শুক্রবার, ১১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
শামসুর রাহমান

কবিমানসে বিচ্ছিন্নতাবোধ

এম আবদুল আলীম

কবিমানসে  বিচ্ছিন্নতাবোধ

শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিরলসভাবে লেখনী সঞ্চালন করেছেন। বিষয়বৈচিত্র্য, ভাবের গভীরতা এবং শৈল্পিক পরিমিতিবোধে তার কবিতা অনন্য। স্বাধিকার চেতনা, স্বাজাত্যবোধ, নাগরিক জীবনের চালচিত্র, ঐতিহ্য অন্বেষা, সমকালীন যুগচৈতন্য এবং মানব হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশ তার কবিতার মৌল উপাদান। পুঁজিবাদী যুগের বৈরী পরিবেশে দাঁড়িয়ে তিনি একাকিত্ব ও নৈঃসঙ্গ্যের যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। ফলত, তার কবিসত্তায় বিচ্ছিন্নতা এবং নিঃসঙ্গতা স্থান করে নিয়েছে অনিবার্যভাবে।

ইংরেজি Alienation শব্দের বাংলা পরিভাষা বিচ্ছিন্নতাবোধ। বিচ্ছিন্ন শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো— সম্পূর্ণ বা সম্যক ছিন্ন, পৃথককৃত, বিযুক্ত, বিভক্ত এবং খণ্ডিত। আধুনিককালে বিচ্ছিন্নতা সব সমাজেই এক জটিল সংকট সৃষ্টি করেছে। ফলে দর্শন, সমাজতত্ত্ব এবং মনস্তত্ত্বে বিচ্ছিন্নতা ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছে। যুগজীবনের সংকট এবং আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অভিঘাতে আধুনিক যুগের পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের বিবেক, নীতিবোধ এবং আদর্শ বিলুপ্ত হয়েছে। ফলে ব্যক্তিচৈতন্যে বাসা বেঁধেছে বিচ্ছিন্নতার জটিল রূপ। কার্ল মার্কসের মতে, পুঁজিবাদের উত্কট শোষণ এবং আর্থ-সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়েই মানুষ বিচ্ছিন্নতার জ্বালা ভোগ করে। আধুনিক সমাজের একজন সচেতন মানুষ হিসেবে শামসুর রাহমান ধনতান্ত্রিক সমাজের নির্মমতা এবং নাগরিক জীবনের জটিলতা দেখে বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত হয়েছেন। তার সংবেদনশীল মনে বাসা বেঁধেছে একাকিত্ব এবং নিঃসঙ্গতা। কবিতার বিষয় এবং প্রকরণকলায় তিনি বিচ্ছিন্নতার বহুমাত্রিক বিন্যাস ঘটিয়েছেন। তার কাব্য-কবিতার বিষয়-নির্বাচন, নামকরণ, শব্দচয়ন এবং অলঙ্কার প্রয়োগেও বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ ঘটেছে।

শামসুর রাহমানের সমকাল ছিল নানা কারণে সংঘাতপূর্ণ এবং সংকটময়। ঔপনিবেশিক শাসনের আলো-বাতাসে তার শৈশব-কৈশোর এবং যৌবন অতিবাহিত হয়েছে। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, দেশবিভাগ, মোহাজের সমস্যা, ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তানি শাসকদের নির্মমতা, ধর্মান্ধদের নিষ্ঠুরতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নানা আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সমস্যা-সংকটে তার যুগ ছিল উত্তেজনামুখর। এসব বিষয় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তার কবিমানসে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যুগের জটিল আবহ তার সংবেদনশীল মনকে বেদনাবিদ্ধ করেছে, তাকে নিপতিত করেছে নৈঃসঙ্গ্যের অতলে। কবিতা রচনার সূচনালগ্নেই তিনি বিচ্ছিন্নতার সুর তুলেছিলেন। একাকিত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার বাণীমূর্তি নির্মাণ করে লিখেছিলেন— ‘গাঢ় রাত্রিতে বিষণ্ন সুরে; তোমার রাজ্যে একা-একা হাঁটি/আমি সম্রাট।’ [‘রূপালি স্নান’, ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’] আরও লিখেছিলেন : ‘মুছে গেল দৃশ্যাবলি, চারদিকের, অনন্তর একা/আমি আর; আকুল শূন্যতা।’ [‘সুন্দরের গাঁথা’, ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’]

শামসুর রাহমান লক্ষ্য করেছেন— ‘এ দেশে হায়েনা, নেকড়ের পাল,/গোখরো, শকুন, জিন কি-বেতাল/জটলা পাকায় রাস্তার ধারে।’ দেশের এই দুর্দশায় তিনি ব্যথিত হয়েছেন। তাকে দেখতে হয়েছে বর্ণমালার দুখিনী রূপ, আসাদের রক্তাক্ত শার্ট, শুনতে হয়েছে মড়ক-মারীতে পর্যুদস্ত মানুষের কান্নার রোল। কবি হতাশা আর বিষাদভরা চিত্তে উচ্চারণ করেছেন— ‘জীবন তো জানি সাবানের বল, জলে/প্রতি মুহূর্তে যাচ্ছে ভীষণ ক্ষ’য়ে।/পুরনো বাড়ির ছায়ায় লালিত আমি,/মুখে বংশের বিষাদ বেড়াই বয়ে।/অস্তে তলাব চিরবিলুপ্তির খাদে,/ভূত-ভবিষ্য মিলাবে শূন্যতায়।’ [‘দৃশ্যপট : আমি এবং অনেকে’, ‘নিরালোকে দিব্যরথ’]

নাগরিক জীবনের জটিলতা শামসুর রাহমান স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন তার ‘শহর প্রত্যহ লড়াই করে বহুরূপী ঝড়ের সাথে।’ নাগরিক জীবনের ভাষ্যকার কবি তাই ‘শূন্যে দুরাশার শত ঢিল ছোঁড়েন’ এবং বিচ্ছিন্নতার চিত্রকল্প আঁকেন : ‘চতুর্দিকে/নিস্তব্ধ ওত পেতে থাকে,/ছায়ার ভেতরে ছায়া, আতঙ্ক একটি/কৃষ্ণাঙ্গ চাদরে মুড়ে দিয়েছে শহরটিকে আপাদমস্তক।/মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক নৈঃশব্দকে/আরো তীব্র করে তোলে।’ [‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’]

মানুষের এই অসহায়ত্ব দেখে তিনি কোনোকিছুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেননি। ধর্মান্ধতার নির্মমতাও তাকে বেদনা-বিহ্বল করেছে। ধর্মান্ধতার ফলে উদ্ভূত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এ দেশের মানুষের জীবনকে কতটা বিপন্ন করেছিল সে সম্পর্কে কবির ভাষ্য : ‘ধর্মান্ধতা মানুষকে কীভাবে অমানুষ করে তোলে,/একে অন্যের গলায় ছুরি চালায়, সম্ভ্রম লুট করে/সস্তা পণ্যের মতো,/ভাই ভায়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে,/একথা আমরা এই উপমহাদেশের/অসহায় মানুষ জেনেছি চরা দামের বিনিময়ে।’ এমন যুগ পরিবেশে বিবেকবান এবং সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে বিচ্ছিন্নতাপীড়িত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কখনো যুগজটিলতায়, কখনো নাগরিক জীবনের রূঢ় বাস্তবতায়, কখনো প্রেমের রিক্ততায়, আবার কখনো প্রকৃতির বিধ্বস্ত রূপের মধ্যে কবি বিচ্ছিন্নতা প্রত্যক্ষ করেছেন। তার প্রেমভাবনায় বিচ্ছিন্নতা রূপায়িত হয়েছে প্রেয়সীর স্মৃতি-বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে : ‘জ্যোত্স্না মাখা উর্ণাজালের মতো স্মৃতি, তোমার স্মৃতি।/হৃদয় জুড়ে কেমন হু-হু বিষাদ-গীতি।’ বিচ্ছিন্নতাদীর্ণ কবি প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে রিক্ততা ও শূন্যতারই ছবি দেখতে পান : ‘ভালোবাসা তুমি অনাবৃষ্টিতে/কেমন রুক্ষ, কী দগ্ধ আজকাল।/তার-পাতা নেই, পাখিরা উধাও;/ভীষণ রিক্ত তোমার সলাজ চোখ।’ [‘ভালোবাসা তুমি’, ‘নিরালোকে দিব্যরথ’]

প্রেম-বিচ্ছিন্নতার পাশাপাশি তার কবিতায় প্রকৃতি বিচ্ছিন্নতার চিত্রও প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতির দিকে চেয়ে তিনি অনেক সময় সদর্থক রূপ দেখতে পাননি। স্নিগ্ধ জ্যোত্স্নার পরিবর্তে তিনি দেখেছেন ‘পাঁশুটে জ্যোত্স্নার’ চিত্র। যান্ত্রিক সভ্যতা তাকে প্রকৃতি-বিচ্ছিন্ন করেছে বলেই লিখেছেন, ‘আমরা বাগান চাই’ ‘অথচ বাগান নেই, কোথাও বাগান নেই আজ’। তার কানে ভেসে আসে না পাখির সুমধুর কলতান, তিনি শুনতে পান : ‘মাঝে মাঝে মধ্যরাতে জীর্ণ/বাড়িটার ছাদ আর প্রাচীন দেয়াল থেকে তীব্র সুরে ভেসে আসে/নিদ্রাছুট রোগা ঈগলের গান, কী বিষণ্ন-গর্বিত গান।’ কবির মানসপটে ভেসে ওঠে বিধ্বস্ত নীলিমা, বিপর্যস্ত গোলাপ বাগান, হেমন্তের সন্ধ্যার মতো স্তব্ধ, রিক্ত, শূন্য প্রকৃতির চলচ্ছবি।

কালিক প্রেক্ষাপট, যুগের বিযুক্তি এবং বিসঙ্গতি শামসুর রাহমানকে বিষাদ-ভারাক্রান্ত করেছে। হতাশা, ক্লান্তি আর নৈরাশ্যে তিনি প্রেম-প্রকৃতি-সমাজ এমনকি আপন সত্তা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়েছেন। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত বৈপরিত্য এবং তার ভিতর-বাহির কাঠামোর দ্বন্দ্ব দেখে কবির মনে বিচ্ছিন্নতার জন্ম হয়েছে। তিনি পারিপার্শ্বিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উচ্চারণ করেছেন— ‘এখন নিঃসঙ্গ আমি, পরিপার্শ্ব কর্কশ, বিমুখ, উপরন্তু/অত্যন্ত বিরল বন্ধু। বুঝি তাই হৃদয়ের তন্ত্র/কেমন বেসুরো বাজে।’ বিচ্ছিন্নতার অনিবার্য পরিণাম সংশয়, উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা এবং একাকিত্ব। এর ফলে নিজের সত্তাও নিজের প্রতিপক্ষ হয়ে যায়। এমনকি সমাজের মানুষের সঙ্গে বাস করেও তাদের সঙ্গে কোনো অন্বয় খুঁজে পাওয়া যায় না। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আর্তনাদ করে বলেছিলেন— ‘সহে না সহে না জনতার জঘন্য মিতালী।’ জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন— ‘সকল লোকের মাঝে বসে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা’। শামসুর রাহমানও আপাদমস্তক বিচ্ছিন্নতাপীড়িত হয়ে ফুটপাতে একাকী আর্তনাদ করে বলেছেন— ‘কবি তার নিঃসঙ্গতা/কাফনের মতো মুড়ে রাখে আপাদমস্তক, হাঁটে/ফুটপাতে একা’। আত্মগত সংকটে সংশয়ী কবি উচ্চারণ করেন : ‘নিজস্ব সংকটে আমি সংশয়ী আর ভীষণ একা,/যেন শূন্য খাঁ-খাঁ দ্বীপাধার।’ [‘খাঁ-খাঁ দ্বীপাধার’, ‘যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে’] বাইরের পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা এবং সমাজ-মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা যেমন শামসুর রাহমানের মধ্যে প্রবল, তেমনি নিজ গৃহেও কবি কখনো কখনো নিঃসঙ্গ বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।

শামসুর রাহমানের কাব্যবিষয়ে যেমন বিচ্ছিন্নতা প্রকটিত হয়েছে তেমনই বিচ্ছিন্নতার রূপায়ণ ঘটেছে তার কাব্যের প্রকরণশৈলীতে। তার কাব্য-কবিতার নামকরণ থেকে শুরু করে ভাষা নির্মাণ, শব্দচয়ন এমনকি অলঙ্কার সন্নিবেশেও বিচ্ছিন্নতার প্রকাশ স্পষ্ট। তিনি কাব্যের নামকরণ করেছেন— ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, ‘দুঃসময়ে মুখোমুখি’, ‘শূন্যতায় তুমি শোকসভা’, ‘স্বপ্নেরা ডুকরে ওঠে বার বার’, ‘ধ্বংসের কিনারে বসে’ প্রভৃতি। তিনি কবিতার নাম দিয়েছেন— ‘নির্জন দুর্গের গাথা’, ‘পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ’, ‘দুঃস্বপ্নে একদিন’, ‘একটি বিনষ্ট নগরের দিকে’, ‘বিপর্যস্ত গোলাপ বাগান’, ‘নগ্ন স্তব্ধতায়’, ‘শূন্য চেয়ার— এভাবে তার কবিতার নামকরণের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার সুর শোনা যায়। কবির শব্দচয়নের ক্ষেত্রেও বিভক্তি-বিযুক্তি-বিচ্ছিন্নতা এবং নিঃসঙ্গতার প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। নিরিবিলি ভোজ, শূন্য দুপুর, নির্জন বারান্দা, ক্লান্ত প্রাণ, সিঁড়ির নির্জন বাঁক, নিঃসঙ্গ বারান্দা, নির্জনতার কারাগারে, অকূল শূন্যতা, শূন্যতার ভার, শূন্যের নীলিমায়, নিঃসঙ্গ সুরের— এ জাতীয় অজস্র শব্দ ব্যবহার করে শামসুর রাহমান তার কবিতায় বিচ্ছিন্নতাকে গভীর করে তুলেছেন। অলঙ্কার, চিত্রকল্প এবং প্রতীক ব্যবহারেও তার কবিতায় বিচ্ছিন্নতার হাহাকার শোনা যায়। এ ছাড়া উপমা, রূপক, উেপ্রক্ষা প্রভৃতি অলঙ্কার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কবি বিচ্ছিন্নতার রূপকে মূর্ত করে তুলেছেন।

যুগজটিলতা, পরাধীনতার গ্লানি, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নাগরিক জীবনের দুর্ভোগ এবং মানবতার লাঞ্ছনার মর্মব্যথী হয়ে শামসুর রাহমান বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। পুঁজিবাদী যুগের নির্মমতা এবং যন্ত্রসভ্যতার অসাড়তায় তিনি নানাভাবে নিঃসঙ্গ হৃদয়ের আর্তি প্রকাশ করেছেন। প্রেম, প্রকৃতি, মূল্যবোধ এমনকি নিজের সত্তা থেকেও তিনি কখনো কখনো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। বিচ্ছিন্নতার সেই বহুমাত্রিক বোধকে তিনি কবিতার মধ্যে প্রকাশ করেছেন। বস্তুত, বাংলা কবিতায় বিচ্ছিন্নতার রূপায়ণে শামসুর রাহমান কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তার বিচ্ছিন্নতাদীর্ণ হৃদয়ের আর্তনাদ কবিতার ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর