শুক্রবার, ৫ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

পাবনায় রবীন্দ্র সংবর্ধনা

এম. আবদুল আলীম

পাবনায় রবীন্দ্র সংবর্ধনা

১৯১৪ সালে পাবনার শীতলাই হাউসে উত্তরবঙ্গ সাহিত্য-সম্মিলনের আয়োজকদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পূর্ববঙ্গ তথা পাবনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য। জমিদারি দেখাশোনা (১৮৯০-১৮৯৭), কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন (১৯০৮), উত্তরবঙ্গ সাহিত্য-সম্মিলন (১৯১৪) প্রভৃতি উপলক্ষে তিনি অনেকবার পাবনায় এসেছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটিয়েছেন এখানকার নিভৃত পল্লীতে। পাবনার প্রকৃতি, মানুষ এবং পল্লী জীবনকে তিনি পরমাত্মীয় জ্ঞানে আপন করে নিয়েছিলেন। এজন্যই বোধ করি গাড়ি গাড়ি ইট কিনে পাবনায় বাড়ি করার বাসনার কথা একটি ছড়ার মধ্যে ব্যক্ত করে লিখেছিলেন— ‘পাবনায় বাড়ি হবে গাড়ি গাড়ি ইট কিনি/রাঁধুনী মহল-তরে করোগেট-শীট কিনি।’

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির চার দেয়ালের বাইরে এসে পাবনার নির্মল প্রকৃতি, সাধারণ মানুষ এবং তাদের পারিপার্শিক জীবন তাঁকে মুগ্ধ করেছে। পদ্মায় নৌকা চালনারত নিরক্ষর মানুষদের কণ্ঠের গান : ‘যুবতী ক্যান বা কর মন ভারী/পাবনা থ্যাহা আন্যা দেব ট্যাহা দামের মোটরী।’—এর মধ্যে তিনি পাবনার পল্লী জীবনের রূপচ্ছবি বাঙ্ময় হয়ে উঠতে দেখেছেন। এখানকার মাটি ও মানুষের নিবিড় সান্নিধ্যে বসে তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ  এবং পত্রসাহিত্য।

১৯১৪ সালের ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি (রবিবার ও সোমবার) পাবনা শহরে দুই দিনব্যাপী ‘উত্তরবঙ্গ সাহিত্য-সম্মিলনে’র সপ্তম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী ও নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়ের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংবর্ধনা নিতে রাজি হয়েছিলেন। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্ত পাল লিখেছেন : ‘এই সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন আশুতোষ চৌধুরী ও মূল সভাপতি নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়—দুই বন্ধুর নির্বন্ধাতিশয্যে তাঁকে পাবনা যাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি দিতে হয়।’ নির্দিষ্ট তারিখে প্রমথ চৌধুরী ও মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ পদ্মা বোটে চড়ে পাবনা পৌঁছেন। পাবনায় এসে প্রথমেই তিনি শীতলাই জমিদার যোগেন্দ্রনাথ মৈত্রের বাড়ি ‘শীতলাই হাউসে’ আতিথ্য গ্রহণ করেন। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষেও কবি রাতযাপন করেন শীতলাই জমিদার বাড়িতেই।

সম্মেলন হয় বেলা দুটোয়, পাবনা ইনস্টিটিউশন চত্বরে। সভায় সভাপতিত্ব করেন নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়। এরপর একে একে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির অভিভাষণ, সভাপতি-নির্বাচন, সভাপতির ভাষণ ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতির ডানপাশে আসন গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে সভাপতির অনুমতিক্রমে ‘সুরাজ’ পত্রিকার সম্পাদক কিশোরী মোহন রায় রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষে আনন্দ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। অধ্যাপক পঞ্চানন নিয়োগী সে-প্রস্তাব সমর্থন করেন।

পাবনা সাহিত্য-সম্মিলনে সংবর্ধনার জবাবে রবীন্দ্রনাথ যে-ভাষণ পাঠ করেছিলেন তা ‘মানসী’ পত্রিকার বৈশাখ, ১৩২১ সংখ্যায় ছাপা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৪ (সোমবার) রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য অতিথি পাবনা কলেজের (বর্তমান সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ) নবনির্মিত ভবন পরিদর্শন করেন। উল্লেখ্য, সম্মিলনের কেন্দ্রস্থল পাবনা ইনস্টিটিউশনের একটি কক্ষে যাত্রা শুরু করেছিল আজকের সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ। এদিকে সাহিত্য-সম্মিলনের দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনের পর বেলা ২টায় সভা শুরু করে বিকাল ৫টায় শেষ করা হয়। ৫টার পরে উদ্যান-সম্মিলন ছিল বলে সভা দ্রুত শেষ করতে হয়েছিল। দুপুরের সভায় প্রবন্ধাদি পাঠের পর অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্য-সম্মিলন পরিচালনা বিষয়ে কিছু উপদেশ দিতে অনুরোধ করেন।

পাবনা সাহিত্য-সম্মিলনে সংবর্ধনা গ্রহণ শেষে ১৯১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে ফিরে যান এবং টমসনকে লেখেন : ‘I was dragged to Pabna to take part in a litetary conference. It is over now and I am allowed to come back to my retreat where I am hiding at present.’

পাবনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের নানা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি জমিদারি তদারকির জন্য ১৮৯০ সালে সর্বপ্রথম তৎকালীন পাবনা জেলার সাজাদপুরে আসেন এবং ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত নিয়মিত-অনিয়মিতভাবে সেখানে বসবাস করেন। এরপর ১৯০৮ সালে পাবনায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন। ১৯১৪ সালে পাবনায় অনুষ্ঠিত ‘উত্তরবঙ্গ সাহিত্য-সম্মিলনে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তা ছাড়া পাবনার হরিপুরের বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার-সূত্রে রবীন্দ্রনাথ বহু বার পাবনায় এসেছেন। তাঁর অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরা দেবীর বিয়ে হয়েছিল পাবনার ভূমিপূত্র প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে। প্রমথ চৌধুরীর অগ্রজ ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের বোন প্রতিভা দেবীর। পাবনার প্রকৃতি ও মানুষ তথা এখানকার পদ্মা, যমুনা, ইছামতি, বড়াল, হুরাসাগর, নাগর প্রভৃতি নদীর সঙ্গে তাঁর প্রাণের বন্ধন স্থাপতি হয়েছিল। সর্বোপরি পাবনায় রবীন্দ্র-সংবর্ধনা ছিল খুবই তাত্পর্যপূর্ণ ও স্মরণীয় ঘটনা। রবীন্দ্রস্মৃতি ধারণ করে পাবনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মহিমান্বিত হয়ে আছে।

সর্বশেষ খবর