শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
সংবর্ধিত গুণী

কবরী আবহমান বাংলার রমণী

অনুপম হায়াৎ

কবরী আবহমান বাংলার রমণী

বাংলা চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান জুটি রাজ্জাক ও কবরী

ফুল ফুটে ঝরে যায় দুনিয়ার রীতি, তুমি কিন্তু বন্ধু বটে রেখো মোর স্মৃতি।

(সুতরাং, ১৯৬৪)

 

দৃশ্য : নির্বাচনী মিছিল, প্রতীক : নৌকা

স্থান : ফতুল্লা নির্বাচনী এলাকা

সময় : ২০০৮ সাল

 

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কবরী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ভোটযুদ্ধে পরাজিত করে বিজয়ী হন। তিনি নির্বাচিত হন এমপি অর্থাৎ মেম্বার অব পার্লামেন্ট, মাননীয় সংসদ সদস্য। চলচ্চিত্রের পর্দা থেকে পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়ে কবরী বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেন। উপমহাদেশে এ ধরনের অধ্যায় আরও সৃষ্টি করেছেন ভারতের অমিতাভ বচ্চন, সি রামচন্দ্রন, জয়ললিতা, শাবানা আজমি প্রমুখ। ১৯৬৪ সালের সুতরাং থেকে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ পর্যন্ত কবরীর বিজয় মুকুটে রয়েছে আরও অনেক সাফল্যের পালক।

 

ফ্ল্যাশব্যাক : চট্টগ্রামের এক সাধারণ ঘরের ১২-১৩ বছরের কিশোরী কন্যা মিনা। সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’-এর নায়িকা জরিনা চরিত্রে কবরী নামে অভিনয় করে ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি, পাকিস্তানি, উর্দু এবং ইউরোপ-আমেরিকার ইংরেজি চলচ্চিত্রের ভিড়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন। চলচ্চিত্রটি সুপার ডুপার হিট হয় এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কৃত হয়। কবরী হয়ে ওঠেন স্বপ্নকন্যা, খ্যাতি পান মিষ্টি মেয়ে হিসেবে। সুতরাং থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, সেখান থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সর্বত্রই কবরী হয়ে ওঠেন আবহমান বাংলার রমণীর প্রতীক, প্রেমময়ী ও সংগ্রামী নারী। এ যেন এক নন্দিত মন্তাজ।

পাকিস্তানি আমল এবং বাংলাদেশ আমলের আশির দশক পর্যন্ত চলচ্চিত্রের পর্দালোকে কবরী ছিলেন দর্শকপ্রিয় নায়িকা। তার অভিনয়-নৈপুণ্যের দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র, তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননাসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পুরস্কার। রাজ্জাকের সঙ্গে জুটি বেঁধে পেয়েছেন কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি। পুরনো দিনের দর্শকরা এখনো স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত হন কবরীর অভিনয় দক্ষতায়। কবরী অভিনীত অনেক শিল্পমণ্ডিত ও বাণিজ্যিক চিত্র রয়েছে। এসবের মধ্যে সহজেই নাম করা যায় সোয়ে নদীয়া জানো পানি, সাত ভাই চম্পা, অরুণ বরুণ কিরণ মালা, আবির্ভাব, বাঁশরী, বিনিয়য়, নীল আকাশের নীচে, দীপ নেভে নাই, ময়নামতি, লালন ফকির, রক্তাক্ত বাংলা, রংবাজ, তিতাস একটি নদীর নাম, আমার জন্মভূমি, মাসুদ রানা, সুজন সখী, বধূ বিদায়, সারেং বউ, আরশীনগর, দেবদাস, দুই জীবন প্রভৃতি চলচ্চিত্রের।

কবরী রাজনীতি ও সমাজসচেতন শিল্পী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে তিনি সেই চেতনার পরিচয় দেন। ওই সময় আকাশবাণীতে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রচারিত তার আবেগমথিত আহ্বান বিশ্ববাসীর কর্ণগোচর হয়েছিল। তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সমাজের বিভিন্ন স্তরে চলচ্চিত্রসহ যে নতুন নির্মাণের পালা শুরু হয় কবরী তাতে শরিক হন। রংবাজের চিনি, তিতাসের অন্তরের মা, সুজন সখীর সখী, সারেং বউর নবীতুন এবং দেবদাসের পার্বতীরূপে কবরী দর্শকচিত্তে স্থান লাভ করেন। একজন বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও তিনি হন নন্দিত।

২০০১ সালে কবরী আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্বপ্রেক্ষাপটে তুলে ধরেন। তার নেতত্বে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় এ উৎসব। এ বছর তিনি চিত্রপরিচালক হিসেবেও আবির্ভূত হন ‘একাত্তরের মিছিল’ নামে একটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে। এটা ছিল কবরীর জাতির ভবিষ্যৎ বংশধরের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করার প্রচেষ্টা।

কবরী আবার চলচ্চিত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেন পোশাককন্যাদের জীবনের কথকতা নিয়ে ‘আয়না’ (২০০৬) নির্মাণ করে এবং চলচ্চিত্রে তার চিত্রগুরু নির্মাতা সুভাষ দত্তও অভিনয় করেন।

কবরীকে প্রথম দেখি ১৯৬৪ সালে সুতরাং চলচ্চিত্রে। তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। আর তার সঙ্গে পরিচয় সারেং বউয়ের ডাবিংয়ে এফডিসিতে ১৯৭৮ সালে সাংবাদিকতার সূত্রে। পরবর্তীতে  সেই পরিচয় আরও দৃঢ় হয়েছে চলচ্চিত্রজগতের নানা কাজকর্মের মাধ্যমে। ফিল্ম আর্কাইভ, এফডিসি, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, সুভাষ দত্তের জন্মদিন পালন, চাষী নজরুল ইসলামের সংবর্ধনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে তার সঙ্গে একত্রে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তাকে নিয়ে আমার একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল পাক্ষিক ‘তারকালোক’ পত্রিকায় ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। লেখাটির শিরোনাম ছিল ‘কবরী আবহমান বাংলার রমণী’।

আমার বিশ্বাস, কবরী নানা সংকট ও ব্যক্তিগত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিজয়ের পতাকা হাতে সব সময় এগিয়ে চলেছেন। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ, সংসদ সদস্য, সমাজসেবা, আয়না এসবই তার উজ্জ্বলতম নিদর্শন। বাংলাদেশের মানুষ এবং দর্শকরা কবরীর মধ্যে বার বার বাংলার সেই চিরন্তন রমণীকেই খুঁজে পেয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর