৩ জুন, ২০১৮ ১০:০৬
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

তুমুল মিডিয়া যুদ্ধে কাতার ও সৌদি আরব!

নিজস্ব প্রতিবেদক

তুমুল মিডিয়া যুদ্ধে কাতার ও সৌদি আরব!

সৌদি বাদশাহ ও কাতারের আমির (ডানে)

কাতার ও সৌদি আরবের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এখন নতুন রূপ পেয়েছে। প্রায় এক বছর ধরে চলা কূটনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি নতুন অস্ত্র যোগ হয়েছে - ইন্টারনেট বট (ওয়েব রোবট, যা আসলে সফটওয়্যারের মাধ্যমে ইন্টারনেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে), ভুয়া সংবাদ ও হ্যাকিং।

২০১৭ সালের ২৪শে মে কাতারের সরকারি বার্তা সংস্থা কিউএনএ ওয়েবসাইটে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয় যাতে বলা হয় কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি একটি বক্তব্য দিয়েছেন।পরে তার এই বক্তব্য কিউএনএ'র সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ও ইউটিউব চ্যানেলেও ওই সংবাদের টিকার প্রচার হতে থাকে।

ওই বক্তব্যে কাতারের আমির ইসলামপন্থী গ্রুপ হামাস, হিজবুল্লাহ ও মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রশংসা করছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই এই রিপোর্ট কিউএনএ'র ওয়েবসাইট থেকে উধাও হয়ে যায় এবং কাতারের পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতি দিয়ে এ ধরনের কোন বক্তব্যের কথা প্রত্যাখ্যান করে।এছাড়া এখন পর্যন্ত এমন কোন ভিডিও ফুটেজ আসেনি যাতে দেখা যায় কাতারের আমির আসলে কী বলেছেন।

কাতার দাবি করেছে, কিউএনএ'র ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে এবং তারা এটাও বলেছে যে কাতারের আমির ও পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে এ ধরনের পরিকল্পিত বক্তব্য প্রচারের জন্যই ওয়েবসাইট হ্যাক করা হয়েছে। আর এজন্য কাতার স্পষ্ট করে দায়ী করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে।

পরে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সূত্রকে উদ্ধৃত করে ওয়াশিংটন পোস্টও একই ধরণের তথ্য প্রকাশ করে। কিন্তু কাতারের আমিরের বক্তব্য সম্বলিত ওই রিপোর্টটিই সব মিডিয়া প্রকাশ করতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সৌদি ও আরব আমিরাতের মালিকানাধীন টিভি চ্যানেল আল আরাবিয়া ও স্কাই নিউজ আরাবিয়া প্রচার শুরু করে। তারা কাতারকে উগ্রপন্থীদের অর্থায়ন ও ওই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার জন্য অভিযুক্ত করতে থাকে।

আর এরপর আরও একটি হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রে আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ আল ওতাইবার ইমেইল হ্যাক হয়ে মিডিয়ার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে। এরপর তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়।

২০১৭ সালের ৫ জুন সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর এবং তাদের সহযোগী মোট নয়টি দেশ কাতারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। তারা কাতারের নাগরিকদের বহিষ্কার করে, কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করে, দেশটির সাথে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়, সব বাণিজ্য স্থগিত করে এবং এমনকি তাদের আকাশসীমা কাতারের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে স্বঘোষিত সন্ত্রাস বিরোধী জোট ১৩ দফা শর্ত দিয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য ১০ দিনের সময় দেয় কাতারকে, যার মধ্যে ছিলো আল জাজিরা বন্ধ করা ও ইরানের সাথে সহযোগিতার অবসান ঘটানো।

সৌদি জোটের এমন পদক্ষেপকে একাধিক টুইট বার্তায় স্বাগত জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমনকি তিনি দাবী করেন এটা ছিলো তার সন্ত্রাস বিরোধী নীতির একটি প্রমাণ। তার এমন বক্তব্য টুইটারে প্রোপাগান্ডা যুদ্ধকে উস্কে দেয় এবং হ্যাশট্যাগ দিয়ে কাতারের পক্ষে-বিপক্ষে সয়লাব হয়ে যায় টুইটার।

কাতারের পক্ষ থেকে হ্যাশট্যাগ দিয়ে 'তামিম দ্যা গ্লোরিয়াস' কিংবা 'কাতার একা নয়' এমন বার্তা টুইটারে উপসাগরীয় অঞ্চলের হোম পেজে ভেসে আসতে থাকে। অন্যদিকে সৌদি ও আরব আমিরাত শেখ তামিমকে অভিযুক্ত করে 'উপসাগরের গাদ্দাফি' হিসেবে। এসব ঘটনাপ্রবাহের দিকে গভীর নজর রাখছিলেন আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো বেন নিম্মো।

তিনি দেখতে পান টুইটারে স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার অর্থাৎ বটগুলো বিভিন্ন মেথডে কাজ করছে, যেমন -হঠাৎ করে কোন হ্যাশট্যাগ স্পাইক অ্যালার্ট হয়ে যাচ্ছিলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পোস্টিং পরামর্শসহ। "#তামিম_দ্যা_গ্লোরিয়াস- পোস্টটি যেই টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে আসে সেখানে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রি-টুইট হয় অন্তত দুশো বার, যা মোটেও স্বাভাবিক নয়"।

পরে টুইটার ওই অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে আর বিবিসি আরব সার্ভিস অনেক চেষ্টা করেও ওই অ্যাকাউন্টের মালিকের সাথে কথা বলতে পারেনি। আর যখন এ ধরনের অনেক বট অ্যাকাউন্ট একযোগে কাজ করতে থাকে তখন তাকে বলা হয় বট নেট।

যদিও বেন নিম্মো এ ধরনের বটস খুঁজে পেয়েছেন কাতার বিরোধীদের দিকেও। তারা সেখানে কাতারের আমিরের ছবি বিকৃত করে পোস্ট করেছে।

আবার দেখা যায় কাতার বিরোধী বটগুলো যেগুলো টুইট বার্তাকে বুস্ট করছিলো সেটা আসলে সব প্রকৃতপক্ষে একটি অ্যাকাউন্ট থেকেই আসছিলো। আর সেই অ্যাকাউন্টের মালিক ছিলেন সৌদ আল কাহতানি। তিনি সৌদি রাজকীয় আদালতের সুপরিচিতি সদস্য ও যুবরাজের পরামর্শক। টুইটারে অত্যন্ত সক্রিয় এ ব্যক্তির প্রায় দশ লাখের মতো ফলোয়ার রয়েছে অনলাইনে।

হ্যাশট্যাগ 'উপসাগরের গাদ্দাফি' টুইটে যত রি-টুইট হয়েছে তার সর্বোচ্চ পাঁচটিই তার অ্যাকাউন্ট থেকে যা মোট ট্রাফিকের ৬৬ শতাংশ। ওই অ্যাকাউন্টেই কাতারকে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে মানুষ হত্যা ও সন্ত্রাসের অর্থায়নের জন্য দায়ী করা হয়।
বয়কট বা কাতারের অবরোধ -যাই হোক সেটির খুব শিগগিরই অবসান হচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার চেষ্টা সত্ত্বেও।

হ্যাশট্যাগ দিয়ে প্রচারণা এখনো চলছে পাশাপাশি চলছে হ্যাকিংয়ের চেষ্টাও। ওই অঞ্চলের টিভি চ্যানেলগুলো এখনও একে অন্যকে অভিযুক্ত করার লড়াইয়ে আছে।

এ সংকটের জের ধরে কাতারের জীবনযাত্রায় কেমন প্রভাব পড়ছে তা নিয়েও পাল্টাপাল্টি খবর প্রকাশ করা হচ্ছে।
আল আরাবিয়া টেলিভিশনে যেমন প্রচার হয়েছে কাতারের খাবার দোকানগুলোতে খাবার নেই। অন্যদিকে আল জাজিরা দেখাচ্ছে সংকট সত্ত্বেও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার দৃশ্য।

স্কুল অফ আফ্রিকান স্টাডিজের সিনিয়র লেকচারার ডিনা মাটার যেমন বলছেন, এটা শুধু রাজনৈতিক যুদ্ধ নয়, এটা একটি মিডিয়া যুদ্ধও। পশ্চিমের মতো আরব বিশ্বেও নানা সমস্যা আছে। আর ভুয়া সংবাদ রয়েছ সর্বত্রই। আরব রাজনীতিক ও নেতারা মিডিয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন রয়েছেন আর সেটি হলো মিডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। এটা প্রোপাগান্ডা চালানোর অস্ত্র। ব্যক্তি ও জনস্বার্থের জন্যও এটি একটি অস্ত্র।

সম্প্রতি আরও একটি হ্যাশট্যাগ দেখা যাচ্ছে যেটি আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: #অ্যানিভার্সারি_অফ_দ্যা_মিডনাইট_ফেব্রিকেশন। এটির ট্রেন্ডিং দেখা যাচ্ছে কাতারে। এটা আসলে এক বছর আগে কাতার নিউজ এজেন্সি হ্যাকিংয়ের সেই অভিযোগের কথাই মনে করিয়ে দেয়ার জন্য।

প্রায় এক বছর হয়ে গেলো ওই ঘটনার কিন্তু এখনো দু পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা কমে আসার লক্ষণ তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না।

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর