২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ১২:৫৩
খবর মানবজমিনের

রাতের রাণীর অন্য জগৎ

অনলাইন ডেস্ক

রাতের রাণীর অন্য জগৎ

আসল নামে কেউ ডাকে না তাকে। নকল নামেই পরিচিত সবার কাছে। একেক জনে একেক নামে কাছে টানে। কেউ সাথী, কেউ প্রিয়া, কেউবা বলে মধু। এ নামও ক্ষণিকের। যতটুকু সময় আপন করে নেয়ার সে সময়টুকুই। নকল নামের ভিড়ে আসল নাম হারিয়ে গেছে তার। দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বাবা-মা ও ৮ ভাইবোনের বড় সংসার। নিজে বাবা-মা’র বড় সন্তান। অনাহার-অর্ধাহারে দিন পার করতে হয়। নিজে এভাবে চললেও ছোট ছোট ভাইবোনদের অনাহারি মুখ সহ্য হচ্ছিল না তার। তাই সে ঢাকার এখানে ওখানে ছুটে বেড়ায় চাকরির আশায়। চাকরি করে কিছু টাকা হলেও বাবার হাতে তুলে দেয়া যাবে। পরিবারে কিছুটা হলেও সচ্ছলতা আসবে। এসব ভেবেই তার এই দৌড়ঝাঁপ। এ ঘটনা ২৩ বছর আগের। একদিন চাকরিও পেয়ে যায় বাবুর্চির সহকারী হিসাবে। বাবুর্চির কাজে প্রায়ই ঢাকার বাইরে যেতে হয়। প্রথম সম্ভ্রম হারায় বাবুর্চির কাছে। কিন্তু চাকরি যাওয়ার ভয়ে কিছুই বলেনি সে। একসময় বিয়েও করে। রিকশাচালক স্বামীর উপার্জন থেকে পিতা-মাতার সংসারে সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়েই একসময় নিজেই নেমে পড়েন এ রাস্তায়। আবারও বিয়ে করেন। এবার স্বামী নিজেই তুলে দেয় অন্যের শয্যায়। এসব করতে গিয়ে বিয়েও করে একে একে সাতটি। ছয়টি সংসার ভেঙ্গেছে। এখন যার সঙ্গে ঘর করছে সেও চায় সাথীর আয়ে চলতে। বলে বিয়ে করে বউয়ের মর্যাদা দিয়েছি এটাইতো বেশি। সাথী এখন রাজধানীর কাওরানবাজার ও মগবাজার এলাকায় রাতের রাণী। ভাসমান পতিতা। অন্য পুরুষের যৌনক্ষুধা মিটিয়ে আয় করে অর্থ। সেই অর্থে বাড়িতে থাকা অন্য ভাই-বোনেরা বড় হয়েছে। আর সাথী কিংবা প্রিয়া ২৩টি বছরে হারিয়েছে শরীরের লাবণ্য, সুখ-শান্তি। হারিয়েছে ভাই-বোনের ভালোবাসা। পিতা মাতার আদর। নিজের যৌবন বিলিয়ে কুড়িয়েছে ঘৃণা, নির্যাতন, বঞ্চনা আর লাঞ্ছনা।

তারই বান্ধবী রঞ্জনা বলেন, সাথী তার ভাই-বোনদের সুখ চেয়েছিল। চেয়েছিল তারা যাতে একসঙ্গে ভালোভাবে থাকে। কিন্তু এখন সাথীর সব ত্যাগ অস্বীকার করে তাকেও পর করে দিয়েছে। এখন সবাই ভালো, সাথীই খারাপ। আর সে যে ‘খারাপ’, তা পুঁজি করে তার স্বামীরাও তাকে অবৈধ উপায়ে রোজগারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাই বারবার তার সংসার ভেঙ্গেছে। বর্তমান স্বামীও তার আয় খাচ্ছে। এখন ৭ বছরের একমাত্র ছেলেকে স্কুলে পড়াচ্ছে।
মিরপুরের বিহারি পল্লীতে জন্ম সাথীর। শৈশবেই বাবা আবদুল খালেক ও মা মানু পরিবার নিয়ে মিরপুর থেকে কাওরানবাজারে এক বস্তিতে চলে আসে এবং বসতি শুরু করে। বাবা ইট ভাঙতো। মা কাজ করতো পরের বাসায়। অভাব অনটনে ভাই-বোনদের খেয়ে না খেয়ে দিন যাচ্ছিল। ৮-৯ বছর বয়সেই তাকে উপার্জনে নামতে হয়। কয়েক বছর পরে এফডিসিতে সে রান্নায় সহায়তার কাজ পায়। এই রান্নার কাজে বার্বুচিদের সঙ্গে যেতে হতো ঢাকার বাইরে। কিছু বুঝে উঠার আগেই সেখানে বাবুর্চিদের কাছে সে বারবার যৌন নিপীড়নের শিকার হতে থাকে। কিন্তু পরিবারের অনটনের জন্য চাকরি হারাতে চায় না। সে জীবনের তাগিদে তাই মেনে নেয়। রান্না-বান্নার আড়ালে সহ্য করতে বাধ্য হয় বিভীষিকাময় যৌন নিপীড়ন।

এ অবস্থায় ১২ বছর বয়সে ফরিদপুরের বাসিন্দা রিকশাচালক মজিদের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তাতে পরিবারকে আর সে আর্থিক সহায়তা দিতে পারছিল না। তখন পরিবারের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। ছোট ভাই-বোনদের ভিক্ষায়ও মুখে আহার জুটছিল না। সে কষ্টে তার ঘুম হারাম হয়ে গেলো। আবার তার রিকশাচালক স্বামীও তাদেরকে দেখছিল না। নিরুপায় হয়ে স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে পতিতাদের সঙ্গে দেখা করে। তাদের সঙ্গে বস্তিতে পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে। এতে যা আয় হয় তা তুলে দিত বাবা-মায়ের হাতে। একদিন বিষয়টি জানতে পারে তার স্বামী। তাকে নিষেধ করে দেয়। কিন্তু বাবা-মা ভাই-বোনদের করুণ অবস্থায় স্থির থাকা হলো না। স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে বারবার সে খদ্দেরদের সঙ্গে চলে যেত। একপর্যায়ে সেই স্বামী তাকে ছেড়ে দেয়। কৈশোরেই ভেঙ্গে যায় প্রথম সংসার।

সাথী আবার ফিরে আসে বাবার পরিবারে। কাওরানবাজারের রেল লাইনের বস্তিতে। সেখানে এসে সে নিষিদ্ধ পেশায় নিয়মিত উপার্জনে ব্যস্ত। এরই মধ্যে একদিন ওই বস্তিটি উচ্ছেদ হয়ে যায়। আরো বেকায়দায় পড়ে পরিবার। তারপর পাশে গড়ে উঠা নতুন অপর একটি ভাসমান বস্তিতে বসতি গড়ে তুলে তারা। সেখানে ওই বস্তি এলাকার আশপাশে এবং বিভিন্ন হোটেলে গিয়ে দেহ ব্যবসা করে যাচ্ছিল। বছরখানেক পর সাঈদ নামে অপর এক যুবক তার প্রেমে পড়ে। বেশ কয়েক মাস ধরে চলে প্রেম। পরে তারা বিয়ে করে। তা ছিল সাঈদেরও দ্বিতীয় বিয়ে। স্বামীর সংসারে মন দিলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দিনে দিনে বাড়তে থাকে সতিনের নির্যাতন। এক সময় ভাঙ্গে দ্বিতীয় সংসারও। আবার বাবার পরিবারে। এর কিছুদিন পর মারা যায় তার বাবা। এরপর সংসারের জন্য তাকে ফের একই রাস্তায় নামতে হয়। ধরতে হয় পরিবারের হাল। তখন উপার্জনক্ষম ভাইয়েরাই কাজ না করে তার টাকায় বসে বসে খেতে থাকে। এ নিয়ে টুকিটাকি ঝগড়াও হতে থাকে। এরই এক পর্যায়ে আবার বস্তির যুবক কবিরকে বিয়ে করে। কিন্তু সে মাদকাসক্ত স্বামীর ঘরেও সুখের ছোঁয়া পায়নি। আগের পতিতাবৃত্তির কথা কবির জানতো। উপার্জন তো করতোই না। স্ত্রীকে উপার্জনের জন্য বাধ্য করে দেহ ব্যবসায়। তার টাকায় সে বসে বসে খেতো। সপ্তাহে কয়েকদিন হকারি করলেও বাকি সময় ঘুরে ফিরে কাটাতো। সাথীকে তার মাদকের টাকাও জোগাতে হতো। আর টাকার জন্য সাথীর ওপর চালাতো নির্যাতন। নির্যাতনে বাধ্য হয়ে রাতে রাস্তায় নামে সাথী। এরপর একে একে আরো চারবার বিয়ের পিঁড়িতে বসে সে। কখনও বস্তি, কখনও বা রাস্তায় সংসার। বাসায় স্বামীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে রাস্তায়। সেখানে বখাটে ও সন্ত্রাসীদের নির্যাতন সহ্য করে দেহদান। এভাবেই নির্দয় জীবনের ঘানি টানছে সাথী। এরই মধ্যে কেটে গেছে তার জীবনের ৩৫টি বছর।

মগবাজারের স্থায়ী বাসিন্দা তার ৭ম স্বামী রাজ্জাকও এখন তার দেহব্যবসার টাকায় ফুর্তিতে রয়েছে। রাত নামতেই তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় দেহ ব্যবসায়। দিনে বাসায় রাতে রাস্তার ঢালে চলছে তার দেহদান। ৩৫ বছরে ভেঙ্গে পড়েছে দেহ সৌষ্ঠব। বুড়িয়ে গেছে বয়সের চেয়ে। মুখে কড়া মেকআপ। চুলে রঙিন খোপা। উৎকট সুগন্ধি। রঙ্গিন পোশাক। রাত ১০টা বা ১১টায় কাওরানবাজার রেল লাইনের কাছে রাস্তায় অপেক্ষা। ঘুরাঘুরি। খদ্দেরের দৃষ্টিকাড়ার চেষ্টা। ১০০ থেকে ৩০০ টাকায় মৌখিক চুক্তি। তারপর রাস্তার ঢালে নেমে পড়া। কিছুক্ষণ খদ্দেরের মনোরঞ্জন। কিন্তু চারদিকে সন্ত্রস্ত ভীত দৃষ্টি। পুলিশের আসা-যাওয়ার কড়া নজর। কখনও স্থানীয় টাউট ও সন্ত্রাসীরা চাঁদা দাবি করে বসে। না দিলে মারধর। কেড়ে নেয় সঙ্গে থাকা টাকাও। আর ফাউ ভোগ তো রয়েছেই। তারপরও শুনতে হয় উল্টো গালি ও বকা। প্রতিদিন ৪ থেকে ৮ খদ্দেরের সঙ্গে মেলামেশা। কয়েক ঘণ্টায় ৫০০ থেকে এক-দেড় হাজার টাকা আয়। এরপর মধ্য বা ভোররাতে বাসায় ফেরা। এই অভিশপ্ত সাতপাকে বাধা জীবন। শুধু সাথী নয়। তার সঙ্গে একই এলাকায় একই পেশায় রয়েছেন রঞ্জনা, সেতু, শিলা ও রাত্রি। এগুলো সবই তাদের অন্যের দেয়া নাম। তাদের সবাই বয়সের প্রথম বা মধ্যভাগে হলেও জীবন ঘনকালো অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছেন। কিন্তু মেনে নিয়েছে সব কিছু। যেন তাই-ই তাদের স্বাভাবিক নিয়তি। দুঃখ থাকলেও নেই খুব একটা অনুযোগও। নেশাও তাদের সঙ্গী হয়েছে। তবে পেশার অনিশ্চয়তা ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে চায় তারা।

সাথী অনেকটা দ্রোহের সঙ্গেই বলেন, আমাদের আবার দুঃখ-কষ্ট কী? কিছু বুঝে উঠার আগেই লম্পটরা আমাকে পতিতা বানিয়েছে। ভাই-বোনেরা দুঃখের পর দুঃখ দিয়েছে। আর ভুল বুঝেছে। প্রতিদিন অমানসিক নির্যাতনের মধ্যে বেঁচে আছি। যার উপর ভরসা করা যায় সেই স্বামীই টাকার জন্য খারাপ কাজে ব্যবহার করছে। ভাগ্যকে ছাড়া আর কাকে দোষ দেব। জানিনা জীবনের ভবিষ্যৎ কী। ভাই-বোনদেরকে একসঙ্গে রাখার স্বপ্নভঙ্গের পর এখন ছেলেটাকে মানুষ করার স্বপ্নটাই তার টিকে আছে বলে জানান তিনি। সূত্র: মানবজমিন

বিডি-প্রতিদিন/২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭/মাহবুব

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর