শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

আমৃত্যু মানুষের সেবা করতে চাই

আমৃত্যু মানুষের সেবা করতে চাই

ছবি : জয়ীতা রায়

অধ্যাপক ডা. সামন্তলাল সেন (১৯৪৯) বাংলাদেশের খ্যাতিমান চিকিৎসক। দেশের অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসায় যিনি ব্যয় করছেন জীবনের পুরোটা সময়। নিজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশের ১৬টি মেডিকেল কলেজে গড়ে তুলেছেন স্বতন্ত্র বার্ন ইউনিট। তারই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাঁচশ শয্যাবিশিষ্ট বিশ্বমানের হাসপাতাল শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন— শেখ মেহেদী হাসান

 

আপনার জন্ম সিলেটে। ছেলেবেলা কীভাবে কেটেছে?

আমার জন্ম ১৯৪৯ সালে, সিলেটে। হবিগঞ্জের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। তখন সেখানে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। হারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করতাম। আমার বাবা জিতেন্দ্রলাল সেন পাকিস্তান আমলে কৃষি সচিব হিসেবে অবসরে যান। মা ছায়া সেন সারা জীবন গৃহিণী ছিলেন। আমরা পাঁচ ভাই, এক বোন। আমি দ্বিতীয়। বাবা যেহেতু সরকারি চাকুরে, বাবার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতাম। দিনাজপুরের সেন্ট ফিলিপস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি ১৯৬৪ সালে। তারপর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ১৯৬৬ সালে ইন্টারমিডিয়েট। আমার ছেলেবেলা ছিল সাধারণ এবং মধুর। আমরা কলের গানের যুগের মানুষ। এখনকার ছেলেমেয়েরা হাতের মোবাইলে সারা বিশ্ব দেখে। তখন আমাদের কাছে বিনোদন ছিল একমাত্র বাংলা সিনেমা। সুচিত্রা-উত্তমের সিনেমা দেখতাম। আর পড়াশোনা করতাম। খুব যে ভালো ছাত্র ছিলাম সেটাও না। আমি সেকেন্ড ডিভিশনে ইন্টারমিডিয়েট পাস করি। এখন তো জিপিএ ফাইভ, কত কিছু। মাঝারি ধরনের ছাত্র ছিলাম। এখন আমার বয়স হয়েছে— এ বয়সে ছেলেবেলার কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা মনে পড়ে না। তবে খুব চঞ্চল ছিলাম। কেন জানি মনে হয়, আমাদের সময়টা অনেক ভালো ছিল।

 

ছোটবেলায় কী ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল?

আমার ছোটবেলায় একটা অভ্যাস ছিল। কলাগাছে ইনজেকশন দিতাম। মানে ডাক্তারি। হয়তো মনের মধ্যে শখ ছিল ডাক্তার হব। ওই শখটা পরে বাস্তবে রূপ পেল ১৯৬৭ সালে, যখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। ওই সময় মন দিয়ে পড়াশোনা করেছি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি থার্ডইয়ারের ছাত্র। আমরা দেখেছি যুদ্ধ কী? যদিও আমি মুক্তিযোদ্ধা নই। কিন্তু এটা বুঝি, কত কষ্ট, কত ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ঠিক স্বাধীনতার পরপরই ডাক্তার হয়ে বের হই। এই গেল পোস্টগ্র্যাজুয়েটের আগের পড়াশোনা।  

 

কর্মজীবনে প্রবেশ করলেন কখন?

১৯৭২ সালে ডাক্তারি পাস করার পর এক বছর ইন্টার্নশিপ করলাম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। তারপর পোস্টিং হলো হবিগঞ্জের বানিয়াচং থানা হেলথ কমপ্লেক্সে। সেখানে তখন রাস্তাঘাট কিছুই ছিল না। এখন তো কি সুন্দর রাস্তা! ওই সময় আমরা নৌকায় যাতায়াত করতাম। সেখানে এক বছর কাজ করেছি। এখন তো ডাক্তারদের অনেকেরই গ্রামে যাওয়ার মানসিকতা নেই। কিন্তু আমি মনে করি, প্রত্যেক ডাক্তারের গ্রামে কাজ করা উচিত। বানিয়াচং খুব এনজয় করেছি। বানিয়াচং তো হিন্দুপ্রধান এলাকা। অনেক বাড়িতে রোগী দেখতে যেতাম। কোনো কোনো বাড়িতে কাঁসার থালায় করে আমাকে খাবার দিত, সে থালার মধ্যেই ভিজিট দিয়ে দিত। দেখেন, হিন্দু ধর্মে কিন্তু এরকম খাবার সাজিয়ে দেওয়া হয় তাদের দেবতাকে। আমাকে কিন্তু সেই জিনিসটাই তারা সিম্বলিক করে দিয়েছে। দেবতার সামনে যেরকম প্রসাদ দেয়, দক্ষিণা দেয়, ঠিক তেমনভাবে আমার সামনে দিত। এই আন্তরিকতা ভোলার নয়।

 

ঢাকায় বদলি হলেন কখন?

১৯৭৫ সালের পরে বদলি হয়ে ঢাকায় চলে আসি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। ডা. আর জে কাস্ট (রোনাল্ড জোসেফ কাস্ট) তখন অর্থোপেডিক সার্জন। বাংলাদেশে এসেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য। তিনি আমার জীবনের অনেক কিছু চেঞ্জ করে দিলেন। একটা অর্থোপেডিক হাসপাতাল বানানোর জন্য নিজে বালির বস্তা টানতেন, নিজেই টাইপ করে সবকিছু লিখতেন। পঙ্গু হাসপাতালে তিনি ইন্ডিয়া থেকে ডা. বেজলিল নামে একজন প্লাস্টিক সার্জনকে নিয়ে আসেন। ডা. আর জে কাস্ট আমাকে বললেন, ‘তুমি ওর সঙ্গে কাজ কর’। আমি ইয়াং ডাক্তার। গ্রাম থেকে এসেছি। বিয়ে করিনি। খুব উৎসাহ নিয়ে কাজ শুরু করলাম। 

 

তাহলে ওই সময় থেকে কী প্লাস্টিক সার্জারি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন?

হ্যাঁ, ওই সময় আমার মাথায় ঢুকল প্লাস্টিক সার্জন, এটা তো সুন্দর জিনিস। মানুষের চেহারা সুন্দর করা যাবে। অনেক টাকা-পয়সা রোজগার করা যাবে। বাড়ি-গাড়ি করা যাবে। এ ধরনের একটা স্বপ্ন নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলাম। পঙ্গু হাসপাতালে চার বছর কাজ করার পর ঢাকা মেডিকেলে বদলি হয়ে এলাম। ১৯৮০ কি ’৮১ সাল হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রথম বার্ন রোগী দেখলাম। প্লাস্টিক সার্জনদের চিকিৎসার একটা পার্ট হচ্ছে এই রোগীদের চিকিৎসা করা এবং ঠোঁট কাটা, তালু কাটা চিকিৎসা করা। পোড়া রোগীদের দেখে আমার জীবনের অনেক কিছু বদলে যেতে লাগল। চেহারা সুন্দর করব কি? ৮০ শতাংশ রোগী মাটিতে পড়ে থাকে। কেউ দেখেও না। মশারির নিচে যেভাবে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা হতো, তাতে আমার ওই স্বপ্নটাই পরিবর্তন হয়ে গেল। চেহারা সুন্দর কিংবা বড়লোক হওয়ার ভূত বিদায় নিল। তখন আমার মাথায় একটাই চিন্তা, এই অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য কী করা যায়?

কখন অনুভব করলেন দেশে বার্ন ইউনিট করা প্রয়োজন?

আমাদের দেশে রান্না করতে গিয়ে আগুনে পোড়ে। গরম পানি ধাক্কা খেয়ে পুড়ে যায়। বৈদ্যুতিক শক খেয়ে পোড়ে। যারা পোড়ে তারা কিন্তু গরিব মানুষ। পোড়া রোগীর প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। একটা টোয়েন্টি পার্সেন্ট বার্ন রোগীর প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকিৎসা করাতে গেলে প্রতি ড্রেসিংয়ে ২০-২৫ হাজার টাকা মিনিমাম খরচ হবে। আমাদের এখানে যারা রোগী তাদের ২০ টাকা খরচেরও সামর্থ্য নেই। তাদের কষ্ট আমরা অনুভব করেছিলাম। আমার টিচার অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অধীনে রেজিস্ট্রার হিসেবে যখন কাজ শুরু করি তখন আমি, তিনি, আরেকজন জেনারেল সার্জন ছিলেন অধ্যাপক কবীর উদ্দিন আহমেদ— আমরা পোড়া রোগীর চিকিৎসা করতাম। তখন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পোড়া রোগীদের জন্য পাঁচটি বেড ছিল। রোগীরা সব বাথরুমের পাশে, কেউ বারান্দায় পড়ে থাকত। কেউ দেখতও না। তখন মাথায় এলো পোড়া রোগীদের জন্য আলাদা কিছু করা যায় কিনা। এটা ১৯৮৬ সালের ঘটনা। ওই বছর আমরা প্রথম সরকারের কাছে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ডিপার্টমেন্ট করার জন্য প্রস্তাব পেশ করি। বহু দুয়ার ঘুরতে হয়েছে। অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, ‘উনি ঘুরতেছেন ধান্দা নিয়া। টাকাটুকা মেরে ইন্ডিয়া চলে যাবেন।’ এগুলো মনে রাখিনি। কারণ জানি এই দেশ আমার। ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ৩০ তারিখে আমরা পৃথক বার্ন ইউনিট চালু করি। এই হাসপাতাল তৈরি করার পর আজকে যে চিকিৎসা নিয়ে মানুষগুলো বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, এটাই তো জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

 

নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের সময় আমরা দেখেছিলাম, এ দেশে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা অত্যন্ত অপ্রতুল। তখন উপলব্ধি করলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সামর্থ্য বাড়ানো প্রয়োজন, প্রয়োজন আরও বার্ন ইউনিট।

নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে একটা ভালো বার্ন ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেখানে সব সময় ৬০ থেকে ৭০ জন রোগী ভর্তি থাকে, তারা সুচিকিৎসা পায়। এ ছাড়া কুমিল্লা, সিলেট এবং রংপুরে ভালো বার্ন ইউনিট করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, সিলেট ও রংপুরসহ ১৬টি মেডিকেল কলেজে বার্ন ইউনিট চালু করা হয়েছে। সেখানে সব সুবিধাই মোটামুটি আছে।

 

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট কবে শুরু করলেন?

আমি একজন সার্জন, নিজে যদি অপারেশন করতে থাকি কতদিন করব? একটা দিন আসবে আমাকে থামতে হবে। কিন্তু আমি যদি একটি প্রতিষ্ঠান বানিয়ে দিয়ে যাই তাহলে এটা যুগ যুগ চলবে। আজকে একটি ভবন হয়েছে এখানে কত মানুষ সেবা পাচ্ছে। বর্তমানে আমাদের তিনশ বেডের বার্ন ইউনিট। মূলত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উৎসাহে ও সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’। আগামী বছর এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। এটা হবে পাঁচশ বেডের হাসপাতাল। এটা বিশ্বের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির অনন্য একটি প্রতিষ্ঠান। এত বড় প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর কোথাও নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই প্রতিষ্ঠানটিতে বাইরের দেশের লোকজনও চিকিৎসা ও পড়াশোনা করতে আসবে। আজকে এই আবুল বাজানদার ও মুক্তামণিকেই দেখুন না। আবুল বাজানদারকে আমি যখন প্রথম গ্রাম থেকে নিয়ে আসি তখন অনেকেই বলেছিল এটা সম্ভব নয়। তাদের চিকিৎসার জন্য আমি সবচেয়ে কৃতজ্ঞ আমার সহকর্মীদের কাছে। সবার সহযোগিতায় আমরা তাদের চিকিৎসা করতে পেরেছি। আমার মনে হয়েছে, আমাদের দেশে মানুষের সচেতনতার অভাব। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে পারলে আমরা অগ্নিদগ্ধ রোগী অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারব।

 

বার্ন ইউনিটও তো আপনি খুব ভালোবাসেন। নিয়মিত চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরও এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আপনি যুক্ত আছেন।

চাকরি ছাড়াই বিনা বেতনে দুই বছর এখানে প্রত্যেক দিন আসতাম। এর কারণ, এখানকার প্রতিটি ডাক্তার-স্টাফ আমাকে খুব ভালোবাসেন। বার্ন ইউনিট তৈরিতে প্রকল্প পরিচালক থাকা অবস্থায় দুবার এক্সটেনশন হলো। সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করতাম। তারপর অবৈতনিক উপদেষ্টা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ওকে একটা দায়িত্ব দাও। ওর জন্য একটা পদ সৃষ্টি করে ওকে সারা বাংলাদেশের দায়িত্ব দাও।’ তিনি আমার ওপর যে আস্থা রেখেছেন এবং এমন একটি মহান দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিয়েছেন এজন্য আমি গর্বিত। এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পেছনে তার অবদান জাতি চিরদিন মনে রাখবে।

 

দেশের পোড়া রোগীদের চিকিৎসাব্যবস্থা আরও উন্নত এবং পর্যাপ্ত করার জন্য কী করা প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

প্রথমেই দরকার আরও অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া। যেখানে প্রায় দেড় হাজার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন, সেখানে মাত্র ৫২ জনকে দিয়ে কখনোই পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে এবং পোড়া রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কেউ পুড়ে গেলে তাকে যাতে ঢাকায় আনতে না হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমে প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, অন্তত বিভাগীয় সদর হাসপাতালগুলোয়, তারপর জেলা হাসপাতাল পর্যন্ত এই চিকিৎসাব্যবস্থা ছড়িয়ে দিতে হবে।

 

চিকিৎসক জীবনের স্মরণীয় কোনো ঘটনা মনে পড়ে?

বাংলাদেশের মানুষের মন কিন্তু ভালো। নিমতলী বলেন আর জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডির কথাই বলেন, যে কোনো জাতীয় দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। জগন্নাথ হলে ট্র্যাজেডির সময় রাতে এখানে আসছিলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল। দেখেছি, সাধারণ মানুষ-ছাত্র-অফিসের স্টাফ-নার্স কাউকে ডাকতে হয়নি। মানুষ ভলান্টারিলি এসে রক্ত দিচ্ছে, মানুষকে সামলাচ্ছে। এটা একটা অন্যরকম ফিলিংস। একটা উদাহরণ দিই, মানুষের জন্য করলে কী পাওয়া যায় এই পৃথিবীতে— নির্বাচনের সময় যখন রাজনৈতিক সহিংসতা হলো, একদিন হাসপাতাল থেকে বাসায় যাচ্ছিলাম সিএনজি করে। নামার পরে ড্রাইভার টাকা নিতে চাইল না। বললাম ‘কেন?’ ‘স্যার, আমি জানি আপনি অনেক মানুষের উপকার করেন। আমাদের অনেক সিএনজি ড্রাইভার পুড়ে গিয়েছিল। আপনারা চিকিৎসা করেছেন।’ এ রিওয়ার্ডটা কোটি টাকা দিয়ে পাবেন? কোটি টাকা দেন। এত বড় সম্মান কেউ দেবে না। আমি এটাতেই তৃপ্ত। আর কিছুই চাওয়ার নেই। আমৃত্যু মানুষের সেবা করতে চাই।

 

অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আপনি জনমত গড়ে তুলেছেন।

আমার মেয়ের মুখে ছোট কিছু দাগ ছিল। একদিন ও আমাকে বলল, বাবা, তুমি প্লাস্টিক সার্জারি করে আমার মুখটা ভালো করে দাও। ওকে একটি অ্যাসিড দগ্ধের ছবি দেখিয়ে বলি, এই মেয়েটিও খুব সুন্দরী ছিল, অ্যাসিড নিক্ষেপের জন্য ওর মুখ ঝলসে বিবর্ণ হয়ে গেছে। ও তখন উত্তর দিল, তুমি আগে ওদের চিকিৎসা কর। সেই থেকে অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলেছি। অ্যাসিড সারভাইবাল ফাউন্ডেশন, প্রথম আলো অ্যাসিডবিরোধী যে সংগঠন এগুলো গড়ে তুলি।

 

আপনার পরিবারের কথা জানতে চাই।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দুর্গাপূজা দেখতে গিয়ে রত্নাকে (আমার স্ত্রী রত্না সেন) প্রথম দেখি। পূজামণ্ডপে পরিচয়। এক বছর প্রেম। তারপর পরিণয়। ও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পাস করেছে। সে ব্রিটিশ হাইকমিশনে চাকরি করত, এখন অবসরে। আমাদের এক ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে নবনীতা সেন, ছেলে অনাবিল সেন। ছেলে চিকিৎসক। মেয়ে ডাচ ছেলে বিয়ে করেছে। বিদেশে থাকে। দুটো নাতনি আছে। আমি জীবনে সংসারের কোনো কিছুই দেখতাম না। এখনো দেখি না। সারা দিন এই হাসপাতালে। মাঝে মধ্যে জানতাম না, আমার ছেলে কোন ক্লাসে পড়ে, মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে, ওদের বেতন দিতে হবে। রত্নার এই সাপোর্টটা না পেলে এ জায়গায় আসতে পারতাম না।

 

আপনার অবসর সময় কিভাবে কাটে?

আমার ম্যাক্সিমাম সময় হাসপাতালে কাটে। অবসরে চেষ্টা করি বাসায় গিয়ে একসঙ্গে খাওয়ার, গল্প করার। পুরনো দিনের সিনেমা দেখতে ভালো লাগে। পছন্দ করি উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা।

আপনাকে ধন্যবাদ।

সর্বশেষ খবর