শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

এক আলাভোলা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন

এক আলাভোলা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন

গ্যালিলিওর মৃত্যুর বছরেই জন্ম হয়েছিল আরেক মহারথি নিউটনের। গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক ৩০০ বছর পরে জন্ম নেন স্টিফেন হকিং। আর আইনস্টাইনের মৃত্যুর বছরে বিল গেটস আর স্টিভ জবসের। এ যেন ইতিহাসের ব্যাটন রেস। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সত্য ও সুন্দরের পতাকা বহন করে চলা। আজকে আমাদের রকমারির আয়োজন মহামতি আইনস্টাইনকে নিয়ে। যিনি স্কুলে ছিলেন খুবই সাধারণ ছাত্র। কিন্তু চিন্তা-পরীক্ষার মাধ্যমে পদার্থবিজ্ঞানে এনেছেন যুগান্তকারী পরিবর্তন। লিখেছেন— সাইফ ইমন

 

একদিন আইনস্টাইনের বাবা তার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চান, ভবিষ্যতে তার ছেলেটির কোন পেশা বেছে নেওয়া উচিত? শিক্ষক জবাব দিয়েছিলেন, যে পেশাই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না, কারণ কোনোটিতেই ও কিছু করতে পারবে না। সেই ছেলেই বড় হয়ে অসাধ্য সাধন করেন। বিজ্ঞান জগতে মহাবিপ্লব রচনা করেন। বিশ্ব ও জগৎ সম্পর্কে নিউটনের ধারণা যা প্রচারিত হয়ে আসছিল তা ভেঙে দেন। আবিষ্কার করেন ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’ বা ‘আপেক্ষিক তত্ত্ব’। তিনি বলেন, এই যে চোখের সামনে আমরা বস্তুর গতি ও শক্তি, ‘টাইম’ ও ‘স্পেস’ অর্থাৎ সময় এবং স্থানকে দেখছি, কোনোটাই ‘অ্যাবসলিউট’ বা অপরিবর্তনীয় নয়, অর্থাৎ কোনোটাই ধ্রুব নয়, সবই আপেক্ষিক। বিষয়টা তখনকার বিজ্ঞানীদের জন্য কিছুটা অস্বস্তিকর। কারণ দৃশ্যমান জগতের দিকে সরাসরি আঙ্গুল তুলে আইনস্টাইন বলছেন, যা দেখছ তা সত্যি নয়। যা দেখছ না তাও সত্যি নয়। আবার কোনো কিছুই অসত্য নয়। খুব বিদঘুটে মনে হচ্ছে কি! তাই না?

বিষয়টা অনেকটা এমনই। বস্তুর গতি আর তার সঙ্গে পর্যবেক্ষকের অবস্থানের পরিবর্তনে বদলে যায় সবকিছু। শুধু বদলায় না আলোর গতিবেগ।

মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন তো তত্ত্ব দিয়েই শেষ। কিন্তু তার প্রমাণ করে যাচ্ছেন সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা। তার তত্ত্ব প্রমাণ করে নোবেল পাচ্ছেন বর্তমান সময়ের বিজ্ঞানীরা।

১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জার্মানির এক মফস্বল শহরে ইহুদি পরিবারে আইনস্টাইন জন্ম নেন। বাবা হেরম্যান আইনস্টাইন ছিলেন ব্যবসায়ী এবং মা পলিন আইনস্টাইন গৃহিণী। আলবার্টের ছেলেবেলা  কেটেছিল মিউনিখেই। খুব ছোট থেকেই ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন আইনস্টাইন।

আইনস্টাইনকে প্রথম স্কুলে পাঠানো হয় পাঁচ বছর বয়সে। কিন্তু স্কুলের ধরা-বাধা পড়াশোনা তার কখনোই ভালো লাগেনি। স্কুলের পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিলেন না। ক্যাথলিক স্কুলের অতিরিক্ত কড়াকড়িও তার ভীষণ অপছন্দ ছিল। তাই শেষ বয়সে সেই অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে গিয়ে আইনস্টাইন একবার বলেন, ‘প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের মনে হতো এক-একজন সার্জেন্ট, আর জিমনেসিয়ামের টিচাররা ছিলেন একেবারে মিলিটারি ল্যাফটেন্যান্ট।’ আইনস্টাইন আসলে স্বাধীনচেতা ছিলেন। স্কুল জীবনে আইনস্টাইনের প্রতিভার কোনো প্রতিফলনই দেখা যায়নি।

ছয় বছর বয়সে একরকম জোর করেই মা তাকে বেহালা শেখানোর ব্যবস্থা করেন। নেহাত অনিচ্ছার সঙ্গে শুরু করলেও একসময় এই বাজনাটার প্রতি আইনস্টাইন আকৃষ্ট হন। বেহালা হয়ে ওঠে তার আজীবনের সঙ্গী। শৈশবের আরেকটি ছোট ঘটনা আইনস্টাইনের জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছিল।

তার বয়স তখন পাঁচ। তার বাবা এনে দিলেন একটি ছোট কম্পাস। শিশু আইনস্টাইন সেটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যত দেখে ততই মুগ্ধ হয়। যন্ত্রটি যে দিকেই ঘোরানো হোক না কেন কম্পাসের কাঁটা উত্তরমুখী হয়ে যায়। শিশু আইনস্টাইন এতে বিস্ময়াভূত হয়ে পড়ে।

এর মাধ্যমেই প্রথম সৃষ্টি জগতের রহস্য নিয়ে চিন্তার বীজ বপন হয়ে যায় তার মধ্যে। ভাবিয়ে তোলে আইনস্টাইনকে। তাই ছোট বয়স থেকেই তাকে বলা হয় ভাবুক প্রকৃতির। আর বড়বেলায় এসেও আইনস্টাইন তার বড় আবিষ্কারগুলোর নেপথ্যে হাতে-কলমে গবেষণার চেয়ে চিন্তা করতেন বেশি। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এ চিন্তা-গবেষণার একটা সুন্দর নাম রয়েছে। আর তা হলো ‘চিন্তা-পরীক্ষা’।  

কৈশোর থেকেই গণিতের প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন আইনস্টাইন। বীজগণিতে তার আগ্রহ জাগিয়ে তোলেন কাকা জ্যাকব। মজা করে জ্যাকব বলতেন, আমরা এমন একটি ছোট্ট জন্তু শিকারে বেরিয়েছি, যার নাম জানা নেই। তাই তার নাম দেওয়া হলো ‘ক’। চলো এবার তাকে ধরি, তারপর ঠিক নামটি বের করি। কাকা জ্যাকবের আনন্দদায়ক পাঠদানে আইনস্টাইনকে বীজগণিতের প্রতি আকৃষ্ট করে।

সময়ের কশাঘাতে সুইজারল্যান্ডের বার্নে পেটেন্ট অফিসে আইনস্টাইন একটি চাকরি পান যুবক বয়সে। তার কাজ ছিল পেটেন্ট সংক্রান্ত আবেদনগুলো পরীক্ষা করা। আইনস্টাইন সুইস পেটেন্ট অফিসে ছিলেন ১৯০২ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত। ১৯০৩ সালে বিয়ে করেন টেকনিক্যাল স্কুলের সহপাঠিনী মাভিয়া ম্যারিকে। বার্নেতে সংসার শুরু করেন তারা। আইনস্টাইনের দুই সন্তান হ্যান্স আলবার্ট আইনস্টাইন ও এডওয়ার্ড আইনস্টাইন। বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯১৯ সালে আইনস্টাইন আবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তার চাচাতো বোন এলসা আইনস্টাইনের সঙ্গে।

ল্যাবরেটরিতে প্রথাগত গবেষণা আইনস্টাইন কখনই করেননি। মস্তিষ্কই ছিল তার ল্যাবরেটরি। আর যন্ত্রপাতি ছিল পেন্সিল আর খাতা। তার পরীক্ষা সবই চলত চিন্তার অসীম জগতে। একে বলা হয়, ‘চিন্তা-পরীক্ষা’ বা ‘থট এক্সপেরিমেন্ট’। জার্মান ভাষায় পর পর আইনস্টাইনের কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে ছিল ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য থিসিস, ‘ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্ট’ অর্থাৎ আলোক তড়িৎ প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ‘স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি’ বা ‘আপেক্ষিক তত্ত্ব’। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনস্টাইনকে ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। ১৯২১ সালে ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্টের কাজের জন্যই নোবেল পুরস্কার পান। তবে ১৯০৫ সালে তার প্রকাশিত বিশেষ আপেক্ষিকবাদ বিজ্ঞানী মহলে আইনস্টাইনকে রাজার আসনে বসায়। খ্যাতি এনে দেয় বিশ্বজুড়ে। এসব গবেষণাপত্র অতি উচ্চগণিতের ভাষায় লেখা, গণিতের বিশেষ জ্ঞান ছাড়া যা বোঝা সম্ভব নয়। তবে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের মূল কথাটি হলো- আলোর গতিবেগই চরম এবং ধ্রুব। আলোর উৎস বা পর্যবেক্ষকের অবস্থান ও গতিবেগ বদলালেও আলোর বেগ একই থাকে। ১৯২১ সালে ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্টের কাজের   জন্য আইনস্টাইন নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৫৫ সালের ১৮ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহান বিজ্ঞানী।

 

আত্মভোলা বিজ্ঞানীর মজার যত কাহিনী

বিশ্বের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বকে নির্ভুল হিসেবে মেনে নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। মহাকর্ষ তরঙ্গের ওপর ভর করেই চলছে মহাবিশ্ব। পৃথিবীর ঘূর্ণন, গ্রহ-নক্ষত্রের গতি সব কিছুই ঘটছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কারণে। মহামতি আইনস্টাইন তার আপেক্ষিক তত্ত্বেই এ তরঙ্গ সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। আসলে তিনি অতিক্রম করেছিলেন সময়। তবে এত কঠিন কঠিন তত্ত্ব যে বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছেন তিনি কথা বলতে শুরু করেন চার বছর বয়সে। আর পড়তে শেখেন আরও পরে; সাত বছর বয়সে। প্রচলিত আছে যে, চার বছর পর্যন্ত যখন তিনি কথা বলছিলেন না তখন বিষয়টি নিয়ে পরিবারের সবাই চিন্তিত তখন হঠাৎ একদিন খাবার টেবিলে আইনস্টাইন বলে ওঠেন, ‘স্যুপটা খুবই গরম’! তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘এতদিন কেন কথা বলোনি?

আইনস্টাইন উত্তর দেন, ‘এতদিন তো সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল।’ এটি ছিল তার জীবনের দ্বিতীয় বাক্য! 

আরেকটি ঘটনা এরকম যে নোবেলজয়ী বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ট্রেনে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। চেকার টিকিট দেখতে চাইলে আইনস্টাইন কিছুতেই টিকিট খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শুধু বিড়বিড় করছিলেন, ‘কোথায় যে রাখলাম টিকিটটা!’

চেকার বললেন, ‘স্যার, আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি নিশ্চয়ই টিকিট কেটেই উঠেছেন। আপনাকে টিকিট দেখাতে হবে না।’ আইনস্টাইন তখন চিন্তিত মুখে বলেন, ‘না না! ওটা তো খুঁজে পেতেই হবে! না পেলে জানব কী করে, আমি কোথায় যাচ্ছিলাম!’ এই হলো আইনস্টাইন!

আরও একটি মজার ঘটনা বলি। আলবার্ট আইনস্টাইন একবার বিজ্ঞানীদের সম্মেলনে যোগ দিতে যান। সেখানে একজন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ মন্তব্য করেন, ‘অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একজন জ্যোতির্বিদ গুরুত্বহীন একটি বিন্দু ছাড়া কিছুই নন।’

জবাবে আইনস্টাইন বলেন, ‘তবে আমার ব্যাপারটি হচ্ছে কি, কোনো মানুষকে যদি আমি এ রকম গুরুত্বহীন বিন্দু মনে করি, দেখি যে ওই ব্যক্তি একজন জ্যোতির্বিদ।’ আইনস্টাইনের রসবোধ এ ঘটনা থেকে ভালো বুঝতে পারা যায়। একদিন আইনস্টাইন রেলগাড়ির ডাইনিংয়ে রাতের খাবার খেতে এসে দেখলেন, চশমা ফেলে এসেছেন। এদিকে খালি চোখে মেন্যুও পড়া যাচ্ছে না। তিনি ওয়েটারসকে ডেকে বললেন, দয়া করে এটা পড়ে দাও। ওয়েটারস তার দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘দুঃখিত স্যার, আমার পড়াশোনার দৌড়ও আপনার মতোই।’ ওয়েটারস আইনস্টাইনকে চিনতে পারেননি। আর তাকে মূর্খ ভেবেছেন!

টিকিট নিয়ে বিশ্বখ্যাত এ বিজ্ঞানীর আরেক গল্প আছে। শহরে বেড়াতে গিয়েছেন আইনস্টাইন। এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে বাসে চেপে হোটেলে ফিরছেন। এমন সময় বাসের কন্ডাক্টর টিকিট চাইলে তিনি খুবই বিব্রতবোধ করলেন। পকেট হাতড়ে কোথাও টিকিট পেলেন না। কন্ডাক্টর তাকে বিব্রত হতে দেখে বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনাকে আর ব্যস্ত হতে হবে না। টিকিটটা কোথাও পড়ে গেছে হয়তো।’

এ কথা শুনে আইনস্টাইন বিচলিত হয়ে বললেন, ‘আরে না, বলছ কী তুমি! টিকিট না পেলে আমি হোটেলে ফিরব কী করে? টিকিটের উল্টো পাশে হোটেলের নাম-ঠিকানা লেখা ছিল যে!’ এই হলো অবস্থা। এক সভায় আইনস্টাইনকে একনজর দেখানোর জন্য বাবা তার ছেলেশিশুকে উঁচু করে ধরলেন আইনস্টাইনের সামনে। শিশুটি তখন তারস্বরে কাঁদছে। বৃদ্ধ আইনস্টাইন শিশুটির গাল টিপে দিয়ে বললেন, ‘এত বছর বয়সের মধ্যে একমাত্র তুমিই অকপটে আমার সম্পর্কে মনের ভাব প্রকাশ করলে। ধন্যবাদ।’

 

নোবেল পুরস্কার

আইনস্টাইন ছিলেন হাতে-কলমে কাজের ব্যাপারে খুবই অলস। তিনি কেবল ‘চিন্তা-পরীক্ষা’ করতে ভালোবাসতেন। আর সেগুলো করেই তিনি আপেক্ষিক তত্ত্বের বিশেষ এবং সাধারণ রূপটি খুঁজে পান। ১৯০৫ সালে জার্মান ভাষার জার্নালে একাধিক যুগান্তকারী ধারণা প্রকাশিত হয়। ১৯০৫ সালের দিকে তিনি তিনটি একেবারে নতুন ধারণা পৃথিবীতে নিয়ে এসেছিলেন। এর পেছনে একটা কারণ হতে পারে আইনস্টাইনের কোনো সুপারভাইজার ছিল না! ফলে তিনি তার ইচ্ছামতো কাজ করতে পেরেছিলেন। নিজের কল্পনার ডানা মেলে করে গেছেন একের পর এক চিন্তা-পরীক্ষা। কিন্তু তিনি প্র্যাকটিক্যালি কিছু করতে পছন্দ করতেন না। এদিকে আইনস্টাইনের মতো প্রতিভাবান একজন নোবেল পুরস্কার পাবে এটাই স্বাভাবিক। আইনস্টাইনের এই আলস্যের কারণে নোবেল পুরস্কার কমিটি বেজায় বিপদে পড়েন। কিছুদিন ধরেই নোবেল কমিটি আইনস্টাইনকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার কথা চিন্তা করছিল। কিন্তু সংশয় দেখা দেয় স্বয়ং নোবেলের ঘোষণার মধ্যে। তিনি বলে গিয়েছিলেন পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পাবেন আবিষ্কারক আর সেই আবিষ্কার যেন মানুষের কল্যাণে লাগে।

আইনস্টাইনের বেলায় বিতর্ক দেখা দিল তার আপেক্ষিক তত্ত্ব যুগান্তকারী হলেও প্রত্যক্ষভাবে তা মানুষের কোনো কাজে লাগবে না। তখন তার ফটো ইলেকট্রিক অ্যাফেক্ট বা আলোক তড়িৎ ফলকে সরাসরি আবিষ্কার হিসেবে বলা সম্ভব এবং এর প্রত্যক্ষ ব্যবহারও হচ্ছে তাই ঘোষণা করা হলো। অবশেষে আসে সাধক বিজ্ঞানীর জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। ১৯১৯ সালে স্যার আর্থার এডিংটন ব্রাজিলের জঙ্গলে গিয়ে আলোর পথ বেঁকে যাওয়ার ব্যাপারটা প্রমাণ করে আসেন। কিন্তু নোবেল কমিটির ‘পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হতে হবে। সবার কাছে সেটি তো তুলনীয় নয়। তবে, শেষ পর্যন্ত ১৯২১ সালে সেই ১৯০৫ সালের আলোর তড়িৎ ক্রিয়ার ওপর করা কাজের কথা উল্লেখ করে আইনস্টাইনকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে নোবেল কমিটি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ইংরেজ বিজ্ঞানীরা সূর্য গ্রহণের ছবি বিশ্লেষণ করে দেখতে পান আলো সত্যিই বাঁকে। আইনস্টাইন তার প্রথম স্ত্রী মিলেভার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের শর্ত অনুসারে নোবেল পুরস্কারের পুরো টাকাটা তাকে পাঠিয়ে দেন।

 

 

আইনস্টাইন-সাইলার্ড এর পারমাণবিক চিঠি!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালের ঘটনা। রণাঙ্গনে মানুষের আহাজারি। চারদিকে ভয়ানক আগ্নেয়াস্ত্রের গন্ধ। আর বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। কারণ, মিত্রবাহিনীকে সমর্থন করে দিয়েছিল। এর আগের বছর, অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে আবিষ্কৃৃত হয়েছে পরিমাণ শক্তির কৌশল। কীভাবে ইউরেনিয়াম পরমাণুর ফিশন ঘটিয়ে বিপুল পরিমাণ শক্তি উত্পাদন করা যায়। আর তা ব্যবহার করেই জার্মানি নাৎসি বাহিনী হয়ে উঠতে পারে ভয়ঙ্কর। হিটলারের হাতে এই বোমা কতটা ভয়ঙ্কর তা ভাবতেই শিউরে ওঠেন তৎকালীন খ্যাতনামা সব বিজ্ঞানী। আলবার্ট আইনস্টাইন, লিও সাইলার্ড, এডওয়ার্ড টেলারসহ খ্যাতিমান সব বিজ্ঞানী তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে চিঠি লেখার পরিকল্পনা করেন, যাতে আমেরিকা মিত্র বাহিনীর স্বার্থে নিজেদের পরমাণু কর্মসূচি শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মান বিজ্ঞানী সিগফ্রিড ফ্লুগ সে সময় পারমাণবিক বোমার বিষয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। পাশাপাশি বেলজিয়ামের নিয়ন্ত্রণাধীন কঙ্গোর খনি থেকে ইউরেনিয়াম কেনার জন্যও তোড়জোড় চালাচ্ছিল হিটলার। বিজ্ঞানী মহলে গুঞ্জন ছিল ইতিমধ্যে জার্মানি পারমাণবিক বোমা তৈরিতে অনেক এগিয়েছে। আর তাই যদি হয়, তাহলে মিত্র বাহিনীকেও পারমাণবিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে অনতিবিলম্বে পারমাণবিক কর্মসূচি গ্রহণের তাগিদ দিয়ে বিজ্ঞানী লিও সাইলার্ড একটি চিঠি লিখেন, যাতে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর করেন আলবার্ট আইনস্টাইন। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন রাজি ছিলেন না। সাইলার্ড তাকে সবিস্তারে বলে রাজি করান। আইনস্টাইন এই কাজের ফলাফল কী হতে পারে তা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। চিঠিতে পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতার কথাও ছিল। আর এর বিবরণ দিতে গিয়ে সাইলার্ড লিখেছিলেন, ‘যদি কোনো বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি জাহাজে একটিমাত্র পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে, তবে পুরো বন্দরটিই ধ্বংস হয়ে যাবে। চিঠির ফলশ্রুতিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু করে কুখ্যাত ম্যানহাটন প্রজেক্ট। এ প্রজেক্ট থেকেই বেরিয়ে আসে হিরোশিমা আর নাগাসাকির ওপর নিক্ষেপিত দুই পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাট ম্যান’।

 

 

আইনস্টাইনের অটোগ্রাফ

খ্যাতির শীর্ষে তখন আইনস্টাইন। এসব ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় নানা মিথ তৈরি হয়। এমনি মিথ তৈরি হতে থাকে আইনস্টাইনকে ঘিরে। আইনস্টাইন অবশ্য মিডিয়ার এসব প্রচারে তেমন গুরুত্ব দেন না। আর তখন যেহেতু ফটোগ্রাফি এখনকার মতো ডাল-ভাত ছিল না তাই লোকজন বিখ্যাতদের কাছ থেকে অটোগ্রাফ সংগ্রহ করতেন। তাই খ্যাতির চূড়ায় অবস্থান করা আইনস্টাইন কোনো পাবলিক সমাবেশে গেলেই অটোগ্রাফের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন অনেকেই। কিন্তু আইনস্টাইনের কাছে এসব ভালো লাগত না।

এই অটোগ্রাফ সংগ্রহকারীদের হাত থেকে বাঁচতে চাইতেন আইনস্টাইন। তার ধারণা ছিল এই অটোগ্রাফ সংগ্রহকারীদের বেশির ভাগেরই বিজ্ঞানের প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। কেবল বিখ্যাত ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে পারলে বা পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারলে নিজেদের সামাজিক মূল্য খানিকটা বাড়ে বলেই অটোগ্রাফ সংগ্রহের জন্য ভিড়।

আইনস্টাইন অটোগ্রাফ সংগ্রহকারীদের ওপর খুবই বিরক্ত হতেন। ব্যক্তিপূজায় বিশ্বাসী ছিলেন না আইনস্টাইন।

অটোগ্রাফ সংগ্রহের নামে গায়ের ওপর উঠে পড়াটাকে তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না। খ্যাতিমানরা প্রকাশ্যে আনন্দ প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু বিরক্তি প্রকাশ করতে পারেন না।

তাই এটা নিয়ে আইনস্টাইন অনেক ভেবে অটোগ্রাফ শিকারিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য একটা উপায় বের করলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন তার অটোগ্রাফ নিতে হলে পয়সা খরচ করতে হবে। তিনি একটা ফরম ছাপলেন অটোগ্রাফ সংগ্রহকারীদের জন্য। ফরমে অটোগ্রাফ সংগ্রহের নিয়ম বেঁধে দেওয়া হলো কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানে চাঁদা দিয়ে চাঁদার রসিদ দেখালে তবেই আইনস্টাইন অটোগ্রাফ দেবেন, নইলে নয়। এতে সমাজেরও উপকার হলো। ফটোগ্রাফ শিকারিদেরও আশা পূরণ হলো। আমেরিকায় স্থায়ীভাবে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই নিয়ম চালু রেখেছিলেন আইনস্টাইন।

 

আপেক্ষিক তত্ত্ব রস!

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব তখনো প্রমাণিত হয়নি।  ইংরেজ বিজ্ঞানীরা সূর্য গ্রহণের একাধিক ছবি তোলেন। সেই ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেল আলো বাঁকে। বিজ্ঞানীরা উত্তেজনায় ফেটে পড়লেন। ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটিতে ঘোষণা করা হলো সেই যুগান্তকারী তত্ত্ব, আলো বেঁকে যায়। এই বাঁকের নিয়ম নিউটনের তত্ত্বে না থাকলেও আলোর বাঁকের মাপ আছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের সূত্রে।

আইনস্টাইন তার এই যুগান্তকারী আবিষ্কার নিয়ে কৌতুক করে বললেন, ‘আমার আপেক্ষিক তত্ত্ব সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। এবার জার্মানি বলবে আমি জার্মান আর ফরাসিরা বলবে আমি বিশ্বনাগরিক। কিন্তু আমার তত্ত্ব যদি মিথ্যা হতো তাহলে ফরাসিরা বলত আমি জার্মান আর জার্মানরা বলত আমি ইহুদি। ’

এভাবেই নিজের আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে রসবোধে মেতে উঠতেন আইনস্টাইন। একদিন এক তরুণ সাংবাদিক বললেন, আপনি সংক্ষেপে বলুন আপেক্ষিক তত্ত্বটা কী?

আইনস্টাইন আবারও কৌতুক করে বললেন, ‘যখন একজন লোক কোনো সুন্দরীর সঙ্গে এক ঘণ্টা গল্প করে তখন তার মনে হয় যেন এক মিনিট বসে আছে। কিন্তু যখন তাকে কোনো গরম উননের ধারে এক মিনিট দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় তার মনে হয় সে যেন এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছে। এই হচ্ছে আপেক্ষিক তত্ত্ব।’

আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে মুখরোচক কিছু কাহিনী ছড়িয়ে পড়ে। একদিন এক সুন্দরী তরুণী তার প্রেমিকের সঙ্গে চার্চের ফাদারের পরিচয় করিয়ে দিলে ফাদার পরদিন মেয়েটিকে জানান, ‘তোমার প্রেমিককে আমার সব দিক থেকেই ভালো লেগেছে শুধু একটি বিষয় ছাড়া। মেয়েটি কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করল, কোন বিষয়? ফাদার বললেন, ‘তার কোনো রসবোধ নেই। আমি তাকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের কথা জিজ্ঞাসা করেছি আর সে আমাকে তাই বোঝাতে আরম্ভ করল।’ ফাদারের এ কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়ল মেয়েটি।

আমেরিকার এক বিখ্যাত সুরকার জর্জ তার এক বন্ধুকে বললেন, একজন মানুষ কুড়ি বছর ধরে একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করলেন আর অবাক হতে হয় এই ভেবে যে সেই চিন্তাটুকুকে তিনি প্রকাশ করলেন মাত্র তিন পাতায়। বন্ধুটি জবাব দিল নিশ্চয়ই খুব ছোট অক্ষরে ছাপা হয়েছিল। আইনস্টাইন মজা করে বলতেন, মেয়েরা সব সময়ই নতুন কিছু পছন্দ করে। এবারের নতুন জিনিস হলো আপেক্ষিক তত্ত্ব।

 

প্রেমিক আইনস্টাইন

ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্ট, থিওরি অব রিলেটিভিটি, মাস-এনার্জি ইকুইভ্যালেন্স ফর্মুলার মতো গুরুত্বপূর্ণ সব আবিষ্কারের জন্য পৃথিবীর মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে আজীবন আলবার্ট আইনস্টাইনকে।

তার ছিল নারীপ্রীতি। জীবনে বিয়ে করেছিলেন তিনি দুবার। এ ছাড়াও তার আরও অর্ধ ডজনের মতো নারীর সঙ্গে সখ্যর কথা জানা যায়। এদেরই একজন ছিলেন রাশিয়ার নাগরিক মার্গারিটা। তিনি আইনস্টাইনকে ভালোবেসেছিলেন নাকি নিজের কার্যসিদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবহার করেছেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এর আগে ১৯৩৫ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় ব্রোঞ্জনির্মিত একটি আবক্ষ মূর্তি তৈরি করতে আগ্রহী হয়। এ উদ্দেশ্যে সের্গেই কোনেনকোভা নামের সোভিয়েত ভাস্করের ওপর দায়িত্ব বর্তায়। ঘটনাটা ঘটে সের্গেইয়ের স্ত্রী মার্গারিটা কোনেনকোভাকে ঘিরেই। নিয়মিতভাবে সের্গেইয়ের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকা লাগত আইনস্টাইনকে। এভাবে নিয়মিত যাওয়া আসা করতে করতে মার্গারিটার সঙ্গে আইনস্টাইনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। চল্লিশ বছর বয়স্ক মার্গারিটা তার সৌন্দর্য ও ব্যক্তিত্বের মোহনীয়তায় আইনস্টাইনকে কাবু করেছিলেন।

আইনস্টাইন আর মার্গারিটার সম্পর্কের কথা তখন কেউই জানত না। কারণ মার্গারিটা বিবাহিত ছিল। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত পুরো ব্যাপারটি গোপনই ছিল। কিন্তু সেই সময় আইনস্টাইনের নয়টি চিঠি নিলামে তোলা হয়, যেখানে ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৬ সালে মার্গারিটাকে উদ্দেশ করে লেখা তার চিঠিগুলো ছিল। এরপরই বিশ্ববাসী সর্বপ্রথম আইনস্টাইনের সঙ্গে মার্গারিটার গোপন প্রেমের সম্পর্কে জানতে পারে। অনেকে দাবি করেন সের্গেই রাখমানিনোভ নামে আরেকজনের সঙ্গেও মার্গারিটার সম্পর্ক ছিল। ১৯৮০ সালে মস্কোতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মার্গারিটা।

এর আগে ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয় স্ত্রী এলসাকে নিয়ে আইনস্টাইন তখন বাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের প্রিন্সটনে। তখন এলসা নানাবিধ অসুখে আক্রান্ত হন। তার হূদযন্ত্র আর কিডনিতে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এলসার অসুখ আইনস্টাইনের সব সমীকরণ ওলটপালট করে দিয়েছিল। ১৯৩৬ সালের ২০ ডিসেম্বর রোগে ভুগেই পরপারে পাড়ি জমান এলসা আইনস্টাইন। আইনস্টাইন শিশুর মতো কাঁদতে থাকেন এলসাকে হারিয়ে! দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল তার।

সর্বশেষ খবর