আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে, আমাদের সমকালেই রামপ্রসাদ, লালন, গগন হরকরা, হাসন রাজা প্রমুখ পুণ্যশ্লোক প্রাতঃস্মরণীয়দের মতো একই ধারায় নিরন্তর সংগীত চর্চায় নিয়োজিত রয়েছেন নবনবোন্মেষ শালিনী প্রজ্ঞার অধিকারী সৃজনশীল সাবির আহমেদ চৌধুরী। আবহমান বাংলা ও বাঙালির সাংগীতিক স্রোতধারায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তদের মতো প্রতিভাধরদের পরে একজন সম্পন্ন গীতিকার হিসেবে সাবির আহমেদ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠা বাঙালি জীবনের চিরায়ত ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন বললেও বোধকরি কম বলা হয়।
আজ যখন দেখি সাবির সংগীত একটি বিশ্বজনীন প্রক্রিয়ায় মরমি জনের মরমে বেজে উঠছে সুললিত ছন্দঝংকারে, বাণীর ঐশ্বর্যে, তখন আমাদের বিস্ময়বোধ যাবতীয় আধ্যাত্মিকতাকে পর্যন্ত অতিক্রম করে এমন এক শিখরে নিয়ে যায়, যার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে বোধকরি একমাত্র সাবির সংগীতই।
চণ্ডীদাসের সেই অমর গীতি : ‘শুনহ মানুষ ভাই/ সবার উপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই’— এ বক্তব্যকে পর্যন্ত রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সাবিরের পাল্টা প্রশ্ন : ‘মানুষ তাহলে কার সৃষ্টি? বিশ্ব নিখিলের সেই মহান সৃষ্টিকর্তা যার অবস্থান, একত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, সার্বভৌমত্ব, এমনকি স্রষ্টার অস্তিত্বের কথাও চণ্ডীদাসের অনুভবে স্বীকৃতি লাভ করে নাই, যা সকল ধর্ম-বিশ্বাসীদের বিশ্বাসের পরিপন্থী এবং চরম নাস্তিকতার শামিল। চণ্ডীদাসের এই ভ্রান্ত ধারণা কোনোক্রমেই গ্রহণীয় নয়।’ সত্যিইতো এভাবে আমরা কোনোদিন চিন্তা করিনি যেখানে সাবির বলেন :সবার উপরে শ্রেষ্ঠ তুমি
জবাবদিহি করার নয়
বিচার ছাড়া করলে ক্ষমা
তাতে তোমার কি ক্ষতি হয়
দোষে গুণে আমরা মানুষ
তুমিই প্রভু মেহেরবান।
অন্যত্র তিনি বলেছেন :
সে ছাড়া আর বলরে সাবির
সত্তা আমার কই
রূপ অরূপে মিলে মিশে
এক হয়ে যে রই।
এ ছাড়াও বর্তমান কর্মকোলাহলমুখর মানুষের যান্ত্রিক জীবনে সাবির যে মরমি সংগীতের চর্চায় মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছেন, সেটা তার ভিতরের গূঢ় গোপনে তার রক্তের প্রবহমান ধারার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে বলেই হয়তো সম্ভব। না হলে কী করে তার মরমি কণ্ঠে ধ্বনিত হতে পারে :
আকাশ আমার ঘরের ছাউনি
পৃথিবী আমার ঘর
সারা দুনিয়ার সকল মানুষ
কেউ নয় মোর পর।
এই একটি ধ্রুবপদের মধ্যেই সাবির বেঁধে দিয়েছেন বিশ্বমানবতার মর্মবাণী, যা তার স্বর্ণপ্রসূ কলমে ঝরনাধারা হয়ে উঠেছে। গৃহী হয়েও একই সঙ্গে এরকম সাধক, গীতিরচক এবং সর্বোপরি সুরসাধক না হলে কী করে এমন ভাবরসপূর্ণ, মধুর ও চিত্তাকর্ষক আনন্দ-সেতু রচনা করে ভক্তিরসে আপ্লুত করতে পারেন গায়ক শ্রোতার সঙ্গে পাঠককেও।
সাবিরের এই সৃষ্টিধর্মিতার উন্মেষ ঘটেছে বিশ্বপ্রকৃতির প্রতি তার ঐকান্তিক ঔদার্য এবং ঐতিহ্য বোধ থেকে। সংগীতকে তিনি শুধু রাগ বৈভিন্ন্যেই নয়, ভক্তিবাদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন তাল-মাত্রা লয়ে আউল-বাউল ভাটিয়ালি লোকগীতি জারি সারি মুর্শিদী গজল প্রভৃতি ধারাকে তার স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত কাব্যমাধুর্যে এতই সমৃদ্ধ করে তুলেছেন যে, আজ অতীতের সব যুগন্ধর গীতি-স্রষ্টাদের নামের পাশে অনায়াসে সাবির সংগীত নিজস্ব ঘরানা সৃষ্টি করে নিতে সক্ষম হয়েছেন বললে অতিরঞ্জিত মনে হবে না।
তবে এত কিছুর পরও আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, বিদেশে নন্দিত বন্দিত হলেও এবং চিরন্তন হয়েও এমন একজন মৌলিক স্রষ্টাকে সে যোগ্য সম্মান আমরা জানাতে পারিনি। এটা কি বহুকথিত বাঙালি মনমানসিকতার কোপনস্বভাবজনিত প্রতিফলন কিনা জানা নেই। সাবির আহমেদ চৌধুরী সম্পর্কে কোনো কিছু বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় তার অনায়াসলব্ধ প্রাঞ্জল কাব্য প্রতিভা যার প্রতি ছত্রে রয়েছে কুল-মাখলুকাতের রূপরস গন্ধমাখা জল মাটি ও হাওয়া আর অকপট সারল্য। সহজিয়া ভাবধারায়, যা বাংলার হয়েও সর্বজনীন বহুজাতিক। অল্প কথার বাধুনিতে অনেক নিগূঢ় রহস্যের উন্মোচন। সাবির আহমেদ চৌধুরী বিশ্বমানবতার দীন সেবক বলেই হয়তো তার সহজ সরল প্রকাশভঙ্গিতে নেই কোনো বাগাড়ম্বর বা অযাচিত তত্ত্ব কথার ভড়ং।
যা বলছেন একেবারে সরাসরি। প্রবেশ করেছে হৃদয়াভ্যন্তরে।
মধ্যযুগে মুসলিম সংস্কৃতি-বিকাশে যেসব সুফি মরমি কবি আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাদের সাধনা ছিল অন্তরঙ্গ আর নিগূঢ় রহস্যাবৃত। সুফি সাধকরা ছিলেন স্রষ্টার প্রেমে মশগুল। যিনি অনন্ত সৌন্দর্য ও অশেষ কল্যাণগুণে সমাশ্রয়ী। স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টি প্রেম ও মিলন। জীবাত্মার ভিতর পরমাত্মার লয়। পারস্যের হাফিজ, রুমি, সাদীর কাব্যে এটাই অতি সহজেই উপলব্ধ হওয়ার মতো মর্মকথা। পরিদৃশ্যমান ব্রহ্মাণ্ড অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। সর্বভূতেই তিনি বিদ্যমান। সুতরাং এই মতাবলম্বীরা যাবতীয় বাহ্য ক্রিয়াকাণ্ড এবং আচার অনুষ্ঠানের সম্পূর্ণ বিরোধী। স্রষ্টার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্বন্ধ স্থাপনই এদের প্রধান লক্ষ্য। ফানাফিল্লাহ অর্থাৎ স্রষ্টার মধ্যে সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে যাওয়াটাই যাদের ধ্যান-জ্ঞান।
বাংলাদেশের বৈষ্ণব প্রেম-কবিতার সমৃদ্ধ মধুর ভাবের সঙ্গে এর আশ্চর্য সঙ্গতি দেখে অবাক মানা ছাড়া উপায় থাকে না।
দেশ-কাল-পাত্র ভেদে এই অপূর্ব সূচনার কোনো তুলনা হয় কি? উপনিষদের ঋষিগণ ছাড়াও ভক্ত কবীর, তুলসীদাস, তুকারাম, রামানন্দ, মীরাবাঈ প্রমুখ মরমি সাধকের সঙ্গে এদের সাদৃশ্য দেখে শুনে মনে হয়— ঐশী প্রেমের কোনো জাতকুল দেশ-বিদেশ ভেদ-বিভেদ নেই। বরং উল্টো দিক থেকে দেখতে গেলে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ গোষ্ঠীর অনেক ঊর্ধ্বে যার অবস্থান, কণ্ঠে যার বিশ্বশান্তি আর মানব কল্যাণ যার ধর্ম, তার উপরে এক জীবনে আর ততধিক কি থাকতে পারে। ব্যক্তিগত ভোগবিলাস আর সাধ আহ্লাদকে সযত্নে পরিহার করে যিনি নানা ধরনের সমাজ হিতৈষণার কাজে নিজেকে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রাখতে পারেন, তার তুল্য ঋষিপ্রতিম মানুষ আর কে হতে পারেন? তিনিই তো সেই রত্নখনির অধিকারী যার ভিতরে নেই কোনো কলুষতা, হিংসা, বিদ্বেষ আর ঈর্ষা। সব শেষে আর একটা কথা না বললেই নয়। বর্তমান এই ক্ষুদ্র পরিসরে সাবির আহমেদ চৌধুরীর মতো ভাবসাধকের বিচার-বিবেচনা করা আমার পক্ষে অবিমৃশ্যকারিতারই শামিল। এ পৃথিবীর আলো-বাতাসের অবারিত দানকে আমরা ঋণ বলে স্বীকার করি না। কোনো না সে দান আমাদের জীবনেরই অঙ্গ। আগেই বলা হয়েছে মরমি সাধক ক্রান্তদর্শী সাবির আহমেদ চৌধুরী আমাদেরই একজন হয়েও নিজগুণে বিশিষ্টদের মধ্যেও বিশিষ্ট সেইজন।