২১ নভেম্বর, ২০১৫ ১২:৫৪

শুধু পশ্চিমা বিশ্ব নয়, আইএস তৈরিতে হাত ছিল সিরিয়ারও

অনলাইন ডেস্ক

শুধু পশ্চিমা বিশ্ব নয়, আইএস তৈরিতে হাত ছিল সিরিয়ারও

শাসককে মিথ্যা বলতে হয়। বলতে হয় অর্ধসত্যও। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই যেমন বললেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদ। মজা হল আসাদ যে মিথ্যাটি কিংবা অর্ধসত্যটি বললেন সেটাই মোটামুটি সবাই বিশ্বাস করে। ইতালির এক সংবাদ সংস্থাকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে আসাদ অভিযোগ করেছেন, ইসলামিক স্টেট-এর (আইএস) এই উত্থানের পিছনে সিরিয়ার কোনও ভূমিকা নেই। বরং এর জন্য পশ্চিমা দুনিয়া দায়ী।

আপাতদৃষ্টিতে আসাদের এই অভিযোগটি সত্য মনে হয়। সুন্নি উগ্রবাদী আইএস-এর উত্থানের সঙ্গে শিয়া (আলওয়াতি) প্রধান আসাদ সরকারের কোনো যোগ থাকবে কী করে? ইতিহাস বলে এদের মধ্যে সম্পর্ক সাপে-নেউলের। একে অপরের সামনে হলেই মারমার-কাটকাট। কিন্তু মধ্য এশিয়া বড় জটিল জায়গা। চোরাস্রোতে এই অঞ্চলের জুড়ি মেলা ভার। যাদের স্বাভাবিক বন্ধু মনে হচ্ছে তারাই যে পিছনে একে অন্যের পিঠে ছুরি বসাতে যাচ্ছে আগে থেকে বোঝা মুশকিল।

আইএস-এর আক্রমণের মূল লক্ষ্য পূর্বে ইরাকি সরকার, পশ্চিমে আসাদ-এর সরকার। ২০১৪-য় ঝড়ের গতিতে আইএস সিরিয়া ও ইরাকের বড় অংশের দখল নিয়ে নেয়। দুইয়ের মাঝে বিস্তৃত অংশে এখনও কায়েম আছে আইএস-এর আধিপত্য। ইরাকি সেনা, শিয়া মিলিশিয়া আর কুর্দ পেশমেরগা যোদ্ধারা ইরাকের বেশ কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করতে পারলেও বাগদাদের পরে ইরাকের সবচেয়ে বড় শহর মসুল আজও আইএস-এর হাতে রয়েছে।

অন্যদিকে, সিরিয়ায় আকাশ থেকে মার্কিন, ফ্রান্স, রাশিয়ার যুদ্ধবিমান আইএস-এর বিভিন্ন ঘাঁটিতে তীব্র আঘাত হানলেও মাটিতে পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সিরিয়ার পূর্বদিকের বিপুল অঞ্চলের অধিকার কার্যত আইএস-এর হাতেই। ইরান ও রাশিয়ায় প্রত্যক্ষ সমর্থনে ক্ষমতায় টিকে থাকলেও আসাদের কাছে এ বড় কাক্ষিত অবস্থান নয়। আসলে আইএস-এর হাতে ইরাক বিপর্যস্ত হলেও মূল আঘাতটি পেয়েছেন আসাদ। তাঁর আইএস নীতি আসলে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু তা স্বীকার করতে পারবেন না আসাদ। এখানেই লুকিয়ে আছে অর্ধসত্য।

মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি বিবেচনা ‘দোষে’ দুষ্ট এ কথা অতিবড় সমর্থকও বলবেন না। ২০০৩-এ ইরাকে ঢুকে পড়ার সময়ে প্রেসিডেন্ট বুশের প্রশাসন ভাবেইনি ভবিষ্যত কী হতে পারে। কোন আগুনে হাত দিচ্ছেন তারা। সাদ্দামকে সরানোর কয়েক মাস পরে তাই মার্কিন রণতরী আব্রাহাম লিঙ্কনে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট বুশ যুদ্ধ জয়ের ঘোষণা করে দিলেন। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়! সামনে আট বছরের রক্তসমুদ্র পেরোতে হবে। দিশাহারা হবেন বুশ। তার প্রশাসন একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নেবে। প্রাণপ্রিয় প্রতিরক্ষা সচিব ডোনাল্ড রামফেল্ডকে সরাতে হবে। সেনা সংখ্যা হুড়মুড়িয়ে বাড়াতে হবে। অবশেষে প্রেসিডেন্ট ওবামা ক্ষমতায় আসার পরে ২০১১-এ হুড়মুড়িয়ে আমেরিকার ইরাক ত্যাগ। ইরাকের পরিস্থিতি কিন্তু তখনও কড়াইয়ে ফুটন্ত তেলের মতো।

পল ব্রেমার। এই আমলার নামটি এখন কারও বিশেষ মনে আসবে না। আসার কথাও নয়। কিন্তু বুশের আমলে এই আমলার দাপট ছিল দেখার মতো। সুট্যের সঙ্গে মিলিটারি বুট পরা এই প্রশাসকের হাতেই মার্কিন সেনা ক্ষমতা হস্তান্তর করে। পদটিও গালভরা, ইরাকের ‘কোয়ালিশন প্রভিশনাল অথরিটি’র চিফ এক্সিকিউটিভ অথরিটি। তৎকালীন প্রতিরক্ষা সচিব ডোনাল্ড রামসফেল্ডের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে। এক কথায় তৎকালীন ইরাকের সর্বময় কর্তা। নিজেকে তাই প্রবাদপ্রতিম জেনারেল ম্যাক আর্থারের সঙ্গে তুলনা করতে পছন্দ করতেন পল ব্রেমার। তবে জেনারেল ম্যাক আর্থারকে জাপান যে ভাবে মনে রেখেছে পল ব্রেমারকে সেভাবেই ভুলে যেতে চেয়েছে ইরাক। ভার হাতে পেয়েই প্রথম দু’টি নির্দেশ জারি করেন ব্রেমার। নির্দেশ এক, সাদ্দামের বাথ পার্টিকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা। প্রশাসন থেকে সব বাথ পার্টির সদস্যকে কার্যত তাড়িয়ে দেওয়া। নির্দেশ দুই, ইরাকি সেনাকে ভেঙে দেওয়া। দুই নির্দেশ মিলিয়ে প্রায় এক লক্ষ ইরাকির চাকরি গেল। যাঁরা সুন্নি, শিয়া বিরোধী হলেও কিন্তু মৌলবাদী নন। বিপন্ন হল সুন্নি জনগণের বড় অংশ। বিপন্ন হল ইরাকের ভবিষ্যতও। এর পরে ধীরে ধীরে বিক্ষুব্ধ সুন্নিদের একটি অংশ অস্ত্র হাতে নেয়। লক্ষ্য মার্কিন সেনা এবং নব্য শিয়া শাসক গোষ্ঠী।

ঠিক এই সময়ে ইতিহাসের মঞ্চে অন্য নাটকের মহড়া শুরু হয়েছে। নেতৃত্বে আল-কায়দা নেতা আবু মুসাব আল-জারকোই। জর্ডনের নাগরিক, অল্প শিক্ষিত, কিন্তু তেজিয়ান জঙ্গি নেতা। আল-কায়দায় যোগ দিলেও ওসামা বিল লাদেনের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে পারেননি। জারকোই-এর জঙ্গিদর্শন ওসামাকেও অস্বস্তিতে রাখত। আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানের পরে প্রাণ বাঁচিয়ে ইরান হয়ে কোনওক্রমে ইরাকের কুর্দিস্তানে আশ্রয়ে ছিলেন।

প্রসঙ্গত ইরাক আক্রমণের সময়ে বুশ প্রশাসন সাদ্দামের সঙ্গে আল-কায়দার যোগাযোগ প্রমান করতে এই জারকোই-এর ইরাকে বাসের উদাহরণ টেনে ছিলেন। জারকোই-এর জঙ্গিদর্শনে শুধু মার্কিন বা পশ্চিমীরাই নন, শিয়াদেরও স্থান নেই। যা শঙ্কিত করেছিল ওসামাকেও। সাদ্দামের পতনের পরে টালমাটাল অবস্থায় সাঙ্গোপাঙ্গো জুটিয়ে ‘আল-কায়দা ইন ইরাক’ খুলে ফেলেছিলেন তিনি। ইরাকে খাতা খুলতে হলে যে শিয়া-সুন্নির পুরনো ক্ষতটিকে চাগিয়ে দিতে হবে বুঝতে পেরেছিলেন জারকোই। এবং তা তার জঙ্গিদর্শনের সঙ্গেও মিলে যায়। ছোট দল নিয়ে বেগ দিতে শুরু করেছিলেন তিনি। শুরু মার্কিন নাগরিক নিকোলাস বার্গের মুণ্ডচ্ছেদ দিয়ে। বিস্ফোরণে ইরাকের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপু়্ঞ্জের প্রতিনিধি সার্গেই ডিমেলোর মৃত্যু, কারবালায় শিয়া সৌধে আক্রমণ, সামারায় প্রাচীন শিয়া সৌধ ধ্বংস— ২০০৬-এ মার্কিন বিমান হানায় মৃত্যুর আগে পর্যন্ত জারকোই-এর কীর্তির তালিকাটি বেশ দীর্ঘ।

জারকোই-এর পরে ‘আল-কায়দা ইন ইরাক’-এর দায়িত্ব বর্তায় আবু ওমর আল-বাগদাদির উপরে। সন্ত্রাস বন্ধ না হলেও ধার ও ভার কিছুটা হলেও হ্রাস পায়। কিন্তু ২০০৮ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসতে থাকে। কাছে আসতে থাকেন বাথ দলের সদস্যরা এবং ‘আল-কায়দা ইন ইরাক’-এর জঙ্গিরা। আর এই যোগসূত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় সিরিয়া। বাসার আল-আসাদ তখন সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী। বাথ দলের মাথাদের অনেকেই ইরাক থেকে বিতারিত হয়ে দামাস্কাসে আশ্রয় নিয়েছেন। একই ভাবে ‘আল-কায়দা ইন ইরাক’-এর গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরও গোপনে দামাস্কাসে নিয়ে যাওয়া হয়। শিয়া হলেও ইরাকের মালিকি সরকার এবং মার্কিন উপস্থিতি— দু’টিই সিরিয়ার পক্ষে অস্বস্তির কারণ। মালিকির সরকারকে বিপদে ফেলতে পারলে বিপদে পড়বে আমেরিকাও। বাগদাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের সম্পর্কেরও অবনতি হবে। তাই ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ সূত্র ধরে এক সময়ের প্রতিপক্ষ বাথ এবং ‘আল-কায়দা ইন ইরাক’-কে মিলিয়ে দেওয়ার কাজেহাতে নিয়েছিল সিরিয়া সরকার, বিশেষ করে সিরিয়ার সেনার গুপ্তচর বিভাগ। ২০০৯-এ দামাস্কাসের আশেপাশে  দু’পক্ষের মাথাদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের খবর ইরাক এবং মার্কিন প্রশাসনের কাছে আসতে থাকে। ইরাক ও আমেরিকা অভিযোগ জানালেও কূটনীতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনে পুরোটাই অস্বীকার করে সিরিয়া। ফলে বাথ-এর সদস্যদের ‘আল-কায়দা ইন ইরাক’-এ মিশে যাওয়া ছিল সময়ে অপেক্ষা। শুধু নির্দিষ্ট লক্ষ্য জঙ্গি হামলা চালানোই নয়, পরিপূর্ণ সামরিক অভিযান চালানোর কৌশলও ‘আল-কায়দা ইন ইরাক’-এর করায়ত্ত হয়ে যায়। সিরিয়ায় চলে আইএস-এর লালন-পালন। শুধু দরকার ছিল এমন এক নেতার যিনি এই শক্তির সদ্বব্যবহার করতে পারবেন। ২০১০-এ তিকরিতে মার্কিন হামলায় আবু ওমর-এর মৃত্যুর পরে সেই নেতাও পেয়ে যায় ‘আল-কায়দা ইন ইরাক’-এ। শীর্ষ পদে বসেন আবু বকর আল-বাগদাদি।

ইতিহাস বড় ছলনাময়ী। কে জানতো আরব বসন্তের মতো কিছু শুরু হবে। আর তাতে উত্তাল হয়ে উঠবে সিরিয়াও। যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক সুন্নি। শিয়া (আলওয়াতি) আসাদের প্রশাসনের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ অচিরেই রক্তক্ষয়ী জাতিদাঙ্গার রূপ নেবে। আর ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে আসাদ বিরোধী প্রধানমুখ হয়ে উঠবে আইএস। তার পরে ঝড়ের গতিতে সিরিয়া আর ইরাকের বিপুল অংশে কর্তৃত্ব স্থাপন করবে আইএস। অস্ত্র, হিংসা, সম্পদে বাকি সব জঙ্গি সংগঠনকে পিছনে ফেলে দেবে। এই পর্বে সৌদি আরব-সহ বেশ কিছু সুন্নি দেশের প্রছন্ন মদত ছিল না কি? অবশ্যই ছিল। ইরানের নেতৃত্বে শিয়া কর্তৃত্ববাদের উত্থান ঠেকাতে গোপনে মদত দিয়েছিল পশ্চিমী বিশ্বও। কিন্তু সন্ত্রাসের অভূতপূর্ব যে কাঠামোটি সিরিয়া গড়ে তুলতে সাহায্য করল তা অস্বীকার করলেও ফল তো ভুগতে হচ্ছে।

আইএস-কে নির্মূল করতে আজ পশ্চিমী বিশ্ব হাত ধরেছে, রণহুঙ্কার দিচ্ছে। আর সেই ফাঁকে নিজের আসনটুকু ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন বাসার আল-আসাদ। মুখে স্বীকার না করলেও অন্য দেশে নাক গলানোর প্রবণতা যে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে তা হাড়ে হাড় টের পাচ্ছেন আসাদ। ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাকে যেমন টের পেয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া।

 

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

 

বিডি-প্রতিদিন/ ২১ নভেম্বর, ২০১৫/ রশিদা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর