শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

এখনো চলছে প্রতিভার অন্বেষণ

ফরিদুর রেজা সাগর

এখনো চলছে প্রতিভার অন্বেষণ

বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমাদের অনেক ঋণ। এভাবেও বলা যায় ঋণের কোনো শেষ নেই। অনুপ্রেরণার উৎসও। যারা বয়সে নবীন, যারা বিভিন্ন টিভিতে নানারকম কাজে মগ্ন, তাদের প্রায় সবারই বোধহয় বিষয়টি অজানা। উপলব্ধি হয়তো তারা সেভাবে করতে পারছেন না। যদি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্ম না হতো তাহলে আমরা হয়তো অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হতাম। বাংলাদেশ টেলিভিশনের অস্তিত্ব ছিল বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানে ঋদ্ধ।

আমি যেমন, অনেকেই আজকে বিভিন্ন চ্যানেলের সঙ্গে জড়িত। আমার কন্যাদ্বয় মেঘনা-মোহনা প্রিয় গানগুলো আমাকে শোনার জন্য সিডি দিয়ে যায়, মনে হয়, আমি সেই ভাগ্যবানের একজন যে একজীবনে মুখোমুখি বসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শুনেছি। রেকর্ডিং দেখেছি। ডিআইটি স্টুডিওতে গান শুনেছি। কথা বলেছি খোলামেলা। বিমানে পাশাপাশি বসে ঢাকা থেকে কলকাতা যেতে যেতে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মূল্যবান সুযোগেরও দাবিদার। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে মেঘনার জন্য সানন্দে অটোগ্রাফও দেন তিনি। সেই অটোগ্রাফটি সযতেœ রক্ষিত আছে মেঘনার কাছে।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্ম না হলে, উপমহাদেশখ্যাত শিল্পী-সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একজীবনে সাক্ষাৎ ঘটত না আমার কখনো। আমি সেই সমুজ্জ্বল দৃশ্যটির কথা ভাবতে চাই। ভারতের সর্বোচ্চ খেতাবধারী শিল্পী ভূপেন হাজারিকা ডিআইটি স্টুডিওতে গান পরিবেশন করছেন। খ্যাতিমান চিত্রগ্রাহক মানিক মিয়া, আমাদের মানিক ভাই ক্যামেরা নিয়ে একদম কাছে চলে গেছেন দর্শককে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে দেখাতে। লাইভ প্রোগ্রামে ক্যামেরা খুব কাছে যেতে তিনি গান থামিয়ে বলে বসলেন, ‘ক্যামেরাটা একটু দূরে সরান। তারপর গান গাই।’

তখন ক্যামেরার এত জুম করার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে জড়িত হওয়ার সুযোগ ছিল বলে এমন অসাধারণ সব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় আমার।  বিখ্যাত ভূপেন হাজারিকার কারিশমা যে কি সাংঘাতিক, ওইদিন ওই মুহূর্তটি বুঝিয়ে দিয়েছিল আমাদের। গান গাইতে গাইতে, একটুও অস্বস্তি না নিয়ে বললেন কথাটা! কী অসামান্য মুহূর্ত! এই একটা জীবনে কি ভোলা সম্ভব?

ক্লিফ রিচার্ড তখন মাত্র একদিনের জন্য বাংলাদেশে এসেছেন। ক্লিফ রিচার্ড বিশ্বজুড়ে এক বিরাট শিল্পীর নাম। আমাদের ইমপ্রেস টেলিফিল্মের অন্যতম স্বত্বাধিকারী মুকিত মজুমদার বাবু সফল প্রকৃতিপ্রেমী, গেলেন ক্লিফ রিচার্ডকে রিসিভ করতে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের পক্ষ থেকে তিনি ক্লিফ রিচার্ডকে রিসিভ করলেন! কত বড় একটা ঘটনা ঘটল। টেলিভিশন ভবনে বাবু সরাসরি। আমরা মানুষটিকে মুখোমুখি দেখলাম। কথা বলে মুগ্ধও হলাম। তাকে ঢাকায় নিয়ে আসাÑ একি কখনো সম্ভব ছিল যদি বাংলাদেশ টেলিভিশন না থাকত?

বাংলাদেশ টেলিভিশনের যারা বাংলাদেশি শিল্পী তাদের অনেকের সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানে, নানা জায়গায় অনেক কথা হয়। টেলিভিশনের কাজের সুবাদে হুমায়ূন আহমেদ নামের কথাশিল্পীকে চিনতাম। পরবর্তীতে ওই কথাশিল্পীর অনেক কিছুর সঙ্গেই নানা সময়ে আমাদের জড়িত থাকার সুযোগ হয়েছে।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ওঠাবসার সুযোগ তৈরি হয়েছে আমাদের। দেশজোড়া এই খ্যাতিমান লেখককে আমরা পেয়েছি টিভিতে ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে। কবি আসাদ চৌধুরীকেও আমরা পেয়েছি ওই ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে। স্বপ্নের কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তো এই কাতারে রয়েছেনই! এদের সান্নিধ্য পাওয়া গেছে, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম, সেটাই প্রধানতম কারণ!

কথা বলার সুযোগ, সম্মান সবকিছু পেয়েছি, পাই ওই বাংলাদেশ টেলিভিশনে যুক্ত থাকার সুবাদে।

আমরা দক্ষ কণ্ঠশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সঙ্গে অনুষ্ঠান করি। তার সেই অনুষ্ঠানে আমরা নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনকে একবার নিয়ে এসেছিলাম। তিনি এসে বললেন, আমি সুযোগ পেলে, সময় পেলে বাংলাদেশের টিভি অনুষ্ঠান দেখি। এই রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা যখন টিভিতে গান পরিবেশনায় এলেন, মনে হয়েছিল, তিনি কথা বললেও ভালো করবেন। তাকে ডাকলাম, সংগীত পরিবেশনার সঙ্গে ‘উপস্থাপনা’ করার জন্য। তিনি সেই প্রস্তাব শুনে সবিনয়ে বললেন, আপনারা বোধহয় জানেন না আমি রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন থেকে এসেছি। গান শিখে এসেছি। আমি গানের শিল্পী। উপস্থাপনা করি না। আমি আর মেনকা হাসান বললাম, আমরা তা জানি বলেই বলছি, উপস্থাপনাটা পাশাপাশি করে দেখুন। আমরা স্ক্রিপ্ট দিচ্ছি। একটু পরীক্ষা করে দেখুন। চেষ্টা করতে তো সমস্যা নেই।

বন্যা বিনীত গলায় বললেন, আমি স্ক্রিপ্ট পড়ব ঠিকই। কিন্তু উপস্থাপনার সময় আমি আমার মতো করে কথা বলব। তাতেই মাথা নাড়লাম আমরা। বললাম, আপনি আপনার মতো করেই বলবেন। কোনো অসুবিধা নেই। দেশের মানুষ আজ এত বছর পর জানে, বন্যা গান পরিবেশনার ফাঁকে ফাঁকে চমৎকার কথা বলেন। গানের পাশাপাশি এটাও শ্রোতা-দর্শকের কাছে বিরাট এক প্রাপ্তিযোগ। বাংলাদেশ টেলিভিশন না হলে হয়তো এই শিল্পীকে এই পরিচয়ে পাওয়া যেত না।

অমর্ত্য সেনের আরেকটি ঘটনা এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে টেনে আনছি।

নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এসেছেন। অনুষ্ঠানের ফাঁকে তার কারও সঙ্গে কথার বলার প্রয়োজন হলো। আমার সহকারী মঈন তার সেলফোনটি দিয়ে ওয়াশ রুমে গেল। মঈনের ফোনে তখন ওপাশ থেকে ফোন করেছেন মঈনের বাবা। অমর্ত্য সেন ফোন ধরে বললেন, জি বলুন, আমি অমর্ত্য সেন বলছি।

মঈনের বাবা উষ্ণ গলায় ওপাশ থেকে বললেন, এটা আমার ছেলের নাম্বার। আপনি ভুল করছেন।

উনি শিক্ষিত, মোবাইলে কখনো রং নাম্বারে যায় না।

অমর্ত্য সেন সবিনয়ে বললেন, আমি ভুল করছি না। আপনি অমর্ত্য সেনের সঙ্গেই কথা বলছেন।

ওপাশ থেকে তখন মঈনের বাবা থ। তার মুখের অবস্থা কেমন হয়েছিল তা সহজে অনুমান করা যাচ্ছিল।

এ ধরনের নানাবিধ ঘটনা টেলিভিশন অনুষ্ঠান করার কারণে আমাদের জীবনে ঘটেছে, পাশাপাশি অভিজ্ঞতাও সঞ্চারিত হয়েছে।

আজ চ্যানেল আইয়ের পর্দায় অনেক কিছু আমরা করি। যা, অন্য অনেক চ্যানেল অনুকরণ করে। আবার অনেক টিভির পর্দায় অনেক কিছু হয় যা পাশাপাশি চ্যানেল আইতেও তার প্রতিফলন হয়।

কেউ যদি এসব অনুষ্ঠানের ভিতরটা দেখে, তবে দেখতে পাবেন, কোনো অনুষ্ঠানই বাংলাদেশ টেলিভিশনের অনুষ্ঠানমালার বাইরে না।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে যারা কাজ করেছেন, কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব, তারা অনেককাল আগে যা-যা করেছেন আজ আমরা আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তারই পুনরাবৃত্তি করছি। কাচের পর্দায় প্রতিফলন ঘটছে সেই অনুষ্ঠানগুলোরই।

খুব যে সাংঘাতিক নতুন কিছু আমরা দিতে পারছি তার দাবি আমরা অকপটে উচ্চারণ করতে পারি না।

২৫-৩০ বছর আগের মুস্তাফা মনোয়ার, আবদুল্লাহ আল মামুন, আতিকুল হক চৌধুরী, মুস্তাফিজুর রহমান, নওয়াজীশ আলী খান, মোস্তফা কামাল সৈয়দের মতো প্রতিভার অন্বেষণ আমরা এখনো করে চলেছি।

সর্বশেষ খবর