শুক্রবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইবনে বতুতার বিশ্বভ্রমণ

ইবনে বতুতার বিশ্বভ্রমণ

সাতশ বছর আগে সুদূর মরক্কোর তাঞ্জিয়ের থেকে পৃথিবী দেখার নেশায় ঘর ছেড়েছিলেন এক মুসলিম যুবক। তিনি ইবনে বতুতা। বিশ বছর বয়সেই শুরু করেন পর্যটক জীবন। মধ্যপ্রাচ্য ইরাক, ইরান, বসরা, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ঘুরে এসেছিলেন এই আমাদের বাংলায়ও। জীবনের ৩০ বছরে তিনি ভ্রমণ করেছেন ৭৫ হাজার মাইল বা ১ লাখ ২১ হাজার কিলোমিটার পথ। তার পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ। ইবনে বতুতার ভ্রমণজীবন নিয়ে লিখেছেন- সাইফ ইমন

 

আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে বতুতা ছিলেন মুসলিম পর্যটক, চিন্তাবিদ, বিচারক। তিনি ১৩০৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মরক্কোর তাঞ্জিয়েরে জন্মগ্রহণ করেন। ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়া এক ঐতিহাসিক নাম তিনি। বিশ্ববিখ্যাত এই ভ্রমণপিপাসু ব্যক্তি ঘুরে বেড়িয়েছেন আফ্রিকা থেকে ভারত উপমহাদেশ, ভারত থেকে তুরস্ক পর্যন্ত। এমনকি বাংলাদেশেও তার পদচিহ্ন পড়েছে। তিনি বিশাল এ পথ পাড়ি দিতে কখনো পেড়িয়েছেন নদীপথ, কখনো উট কাফেলায় আবার কখনোবা পায়ে হেঁটে। ২১ বছর বয়স থেকে তার এ ভ্রমণ শুরু। এরপর প্রায় ৩০ বছর বিশ্বভ্রমণ করেছেন। অনেকে মার্কো পালোকে তার সমকক্ষ মনে করেন। তবে মার্কো পালোর চেয়ে ইবনে বতুতা বেশি অঞ্চল ভ্রমণ করেছেন। এ কারণে অধিকাংশ ইতিহাসবিদ ইবনে বতুতাকেই বিশ্বের সেরা ভ্রমণকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। বিশ্বভ্রমণের সময় তিনি জীবনের অনেকটা সময় কাজীর চাকরি করেছেন, মন্ত্রীর মেয়ের পাণিগ্রহণ করেছেন। এমনকি কখনো রাষ্ট্রদূত কখনো সেনাকমান্ডের দায়িত্বও পেয়েছেন। বেশির ভাগ ভ্রমণে ইবনে বতুতার সঙ্গে কাফেলা ছিল। তিনি নিজে একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তার পূর্বপুরুষরা কাজীর পেশায় ছিলেন। ফলে তিনি যে দেশে গেছেন সেখানেই রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়েছেন।

নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিশেষ প্রয়োজনে তিনি কখনো কখনো পরিচয় গোপন করেছেন এবং কূটনৈতিক কারণে ভিন্ন নামও ব্যবহার করেছেন। চীনে তার নাম ছিল শামসুদ্দিন এবং ভারতে তার নাম ছিল মাওলানা বদর উদ্দীন। ইবনে বতুতা সারা জীবন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে বেড়িয়েছেন। পৃথিবী ভ্রমণের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছেন তিনি। প্রথম তিনি পবিত্র হজ পালন করার জন্য মক্কার উদ্দেশে রওনা হন। জীবনের পরবর্তী ৩০ বছর তিনি প্রায় ৭৫ হাজার মাইল (১,২০,০০০ কি.মি.) অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি সে সময়ের সমগ্র মুসলিম বিশ্ব ভ্রমণ করেছিলেন। সে সময়ের সুলতানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের কথা লিখে গেছেন। তিনি যেমন মহান মুসলিম শাসকদের গুণগান করেছেন তেমনি অত্যাচারী শাসকদের বর্বরতার কথাও লিখেছেন। বর্তমান পশ্চিম আফ্রিকা থেকে শুরু করে মিসর, সৌদি আরব, সিরিয়া, ইরান, ইরাক, কাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং চীন ভ্রমণ করেছিলেন। তার কিছুকাল আগে এমন দীর্ঘ ভ্রমণ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন ভেনিসের ব্যবসায়ী এবং পরিব্রাজক মার্কো পোলো। কিন্তু তিনি মার্কো পোলোর চেয়েও তিনগুণ বেশি পথ সফর করেছেন। ভ্রমণকালে তিনি এই উপমহাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, সুফি, সুলতান, কাজী এবং আলেমদের সাক্ষাৎ লাভ করেন। ৩০ বছরে প্রায় ৪০টি দেশ ভ্রমণ করে নিজ দেশ মরক্কোয় ফেরার পর মরক্কোর সুলতান আবু ইনান ফারিস তার ভ্রমণ কাহিনীর বর্ণনা লিপিবদ্ধ করার জন্য একজন সচিব নিয়োগ করেন। এই ভ্রমণ কাহিনীর নাম ‘রেহলা’। এটিকে ১৪০০ শতকের পূর্ব, মধ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সাম্রাজ্যের ইতিহাসের অন্যতম দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বাংলাদেশেও এসেছিলেন তিনি। বর্তমান বাংলাদেশ তৎকালীন বাংলা সম্পর্কে তিনি বলেন, টানা তেঁতাল্লিশ রাত সাগরে কাটিয়ে অবশেষে আমরা বাংলাদেশে  পৌঁছলাম। সবুজে ঘেরা বিশাল এক  দেশ, প্রচুর চাল পাওয়া যায়। অন্যসব জিনিসও এত সস্তায় পাওয়া যায় সে  দেশে যে, এরকম আর কোথাও দেখিনি। ইবনে বতুতার বাংলাদেশে আসার উদ্দেশ্য ছিল হজরত শাহ জালাল (র.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, হজরত শাহ জালাল (র.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পর পথিমধ্যে দুই দিনের দূরত্বেই দুজন শিষ্যের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ইবনে বতুতার। তাদের কাছে নির্দেশ ছিল, পশ্চিম থেকে যে পর্যটক হজরত শাহ জালাল (র.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসছেন তাকে যেন স্বাগত জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

অথচ ইবনে বতুতার সঙ্গে হজরত শাহ জালাল (র.)-এর আগে থেকে কোনো পরিচয় ছিল না কিংবা ইবনে বতুতা তার আগমনের কোনো খবরও দেননি। ইবনে বতুতা তার গ্রন্থে নিজের সম্পর্কে যতটুকু লিখে গেছেন তার চেয়ে বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি।

এই মহান পরিব্রাজক অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে, তিনবার হজ করে তার জন্মভূমিতে ফিরেছিলেন ৩০ বছর পর। ইবনে বতুতা উল্লেখ করেন- ‘হজ পালন ও মোহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের আকাক্সক্ষা নিয়ে আমি যেদিন জন্মভূমি তাঞ্জিয়ের ছেড়ে মক্কার পথে যাত্রা করলাম, সেদিন ছিল ৭২৫ হিজরির ২ রজব (১৪ জুন ১৩২৫, বৃহস্পতিবার)। সেই হিসাব মতে তখন আমার বয়স ২২ বছর (২১ বছর ৪ মাস)। পথে সঙ্গী হিসেবে কাউকে না পেয়ে বা কোনো কাফেলার খোঁজ না পেয়ে আমি একাই বেরিয়ে পড়ি। তখন আমার মা, বাবা বেঁচে ছিলেন। তাদের ছেড়ে আসার পর্বটা খুবই কঠিন ছিল। বিদায়ের সময় ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল সবার।

 

মক্কা থেকেই যাত্রা শুরু

ইবনে বতুতা ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে আলাদা একজন। বিশ্বভ্রমণই ছিল তার মনের গহিন কোণে। মাত্র ২০-২১ বছরেই তিনি ভ্রমণে বের হলেও আরও অনেক আগে থেকেই অর্থাৎ কিশোর বয়স থেকেই বিশ্বকে জানার তীব্র ইচ্ছা তৈরি হয় তার মনে। অবশেষে এক দিন পরিবারের সবার থেকে বিদায় নিয়ে ১৩২৫ সালের ১৪ জুন মরক্কোর তাঞ্জিয়ের থেকে হজের উদ্দেশে তিনি উত্তর আফ্রিকার সমুদ্রতীর ঘেঁষে পায়ে হেঁটে মক্কা রওনা দেন। এই পথে তিনি আব্দ-আল-ওয়াদিদ এবং হাফসিদ সাম্রাজ্য, তিমসান, বিজাইরা এবং তিউনিস হয়ে মক্কায় পৌঁছান। যাত্রাপথে তিনি তিউনিসে দুই মাস অবস্থান করেন। আরব বেদুইনদের থেকে নিরাপদ থাকতে এবং অন্যান্য সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন কাফেলার সঙ্গে এই পথ অতিক্রম করেন। পথিমধ্যে আলেকজান্দ্রিয়ায় তিনি দুজন ধার্মিক তপস্বীর

সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি কায়রোয় পৌঁছান। কায়রোতে প্রায় এক মাসের মতো অবস্থান করার পর তিনি মক্কার উদ্দেশে রওনা করেন। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। তাকে আবার কায়রোতেই ফেরত আসতে হয়। কারণ তিনি মক্কা যাওয়ার অন্যতম পথগুলো রেখে নীল নদ পার হয়ে আইদাব বন্দর দিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন। এবার তিনি একজন সুফি সাধকের সাক্ষাৎ পান। তার নাম শেখ আবুল হাসান আল সাদিদি। তিনি ইবনে বতুতাকে পথ বাতলে দেন।

তিনি মদিনাগামী একটি কাফেলার সঙ্গে যোগ দেন। মদিনায় হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করে চার দিন পর তিনি মক্কার উদ্দেশে রওনা দেন। মক্কা পৌঁছে হজ পালন করে তিনি তাঞ্জিয়ের ফিরে যাওয়ার বদলে মধ্য এশিয়ার দিকে যাত্রা করেছিলেন।

 

পৃথিবীর মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ

প্রায় সমস্ত মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ করেছিলেন ইবনে বতুতা। হজ পালনের পরই তিনি পৃথিবীর মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ শুরু করেছিলেন। মক্কা থেকে তিনি ১৩২৬ সালের নভেম্বরের ১৭ তারিখ আরব সাগর হয়ে ইরাকের উদ্দেশে এক কাফেলার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। এই কাফেলা তাকে নাজাফ শহরে নিয়ে যায়। নাজাফ শহরে হজরত  মোহাম্মদ (সা.)-এর জামাতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর মাজার জিয়ারত শেষে বতুতার কাফেলা ইরাকের উদ্দেশে রওয়া দিলেও তিনি কাফেলার সঙ্গে না গিয়ে আরও দক্ষিণে টাইগ্রিস নদী পার হয়ে বসরা নগরীর দিকে রওনা করেন।

ইবনে বতুতা মক্কায় ৩ বছর অবস্থান করে ১৩৩০ সালে হজ পালন করেন। অবশ্য কেউ কেউ এই সময় নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। অনেকের মতে তিনি ১৩২৮ সালে হজ পালন করেন। ইবনে বতুতার সব মুসলিম সাম্রাজ্য ভ্রমণ শেষে একটি দেশই বাকি ছিল। তা হলো নিগ্রোল্যান্ড। ১৩৫১ সালের এমনি এক বসন্তের সময় ইবনে বতুতা সাহারা মরুভূমির উত্তরে সিজিলমাসার উদ্দেশে ফেজ নগরী ত্যাগ করেন। সিজিলমাসা থেকে ১৩৫২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি লবণের খনির শহর তাঘাজার উদ্দেশে রওনা  দেন। তাঘাজা থেকে বিশাল সাহারা মরুভূমি পার হওয়ার পর নিগ্রোল্যান্ড থেকে ১৩৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মরক্কোর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন এবং ১৩৫৪ সালের শুরুর দিকে তার জন্মভূমিতে শেষবারের মতো পদার্পণ করেন। তার দীর্ঘ সফরে মরুভূমির তপ্ত বালিতে উটের পিঠে চড়া, সমুদ্রে জাহাজডুবি থেকে ভিনদেশের সৈন্যদলের আক্রমণ সবই ছিল।

 

রেহলা এক জীবন্ত ইতিহাস

ইবনে বতুতার লিখিত ‘রেহলা’ গ্রন্থ হলো ইতিহাসকে জানার অন্যতম প্রধান উৎস। ৩০ বছরে চল্লিশটিরও  বেশি দেশ ভ্রমণ করা এই পর্যটক তার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন এই বইয়ে। আফ্রিকা থেকে শুরু করে মিসর, সৌদি আরব, সিরিয়া,

ইরান, ইরাক, কাজাকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান,

মালদ্বীপ, ভারত, বাংলাদেশ , শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব

এশিয়া এবং চীন ভ্রমণ করেছিলেন। এই গ্রন্থটি ভারতীয় উপমহাদেশের এবং বাংলার ইতিহাসের অন্যতম প্রধান উৎস। ইবনে বতুতা তার ৩০ বছরের বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতা এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। তবে ইবনে বতুতা তার অভিজ্ঞতার বিবরণ নিজে লিপিবদ্ধ করেননি বলে জানা যায়। যতদূর সম্ভব ইবনে জুজাই নামক এক পণ্ডিত যিনি মরক্কো সুলতানের ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন তিনিই সুলতানের নির্দেশে শ্রুতি লিখন পদ্ধতিতে ইবনে বতুতার ভ্রমণ কাহিনী লিপিবদ্ধ করেন। ১৩৫৫ সালের ৯ ডিসেম্বর মৌখিক বর্ণনা শেষ হলে ‘রেহলা’ নামক বইটি লিপিবদ্ধ করার কাজ শেষ হয়। রেহলা কথাটির সারমর্ম হলো ‘মুসলিম সাম্রাজ্য, এর সৌর্য, শহর এবং এর গৌরবান্বিত পথের প্রতি উৎসাহীদের জন্য একটি দান’ এ রেহলা গ্রন্থে আফ্রিকা, মিসর, চীনসহ ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিবরণ অত্যন্ত সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলার ইতিহাসে ‘রেহলা’ গ্রন্থের ভূমিকা অনবদ্য। সফর শেষে মরক্কোর ফেজ নগরীতে গিয়ে ইবনে বতুতা সুলতান আবু ইনান ফারিজ এবং তার সভাসদদের কাছে তার সব ভ্রমণ কাহিনী খুলে বলেন। তখনই সুলতান নিজের একান্ত সচিবদের একজন ইবনে জুজাইকে তার ভ্রমণের বিস্তারিত লিখে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

 

বাংলাদেশে কী দেখলেন ইবনে বতুতা

ইবনে বতুতা ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সফর করেন। এখানে ইবনে বতুতা প্রথম পৌঁছেন ১৩৪৬ সালের ৯ জুলাই। সাদকাঁও (চাটগাঁও) প্রথম আসেন তিনি। সেখান থেকে সরাসরি তিনি কামাররু (কামরূপ) পার্বত্য অঞ্চল অভিমুখে রওনা হন। সাদকাঁও থেকে কামাররু বর্ণনায় এক মাসের পথ। হজরত শাহ জালালের (র.) সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশেই তিনি বাংলা সফরে এসেছিলেন বলে ইতিহাসে আছে। হজরত শাহ জালালের (র.) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ফেরার পথে ইবনে বতুতা একটি ছাগলের পশমের কোট উপহার পান। তিনি আন-নহর উল-আয্রক (নীল নদী অর্থে) নদীর তীরবর্তী হবঙ্ক শহর অভিমুখে রওনা হন। এই নদীপথে ১৫ দিন নৌকায় ভ্রমণের পর তিনি সুনুরকাঁও (সোনারগাঁ) শহরে পৌঁছেন ১৩৪৬ সালের ১৪ আগস্ট। সোনারগাঁ থেকে একটি চীনা জাহাজে করে তিনি জাভার উদ্দেশে রওনা হন। যখন ইবনে বতুতা বর্তমান বাংলাদেশে এসে পৌঁছান তখন এখানকার সুলতান ছিলেন ফখর-উদ্দিন। তৎকালীন মুসলিম শাসনামলে মানুষের আর্থিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত সচ্ছল। দেশে খাদ্যশস্যের প্রাচুর্য এবং  দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্যের সস্তা দর উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে, পণ্যের এমন প্রাচুর্য ও সস্তা দর তিনি পৃথিবীর আর কোথাও দেখেননি। তার বর্ণনায় পাওয়া যায়, মাত্র এক দিরহাম দিয়ে তখন বাংলাদেশে আটটি স্বাস্থ্যবান মুরগি পাওয়া যেত। এ ছাড়াও এক দিরহামে পনেরোটা কবুতর, দুই দিরহামে একটি ভেড়া এবং এক স্বর্ণমুদ্রারও কম মূল্যে দাস-দাসী কিনতে পাওয়া যেত। ইবনে বতুতা তার ভ্রমণ কাহিনীতে বাংলার জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। বাংলার সুদৃশ্য শ্যামল সবুজ প্রান্তর, পল্লীর ছায়া-সুনিবিড় সবুজের সমারোহ তাকে এতটাই মুগ্ধ করে। তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে মন্তব্য করেন, ‘আমরা পনেরো দিন নদীর দুই পাশে সবুজ গ্রাম ও ফলফলারির বাগানের মধ্য দিয়ে নৌকায় পাল তুলে চলেছি, মনে হয়েছে যেন আমরা কোনো পণ্যসমৃদ্ধ বাজারের মধ্য দিয়ে চলছি।’

 

বিচিত্র জীবন

বেশির ভাগ ভ্রমণের সময় ইবনে বতুতার সঙ্গে কাফেলা ছিল। তিনি নিজে একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন, তার পূর্বপুরুষরা কাজীর পেশায় ছিলেন। ফলে তিনি যে দেশে গেছেন সেখানেই রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়েছেন।

 

জীবনের অনেকটা সময় তিনি কাজীর চাকরি করেছেন, মন্ত্রীর মেয়ের পাণিগ্রহণ করেছেন। এমনকি কখনো রাষ্ট্রদূত কখনো সেনাকমান্ডের দায়িত্ব পেয়েছেন।

 

সে সময় সমৃদ্ধ সোনারগাঁ সম্পর্কে তিনি অনেক কথাই লিখে গেছেন। গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য হলো এই সোনারগাঁ থেকে সারা পৃথিবীর উদ্দেশে পালতোলা জাহাজ ছেড়ে যেত। তের শতাব্দীর কথা। তিনি ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার জন্য এখানে জাহাজে চড়ে বসেছিলেন।

 

বিভিন্ন দেশের রাজা, রানী ও মন্ত্রীগণ, জাহাজ ভর্তি উপহার, শত শত ঘোড়া, উট এবং অসংখ্য দাস-দাসী উপহার দিয়েছেন। তিনি নিজেও বিভিন্ন দেশে দাস-দাসী কিনেছেন।

 

তিনি একজন পরহেজগার মুসলিম ছিলেন। তিনি যেমন মহান মুসলিম শাসকদের গুণগান করেছেন তেমনি অত্যাচারী শাসকদের বর্বরতার কথাও লিখেছেন।

 

তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলে কোরআনের একটি পাতা খুলে পড়তেন। সে পাতায় তার চোখে যে আয়াতটি পড়ত তিনি সে আয়াতের অর্থ বুঝে সিদ্ধান্ত নিতেন তিনি কোন পথে যাবেন।

 

নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিশেষ প্রয়োজনে তিনি কখনো কখনো নিজের পরিচয় গোপন করেছেন এবং কূটনৈতিক কারণে ভিন্ন নামও ব্যবহার করেছেন। চীনে তার নাম ছিল শামসুদ্দিন এবং ভারতে তার নাম ছিল মাওলানা বদর উদ্দীন।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর