এ ধরনের উদ্যোগ নিলেন কেন?

মাত্র ১২ বছর বয়সে আমি শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত হই। আমি তখন গাজীপুরের মঠবাড়ী মিশন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। ফাদার বার্কম্যান আমাকে একই স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ করলেন। বেতন মাসে ১০ টাকা। আমার দায়িত্ব ছিল শিশুদের পড়ানো। অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমি যশোর সেক্রেট হার্ট মিশন স্কুলে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করি। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা পেশায় ছিলাম। এই সময় আমি বেশকিছু গ্রাম ঘুরেছি। অবহেলিত-বঞ্চিত নারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। লেখাপড়া শেষে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে নারীদের বাঁচতে শেখানোর জন্য কাজ শুরু করি। আমাদের সমাজে নারীরা নানাভাবে পিছিয়ে আছে। তারা অত্যাচারিত, অধিকার বঞ্চিত, ক্ষমতাহীন। এ কারণে আমি কাজ করছি, যাতে নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। তাদের যোগ্যতা ও আত্মবিশ্বাসকে জাগিয়ে তুলতে চাই। এজন্য আমি নিবিড়ভাবে কাজ করছি।

 

যশোরে ‘বাঁচতে শেখা’ নামে এ প্রতিষ্ঠানটি কবে চালু করলেন? এর উদ্দেশ্য কী ছিল?

বাঁচতে শেখা শুরু করি ১৯৮১ সালে। সমাজকল্যাণ অফিস থেকে নিবন্ধন নিয়ে যশোর শহরের পুরনো কসবা এলাকার ফাতেমা হাসপাতালের সামনে ঘর ভাড়া নিয়ে অস্থায়ী কার্যালয়ে এর শুরু। আমরা শুরু থেকেই গ্রামীণ নারীদের নিয়ে কাজ করি। প্রথমে নারীদের দিয়ে হস্তশিল্পের কাজ চালু করি। হস্তশিল্পের মানোন্নয়নের জন্য কাশিমপুর, পাগলাদহ, নূরপুর, খোলাডাঙায় কিছু ঘর তৈরি করে গ্রামের শত শত নারীকে এ কাজে সম্পৃক্ত করি। তারপর তাদের শিক্ষা, মানবাধিকার, নারী-স্বার্থ, স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ব্যাপক কর্মসূচি নিই। হাজামজা পুকুরে মাছ চাষ, কৃষি কাজ করার জন্য সীমিত পরিসরে ক্ষুদ্রঋণ দেই। ১৯৮৫ সালে ভাড়া বাড়ি থেকে আমাকে বিতাড়িত হতে হয়। ১৯৮৬ সালে আরবপুর এলাকায় স্বল্পমূল্যে (বতর্মানে বাঁচতে শেখার প্রধান কার্যালয়) ১৭ বিঘা জমিসহ একটি পরিত্যক্ত ভবন কিস্তিতে কিনে ফেলি। আমরা জঙ্গলাকীর্ণ জমি পরিষ্কার করে কৃষি কাজ শুরু করি। পুকুর সংস্কার করে মাছ ছাড়ি। হস্তশিল্প, আচার তৈরি, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের খামার চালু করি। এ প্রকল্পগুলো আমাদের কিছুটা সফলতা এনে দেয়। আমরা নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছি। তাদের প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছি। গ্রামে গ্রামে কমিটি করে নারী নির্যাতন বিষয়ক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র তৈরি করেছি। এখন গ্রামের নারীরা কথা বলতে পারছে, বিচার পাচ্ছে। নিজেদের সংসারে দুঃখ-কষ্ট স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করছে। তারা শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়তে ভূমিকা রাখছে। আমি বিশ্বাস করি, মানুষের ভালোবাসা বাঁচতে শেখার সবচেয়ে বড় শক্তি।

 

আপনারা কোনো বিদেশি অর্থ সহায়তা পেয়েছিলেন?

১৯৮৭-৮৮ সালে নরওয়ে দূতাবাসের কূটনীতিক এলিজাবেথ আই ‘বাঁচতে শেখা’র ভাঙ্গাবাড়ী পরিদর্শনে আসেন। এরপর দূতাবাসের  আরেকজন কর্মকর্তা রগ রনভেট এসে আমাদের কাজ দেখে প্রশংসা করেন। রগ রনভেট আমাকে ঢাকায় নরওয়ে দূতাবাসে আমন্ত্রণ জানালেন।

তার সঙ্গে আমরা যোগযোগ করলাম। এক পর্যায়ে তিনি বাঁচতে শেখার অবকাঠামো তৈরির জন্য বাজেট দিতে বললেন। আমরা তাকে একটি বাজেট দেই আর সেই সূত্র ধরে ১৯৯২ সালে নরওয়ে দূতাবাসের আর্থিক সহায়তায় ‘বাঁচতে শেখা’র প্রধান কার্যালয় নির্মাণ করা হয়। অফিস, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ক্যাফেটেরিয়া, শ্রেণিকক্ষ, ১০০ জন প্রশিক্ষণার্থী থাকার জন্য আবাসিক ব্যবস্থা, লাইব্রেরি ইত্যাদি গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে আমাদের প্রতিষ্ঠানে ১০ লাখ উপকারী ভোগীর জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। আমরা চাই নারীরা আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচুক।

আপনারা কোন ধরনের প্রকল্প পরিচালনা করেন?

আগেই বলেছি ‘বাঁচতে শেখা’র মাধ্যমে আমরা গ্রামীণ অসহায় নির্যাতিত গরিব মহিলাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছি। আমাদের প্রকল্পসমূহের মধ্যে রয়েছে বয়স্ক নারীদের শিক্ষা, সুযোগবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের শিক্ষা। বয়স্ক নারী শিক্ষা তিন বছর মেয়াদি কর্মসূচির আওতায় একজন নারী বাংলা পড়া, লেখা ও হিসাব করতে শেখানো হয়। গরীব অসহায় ও নানা কারণে ঝরেপড়া শিশুকিশোরদের ‘কিশোর শিক্ষা’ কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত চার লাখের বেশি প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছে। ‘বাঁচতে শেখা’র একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরিচর্যা’। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ লাখের অধিক নারী পুষ্টিজ্ঞান, গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব, প্রসূতিসেবা নিয়েছে। মানবাধিকার প্রশিক্ষণের আওতায় ১০ লাখ মানুষ উপকৃত হয়েছে। গ্রামীণ নারীদের ভোট শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্যও ‘বাঁচতে শেখা’ কাজ করে। এ ছাড়া আমাদের হস্তশিল্প উন্নয়ন, মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু পালন, মৌ চাষ, রেশম চাষ ও ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প রয়েছে। এর বাইরে গ্রামীণ নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড  বাস্তবায়নের জন্য ‘বাঁচতে শেখা’ কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করে। বাস্তবভিত্তিক জ্ঞানার্জনের জন্য নানা ধরনের গবেষণা ও প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়।

 

‘বাঁচতে শেখা’ আজ বৃহত্তর পরিবার। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে আপনার কোনো সমস্যা হয় না?

‘বাঁচতে শেখা’ সংগঠনই আমার পরিবার, আমার স্বপ্ন। বাঁচতে শেখার কর্মী, উপকার ভোগীরাই আমার পরিবারের সদস্য। আমার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এখানেই কাটে। সংসার করেনি। কারণ বাঁচতে শেখার আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছি। আমাদের প্রধান কার্যালয় ক্যাম্পাসের একটি ঘরে আমি থাকি। সংগঠনের আর দশজনের সঙ্গে ‘বাঁঁচতে শেখা’র ক্যাফেটরিয়ায় তিন বেলা খাওয়া-দাওয়া করি। আমার বাবা ও মা মারা যাওয়ার পর বড়দিনে ভাইবোনদের সঙ্গে দেখা হয়। বড়দিনে গাজীপুরের মাল্লা গ্রামে যাই। সেখানে কয়েকদিন আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে সময় কাটাই।

 

অবসরে কী করেন?

প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কর্মব্যস্ত থাকি। কখনো আবেগতাড়িত হলে ‘বাঁচতে শেখা’র দরিদ্র, অসহায়, নির্যাতিত নারীদের সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করি। কখনো ক্যাম্পাসের প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্রের মেয়েদের সময় দেই।

 

আপনার কবিতার বই বেরিয়েছে?

সমাজে নারী অধিকার-ক্ষমতায়ন বিষয়ে কিছু কবিতা ও গান লিখেছি। ‘ছোটদের সহজভাবে বাঁচতে শেখা’, ‘বড়দের কাজ করে বাঁচতে শেখা’, ‘ছোটদের সহজভাবে বাঁচতে শেখা কবিতা গুচ্ছ’, ‘নারী জাগরণের গান কবিতা ও স্লোগান’, ‘সচেতনভাবে বাঁচতে শেখা’ ‘ছোট্টমণি’ নামে কিছু পুস্তিকা লিখেছি।

 

বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নের জন্য আর কী করতে চান?

আমার ইচ্ছা আছে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারকে আলোকিত করব। আমাদের যে রিসোর্স আছে তা কাজে লাগাব। র‌্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কারের সব টাকা আমি এক লাখ, দুই লাখ টাকা করে বিভিন্ন স্কুলে অনুদান দিয়েছি। আমার স্বপ্ন আছে সাহায্য-সহযোগিতা পেলে আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করব। আমি মনে করি, ওপেন রুরাল ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে গ্রামের নারীদের বাস্তবভিত্তিক কারিগরি শিক্ষা দেওয়া সম্ভব। এই শিক্ষার মাধ্যমে গ্রামীণ নারী সমাজ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। অন্যদেরও স্বাবলম্ব্বী হতে সহায়তা করবে। টেকনোলজি ট্রান্সফার হবে। ফলে গ্রামীণ নারীর উন্নয়ন ঘটবে, গ্রামের উন্নয়ন হবে, দেশের উন্নয়ন হবে।

আপনাকে ধন্যবাদ।

সর্বশেষ খবর