শুক্রবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
দুই নক্ষত্রের গল্প

একজন নীল লোহিত

২৩ অক্টোবর ছিল কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন। ওই দিনই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যের নন্দিত দুই কথাসাহিত্যিক, ধ্রুবতারা। নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে তাদের কবিতা, গান, উপন্যাস ও অন্যান্য রচনা। তাদের স্মরণেই এই আয়োজন—

তানভীর আহমেদ

একজন নীল লোহিত

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় [জন্ম : ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ মৃত্যু : ২৩ অক্টাবর ২০১২]

ছেলেটার বয়স তখন ষোলো। ওই বয়সেই প্রেম সাগরে ডিঙি ভাসানো, প্রেমিকার জন্য লিখলেন কবিতা ‘একটি চিঠি’—

‘বলাকা তোমার শুভ্র চোখেতে পায়নি ঘুম?

জানোনা কি এটা কুয়াশায় ঢাকা

রাত নিঝুম!

স্বপ্ন দেখো না? এখনো কি তার

সময় নয়?

বলাকা, তুমি কি পেয়েছো ভয়?’

১৯৫০ সালের ওই প্রেম টেকেনি। কিন্তু এখনো জ্বলজ্বল করছে কবিতাটি। ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হওয়া ওই কবিতার কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তারপর তিন বছর কোনো কবিতা বেরোয়নি তার। তাই বলে ওই তিন বছর কলম থেমে ছিল না। কবিতা ছাপায় অনাগ্রহ। সাহিত্যপাড়ায় কেউ চেনে না তাকে, তিনিও চেনেন না কাউকে। তিন বছর পর একে একে আরও তিনটি কবিতা ছাপা হলো তার। আর থামেননি। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গান, সাহিত্যের সাগরে উত্তাল ঢেউয়ে ভাসালেন পাঠকদের। বাংলা সাহিত্যের ধ্রুবতারা হয়ে ওঠা সুনীলের কবিতা, উপন্যাস, গল্প ও অন্যান্য রচনা এখনো পাঠকদের মোহগ্রস্ত করে রাখে।

১৯৩৪ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্ম নেওয়া সুনীল দেশভাগের পর চলে যান কলকাতায়। তখন তার বয়স চার বছর। বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। টাকার অভাবে শৈশব, কৈশোর পার করেছেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর কদিন ছুটি। ওই অবসরে ছেলে যেন বখে না যায় তাই বাবা বললেন টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করে দিতে। দুপুরে বসতেন টেনিসনকে নিয়ে। কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে দেখলেন বাবা আক্ষরিক অনুবাদের চেয়ে সাহিত্যের অমৃতটাই চাইছেন। শুরু হলো কবিতা লেখা। ১৯৫৩ সালে বেশ কয়েকটি কবিতা, তারপর ছোট গল্প দিয়ে পাঠকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে দিলেন।

সুনীলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েক জন’ প্রকাশ পায় ১৯৫৮ সালে। ভবঘুরে মন তার, জীবনটাও কাটিয়েছেন ওভাবে। কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে বন্ধুত্বটা ছিল পাকাপোক্ত। ১৯৬৩ সালে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পল এঙ্গেলের আমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক লেখক কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলেন সুনীল। তখন নিউইয়র্কে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদর দালির সঙ্গে পরিচয় হয় তার। বিলেতে দেখা করেন স্টিফেন স্পেন্ডার এবং টি এস এলিয়েটের সঙ্গে। ফরাসি বান্ধবী মার্গারিটের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন প্যারিসে। একা একা ছুটলেন সুইজারল্যান্ড, রোম, কায়রো। পায়ের তলায় সর্ষে আর কিং! তারপর দমদম (নেতাজি সুভাষ বোস) বিমানবন্দরে যখন নামলেন সুনীল, পকেটে ছিল সবে মাত্র দশ টাকা! অর্থ সংস্থানে ছোটখাটো নানা কাজে জড়িয়েছিলেন। আমেরিকায় ডিগ্রি শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপগ্রন্থাগারিক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন সুনীল। অফিসের আটটা থেকে পাঁচটার চাকরি করেছেন। কিন্তু পায়ে শিকড় গজাতে দেননি। আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পুরোদস্তুর সাংবাদিক হয়ে উঠলেন। তার প্রথম উপন্যাসও ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশ পায় আনন্দবাজারে। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘অর্জুন’, ‘জীবন যে রকম’, ‘যুবক-যুবতীরা’ লিখে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সন্তু-কাকাবাবু সিরিজ দিয়ে পাঠকপ্রিয়তা আকাশ পেড়িয়ে গেল। আশির দশকে সুনীল নিজেই হয়ে উঠলেন মহীরুহ। ঐতিহাসিক উপন্যাসে হাত দিলেন তিনি। জন্ম নিল ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘প্রথম আলো’। বাংলা সাহিত্যের রত্নভাণ্ডারে সুনীলের লেখাগুলো দুর্লভ নীলকান্তমণির মতো আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে। তার ঝরঝরে লেখনী, সময় ও মানুষের গল্প বলেছে। বাউণ্ডুলেদের জীবন টেনেছে তাকে, তার গল্প-উপন্যাসে সে ছাপ স্পষ্ট। তার পাঠকপ্রিয় উপন্যাস হচ্ছে— যমজ কাহিনী, অচেনা মানুষ, ছায়া দর্শন, মধুকাহিনী, আমার স্বপ্ন, আঁধার রাতের অতিথি, অন্য জীবনের সাধ, স্বপ্ন সম্ভব, সুনীলের সাত দিন, রাণী ও অবিনাশ ইত্যাদি। উপন্যাস ছাড়াও সুনীল ভ্রমণকাহিনী, শিশুতোষ গল্প, প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তার সাহিত্যিক ছদ্মনাম ছিল নীল লোহিত, সনাতন পাঠক আর নীল উপাধ্যায়।

 

সুনীলের বিনা টিকিটে ঘোরাঘুরি

আধা বোহেমিয়ান সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। প্রতিদিন সকালবেলা লিখতে বসতেন। লিখলেন পঞ্চাশ বছর! কে বলবে আধা যাযাবর এই মানুষটির শখ ছিল ঘুরে বেড়ানো? তার ‘পায়ের তলায় সর্ষে’ থেকে কিছু অংশ—

 

‘বিনা টিকিটে অনেক ঘুরেছি। একবার এ রকম হল, কোথায় যেন যাচ্ছি ট্রেনে করে, একজন বন্ধু চেকারকে দেখে বাথরুমে ঢুকে লুকিয়ে রয়েছে। শীতের রাত্রি ছিল, প্ল্যাটফর্মে নেমে ঘোরাঘুরি করাটা সুবিধার ছিল না মোটেই। টিকিট চেকার এদিক থেকে ওদিকে টিকিট চেয়ে-চেয়ে ঘুরছে। হঠাৎ দেখি, সে কানে পৈতে গুটোচ্ছে। মানে, সেও যাবে বাথরুমে। বাথরুম বন্ধ। কিন্তু সে যদি বোঝে বাথরুমে একজন কেউ রয়েছে, সে হয়তো অপেক্ষা করবে তার টিকিট দেখার জন্য। তখন কী করা! আমাদের এক বন্ধু করল কি, টিকিট চেকারটাকে ঠেলে সরিয়ে ওই বাথরুমটাতেই ঢুকে গেল। ভাবটা এমন যেন সে আর হালকা না হয়ে থাকতে পারছে না। যদি কখনও চেকার ধরত, ধরা পড়েছিও বেশ কয়েকবার, বিশেষ কিছু অবশ্য করত না। আমরা শুনতাম জেলে-টেলে দেয়। তা কিন্তু দিত না। প্ল্যাটফর্মে বসিয়ে রাখত অনেকক্ষণ। তারপর বলত দু-টাকা দাও, কি তিন টাকা দাও। তারপর ছেড়ে দিত। দু-টাকা দিয়ে যদি দশ-বারো টাকার টিকিট খরচা বাঁচানো যেত তো ভালোই হত ব্যাপারটা। জানি না, এখন কী শাস্তি দেয়, অথবা ঘুষের রেটটা কত বেড়েছে।’

 

সুনীলের প্রেমপত্র

প্রেম প্রস্তাব দেওয়ার পর রাজি হয়ে যান স্বাতী। সুনীল তাকে লিখলেন এই প্রেমপত্র—

 

স্বাতী,

মনটা কী চমৎকার হালকা হয়ে গেছে আমার, কী যে ভালো লাগছে আজ। যে কথাটা বলার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে ঘুরেছি এ কদিন, অথচ মুখ ফুটে বলতে পারিনি, বলার সাহস হয়নি, সেদিন সন্ধ্যেবেলা যখন হঠাৎ বলে ফেললুম, হাঁটুর উপর মুখ রেখে তুমি যখন আস্তে বললে ‘হ্যাঁ’, সেই মুহূর্তে আমার জীবনটা বদলে গেল। আমি তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, তোমাকে হারাবার ক্ষতি কিছুতেই আমি সহ্য করতে পারবো না। এই কথাটা প্রবলভাবে দাবি করতে চেয়েছিলুম, কিন্তু ভয় ছিল যদি এ আমার স্বার্থপরতা হয়, তাছাড়া, আমি তোমাকে চাই, তুমি যদি আমাকে না চাও? সত্যিই, স্বাতী, সত্যিই তুমি আমার হবে, এবং আমি তোমার হবো? আমি তো তোমার হয়েই আছি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর