শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

সাংবাদিকরা নৈতিকতার একটা সংহিতা তৈরি করতে পারেন

আনিসুজ্জামান

সাংবাদিকরা নৈতিকতার একটা সংহিতা তৈরি করতে পারেন

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। সম্পৃক্ত থেকেছেন দেশের বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে। তিনি গবেষণায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, ভারতের পদ্মভূষণসহ একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন। তরুণ বয়সে ভাষা আন্দোলন এবং ’৭১ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তার গবেষণা, মৌলিক প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা ও সম্পাদিত বহু গ্রন্থ রয়েছে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন-শেখ মেহেদী হাসান

 

আপনার দাদা, বাবা এবং আপনাকে বাঙালি মুসলমান সমাজের বিবর্তনের ধারার অনন্য উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। সম্পর্কে কিছু বলুন।

আমার দাদা শেখ আবদুর রহিম ছিলেন সাংবাদিক ও গ্রন্থকার। উনিশ শতকের শেষ দিকে বাঙালি মুসলমানের উদ্যোগে যেসব পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল তার অধিকাংশের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। তার সম্পাদিত দুটি পত্রিকা বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী এবং জনপ্রিয় হয়েছিল। একটি ‘মিহির ও সুধাকর’ এবং ‘মুসলিম হিতৈষী’। তার প্রথম বই ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘হজরত মুহাম্মদের জীবনচরিত ও ধর্মনীতি’। এটি তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই। এ ছাড়া তিনি ইসলামের ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্ব নিয়ে অনেক বই লিখেছিলেন এবং কিছুটা বলা যায় ভিন্নধর্মের বই লিখতে গিয়ে ওয়াশিংটন আর্নিংয়ের একটি উপন্যাস অনুবাদও করেছিলেন। আমার আব্বা লেখালেখি করতেন না। খুব সামান্যই লিখেছেন লোকের অনুরোধের পর। কারও জীবনী, কারও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা কিন্তু তাকে লেখক বলা যাবে না। আমাদের বাড়িতে মোটামুটি একটা সাহিত্যচর্চার আবহাওয়া ছিল, সাহিত্যের পরিবেশ ছিল। আমার মাও কিছু কিছু লেখার চেষ্টা করতেন। আমার বড় বোন কবিতা লিখতেন। এক ধরনের সাহিত্যিক পরিম-ল ছিল আব্বার সূত্রে। বহু লেখক আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন। এখন মুসলমান সমাজে বিবর্তনের অংশ হিসেবে আমাদের পরিবারকে দেখা যাবে কিনা তা অন্যরা বিচার করবেন। তবে নিশ্চয় এক ধরনের ঐতিহাসিক বিবর্তনের সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক আছে। আমার দাদা প্রধানত মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী লেখা এবং রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমাদের প্রজন্মে আমরাও স্বাতন্ত্র্যবাদী রাজনীতির মধ্য দিয়ে এসেছি। আমার আব্বা পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন। আমরা পাকিস্তানে আসার পর অনেকটা ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ বেছে নিই। কাজেই এক ধরনের বিবর্তনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল।

 

আপনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে কলকাতা, খুলনা এবং ঢাকায়। সম্পকের্ জানতে চাই।

আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে কলকাতায় দশ বছর সাড়ে দশ বছর বয়স পর্যন্ত। তারপর দেশভাগের পর আমরা এসেছি খুলনায়। সেখানে ছিলাম পনের মাস, তারপর ঢাকায়। ঢাকার সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ বলা যেতে পারে। এখানে এসে আমার জীবনে প্রথম বড় ঘটনা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যোগ। আমার শৈশব-কৈশোরের মধ্যে অসাধারণত্ব¡ কিছু নেই। কেবল এই যে অনেক লেখকের সান্নিধ্যে এসেছিলাম। এক ধরনের সাহিত্যপ্রীতি ছিল এবং নানারকম লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি।

 

আপনার ছাত্রজীবন আর একালের ছাত্রদের পার্থক্য কী রকম?

আমাদের ছাত্রজীবনের সঙ্গে একালের ছাত্রজীবনের প্রধান পার্থক্য যা হয়েছে সংখ্যায় আমরা ছিলাম মুষ্টিমেয় আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা তখন খুব একটা বড় ব্যাপার ছিল। এখনকার যে ছাত্র রাজনীতি তার সঙ্গে আমাদের কালের ছাত্র রাজনীতিরও পার্থক্য ছিল। ছাত্র সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ছাত্রনেতারা নিজেদের মতো করে ভাবতেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের নানা বিষয়ে মতামত জানাতেন ও চাপও দিতেন। তারা যে রাজনৈতিক নেতাদের ইচ্ছা পূরণ করতেন তা নয়। এখন আমি দেখি যে, শৃঙ্খলার মারাত্মক অভাব এবং পড়াশোনার প্রতি মনোযোগও আগের চেয়ে কম বলে মনে হয়। কেননা অনেকেই যা পড়তে চায়, তা হয়তো পড়তে পারেনি। এমন বিষয় পড়তে এসেছে, যে বিষয় তার মনোযোগ ও রকম আকষর্ণ করে না। শৃঙ্খলাবোধ কম আর ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে নানারকম সুবিধাবাদ জড়িয়ে গেছে। ছাত্র রাজনীতি কিছুটা লেজুড়বৃত্তির রূপ নিয়েছে। এগুলো বেশ একটা পার্থক্যের বিষয়। তবে এখনো অনেক ভালো ছাত্র আছে যারা আমাদের কালের ভালো ছাত্রদের চেয়ে ভালো ছাড়া খারাপ নয়। নির্বিচারে সবার সম্পর্কে এক কথা বলা যাবে না। এখন ছাত্ররা নানা বিষয়ে জানার যে সুযোগ পাচ্ছে এবং সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। আমাদের সময় তা ছিল না। প্রযুক্তির উন্নয়ন তাদের এ সুবিধা এনে দিয়েছে।

 

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় আপনিরাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কী কেন?’ নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেছিলেন। সম্পর্কে বলুন।

ভাষা আন্দোলনের সময় আমার বয়স ছিল পনের। ’৫২ সালে আমি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের দফতর সম্পাদক ছিলাম। ঘুরঘুর করতাম। ওঁরা লাগিয়ে দিলেন অফিসের কাজে। যখন ’৫২-এর ফেব্র“য়ারিতে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে কাজকর্ম শুরু হলো তখন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ আমাকে বললেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে একটি পুস্তিকা লিখতে হবে। আমি নিজে প্রথমে দ্বিধা করলাম যে, আমি কী-ই বা জানি যে লিখব। তিনি বললেন, আপনি লেখেন আমি দেখে দেব। আমার মোটামুটি জানা ছিল কোনো কোনো দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। এসব যুক্তিতর্ক দিয়ে ছোট একটি পুস্তিকা। কিন্তু সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ তোহা সাহেবকে বলেছিল, একটি পুস্তিকা লিখতে। তিনি সময়ের অভাবে লিখতে পারছিলেন না। ফলে আমার লেখাটাই প্রথম বের হলো। আর পরে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ থেকে তোহা সাহেবের জায়গায় বদরুদ্দীন উমর সাহেবকে ভার দেওয়া হয়। তিনিও একটি বই লিখেছিলেন; যা আমার পরে বেরিয়েছিল। আমারটার চেয়ে সেটি বড় এবং ভালো ছিল।

 

১৯৬১ সালের রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে আপনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।

’৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ যখন এগিয়ে এলো তখন আমার বন্ধু সৈয়দ আহমদ হোসেন এবং আমি সৈয়দ আলী আহসানের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি তখন বাংলা একাডেমির পরিচালক। বাংলা একাডেমিতে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদ্যাপন করা হবে কিনা, হলে কীভাবে হবে তা জানতে। তার সঙ্গে কথা বলে আমাদের ধারণা হলো যে, পাকিস্তান সরকারও চাইছে না এই জন্মশতবর্ষ পালিত হোক আর বাংলা একাডেমি এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেবে না। পরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম উদ্যোগটা নেওয়া হয়। বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আবদুল হাইয়ের কক্ষে প্রথম সভাটা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, ইংরেজি বিভাগের রিডার খান সারওয়ার মুরশিদ, দর্শন বিভাগের রিডার গোবিন্দ চন্দ্র দেব, বাংলা বিভাগের মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিম, আহমদ শরীফ, আমি, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান আমরা সবাই ছিলাম। তখন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ইংরেজি বিভাগের মনজুরে মওলা, ইতিহাস বিভাগের মোস্তাক আহমদ প্রমুখ। পরে বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদকে সভাপতি ও খান সারওয়ার মুরশিদকে সম্পাদক করে একটি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির উদ্যোগে বড় করে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালিত হয়। তা ছাড়া বেগম সুফিয়া কামালকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠিত হয়। প্রেস ক্লাবকে কেন্দ্র করে আরও একটি কমিটি গঠিত হয়। পরে এ তিনটি কমিটির কর্মসূচি আমরা মিলেমিশে করি। প্রথমে সাত দিন অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল, পরে তিন দিন হয়। কিন্তু সেই তিন দিনই এতই জমকালোভাবে হয়েছিল এবং এত মানুষের অংশগ্রহণ ছিল যে সরকারের বাধা সত্ত্বেও রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ ঢাকায় খুব বড় করে পালিত হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রামেও খুব বড় করে হয়েছিল। সেখানে শতবর্ষ উদ্যাপন কমিটির সভাপতি ছিলেন এম এ বারী। তিনি তখন রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি আগাগোড়াই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরে আমরা আরেকটি কাজে জড়িয়ে পড়েছিলাম। ১৯৬৭ সালে কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী যখন বললেন, পাকিস্তানের আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে বেতার ও টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসংগীত হ্রাস করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তখন তার প্রতিবাদ করেছিলাম আমরা। ১৯ জনের একটি বিবৃতি খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়। বিবৃতির সব সই আমি নিয়েছিলাম। বিবৃতি লিখেছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী।

 

বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একবার অসুস্থ হওয়ায় বঙ্গবন্ধু আপনাকে দেখতে এসেছিলেন।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দেওয়ার উদ্দেশে যাচ্ছিলাম ’৬৯ সালের জুন মাসের গোড়ার দিকে। তখন কুমিল্লার চান্দিনার কাছে গিয়ে আমি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হই। ওখানে কিছুদিন চিকিৎসা নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। তো ঢাকায় ফিরে আসার পর নীলক্ষেতে আমার বিশ্ববিদ্যালয় বাসস্থানে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ, আওয়ামী লীগের তখনকার প্রচার সম্পাদক আবদুল মান্নান (যিনি পরে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় খাদ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন) তিনজন আমাকে দেখতে এসেছিলেন। এটি একটি স্মরণীয় ঘটনা বটেই। আমার মেয়ের বয়স তখন পাঁচ বছর।

ওরা স্লোগান দিত ‘আসাদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব।’ শেখ মুজিব ও আসাদের নাম ওদের কাছে অবিচ্ছেদ্য হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে দেখে ও আমাকে ফিসফিস করে বলছিল, আসাদ আসেনি? বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মেয়ে কী বলে? আমি বললাম, ও জিজ্ঞেস করছে আসাদ আসেনি? তখন উনি যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি নিচু হয়ে ওর গাল ধরে বললেন, ওরা তো আমার কাছে কৈফিয়ত দাবি করতেই পারে।

 

আপনি সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তখনকার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলাম। এপ্রিলের ১ তারিখে বেরিয়ে পড়ি। কিছুদিন দেশের মধ্যে থেকে ২৬ এপ্রিল আমরা আগরতলায় যাই এবং মে মাসের মাঝামাঝি কলকাতায়। কলকাতায় গিয়ে প্রথমে যা করি, বাংলাদেশের শরণার্থী সব ধরনের শিক্ষককে সংগঠিত করার জন্য ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’ গঠন করি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এ আর মল্লিক ছিলেন এর সভাপতি, আর আমি সাধারণ সম্পাদক। আমি অল্প দিনই কাজ করেছিলাম। আমরা সাধারণত উত্তর ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলাদেশের হয়ে প্রচারাভিযান করি। জুনে দিল্লিতে যখন যাই তখন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়। পরে আমি যখন বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে যোগ দিলাম তখন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সম্পাদকের দায়িত্ব নেন অধ্যাপক অজয় রায়।

 

আপনি তো মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে কাজ করেছিলেন। সে অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে যখন কাজ করি, প্রথমটায় আমরা চারজন সদস্য ছিলাম। পরে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী কলকাতায় গেলে ওকে এর সভাপতি করা হয়। সদস্য ছিলেন খান সারওয়ার মুরশিদ, অর্থনীতিবিদ মোশারফ হোসেন, স্বদেশরঞ্জন বসু আর আমি। আমাদের একটি ছোট্ট দফতর ছিল। সেখানে সনৎ কুমার সাহা একজন গবেষক হিসেবে যোগ দেন। আমরা ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কিছু কাজ করেছিলাম। তবে আমাদের পরিকল্পনা সরকার যে খুব কাজে লাগিয়েছিল তা নয়। কারণ সরকারের মধ্যেই পরিকল্পনা কমিশন গঠন নিয়ে মতভেদ ছিল। তারপর আমরা যারা পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হয়েছিলাম তারা ঠিক কেউই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম না। আমরা আওয়ামী লীগের ’৭০ সালের নির্বাচনের যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা সামনে রেখেই কাজ করেছিলাম। যখন ডিসেম্বরে সরকার চলে আসে ঢাকায় তখন তারা আর পরিকল্পনা কমিশনের কাগজপত্র কিছুই নিয়ে আসেননি। আমার কাছে যেসব কাগজপত্র ছিল তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করা হয়নি। তবে মূল কথাটা বোধহয় তারা মেনে নিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশে একই মাধ্যমে একই পদ্ধতির শিক্ষা হওয়া উচিত। যদিও তা কার্যকর হয়নি।

 

আপনার বহুল পঠিতমুসলিম মানস বাংলা সাহিত্য বইটির সর্বশেষ ভূমিকায় আপনি লিখেছেন, এটি এখন লিখলে আপনি আরও অনেক প্রশ্ন তুলতেন। খেলাফত আন্দোলনকে আপনি ইতিবাচক বলে ভেবেছেন। কিন্তু ধর্মকেন্দ্রিক এসব আন্দোলনের ক্ষতিকর প্রভাব তো পরবর্তী ইতিহাসেও পড়েছে।

‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ বইটি পঞ্চাশ বছরের বেশি আগে লেখা। এ পঞ্চাশ বছরে আমি যে বিষয়ে লিখেছিলাম সে বিষয়ে অনেক নতুন গবেষণা, বইপত্র হয়েছে। কাজেই সেসব গবেষণা থেকে যা কিছু নেওয়ার তা যদি নিতে পারতাম তাহলে বইটা নতুন করে লিখতে হতো। এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া হয়েছে খেলাফত আন্দোলন সম্পর্কে। আসলে খেলাফত আন্দোলন বলে নয়, এ উপমহাদেশে যেসব ধর্মীয় সমাজ সংস্কার আন্দোলন হয়েছে বা ধর্ম আন্দোলন হয়েছে বিশেষ করে মুসলিম সমাজে তাতে দেখা যায় তার একটা ইতিবাচক ভূমিকা আছে আবার নেতিবাচক ভূমিকাও আছে। যাকে আমরা ওহাবি আন্দোলন বলি তার একটা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী দিক আছে। আবার এটি অন্য সম্প্রদায় থেকে মুসলমানদের স্বতন্ত্র করার জন্য কাজ করবে। তেমনি খেলাফত আন্দোলনের একটা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা আছে। আবার এই যে তুরস্কের খলিফা যিনি একজন স্বেচ্ছাচারী নৃপতি ছিলেন; তার জন্য যে দুঃখবোধ এটি তো নেতিবাচক ব্যাপার এবং খোলাফায়ে রাশেদিনের সেই খেলাফত তো তখন ছিল না। তখন খেলাফত নামেই এটা ছিল রাজতন্ত্র। সেই রাজতন্ত্রের জন্য আমরা সবাই দুঃখ প্রকাশ করলাম এটা নেতিবাচক বলতে হবে। কামাল পাশা তুরস্কে যে নতুন জীবন নিয়ে এসেছিলেন তা খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কেউ লক্ষ্য করেননি। ধর্মকেন্দ্রিক আন্দোলনের প্রতিফলন আগেও হয়েছে পরেও হয়েছে এবং সেখানেও একই রকম দেখেছি আমরা। মুসলিম লীগের রাজনীতি এটা ধর্ম আন্দোলন বলব না; কিন্তু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে তারা। তার একটা দিকে আছে যে দুর্বল বা দরিদ্র মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। অন্যদিকে সম্প্রদায়। এটিই হিন্দু সংস্কার আন্দোলন সম্পর্কে খানিকটা বলা যাবে। যখন হিন্দু মেলাকে কেন্দ্র করে জাতীয় ভাবধারাভিত্তিক আন্দোলন বা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠতে চায় সে আন্দোলন মুসলমান সমাজকে গ্রহণ করেনি বরং তাদের কিছুটা বিরোধিতা করেছিল।

 

আপনারপুরোনো বাংলা গদ্য বইয়ে আপনি দেখিয়েছেন, উপনিবেশ শাসন প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই অঞ্চলে বাংলা গদ্য ছিল এবং ইতিহাসের অভিজ্ঞতার ভিতর তা ক্রমে স্পষ্ট আকার পাচ্ছিল। আপনার কি মনে হয় ঔপনিবেশিক শাসকের হস্তক্ষেপ ছাড়াই বাংলা গদ্য নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত?

‘পুরোনো বাংলা গদ্য’ বইতে আমি যা বলেছি যে উপনিবেশের আগে থেকে বাংলা গদ্য ছিল এবং বাংলা গদ্যের এক ধরনের বিকাশ আমরা দেখতে পাই। আমি মনে করি যে, উপনিবেশের হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজস্ব গতিতে চলত যেমন অন্যান্য দেশে হয়েছে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় এ গদ্য কিছুটা ভিন্নরূপ ধারণ করেছে এটি আমার মনে হয়েছে। আগের যে ধারা তাকে পাশ কাটিয়ে আমরা একটা নতুন ধরনের গদ্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে আরম্ভ করে পরবর্তীকালে সৃষ্টি করলাম। এ গদ্যে নিশ্চয় অনেক গুণ আছে। কিন্তু আমার কথা ছিল, আমরা একটা দেশীয় রীতির গদ্য গড়ে তুলেছিলাম সেটি এর মাঝখানে হারিয়ে গেল।

 

দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিপুল পরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?

আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিপুল পরিবর্তন আমি ইতিবাচক হিসেবে দেখি। বিশেষ করে বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে তা খুবই সন্তোষজনক। সামাজিক অবস্থারও খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এ দুটি ক্ষেত্রেই কিছু নেতিবাচক দিক আছে। যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে আর্থিক বৈষম্য বেড়েছে। সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন সত্ত্বেও আমরা দেখি, কতগুলো সামাজিক সংকট রয়ে গেছে। যেমন নারীর প্রতি যে আচরণ আমরা দেখছি- এখনো পণের জন্য তাদের নৃশংসতা সহ্য করতে হচ্ছে। এগুলো কিছুতেই এড়াতে পারলাম না। তাই সামাজিক পরিবর্তন যা হয়েছে তা যথেষ্ট পরিবর্তন নয়, আমি বলব। খবরের কাগজের সংবাদ অনুযায়ী বাল্যবিয়ে বেড়েছে। না বাড়লেও খুব যে আমরা কমাতে পেরেছি তা নয়।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের মাতৃভাষার ওপর বিদেশি ভাষার চাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো নিজেদের মতো ভাষার ব্যবহার করছে। আপনার মতামত কী?

শহরাঞ্চলে আমরা ছেলেমেয়েদের যে ইংরেজিমাধ্যমের স্কুলে পাঠাচ্ছি তার একটা ফল হলো তারা বাংলা ভাষা থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। টেলিভিশনের ফলে হিন্দি ভাষার প্রভাব দেখা যাচ্ছে। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা হিন্দি ভাষার শব্দ ব্যবহার করছে। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিকর হয়েছে বোধহয় এফএম রেডিও। যারা ইচ্ছা করেই বাংলা-ইংরেজি-আঞ্চলিক শব্দ মিলিয়ে এমন একটি ভাষায় কথা বলে যা কোনো স্বীকৃত ভাষা নয়। এটা শুনে অনেকেই মনে করে এটা বোধহয় ভাষার আধুনিক রূপ। তারা তা অনুসরণের চেষ্টা করে।

 

রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ভাষানীতি চালু করা যায় কিনা?

করা যায়, কিন্তু সবাই যে তা অনুসরণ করবে বলা মুশকিল। আবার এই রাষ্ট্রীয় ভাষানীতি তৈরি করতে গিয়ে যারা তৈরি করবেন তারা কতটা একমত হবেন তাও বলা মুশকিল। তবে চেষ্টা হয়তো করে দেখা যেতে পারে। ফ্রান্সে ফ্রেন্স একাডেমির একটা ক্ষমতা আছে। ফ্রেন্স একাডেমি যেসব শব্দকে স্বীকৃতি দেয় সেগুলো অভিধানে যায় এবং সৃষ্ট সাহিত্যে সেগুলো ব্যবহার করা হয়। আমাদের এখানে এখন ওইভাবে কোনো সংগঠন গড়ে ওঠেনি।

 

বাংলা একাডেমি তো প্রমিত বাংলা বানানরীতি প্রচলন করেছে।

বাংলা একাডেমি-প্রণীত প্রমিত বাংলা বানানরীতি মোটামুটিভাবে গৃহীত হয়েছে। তবে এর চেয়ে বেশি করা হয়তো বাংলা এাডেমির জন্য মুশকিল।

 

ভর্তি পরীক্ষায় নিয়মিত প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। উচ্চশিক্ষার গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। শিক্ষার গুণগতমান অক্ষুণœ রাখতে আপনার পরামর্শ কী?

পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস একটা বড় রকম সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে অনেক বেশি লোক জড়িত বলে মনে হয় এবং দুঃখের বিষয় হচ্ছে এর সঙ্গে কিছু শিক্ষক এখন জড়িত হয়ে পড়েছেন। সঙ্গে অভিভাবকরা। এটা আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের বড় প্রমাণ। শিক্ষার প্রশ্নটা বাদ দিলেও যারা প্রশ্ন পেয়ে পাস করে যাচ্ছে তারা তো কিছু না শিখে পাসের সনদ পেয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে সেখানেও তাদের না জেনে পাস করার প্রভাব আমরা দেখতে পাব। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও একটা সংকট সৃষ্টি করবে। শিক্ষার গুণগতমান কমছে বলে আমরা বলছি এটা ঠিকই এক অর্থে। শিক্ষার পরিমাণগত মান বেড়েছে। পরিমাণ বাড়লে গুণের ক্ষতি হয় এটা সব সময় বলা হয় এবং উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে যতগুলো শিক্ষা কমিশন হয়েছে সবাই বলছে শিক্ষার মান অবনত হয়েছে। তার মানে এক ধরনের ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। আমাদের দেশে আমরা মনে করি যে, সবচেয়ে অবনতি ঘটেছে ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে। ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজি, বাংলা কোনো ভাষাই ভালো করে শিখছে না। তার কারণ উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব। উপযুক্ত উপকরণের অভাব। বিদেশে গেলে ১০ মাসে একটা বিদেশি ভাষা ব্যবহারযোগ্যভাবে শেখা যায়। ওই ১০ মাসে একটা বিদেশি ভাষা শিখে তারা লেখালেখি করে, অভিসন্দর্ভ লেখে কিন্তু আমাদের দেশে ১০ বছর পড়িয়েও ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করানো যাচ্ছে না। কাজেই আমাদের ভাষা শিক্ষা দেওয়ার যে প্রণালি তার পরিবর্তন হওয়া দরকার। যাকে বলা হয় অডিও ভিজুয়াল মেথড। এটা ব্যবহার করতে পারলে অনেক উপকার হবে।

 

উচ্চতর পড়াশোনার ক্ষেত্রে মাতৃভাষায় টেক্সট বুক রচনার সুযোগ সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

উচ্চতর পড়াশোনার ক্ষেত্রে বাংলায় পাঠ্যবই লেখার উদ্যোগ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না এর জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় যারা শিক্ষকতা করেন তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। কারণ তারাই বিশেষজ্ঞ, এসব বিষয়ে তারাই ভালো জানেন। তারাই ওই বিষয়ে বই লিখতে পারেন। তারা যদি আগ্রহবোধ না করেন তাহলে আমরা কাদের কাছ থেকে বই পাব। আমাদের ভাষা শিক্ষার মান এমন নয় যে, আমরা ইংরেজি বই পড়াতে পারব কিংবা ইংরেজি বই পড়ে পরীক্ষায় উত্তর দিতে পারব। কাজেই এখানে বাংলায় উচ্চশিক্ষা দানের ক্ষেত্রে বড় রকমের অসুবিধা ঘটে যাচ্ছে। এটা দূর করার জন্য সবার চেষ্টা করা উচিত।

 

বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিয়ে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কিনা?

বাংলাদেশের গণমাধ্যম আমার মনে হয় অন্য দেশের মতো এর স্বচ্ছতা আছে, জবাবদিহিও আছে। আবার যেহেতু অনেক দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন পত্রপত্রিকা বের হয় সেখানেও আমরা এক ধরনের অস্বচ্ছতা দেখি। সত্যকে কিছুটা বিকৃত করার চেষ্টাও সেখানে আছে। এ বিষয়ে আমার আলাদা কোনো পরামর্শ নেই। সাংবাদিকরা একটা নীতি মেনে চলেন। তারা নৈতিকতার একটা সংহিতা তৈরি করতে পারেন। যা সবাই অনুসরণ করবে। তার বাইরে গেলে প্রেস কাউন্সিলের মতো সংগঠনের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। তবে স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর বেশি চাপ যেন না আসে, তাও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

ধন্যবাদ।

সর্বশেষ খবর