শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

নেরুদার জীবনের চমকপ্রদ উত্থান-পতন

নেরুদার জীবনের চমকপ্রদ উত্থান-পতন

বিশ্বের হাতে গোনা শ্রেষ্ঠ কয়েকজন কবির অন্যতম পাবলো নেরুদা। জীবদ্দশায় তো বটেই, মৃত্যুর বহুকাল পরে এখন পর্যন্ত তার কবিতা বহুল পঠিত ও সমাদৃত। প্রেম, হতাশা, প্রকৃতি, রাজনীতি এবং দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা তার কবিতার মূল উপজীব্য বিষয়। লেখার ধরনে নিজস্ব শৈলী দিয়ে বারবার নিজেকেই অতিক্রম করেছেন এই কবি। তার মূল পরিচয় কবি হলেও রাজনীতিক হিসেবেও সমান সমাদৃত ছিলেন। এই বিশ্বকবির জীবনের চকমপ্রদ উত্থান-পতন নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন— তানিয়া তুষ্টি

 

তার বেড়ে ওঠা

পরিবারের কাছে জবাবদিহিতা এড়াতে এতটুকু ছেলে নিজের কবিতায় ছদ্মনাম ব্যবহার করতে থাকেন। চেক কবি জাঁ নেরুদার (১৮৩৪-১৮৯১) নামানুসারে নিজের নাম রাখেন পাবলো নেরুদা।

 

মানব প্রগতি, কল্যাণ, বিশ্বশান্তি ও সুন্দর পৃথিবীর জন্য যতগুলো শুভ বিশেষণ আছে সবই বিশ্বকবি নেরুদার জন্য শোভনীয়। তার প্রকৃত নাম নেফতালি রিকার্দো রেইয়েস বাসোয়ালেতা। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই, চিলির প্যারেল শহরে। নেরুদার বাবা ডন হোসে কারমেন ছিলেন রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। মা রোসা বাসোয়ালেতা দা রেইয়েস শিক্ষকতা করতেন। জন্মের কয়েক সপ্তাহ পরেই নেরুদা মাকে হারান। ১৯০৬ সালে তার বাবা টেমাকো শহরে গিয়ে আবার বিয়ে করেন। নেরুদার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের শুরুতে বাবা ও সৎ মায়ের সঙ্গে এই টেমাকো শহরেই কেটেছে। বাবার অপছন্দকে পাশ কাটিয়ে দশ বছরের পাবলো নেরুদা কবিতার প্রতি ছিলেন অত্যন্ত আকৃষ্ট। পরিবারের কাছে জবাবদিহিতা এড়াতে এতটুকু ছেলে নিজের কবিতায় ছদ্মনাম ব্যবহার করতে থাকেন। চেক কবি জাঁ নেরুদার (১৮৩৪-১৮৯১) নামানুসারে নিজের নাম রাখেন পাবলো নেরুদা। তিনি টেমাকো বয়েজ হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। সেই স্কুলের বালিকা শাখার অধ্যক্ষ ছিলেন বিখ্যাত নোবেলজয়ী কবি গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল। ১৯১৭ সালে শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয়ের পর নেরুদা ব্যাপক অনুপ্রেরণা পান।

মাত্র তের বছর বয়সে নেরুদা ‘লা মানানা’ দৈনিক পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। ১৯২০ সালে তিনি নিজের নাম বদলে পাবলো নেরুদা নামে সাহিত্য পত্রিকা ‘সেলভা অস্ত্রাল’-এ লিখতে শুরু করেন। এর প্রায় ২৫ বছর পর, ১৯৪৬ সালে, তিনি এই ছদ্মনামটিকেই নিজের করে প্রচার করেন।

প্রকাশক না পেয়ে নেরুদা নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে মাত্র ১৯ বছর বয়সে বের করেন প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘টুইলাইট’। বইটি তাকে ব্যাপক প্রশংসা ও পরিচিতি এনে দেয়। এর পরের বছর এক প্রকাশক আগ্রহী হয়ে প্রকাশ করে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘টুয়েন্টি লাভ পোয়েমস অ্যান্ড এ সং অফ ডিসপেয়ার’। এই বইটিও ব্যাপক খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। বলা বাহুল্য, এটিই এখনো পর্যন্ত সারা বিশ্বে তার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুলপঠিত কবিতাগ্রন্থ। অনেকে এটাকেই তার মাস্টারপিস রচনা বলে অভিহিত করেন। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি নেরুদা সান্তিয়াগোতে চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা ও অধ্যাপনা বিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন।

লেখাপড়া শেষে প্রথম চাকরি হিসেবে ১৯২৭ সালে বার্মায় পাঠানো হয় চিলির কনসাল হিসেবে। তারপর সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, আর্জেন্টিনা, ইটালি, স্পেন ও মেক্সিকোসহ বিভিন্ন দেশে একই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৩ সালে বের হয় তার সাড়া জাগানো কাব্যগ্রন্থ ‘রেসিডেন্স অন আর্থ’। স্পেনে থাকাকালে সেখানকার গৃহযুদ্ধ এবং এই যুদ্ধে তার প্রিয় বন্ধু স্প্যানিশ কবি গার্সিয়া লোরকার প্রাণহানি তাকে ভীষণ নাড়া দেয়। এই সময় তিনি রাজনীতির দ্বারা ভীষণভাবে আলোড়িত হন। প্রথমে যোগ দেন স্পেনের রিপাবলিকান পার্টি এবং পরে ফ্রান্সের রিপাবলিকান পার্টিতে। এই সময়ে লিখিত কবিতার সংকলন ‘এসপানা এন এল কোরাজন’ ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৪৩ সালে নেরুদা আবার দেশে ফেরেন। দেশে এসে প্রত্যক্ষভাবে জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৫ সালে চিলির কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং সিনেটর নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গ্যাব্রিয়েল গঞ্জালেস ভিদেলার বিজয়ের জন্য তিনি সক্রিয় প্রচারণা চালান। ১৯৫০ সালে তার বিখ্যাত এপিকধর্মী রচনা ‘কান্টো জেনারেল’ প্রকাশিত হয়। একই বছর তিনি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার, ১৯৫৩ সালে লেনিন শান্তি পুরস্কার এবং স্টালিন শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭১ সালে তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ফ্রান্সে অ্যাম্বাসাডরের দায়িত্ব পালনকালে তার রক্তে ক্যান্সার (লিউকিমিয়া) ধরা পড়ে। তখন তিনি চাকরি থেকে পদত্যাগ করে চিলিতে ফিরে যান। ১৯৭৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এই রোগেই তার মৃত্যু হয়।

 

আজও অমর

মৃত্যুর পরেও কবি হিসেবে পাবলো নেরুদার জনপ্রিয়তা সামান্যতম হ্রাস পায়নি। একদিকে তার চমৎকার প্রেমের কবিতা, অন্যদিকে রাজনৈতিক ও সমাজবাস্তবতা বিষয়ক কবিতা সব ধরনের পাঠকের কাছে তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। তিনি প্রথম জীবনে প্রেম ও প্রেমজনিত হতাশার কবিতা লিখতেন। তবে ১৯৪০ সালের পর থেকে কবি সমাজবাস্তবতার দিকে বেশি মনোযোগী হন। ক্রমান্বয়ে তার মধ্যে বামপন্থি চিন্তা জেঁকে বসে। তার কবিতার বিষয়-বৈচিত্র্য এবং আঙ্গিক-প্রকরণের দিক থেকে বারবার বাঁক বদল করে দেয়। এতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কবির লেখাগুলো পাঠযোগ্য করে রাখে। তিনি যেমন রাজনৈতিক অবস্থানে ছিলেন দৃঢ় ও অটল, তেমনি কবিতায় নারী, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি প্রেমেও ছিলেন দুঃসাহসী। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘টুয়েন্টি লাভ পোয়েমস অ্যান্ড এ সং অফ ডিসপেয়ার’ কাব্যগ্রন্থটির জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। ১৯৭০-এর দশকেই কমপক্ষে কুড়ি লাখ কপি বিক্রি হয়। কবি নিজেও অবাক হয়েছিলেন এই প্রেম-দুঃখ-যন্ত্রণার বইটি এত তরুণ ক্রমাগত পড়েই চলেছে। কবি বলেছেন, সম্ভবত এই বই তারুণ্যসংশ্লিষ্ট অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং সে সব রহস্যের উত্তর দেয়। এটা একটা শোকপূর্ণ গ্রন্থ, কিন্তু বহুল ব্যবহারেও এর আকর্ষণ হ্রাস পায়নি।’ কবির মৃত্যুর পরেও এমন সহস্র লেখা জীবিত থেকেছে। বারবার পঠিত হয়েছে পাঠকের কাছে। তার মতে, রাজনৈতিক কবিতা অন্য ধরনের কবিতার চেয়ে অনেক বেশি আবেগময়। ঠিক প্রেমের কবিতার মতোই আবেগময়। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক কবি হতে চাইলে প্রথম প্রয়োজন অন্য সব ধরনের কবিতাচর্চার মধ্য দিয়ে পার হয়ে আসা। কবিতা এবং রাজনীতি কোনো ক্ষেত্রে আপস না করেও এই প্রায়-পরস্পরবিরোধী বিষয়কে তিনি এভাবে সমন্বিত করেন। সেখানেই তার সাফল্য। সে কারণেই ব্যক্তিবাদী ও সমাজবাদীসহ সব মহলেই তার কবিতা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

 

উল্টো পথের পথিক

ব্যক্তিজীবনে প্রত্যেকটি মানুষই বিভিন্ন ধরনের আবেগ ও অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। পাবলো নেরুদাও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। পরম আনন্দ এবং চরম বিষাদ নেরুদার ব্যক্তিজীবনের মতো তার কবিতাকেও আক্রান্ত করেছে। কবিতায় তার প্রতিফলন ঘটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে যদি কেউ বিপরীত ভূমিকা পালন করে তাকে কি বলবেন? পাবলো নেরুদা ছিলেন চরম মাত্রার উল্টোপথের পথিক। দ্বৈত চরিত্রায়নে তার জুড়ি ছিল না। চরম আনন্দের সময়ও নেরুদার কবিতায় নিরানন্দাত্মক চিত্রকল্প ফুটে উঠত। আবার অনেক বেশি কষ্টের মুহূর্তে তিনি আনন্দ ও প্রেমময় রচনায় নিজের দক্ষতা প্রকাশ করতেন। তার সে সময়কার লেখা দেখে যে কেউ হয়তো ভেবে বসতেন কবি খোশ মেজাজেই আছেন। ভিন্ন আলোকে দেখলে প্রতীয়মান হয় যে, তার কবিতা ও চিত্রকল্পগুলো আসলে জীবনের ট্র্যাজেডির বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম কিন্তু শক্তিশালী প্রতিবাদ। তিনি একদিকে যেমন প্রেমের কবিতা লিখতেন, অন্যদিকে তেমনি জীবনের ভয়াবহতা থেকেও মুখ ফিরিয়ে রাখতেন না। সেটা হোক কবির সুদিনে অথবা দুর্দিনে। প্রাত্যহিক পার্থিব বস্তুনিষ্ঠতা থেকে নেরুদা কীভাবে অশুভ শক্তির বিস্তারকে তুলে আনেন তার উদাহরণ তার ‘রেসিডেন্স অন আর্থ’ কাব্যগ্রন্থ।

 

প্রেম এসেছে বারবার

প্রেম, বিয়ে, বিচ্ছেদে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করা আবেগ ও অভিজ্ঞতা তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে।

 

ভ্রমণে, চলনে, প্রবাস জীবনে, কর্মস্থলে কবি নেরুদা পেয়েছেন নারীসঙ্গ। তার জীবনে প্রেম এসেছে বারবার। দেহ সম্ভোগ আর শারীরিক আস্বাদনে লুফে নিয়েছেন তৃপ্তি। তার প্রতি আগ্রহীদের কাছে এ বিষয়ে স্বীকৃতিতে কোনো কার্পণ্য ছিল না। বিয়ে করেছেন তিনবার। প্রত্যেকটি বিয়েই ছিল প্রেমঘটিত। তার প্রথম সম্পর্ক ও বিয়ে হয় মারিয়া অ্যান্তোনিয়েতা হাগেনার ভগেলজানজিন জাভার সঙ্গে। তার সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পরে তিনি বিয়ে করেন ডালিয়া দেল কেরিলকে। দ্বিতীয় বিয়ে চিলির সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। পরবর্তীতে সেটাও ডিভোর্সের শিকার হয়। শেষে বিয়ে হয় স্বদেশি গায়িকা মাতিলতা উরুতিয়ার সঙ্গে। তাকে তিনি ১৯৬৬ সালে বিয়ে করেন। এই বিয়ে জীবনের শেষ পর্যন্ত টিকে ছিল। প্রেম, বিয়ে, বিচ্ছেদে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করা আবেগ ও অভিজ্ঞতা তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। তৃতীয় স্ত্রীকে কাছে পাওয়ার পর তার মধ্যে আবার এই রোমান্টিকতা নতুন মাত্রা নিয়ে ফিরে আসে। সেখানে নারী, প্রকৃতি ও দেশ একাকার হয়ে যায়। তার প্রেমের কবিতাগুলোয়, বিশেষ করে ‘টুয়েন্টি পোয়েমস অ্যান্ড এ সং অফ ডিসপেয়ার’ (১৯২৪) এবং ‘ওয়ান হান্ড্রেড লাভ পোয়েমস’ (১৯৬০) কাব্যে দুঃখ ও হতাশার মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে জীবনের প্রতি নেরুদার গভীর আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছে।

 

নির্বাসিত জীবন

দুই বছর দেশের অভ্যন্তরেই আত্মগোপন করে থাকার পর ১৯৪৯ সালে দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।

 

কবিরা সাধারণত কিছুটা ভাবুক, সংসার ত্যাগী, অন্যমনস্ক হয়ে থাকেন। সেখানে রাজনীতির মতো খটখটে কোনো বিষয় একেবারেই যেন বেমানান। অথচ কবিতার জগতে মধ্য গগনে যখন পাবলো নেরুদা একটি আগুনজ্বলা সূর্য তখনই তাকে রাজনীতির প্রতি ঝুঁকতে দেখা গেছে। এই কবি চিলির কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন ১৯৪৫ সালে। এমনকি সে দেশের সিনেটর হিসেবেও নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গ্যাব্রিয়েল গঞ্জালেস ভিদেলার বিজয়ের জন্য তিনি সক্রিয় প্রচারণা চালান পেশাজীবী রাজনীতিকের মতো। কিন্তু কবি রাজনীতিবিদ হলেও নিজের সততা থেকে সরে দাঁড়াতে পারেননি। ১৯৪৭ সালে খনি শ্রমিকদের ওপর গঞ্জালেসের নিপীড়নমূলক নীতিতে চুপ না থেকে বিরোধিতা করেন তিনি। এতেই সরকারি রোষের শিকার হন। তার ওপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। দুই বছর দেশের অভ্যন্তরেই আত্মগোপন করে থাকার পর ১৯৪৯ সালে দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এরপর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নির্বাসিত জীবন যাপন করেন। ১৯৫২ সালে আবার দেশে ফেরেন। নির্বাসিত থেকেও বের হয় তার কাব্যগ্রন্থ ‘লাস উভাস ওয়াই এল ভিয়েন্তো’ (১৯৫৪) এবং পরে ‘দ্য এলিমেন্টারি ওডস’ (১৯৫৯)। ততদিনে চিলির রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয় এবং নেরুদা চিলির রাজনীতি ও কবিতার জগতে জাতীয় নায়কে পরিণত হন।

 

কবির অনুপ্রেরণা

লেখালেখির পেছনে অনেক কবিরই কারও অনুপ্রেরণা থাকে। কবিতাচর্চার একেবারে প্রথমদিকে গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত কবি পাবলো নেরুদার অনুপ্রেরণার উৎস। এরপর ১৯৩৩ সালে আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে স্প্যানিশ কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তারা গভীর বন্ধুত্বে আবদ্ধ হন। নেরুদা ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেক ও শেকসপিয়রের কবিতা অনুবাদ করতেন। তিনি লোরকা, হোর্হে লুই বোর্হেস ও মিগুয়েল দা সার্ভেন্তিসের ঘনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। তবে তিনি বলতেন— ‘আমি স্প্যানিশ ভাষার কবি, কিন্তু আমি সার্ভেন্তিসের চাইতে ওয়াল্ট হুইটম্যানের কাছ থেকেই বেশি শিখেছি।’ নেরুদার ছিল নিজস্ব বিষয়চেতনা ও বক্তব্য এবং তার প্রকাশে তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজস্ব শৈলী। সাহিত্য সমালোচকরা বলেন, নেরুদা বারবার বাঁক বদল করেছেন এবং নিজেই নিজেকে বারবার অতিক্রম করেছেন। এক ছুতার মিস্ত্রি তার ঘরে ওয়াল্ট হুইটম্যানের ছবি দেখে নেরুদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি তার দাদা কিনা। মিল যতই থাকুক এই কবিরা বিষয় ও প্রকরণে তাকে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেননি।

 

রাজনীতির মঞ্চে কবি

প্রেমের কবি, প্রকৃতির কবি ও দেশপ্রেমিক কবি পাবলো নেরুদা। তিনি রাজনৈতিক আদর্শে ছিলেন ঘোর মার্কসবাদী। সিনেটর নির্বাচিত হন। একবার প্রেসিডেন্ট পদেও প্রার্থী হয়েছিলেন। তার চরিত্র বর্ণনায় অনেকেই ‘প্রেম ও রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পাবলো নেরুদা বেঁচে থাকাকালীন কবি হিসেবে কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করেন। একই সঙ্গে তার রাজনৈতিক দর্শন সমাজতান্ত্রিক ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য করে তোলে। নেরুদা পুরোদমে যেমন রাজনীতিক তেমনি রাজনৈতিক কবিতাও লিখেছেন। কিন্তু সাহিত্যের উৎকর্ষের ক্ষেত্রে কখনো আপস করেননি। তার কবিতা এতটাই উঁচু মানের এবং নিজস্ব শৈলীর যে তাকে কোনো বিশেষ শ্রেণি বা ধরনের অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। তারপরেও তার রচনাসমগ্রকে চারটি ধারায় বিভক্ত করে দেখা হয়। প্রথম ধারায় রয়েছে প্রেম ও দুঃখ-হতাশার কবিতা। এর মধ্যে বিখ্যাত হচ্ছে টুয়েন্টি লাভ পোয়েমস অ্যান্ড এ সং অফ ডিসপেয়ার (১৯২৪) এবং দ্য ক্যাপটেইন ভার্সেস (১৯৫২)। দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিতাগুলো একাকীত্ব ও নিপীড়নের অভিজ্ঞতা থেকে রচিত, যেমন রেসিডেন্স অন আর্থ (১৯৩৫)। তৃতীয় পর্বের কবিতাগুলো এপিকধর্মী। জেনারেল স্টাডি (১৯৫০) এই ধারার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এ ছাড়া তিনি বাস্তব জীবনের সাধারণ বস্তু নিয়ে কবিতা লিখেছেন, যেমন এলিমেন্টারি ওডস (১৯৫৪)। আসলে প্রেম, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, প্রকৃতি এবং রাজনীতি তার কবিতার মূল বিষয় হয়ে এসেছে বিভিন্ন সময়। সাহিত্য সমালোচকরা বলেন বিষয়গত ঐক্য থাকলেও তার প্রতিটি গ্রন্থ, এমনকি প্রতিটি কবিতাই প্রকরণগতভাবে একক ও অনন্যসাধারণ।

 

অবিস্মরণীয় সেই বক্তৃতা

১৯৭১ সালে তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পুরস্কার গ্রহণকালে তিনি যে বক্তৃতা দেন তা এখনো অবিস্মরণীয় হয়ে আছে ভক্তদের কাছে। তার বক্তব্য ছিল, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আমি কোনো বই পড়ে কবিতা লিখতে শিখিনি। কাউকে আমি শেখাতেও পারব না কী করে কবিতা লিখতে হয়। আজকের এই পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সেই দিনটির কথা মনে করলে কিছু ভাবনার সৃষ্টি হয়। সেই ভাবনাগুলোকে আমি ভেজাল শব্দবন্ধ দিয়ে প্রকাশ করি না, কিন্তু নিজের কাছে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। তাই আমার এই পথচলার কাহিনী দিয়ে একটা কবিতা তৈরি হয়ে যায়। তাতে আমি মাটি থেকে উপাদান নিই, আত্মা থেকে উপাদান নিই। আমার কাছে কবিতা একটা কাজ, একটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ক্ষণস্থায়ী কাজ, যার মধ্যে মিশে আছে একাকীত্ব, ভাবনার বিশ্বস্ততা, আবেগ ও গতি, নিজের কাছে আসা, মানুষের যে সমাজবদ্ধতার চেতনা, তা সম্ভব হয়েছে। কারণ মানুষের একটা প্রচেষ্টা আছে স্বপ্ন আর বাস্তবকে একসঙ্গে মেলানোর। কবিতা এই স্বপ্ন আর বাস্তবকে মেলানোর কাজটা করে। আমি যখন সেই পাহাড়ি নদী পার হচ্ছি, যখন ষাঁড়ের খুলি ঘিরে ঘিরে নাচছি, যখন সেই পোড়ো বাড়িতে স্নান করে শুদ্ধ হচ্ছি, তখন আমি জানি না যে আমিই এগুলো কবিতায় লিখে অন্যকে জানাচ্ছি না অন্যরাই তাদের বক্তব্যগুলো এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে আমায় জানিয়েছে। আমি জানি না আমার এই অভিজ্ঞতাগুলো আমারই তৈরি কিনা, আমি জানি না এগুলো সত্যি না কবিতা, এগুলো স্থায়ী না ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু এই অভিজ্ঞতাগুলোই আমার কবিতার উপাদান। এই ঘটনাগুলো থেকেই কবি অন্যের কাছ থেকে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে। এমন কোনো একাকীত্ব নেই যা অনতিক্রম্য। সব পথের শেষ এক, সবাইকে জানানো যে আমরা কে, আমরা কী, আমাদের একাকীত্ব ভুলে মুশকিলগুলোকে দূরে সরিয়ে স্তব্ধতা কাটিয়ে আমরা পৌঁছব আশ্চর্য দেশে, সেখানে আমরা গাইব আমাদের দুঃখের গান, বা নাচব বেতালে কিন্তু সেই নাচ-গানই আমাদের মনুষ্যত্ব, আমাদের বিবেক বা আমাদের সচেতনতা প্রকাশের আদিতম আচার, যা পালন করার মাধ্যমে আমরা বিশ্বাস করি আমরা মানুষ, আমরা বিশ্বাস করি আমাদের সবার নিয়তি একই।

 

দেশে দেশে নেরুদা

নেরুদার প্রেমের কবিতায় যেমন আছে উর্বর বিস্ফোরক ও দুরন্ত দেহলি, তেমনি আছে নিসর্গ ঐশ্বর্য, সজীব প্রকৃতি। সেখানে খুঁজে পাবেন বহমান নদী আর মাটি ও মানুষ এবং ফসল তোলার গান। তার একটি অসাধারণ কবিতা ‘দুরন্ত দেহলি’- ‘তুমি এক উর্বর দুরন্ত দেহলি- বিস্ফোরক তোমার দেহ, যেন কারুময় বিন্যাসে এক নান্দনিক শৈল আর পালিম করা স্তম্ভের মতো মসৃণ শ্বেতশুভ্র তোমার উরু এবং তোমাকে মনে হয় অপরূপ কাব্যময় এক পৃথিবী আরও মনে হয় তোমাকে-ব্রীড়াময় ভঙ্গিমায় নিবেদিত এক শায়িতা।...’

এসব কবিতা বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় অনূ দিত হয়েছে। হয়তো দেশে দেশে তার শিরোনাম তাদের ভাষায় বদলে গেছে। কিন্তু ভাবার্থ থেকেছে এক। নেরুদার ‘বিশটি প্রেমের কবিতা’ কমপক্ষে পঞ্চাশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এসব কবিতার আবেদন শুধু চিলি, স্পেন কিংবা লাতিন আমেরিকায় নয়, সমগ্র বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা জীবনের বিশেষ মুহূর্তে এর কবিতা রক্তের স্পন্দনে উচ্চারণ করেছে। অনেকে হাতে লিখে একান্ত প্রিয়জনকে উপহার দিয়েছে তার কবিতা। নেরুদার নির্বাসিত জীবনে থেকেও  বেনামিতে ইতালিতে একটি প্রেমের কাব্য প্রকাশিত হয়। ব্যক্তিজীবনের অনেক গোপন বিষয় বইটির সঙ্গে জড়িত ছিল। ১৯৭২ সালে ডোনাল্ড ডি ওয়ালশ-এর ইংরেজি ভাষান্তরে বইটি প্রকাশ পায়। ভূমিকায় ওয়ালস বলছেন কবিতাগুলোর সঙ্গে মাতিলদে প্রেমের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কবিতাগুলোর দেহ ও আত্মা। আমরা জানি মাতিলদে নেরুদার দ্বিতীয় স্ত্রী। বইটিতে প্রকাশ পেয়েছে নেরুদার প্রেম ও ক্রোধ। আর যুগে যুগে আন্দোলিত করেছে বহু যুবক হৃদয়।

সর্বশেষ খবর