শুক্রবার, ৮ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিশ্বজুড়ে অপূর্ব মুসলিম স্থাপনা

তানভীর আহমেদ

বিশ্বজুড়ে অপূর্ব মুসলিম স্থাপনা

তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক সুলতান আহমেদ মসজিদ, অনেকেই চেনেন ইস্তাম্বুলের ব্লু মস্ক বা নীল মসজিদ নামে

ইসলামিক স্থাপত্যবিদ্যার প্রশংসা সারা বিশ্বেই। নিজস্ব নকশা ও স্থাপত্যশৈলীর কারণে ইসলামিক স্থাপনাগুলো মানুষকে হাজার বছর ধরে মুগ্ধ করে আসছে। মুসলিম শাসকরা তাদের সাম্রাজ্য ছড়িয়েছিলেন গোটা বিশ্বে। তাই ইসলামিক স্থাপত্য নিদর্শন ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে। ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর মধ্যে রয়েছে মসজিদ, রওজা, রাজপ্রাসাদ, দুর্গ, সেতুসহ বিভিন্ন ধরনের দালান। পারস্য অঞ্চলের পাশাপাশি ইসলামিক স্থাপনাগুলো গড়ে উঠেছিল ইউরোপ থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত। অটোমান সাম্রাজ্যের বিস্তার ইসলামিক স্থাপনাকে নিয়ে গিয়েছিল অন্যমাত্রায়। ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি ইসলামিক স্থাপনাগুলো সভ্যতা ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শত, সহস্র ইসলামিক স্থাপনার মধ্য থেকে কয়েকটি নিদর্শন নিয়ে আজকের রকমারি—

 

 

ইস্তাম্বুলের নীল মসজিদ

তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক মসজিদ সুলতান আহমেদ মসজিদ। সুলতান আহমেদ মসজিদটি তুর্কি স্থাপত্যের এক অনন্য উদাহরণ। ১৯৩৪ সালে ‘হাজিয়া সুফিয়া’-কে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করার পর ইস্তাম্বুলের প্রধান মসজিদে পরিণত হয় ব্লু মসজিদ। মসজিদের ভিতরে ঢুকলে মনে হবে সমুদ্র জলরাশির রঙে রাঙানো। ভিতরের দেয়াল নীল রঙের টাইলস দিয়ে সাজানো হয়েছে। বাইরে থেকে এই নীল রঙের ঝিলিক দেখে অনেকেই একে বলেন ‘ব্লু মস্ক’ বা নীল মসজিদ। এর মিনার ও গম্বুজগুলো সিসা দ্বারা আচ্ছাদিত এবং মিনারের ওপরে সোনার প্রলেপযুক্ত তামার তৈরি ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছে। ১৬০৯ থেকে ১৬১৬ সালের মধ্যে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান আহমেদ বখতি এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিক এ মসজিদটির স্থপতি ছিলেন মুহাম্মদ আগা। মসজিদ কমপ্লেক্সে একটি মাদ্রাসা, একটি পান্থনিবাস এবং প্রতিষ্ঠাতার সমাধি  অবস্থিত।

 

তাজমহল [ভারত]

বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি তাজমহল। মোগল সম্রাট শাহজাহান তার তৃতীয় স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মৃতি রক্ষার্থে এটি তৈরি করেছিলেন। তাজমহল খুব ভোরে গোলাপি, দিনে সাদা ও চাঁদের আলোয় সোনালি রঙের দেখায়। এই অনন্য স্থাপনাটির স্থপতি ছিলেন আহমেদ লাহোরি। তাজমহল নির্মাণের জন্য তিনি ২২ হাজার মানুষ নিযুক্ত করেন। যারা ছিলেন শ্রমিক, স্টোনকাটার, চিত্রশিল্পী, সূচিকর্মশিল্পী ও ক্যালিগ্রাফার। সম্রাট রাজস্তান, আফগানিস্তান, তিব্বত ও চীন থেকে মার্বেল পাথর আনিয়েছিলেন। এ ছাড়াও ২৮ ধরনের মূল্যবান ও আধামূল্যবান পাথর সাদা মার্বেলের ওপর বসানো হয়েছিল। যার মধ্যে আকর্ষণীয় নীলকান্তমণি ও ছিল। তাজমহলের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ সালে এবং সম্পন্ন হয়েছিল ১৬৫৩ সালে। এটি সম্পন্ন করতে ২২ হাজার শ্রমিকের ২২ বছর সময় লেগেছিল।

 

গোলাপি মসজিদ [ইরান]

চোখ ধাঁধানো মসজিদগুলোর তালিকা করলেই নাম উঠে আসে গোলাপি মসজিদের। ইসলামিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোরও একটি এটি। ইরানি স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মসজিদ ইরানের অন্যতম সুন্দর একটি মসজিদ। গোলাপি মসজিদ নামে পরিচিত এই মসজিদটি আসল নাম নাসির উল মুলক মসজিদ। ইরানের শিরাজে অবস্থিত এই ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। মসজিদটি অনেক রঙ্গিন কাচ দিয়ে সাজানো হয়েছে। যে কারণে মসজিদের ভিতরে লাল-নীল-বেগুনি-গোলাপির দ্যুতি ছড়ায়। নকশার কারুকাজ অতুলনীয়। মসজিদের ভিতরের জলাশয় সবাইকে মুগ্ধ করে। এই মসজিদকে গোলাপি মসজিদ বলার কারণ এতে অনেক গোলাপি রঙের টাইলস নকশা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৮৭৬ থেকে ১৮৮৮ সালের মধ্যে মির্জা হাসান আলী (নাসির উল মুলক) এর আদেশে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।

 

আবদুল কাদের জিলানির (রহ.) রওজা [ইরাক]

গাউসুল আজম খ্যাত বড়পীর আবদুল কাদের জিলানির রওজা ইরাকের বাগদাদ শহরে। তার রওজাকে ক্রেন্দ্র করে বাগদাদে গড়ে উঠেছে কাদেরিয়া সুফি কমপ্লেক্স। জায়গাটিকে বলা হয় কিলানি স্কয়ার। এর ভিতরে রয়েছে সুদৃশ্য মসজিদ, রওজা শরিফ ও বিশাল একটি লাইব্রেরি। লাইব্রেরিতে বহু পুরনো বইয়ের সমাহার। কাদেরিয়া লাইব্রেরি নামে এটি সারা বিশ্বের ইসলাম ঐতিহ্য গবেষকদের কাছে পরিচিত। শাহ ইসমাইলির আমলে রওজাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৫৩৫ সালে অটোমান সুলতান সুলাইমান এই রওজার ওপর বড় গম্বুজ বসান এবং সংস্কার করে আজকের রূপটি দেন। ২০০৭ সালে এই রওজায় গাড়ি বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

 

কুব্বাত আস সাখরা [জেরুজালেম]

জেরুজালেমের পুরনো শহরের টেম্পল মাউন্টের ওপর রয়েছে কুব্বাত আস সাখরা। ইতিহাস বলছে, বারবার এর দখল নিয়ে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ইবনে মারওয়ানের আদেশে ৬৯১ সালে এর নির্মাণ সমাপ্ত হয়।

উমাইয়া স্থাপত্যে বাইজেন্টাইন প্রভাবের উদাহরণ এখানে রয়েছে। ইহুদিদের দ্বিতীয় মন্দির এখানে অবস্থিত ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। অন্যদিকে, মুসলিম বিশ্বাসীরা এই স্থানটিকে পবিত্র মেরাজের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে থাকেন। ইহুদি ও মুসলিম শাসকদের পালা বদলে বারবার ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনার ইতিহাসও বদলেছে। বর্তমানে ইসলামের অন্যতম প্রাচীন এই স্থাপনা ইসরায়েলি সেনারা দখল করে রেখেছে।

 

মেহমেদ পাশা ব্রিজ  [বসনিয়া-হার্জেগোভেনিয়া]

ইতিহাস জড়ানো মেহমেদ পাশা সকলোভিক ব্রিজ। স্থানীয়রাা বলেন, পাশা ব্রিজ। দক্ষিণ ইউরোপের নির্জন এক দেশ বসনিয়া-হার্জেগোভেনিয়া। বলকান অঞ্চলের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাসের সঙ্গে ইসলামিক স্থাপত্যের নিদর্শন এই সেতুটি। অটোমান সাম্রাজ্যের গৌরব মাখানো ব্রিজ এটি। এই ব্রিজটি তৈরি করা হয় ১৫৭৭ সালে। স্থাপত্যশৈলীতে তুরস্কের নকশাবিদদের ছোঁয়া পাওয়া যায়। ১১টি ধনুকের মতো বাঁকানো স্তম্ভের প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে নদীর ওপর। কখনো শান্ত, কখনো রুদ্র দ্রিনা নদীর ওপর এই ব্রিজটি এখনো মনে করিয়ে দেয় মুসলিম শাসকদের ঐশ্বর্য ও স্থাপত্যবিদ্যার গৌরবের কথা। ৫৮৯ ফুট দীর্ঘ ব্রিজটি বিখ্যাত স্থপতি মিমাম সিনারের মাস্টারপিস হিসেবে গণ্য।

 

আলহাম্বরা [স্পেন]

স্পেনের আন্দালুসিয়ার গ্রানাডা শহর। গ্রানাডা শহরের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের আসসাবিকা পাহাড়ের ওপর রয়েছে এক দুর্গ। প্রাসাদও রয়েছে দুর্গের ভিতরে। পুরো জায়গাটিকে বলা হয় আলহাম্বরা। ১৩০০ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে আন্দালুসের গ্রানাডা আমিরাতের মরিশ শাসকরা এটি নির্মাণ করেন। আলহাম্বরা প্রাসাদটি নাসরি রাজবংশের শাসনকালে তৈরি করা হয়েছিল। তখন এটি রাজার বাসস্থান এবং রাজসভা হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

১২৩৮ সালে, মুহাম্মদ ইবনে নাসর গ্রানাডা দখলের জন্য এলভিয়ার দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেন এবং তিনি এর নাম দেন আল-হামার যার অর্থ লাল, কারণ তার দাড়ির রং ছিল লাল। এত বিশাল প্রাসাদ ও দুর্গ নির্মাণের জন্য কোনো নকশাবিদের পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। তাই এটির অবিন্যস্ত গঠন দেখে অনেকেই বিস্মিত হন।

 

রোম মসজিদ [ইতালি]

খ্রিস্টানদের কাছে ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ রোমেই রয়েছে ইসলামিক স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন রোম মসজিদ। বিশাল এই মসজিদটিকে ডাকা হয় মস্কো দি রোমা নামে। তবে মুসলিম বিশ্বের কাছে এটি রোম মসজিদ নামেই পরিচিত। বিশাল এই মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। প্রায় দশ বছর লাগে মসজিদটির নির্মাণ কাজ শেষ হতে। ১৯৯৫ সালের ১ জুলাই মসজিদটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। তিন লাখ বিশ হাজার বর্গফুটের এই মসজিদটি ইসলামিক স্থাপত্যের গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। এর ভিতর একত্রে ১২ হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন। রোম মসজিদ ইতালি ও ইউরোপের সবচেয়ে বড় মসজিদ। আফগানিস্তানের রাজপুত্র মুহাম্মদ হাসান ও তার স্ত্রী রাজিয়া বেগমের উদ্যোগের পাশাপাশি সৌদি আরবের যুবরাজ ফয়সাল এই মসজিদ নির্মাণের জন্য অর্থ সহায়তা করেন। মসজিদটি নির্মাণে খরচ হয় ৪০ মিলিয়ন ইউরো। ইসলামিক স্থাপত্য হিসেবে এটি বেশ আলোচিত হলেও এর স্থপতি দুজন কেউই মুসলমান নন।

 

ষাট গম্বুজ মসজিদ [বাংলাদেশ]

মুসলিম স্থাপত্যের গুরুত্ব ও নান্দনিকতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থাপনার নাম বারবার উঠে এসেছে গবেষকদের কাছে। তারই একটি ষাট গম্বুজ মসজিদ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা বাগেরহাট শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত এই মসজিদটি। এই মসজিদ ১৫ শতকে নির্মিত। ধারণা করা হয়, সুলতান নসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৫-৫৯) আমলে খান আল-আজম উলুগ খানজাহান সুন্দরবনের কোলঘেঁষে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তোলেন। খানজাহান বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল গড়ে তোলেন, যা পরে ষাট গম্বুজ মসজিদ হয়। মসজিদটি ষাট গম্বুজ নামে পরিচিত হলেও এতে মোট গম্বুজ আছে ৮১টি। মসজিদের চার কোণের মিনার বা বুরুজের উপরের ৪টি গম্বুজ বাদ দিলে গম্বুজ সংখ্যা ৭৭টি। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। এ মসজিদটিকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে মর্যাদা দেয়।

সর্বশেষ খবর