২১ নভেম্বর, ২০১৬ ১০:০৪

বিয়ের রক্তমাখা কার্ড হাতে বাবাকে খুঁজছে মেয়েটি

অনলাইন ডেস্ক

বিয়ের রক্তমাখা কার্ড হাতে বাবাকে খুঁজছে মেয়েটি

এক বুক স্বপ্ন নিয়ে ট্রেনে চড়েছিলেন। সামনে নতুন জীবন। নতুন মানুষের হাতে হাত রেখে বাঁচার শুরু। ১ ডিসেম্বর বিয়ে ঠিক ছিল রুবি গুপ্তর। বাবা আর ভাইবোনেদের সঙ্গে ফিরছিলেন গ্রামের বাড়িতে। বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ওই বাড়ি থেকেই। রবিবার সকালে ভাঙাচোরা কামরার ফাঁকে বাবাকে খুঁজে যাচ্ছিলেন বিশ বছরের রুবি। সঙ্গে থাকা দুই ভাই ও দুই বোনকে ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু রুবির বাবা রামপ্রসাদ গুপ্তর হদিস মেলেনি।

গাজীপুরের লক্ষ্মীর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি এই ধ্বংসস্তূপে। তবে তাঁর জীবনটাও যে বদলে গেছে, বুঝতে অসুবিধা হল না। গুটিয়ে যাওয়া রেললাইনের পাশে পড়ে ছিল কয়েকটা বিয়ের কার্ড। রক্তমাখা। কার্ডে লেখা— ‘রাকেশ ওয়েডস  লক্ষ্মী’। পরে জেনেছি, রাকেশ ওই ট্রেনেই ছিলেন। তিনি, তার বাবা-মা— কেউ আর বেঁচে নেই।

লক্ষ্ণৌ থেকে প্রায় দেড়শ' কিলোমিটার উজিয়ে ঘটনাস্থলে যখন পৌঁছাই, তখন উদ্ধারকাজ অনেকটাই এগিয়েছে। কামরার ইস্পাতের চাদর ছাড়াতে ব্যস্ত সেনার ক্রেন। দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম, একের পর এক কামরা চারদিকে ছিটকে পড়ে রয়েছে। কোনো আসুরিক শক্তি যেন খেলা করেছে সেগুলোকে নিয়ে।

হঠাৎ মনে হল, যেন কোনও স্ক্র্যাপইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে আছি। বারো ঘণ্টা আগেই যে কামরাগুলো মানুষের আওয়াজে প্রাণময় ছিল, সেগুলো এখন ইস্পাতের মণ্ড ছাড়া কিছু নয়। ততক্ষণে ১৪টা কামরার মধ্যে ১২টার থেকেই বের করে আনা হয়েছে মৃত ও আহতদের। বাকি দু’টোর মধ্যে একটা কামরা চেপে রয়েছে আর একটার ওপরে। নিচের কামরাটা প্রায় মিশে গিয়েছে মাটিতে। উঠে পড়লাম রেললাইনে। যদিও লাইন বলে কিছু নেই। প্রায় ৭০০ মিটার রেললাইন যেন ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়েছে কেউ। নিচে লাইন না পেয়ে কামরাগুলো ঘষটে ঘষটে এগিয়ে এসে একে অন্যের ঘাড়ে পড়ে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। তারই মধ্যে উঁকি দিচ্ছে কারও চুল। কারও হাতের নিষ্প্রাণ আঙুল। জলের বোতল। কামরার মাথায় পতপত করে উড়ছে ছেঁড়া শাড়ি।

লাইনের দু’ধারে গ্রামবাসীদের ভিড়। সেনা, রেল ও জাতীয় বিপর্যয় মোকাবেলা বাহিনীর দল আসার আগে পর্যন্ত উদ্ধারকাজ তাঁরাই চালিয়েছেন। লাইনের ধারে, মাঠের এক কোণে ডাঁই করা ব্যাগপত্র। আহত অনেক যাত্রীই প্রাথমিক চিকিৎসার পালা সেরে চলে আসছেন সেখানে। খুঁজেপেতে নিচ্ছেন নিজের জিনিস।

সতীশের সঙ্গে দেখা হল ওখানেই। মধ্যপ্রদেশের বিনা থেকে বাবা-মাকে নিয়ে ট্রেনে উঠেছিলেন। দুর্ঘটনার পরে জ্ঞান ফিরলে স্থানীয়দের সাহায্যে মাকে উদ্ধার করেছেন। কিন্তু বাবার খোঁজ পাননি। সতীশ বলছিলেন, “দিব্যি ঘুমোচ্ছিলাম। আচমকা প্রচণ্ড আওয়াজ। কামরা একপাশে হেলে পড়ল। তারপর ঘষটে ঘষটে এগোতে লাগল। আপার বার্থ থেকে ছিটকে পড়লাম নিচে। তাতেই জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরতে কোনও রকমে মাকে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু বাবা কোথায় চাপা পড়ে আছেন, বুঝতে পারছি না।”

দুর্ঘটনার ভয়াবহতা দেখে চমকে উঠেছেন পোড়খাওয়া সেনা কর্তারাও। কানপুরের সেনা ছাউনি কাছে থাকায় দুর্ঘটনার দু’ঘণ্টার মধ্যেই চলে এসেছেন তারা। এক সেনা কর্তার আক্ষেপ, ‘‘একটা কামরার তলায় আর একটা কামরা সম্পূর্ণ চাপা পড়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় কেউ বাঁচতে পারে! কামরা ক্রেন দিয়ে তুললেই ঝুরঝুর করে মৃতদেহ পড়ছে।’’ সেনা সদস্যদের আশঙ্কা, মাটিতে গেঁথে যাওয়া ওই কামরাটা তোলা গেলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে। সরকারি ভাবে সংখ্যাটা ১২১ হলেও সংরক্ষিত কামরায় অতিরিক্ত কত জন ছিলেন, তার কোনও হিসেব নেই রেলের কাছে।

বিকেল সাড়ে পাঁচটা। শীতের সন্ধ্যায় ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে শুরু করেছে দৃশ্যপট। জ্বলে উঠছে হ্যালোজেন, পেট্রোম্যাক্স। আচমকা ভিড়ের মধ্যে আওয়াজ— ‘অ্যাম্বুল্যান্স কোথায়? জলদি লে আও।’ মুহূর্তের মধ্যে গোঁ-গোঁ করে ঢুকে পড়ল অ্যাম্বুল্যান্স। জানা গেল, মাটিতে মিশে যাওয়া ওই কামরা থেকে তিন জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। দু’জন বৃদ্ধ পুরুষ। এক জন মহিলা। দুই বৃদ্ধের দেহে এখনও প্রাণ রয়েছে। ধরণী দ্বিধা হওয়ার মতো নিমেষে ভাগ হয়ে গেল ভিড়। সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ছুটে গেল কানপুরের দিকে।

সূর্য অস্ত গেল রুবি-সতীশের জন্য ক্ষীণ আশাটুকু জিইয়ে রেখে।


সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা


বিডি-প্রতিদিন/ ২১ নভেম্বর, ২০১৬/ আফরোজ-০১

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর