২৮ মে, ২০১৬ ১০:০২

স্বনির্ভরতার নতুন দিশা দেখাচ্ছে 'ধোবিঘর'

অনলাইন ডেস্ক

স্বনির্ভরতার নতুন দিশা দেখাচ্ছে 'ধোবিঘর'

আত্মবিশ্বাসের চূড়ান্ত অভাব ছিল। আসলে দায়িত্বের কোন কাজ যে ওরা করতে পারেন, সেটাই ভুলতে বসেছিলেন সকলে। একটি সরকারি প্রকল্প ধীরে ধীরে সেই হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে পেরেছে। এখন ওরা অনেকটাই স্বনির্ভর। নিজেদের ভরণপোষণের ব্যবস্থাও নিজেদেরই হাতে আসতে চলেছে।

প্রকল্পটি শুরু হয়েছে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে। সেরে উঠেও হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফেরা হয় না বহু রোগীর। ফলে হাসপাতালের শয্যা আটকে থেকে যাওয়াটাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমন রোগীদের জন্য একটি পুনর্বাসন প্রকল্পের সফল রূপায়ণ করতে পেরেছে ভারতের রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। এক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে একটি লন্ড্রি, যেখানে কাজ করবেন সেরে ওঠা মানসিক রোগীরা। আজ শনিবার তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। যার পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে ‘ধোবিঘর’।

আপাতত পাভলভের রোগীদের ব্যবহৃত পোশাক ও বিছানার চাদরই ধোয়া হবে সেখানে। ধাপে ধাপে আসবে অন্য হাসপাতালের জিনিসও। পাভলভের চিকিৎসকেরাই জানাচ্ছেন, যে পাভলভে এক সময়ে বহু রোগীর পরনে একটু সুতাও জুটত না, সেখানে সাফসুতরো পোশাক ও পরিচ্ছন্ন বিছানার স্বপ্ন দেখাচ্ছে এই প্রকল্প।

শুধু মানসিক রোগীদের কেন্দ্র করে প্রকল্পটি তৈরি হলেও অনেকের মতে এটা মূল স্রোত থেকে পিছিয়ে পড়া অন্য মানুষদের দিশা দেখানোর পক্ষেও সহায়ক। মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাজদারের মতে, 'আর্থিক স্বনির্ভরতা যে কোন মানুষকে বহুগুণ শক্তি জোগায়। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অন্যের বোঝা ভাবতে ভাবতে যাদের আত্মবিশ্বাস বলে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, এই ধরনের প্রকল্প তাদের মনের জোর বাড়াতে বাধ্য।'

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গেছে, সেরে উঠেও বাড়ি ফিরতে পারেননি, এমন ২০ জনকে ধোবিঘরে কাজ করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রথম ধাপে আপাতত সোম থেকে শুক্র প্রতিদিন তিন ঘণ্টার তিনটি শিফ্‌টে কাজ হবে। প্রকল্পে সহায়তাকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষে রত্নাবলী রায় মনে করেন, পাভলভ এ ক্ষেত্রে গোটা দেশেই একটা দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে চলেছে। কারণ, মানসিক হাসপাতালের ভিতরে আবাসিকদের দিয়েই কমার্শিয়াল অটোমেটেড লন্ড্রি চালানোর কোন নজির এখনও কোথাও নেই। রত্নাবলীর কথায়, ‘‘সমাজ যাদের দিকে ঘুরেও তাকায় না, তারা নিজের চেষ্টায় আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হবেন। আমাদের কাছে সবচেয়ে আশার কথা এটাই। শুধু বাড়ি পাঠানোটাই পুনর্বাসন নয়, সঠিক পুনর্বাসন তখনই হয়, যখন তারা আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হতে পারবেন।'

পারিশ্রমিক কী ভাবে পাবেন ওরা? এমন প্রশ্নের জবাবে সংস্থার পক্ষ থেকে শুক্লা দাস বড়ুয়া বলেন, 'বহু চেষ্টা করে ওদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। অদক্ষ শ্রমিকদের যে হারে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়, সেই হিসেবেই ওদের প্রাপ্য টাকা অ্যাকাউন্টে জমা পড়বে।'

পাভলভের এই প্রকল্পটি চূড়ান্ত হয় মলয় দে স্বাস্থ্যসচিব থাকাকালীন। বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সরকারের ‘মউ’ স্বাক্ষরও হয় তখনই। দফতরের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, 'লন্ড্রি ভাল ভাবে চললে ওই আবাসিকদের হাসপাতালের বাইরে থাকার ব্যবস্থা হতে পারে। সরকার তো সাহায্য করবেই, পাশাপাশি ওই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও তাদের পাশে দাঁড়াবে।'

বছরের পর বছর গরাদের ভিতরে কাটার পরে এখন বাইরের আলো দেখছেন অনুপ ধর, বিভাস ঘোষ, প্রদীপ ঘোষ, মৌসুমী ঘোষেরা। তাদের কথায়, ‘‘শনিবার থেকে আমাদের অগ্নিপরীক্ষা। আমাদের মতো আরও অনেককে আলো দেখাতে আমাদের সফল হতেই হবে।’’

দিনের পর দিন যারা ব্রাত্য হয়ে থাকতেই অভ্যস্ত ছিলেন, তাদের এ ভাবে কাজে ফেরানো কি খুব সহজ ছিল? যে সংস্থা এ কাজে প্রযুক্তিগত সহায়তা করেছেন তাদের কর্মীরা জানান, বাধা এসেছে প্রতি পদেই। শুরুর দিকে প্রত্যেক মুহূর্তে মনে হতো শেষ পর্যন্ত হয়তো উদ্যোগটা সফল হবে না। নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে ভয় পেতেন ওরা। অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে হয়েছে। সংস্থার পক্ষে সুমন ভৌমিকের দাবি, ‘‘বাণিজ্যিক সংস্থা যে খরচে কাজ করে, তার চেয়ে কম টাকায় অনেক উন্নত পরিষেবা দিতে এখন তৈরি ধোবিঘর। স্বয়ংক্রিয় লন্ড্রিতে কাজ করতে করতে মানসিক হাসপাতালের আবাসিকদের যাতে কোন সমস্যা না হয়, নজর থাকছে সে দিকেও। এক-একটি শিফ্‌টে তিন জন করে সুপারভাইজার রাখা হচ্ছে। এদের সকলকেই নিয়োগ করা হচ্ছে বাইরে থেকে।’’

শুধু মানসিক হাসপাতাল নয়, শারীরিক বা মানসিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষদের স্বনির্ভর করার এমন প্রকল্প কি আরও নেওয়া যায় না? স্বাস্থ্য এবং সমাজকল্যাণ দফতরের কর্তারা জানান, অন্য কয়েকটি ক্ষেত্রেও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছু রোজগারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্প সে সবের থেকে আলাদা। কারণ প্রথমত এটি হয়েছে মানসিক হাসপাতালে। দ্বিতীয়ত, এটি একটি বাণিজ্যিক সংস্থার থেকে সেরে ওঠা মানসিক রোগীদের হাতে দেওয়া হয়েছে, যে ভাবনাটাই অভিনব। পরবর্তী সময়ে এই মডেল রাজ্যের বেশ কিছু হোমে চালু করার চেষ্টা হবে বলেও জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

 

বিডি প্রতিদিন/২৮ মে ২০১৬/ হিমেল-০৫

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর