৫ নভেম্বর, ২০১৫ ১০:৩৯

রূপকথাকেও হার মানায় যে মেয়ের গল্প

অনলাইন ডেস্ক

রূপকথাকেও হার মানায় যে মেয়ের গল্প

বাবা, মা পর্যন্ত যখন ছোট্ট নেহার বাঁচার আশা ছেড়ে দিয়েছেন তখন সাহস দিলেন চিকিৎসকেরা। বললেন, ‘‘ভয় নেই। আমরা আছি।’’ এবং সত্যিই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল নেহা। শুধু তাই নয়, পরবর্তী চিকিৎসার খরচের একটা বড় অংশ নেহার বাবা শীতল মাহাতোর হাতে তুলে দিলেন সেই চিকিৎসকেরাই। ‘‘পুরো ঘটনাটাই যেন রূপকথার মতো। ডাক্তাররা না থাকলে যে কী হত?’’—নেহাকে কোলে নিয়ে বলছিলেন নেহার মা মঞ্জু মাহাতো।

কী হয়েছিল নেহার?

নেহার বাবা শীতল মাহাতো জানান, ঘুমোতে ভয় পেত দশ বছরের নেহা। সন্ধ্যায় পড়তে বসে যখন ঘুমে চোখ ঢুলে আসত, তখন নিজেই নিজেকে শাসন করত সে। রাতেও জেগে বসে থাকত বাবা, মায়ের মাঝখানে। ঘুমোলেই যে বড় কষ্ট হয় তার। দম আটকে আসে। অনেক চিকিৎসকের কাছে মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সারেনি। এমনিতেই ছোট থেকে নেহার সর্দিকাশির ধাত। সর্দিকাশি হলে কষ্ট আরও বাড়ত। তার পর এক দিন হঠাৎই সামান্য সর্দিজ্বর থেকে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়ল নেহা। কিছুতেই সে শ্বাস নিতে পারছিল না। ক্রমশই নীল হয়ে আসছিল শরীর। কলকাতার ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড হেল্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া মাত্র শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রভাসপ্রসূন গিরি, অগ্নিশেখর সাহা এবং সৌমেন মেউর ভেন্টিলেশনে রাখার নির্দেশ দেন নেহাকে। তার পর প্রায় ২১ দিন চলে যমে-মানুষে টানাটানি। অবশেষে সুস্থ হল সে।

কিন্তু কেন এমন হত নেহার?

 চিকিৎসক প্রভাসপ্রসূন গিরি জানালেন, ছোটবেলা থেকেই নেহার মেরুদণ্ডটি বাঁকা। ফলে তার সমস্যা ছিল পাঁজরেও। শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার সময় পাঁজরের যতটা এগিয়ে যাওয়ার কথা নেহার ক্ষেত্রে ততটা হত না। ফলে তার ফুসফুসটিও ঠিকমতো ফুলতে এবং চুপসোতে পারত না। ফলে দীর্ঘ দিন ধরেই তার শরীরে কমে আসছিল অক্সিজেনের পরিমাণ। বাড়ছিল কার্বন ডাই অক্সাইড। তীব্র চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল ফুসফুসের ওপর। ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম ‘পালমোনারি হাইপারটেনশন’। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল হার্টও। শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারার এই বিরল রোগের নাম ‘সেন্ট্রাল হাইপোভেন্টিলেশন সিন্ড্রোম’। তার জেরেই দেখা দিয়েছিল ‘স্লিপ অ্যাপনিয়া’। যে কারণে ঘুমোতে গেলেই আর নিশ্বাস নিতে পারত না নেহা।

২১ দিন ভেন্টিলেশনে রাখার পর নেহা খানিকটা সুস্থ হলেও সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়। বাড়ি ফিরে ঘুমোনোর সময় নেহা যাতে ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে তার জন্য দরকার ছিল একটি যন্ত্রের। এই যন্ত্রটির নাম ‘বাইপ্যাপ’। এর সাহায্যে স্লিপ অ্যাপনিয়ার রোগী ঘুমোনোর সময় স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে। যন্ত্রটির দাম দু’লক্ষ টাকা। কিন্তু তা কিনবার ক্ষমতা ছিল না ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শীতলবাবুর। এর আগে একবার ভেলোরে মেয়ের চিকিৎসা করাতে খরচ হয়েছে প্রায় চার লক্ষ টাকা। তার ওপর দীর্ঘদিন ধরে মেয়ের চিকিৎসা করাতে করাতে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন শীতল মাহাতো। তিনি চিকিৎসকদের জানান, এত দামি যন্ত্র তিনি কিনতে পারবেন না। চিকিৎসকেরা যেন বিকল্প কিছু ভাবেন। অথচ নেহার বেঁচে থাকার জন্য খোলা ছিল ওই একটি মাত্র রাস্তাই।

এগিয়ে এলেন চিকিৎসকেরাই। ডা. সৌমেন এবং ডা. অগ্নিশেখর জানালেন, তারা ঠিক করেন, যে ভাবেই হোক নেহাকে বাঁচাতে হবে। নেহার পরবর্তী চিকিৎসার জন্য তখন তাঁরা নিজেরাই টাকা জোগাড় করার সিদ্ধান্ত নেন। নেহার জন্য তৈরি করেন একটি তহবিল। এগিয়ে আসেন জুনিয়র চিকিৎসক অনিরুদ্ধ, রজন, কাকলি, অভিজিৎ, রস্মিতারা। চিকিৎসকেরাও দান করেন যথাসাধ্য। টাকা তোলার পুরো দায়িত্বটিই নিজের কাঁধে নিয়ে নেন অনিরুদ্ধ ঝা। কিন্তু তাতেও উঠছিল না পুরো টাকা। অগ্নিশেখর বলেন, ‘‘তখনই প্রভাস সিদ্ধান্ত নেয় এই খবরটা সোস্যাল মিডিয়ায় জানাবে। আমরাও সায় দিই ওর প্রস্তাবে।’’

প্রভাস জানান, ফেসবুকে দেওয়ার পর থেকেই সাহায্য করতে চেয়ে প্রচুর মানুষ ফোন করেন। নেহার বাবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরটি জানানো হয়েছিল ফেসবুকে। সেখানেই টাকা পাঠাতে থাকেন ইচ্ছুক মানুষেরা। উঠে আসে বাইপ্যাপ কেনার খরচ। প্রভাসবাবু বলেন, ‘‘কত লোক সোস্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার করে। কিন্তু দেখুন এর সাহায্যেই আমরা একজনের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারলাম।’’

পরে যদিও মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে এসেছে। কিন্তু সেই কঠিন সময়ে অচেনা একটি মেয়ের জন্য কেন এই উদ্যোগ নিতে গেলেন প্রভাসবাবুরা?

প্রভাস বলছেন, ‘‘একজন চিকিৎসক হিসেবে আমরা তো সব রোগীকেই বাঁচিয়ে তুলতে চাই। কিন্তু পারি না। আসলে নেহা মেয়েটা এত মিষ্টি, এত বুদ্ধিমান। শুধু কটা টাকার জন্য ও বাঁচবে না, এটা মানতে পারিনি। আমরা সবাই বড্ড ভালবেসে ফেলেছিলাম মেয়েটাকে। আমি না উদ্যোগ নিলে অন্য কেউ নিত। কিন্তু বাঁচতে হতই নেহাকে।’’

সুস্থ হয়ে নেহা এখন নিজেই বাইপ্যাপ ব্যবহার করা শিখে নিয়েছে। ঘুমোতে যাওয়ার আগে সে পরে নেয় যন্ত্রটি। ঘুমোতে এখন আর ভয় লাগে না তার। হাসপাতাল থেকে আসার আগে ‘আঙ্কেল, আন্টি’রা অনেক খেলনা কিনে দিয়েছিল। সেগুলো বুকে জড়িয়েই আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে নেহা।


সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা


বিডি-প্রতিদিন/ ০৫ নভেম্বর, ২০১৫/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর