শুক্রবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

জালালউদ্দিন রুমির সুফি জীবন

ফারসি সাহিত্যে একটি প্রবাদ আছে— সাতজন কবির সাহিত্যকর্ম রেখে যদি বাকি সাহিত্য দুনিয়া থেকে মুছে ফেলা হয়, তবু ফারসি সাহিত্য টিকে থাকবে। এই সাতজন কবির একজন হলেন মাওলানা রুমি। অপর ছয়জন কবি হলেন ফেরদৌসী, হাফিজ, নিজামী, শেখ সাদি, রুদাকি এবং কবি জামি। সুফি সাহিত্যের অন্যতম কর্ণধার ভালোবাসার কবি জালালউদ্দিন রুমিকে নিয়ে আজকের রকমারি। যিনি তার কবিতায় বলেন, আমি তো মহামিলনের মহাযাত্রার অভিযাত্রী।

সাইফ ইমন

জালালউদ্দিন রুমির সুফি জীবন

কবি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি। সাহসী আর প্রেমময় উচ্চারণের কণ্ঠস্বর এই মানুষটি আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে চলে গেছেন এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু তার ভালোবাসার রাজত্ব আজও শেষ হয়নি। শিল্প সাহিত্য প্রেমী মানুষের মনের রাজ্যে তার রাজার আসন প্রতিদিন উজ্জ্বল হচ্ছে। দুনিয়ার মানুষের ভোগের নেশা কেটে যাচ্ছে তার কবিতা আর গানের ছন্দে। তাদের অন্তরাত্মা শান্তির আশায় নেশার পেয়ালা ছেড়ে এ বিশ্বজগতের মহান সত্যের সান্নিধ্য প্রত্যাশী হচ্ছে। মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি তার কবিতায় যে দিগদর্শন উপস্থাপন করেছেন তা নিয়ে তাদের গবেষণার অন্ত নেই। তার  লেখা কোনো কবিতার বই ইংরেজি অনুবাদ হয়ে বাজারে আসলেই বেস্ট সেলার, গীতিকবিতার অ্যালবাম কিনতে বিশাল লাইন পড়ে যায় দোকানের সামনে। বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বে মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি কবিদের মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত ও পঠিত। ফারসি ভাষাভাষীদের গবেষকরা জালালউদ্দিন রুমিকে তাদের সবচেয়ে বড় কবি হিসেবে দেখেন। বিশ্বে তার জনপ্রিয়তার কারণ তিনি তার কবিতার মাধ্যমে যে ভালোবাসা আর প্রেমের বার্তা তুলে ধরতে চেয়েছেন তা ভাষা ও জাতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি তার কাব্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দর্শন দিয়েছেন যা সমগ্র মানবজাতির আত্মার রহস্যের বিষয়। কাব্য-সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি গদ্যও রচনা করেছেন। তার গদ্য সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে কিছু সংলাপ, যেগুলোর মানসম্পন্ন অনুবাদ করেছেন এ জে আরবেরি। রুমি ত্রয়োদশ শতকের একজন ফারসি কবি, ধর্মতাত্ত্বিক এবং সুফি দর্শনের শিক্ষক ছিলেন। রুমি আফগানিস্তানের বলখ শহরে ১২০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাদের পরিবার ছিল বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও ধর্মতত্ত্ববিদ পরিবার। তার পিতা শেখ বাহাউদ্দিন ছিলেন সে যুগের একজন বিখ্যাত বুজুর্গ আলেম। পিতার সঙ্গে পবিত্র হজ পালনের পর সিরিয়া গমন করেন। শেষ পর্যন্ত পূর্ব রোমে সালজুকি বংশের দ্বাদশতম শাসক, সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদের (৬১৬-৬৩৪ হিজরি) আমন্ত্রণে তার রাজধানী বর্তমান তুরস্কের কুনিয়ায় গমন করেন এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে সেখানে অবস্থান করেন। জালালউদ্দিন মুহাম্মদ রুমি তার পিতার কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। ২৪ বছর বয়সে পিতার ইন্তেকালের পর তিনি সৈয়দ বোরহান উদ্দিন মুহাক্কেক তিরমিজির সাহচর্য গ্রহণ করেন। সৈয়দ বোরহান উদ্দিন ছিলেন মাওলানা রুমির পিতার শিষ্য। সৈয়দ বোরহান উদ্দিনের পরামর্শক্রমে দেশ সফরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, উচ্চতর জ্ঞান আহরণ ও তরিকতের বুজুর্গদের সাহচর্য লাভের জন্য দামেস্ক সফর করেন। দামেস্কে জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতায় পূর্ণতা হাসিলের পর তিনি পুনরায় কুনিয়া ফিরে আসেন। দীর্ঘকাল কুনিয়ায় অবস্থান করেন মাওলানা রুমি। কুনিয়া তখন পূর্ব রোমের অন্যতম নগরী এবং তা রুমিয়াতুছ ছোগরা বা ছোট রুম নামে প্রসিদ্ধ ছিল। মাওলানা রুমি কুনিয়ায় অতি সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে শিক্ষা-দীক্ষা ও অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন। এমন সময় এক মহান মজজুুব অলির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এবং তার জীবনধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। সেই মহা সাধকের নাম শামসে তাবরিজি। সাহিত্যের সামগ্রিক বিচারে রুমির মাহাত্ম্য নিহিত এইখানে যে তিনি পবিত্রতার নির্যাসটুকু হাজির করতে পেরেছিলেন তার লেখনীতে। যা মানুষকে পবিত্র ও সৌন্দর্যের সন্ধান দেয়। মানব সন্তান সীমাহীন স্বাধীনতা ও অফুরন্ত স্বর্গীয় মহিমা নিয়ে জন্মলাভ করেছে। এ দুটি পাওয়া মানুষের জন্মগত অধিকার। আর এই অধিকার পেতে হলে অবশ্যই ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। মাওলানা রুমি অত্যন্ত সরাসরি দৈনন্দিন জীবনাচরণ থেকে উদাহরণ টেনে সত্যকে জীবন্তভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। উন্মোচন করতে চেষ্টা করেছেন মানবাত্মার রহস্য। পরম করুণাময়ের ভালোবাসা কীভাবে হাসিল করা যায় তার ওপর অনেক চিত্তাকর্ষক লেখা তিনি লিখেছেন। রুমির জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ১২৪৪ সালে। সে সময় তিনি কনিয়ায় একজন অতি আশ্চর্যজনক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন। তার নাম শামস আল-দীন তাবরিজ বা শামস-ই তাবরিজ। শামস রুমিকে আধ্যাত্মিক প্রেমের সবক দেন যা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে রুমির মাঝে। শামস-ই তাবরিজ যেন সৌন্দর্য ও মহত্ত্বের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি তিনি উপলব্ধি করতে থাকেন, তিনি যেন পরম করুণাময়ের ছায়াতলে আশ্রয় পাচ্ছেন। এমতাবস্থায় এক দিন শামস-ই তাবরিজ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। আবার অনেকে ধারণা করেন শামস-ই তাবরিজ নিহত হয়েছেন। তবে এর পর থেকে রুমির মনের ভিতরে আমূল পরিবর্তন ঘটে। তার কলম দিয়ে ঝরনা ধারার মতো কবিতা বেরোতে থাকে। রুমি অবশ্য তার অনেক লেখার মাধ্যমে এ কথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন। আর বাকি থাকে না যে তিনি কোন পর্যায়ের আলেম। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সাধক কবি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি ৬৭২ হিজরির ৫ জমাদিউল আখের (১২৭৩ ইং) ৬৮ বছর বয়সে সূর্যাস্তের সময় পরম প্রেমাস্পদ আল্লাহর সন্নিধানে চলে যান।

সর্বশেষ খবর