শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

স্কুলজীবনে বাড়িতে বই নয় পত্রিকা পড়ার চাপ ছিল

---------- অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক

স্কুলজীবনে বাড়িতে বই নয় পত্রিকা পড়ার চাপ ছিল

ছবি : রোহেত রাজীব

অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। ছিলেন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন। একাধিকবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। বিশ্বের খ্যাতনামা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা বিষয়ে নিয়েছেন উচ্চতর প্রশিক্ষণ। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শামীম আহমেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

 

বা. প্র. সত্তর দশকে সাংবাদিকতা বিভাগে পড়েছেন। তখন পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা অতটা সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। এ বিষয়ে পড়ার আগ্রহ কেন হলো?

ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : আমরা যখন বেড়ে উঠেছি তখন ছিল পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আমল। সেই সময় দেখেছি, সীমিত সুযোগ-সুবিধার মাঝেও সাংবাদিকরা ঝুঁকি নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে দেশকে সেবা দিয়ে গেছেন। তাদের সাহসী ভূমিকা স্কুলজীবনেই আমাকে সাংবাদিকতার প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের পরিবারে অনেকগুলো সংবাদপত্র রাখা হতো। আব্বা-আম্মা এখনকার বাবা-মায়ের মতো ভালো রেজাল্টের জন্য সারাক্ষণ পাঠ্যবই নিয়ে পড়ে থাকতে বলতেন না। আমার ওপর চাপ ছিল পত্রিকা পড়ার। তারা সব সময় বলতেন, পত্রিকা পড়, তাহলে দেশ সম্পর্কে জানতে পারবে, পৃথিবী সম্পর্কে জানতে পারবে। স্কুলজীবনেই আমি নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম। এভাবে মনের অজান্তেই এক সময় সাংবাদিকতার প্রতি ঝোক তৈরি হয়। সেই কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হওয়া।

 

বা. প্র. তাহলে পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিলেন যে?

আরেফিন সিদ্দিক : ইচ্ছা ছিল সাংবাদিকতার। ছাত্রজীবনে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্তও ছিলাম। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতার সুযোগ এল। ভাবলাম নিজে সাংবাদিকতা করার চেয়ে আরও বহু সম্ভাবনাময়ী ছেলেমেয়েকে সাংবাদিকতা শিক্ষা দিতে পারলে তারা আরও বড় অবদান রাখতে পারবে। এ কারণেই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়া।

 

বা. প্র. ৪০ বছর হতে যাচ্ছে আপনি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। এ সময়ে বৈশ্বিক গণমাধ্যমে নানা পরিবর্তন এসেছে। অনলাইন সাংবাদিকতার প্রসার ঘটেছে। প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। সে সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের সাংবাদিকতা শিক্ষা কতটা যুগোপযোগী হয়েছে?

আরেফিন সিদ্দিক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা যদি বলি, তাহলে বলব যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা অনেক কিছু যুগোপযোগী করার চেষ্টা করেছি। শিক্ষার সঙ্গে সাংবাদিকতা পেশার সংমিশ্রণ ঘটাতে ইন্টার্নশিপ প্রথা চালু করেছিলাম। আমি ছাত্র থাকাকালীন বিভাগের সুযোগ-সুবিধা ছিল খুবই অপ্রতুল। আমি যখন বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলাম তখন মিডিয়া সেন্টারসহ আরও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। আমার আগে বা পরে যারা এ দায়িত্বে বসেছেন তারাও করেছেন। অর্থ, সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতার মাঝেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ বিভাগের উন্নয়নে যথেষ্ট সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এখন বিভাগে অন্তত তথ্য-প্রযুক্তির প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার মতো ব্যবস্থা আছে। সময়ের কারণেই বিবর্তন ঘটে। সাংবাদিকতা পেশায় বিবর্তন ঘটছে, প্রযুক্তিতে বিবর্তন ঘটছে। এই বিবর্তনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিকতা শিক্ষাকে আরও এগিয়ে নেওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব।

 

বা. প্র. অনেক সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়ানো হয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাংবাদিকতা শিক্ষার পাঠ্যক্রম তৈরি বা শিক্ষার মান উন্নয়নে সম্মিলিত কোনো উদ্যোগ আছে কি?

আরেফিন সিদ্দিক : সম্মিলিতভাবে হয়তো তেমন কোনো উদ্যোগ দেখছি না। তবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন সাংবাদিকতা বিভাগ চালু হয় তখন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারা সেখানে পাঠ্যক্রম তৈরিসহ নানা প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকেন। সেই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একটা সমন্বয় তৈরি হয়। সামগ্রিকভাবে সমন্বয় করার সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কম। একটা সমন্বয় থাকবে, তবে বৈচিত্র্যও থাকবে।

 

বা. প্র. বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কতটা সমসাময়িক সাংবাদিকতা বা আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন?

আরেফিন সিদ্দিক : এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটা সুযোগ দিয়েছে। যারা সাংবাদিকতা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত আছেন, তারা চাইলে খণ্ডকালীন সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেও যুক্ত থাকতে পারবেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সঙ্গেও যুক্ত হতে পারবেন। এভাবে তারা চাইলে শিক্ষকতার পাশাপাশি আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি ও সাংবাদিকতার সমসাময়িক ধারা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে পারবেন। তবে কে নিজেকে কতটা সমৃদ্ধ করবেন সেটা তার ওপরই নির্ভর করে।

 

বা. প্র. বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী সাংবাদিকতায় উচ্চ শিক্ষা নিতে বিদেশ যান। বিদেশি শিক্ষার্থীরা কি এখানে পড়তে আসছেন?

আরেফিন সিদ্দিক : হ্যাঁ, অনেক শিক্ষার্থী সাংবাদিকতায় উচ্চতর ডিগ্রি নিতে বিদেশ যাচ্ছেন। সেখানে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও যুক্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশেও এক সময় সোমালিয়া, নাইজেরিয়াসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এসে লেখাপড়া করে গেছে। এক সময় নরওয়ের অসলো ইউনিভার্সিটির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের একটা যৌথ কর্মসূচি ছিল। আঞ্চলিক মাস্টার্স ডিগ্রি চালু করা হয়েছিল। তখন নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কার শিক্ষার্থীরা এখানে লেখাপড়ার সুযোগ নিয়েছে। নরওয়েজিয়ান প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অনুদানে এ কর্মসূচি চালু ছিল। পরবর্তীকালে সেটা আর অব্যাহত থাকেনি। এই মুহূর্তে বিদেশি শিক্ষার্থী আছে কিনা আমি নিশ্চিত নই। তবে আমাদের বিভাগের যে সক্ষমতা, যে উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক ও গবেষণাগার আছে তা দিয়ে আমরা অনায়াসে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারব। এক্ষেত্রে তাদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে।

 

বা. প্র. একাডেমিক সাংবাদিকতা ও মাঠের সাংবাদিকতার মধ্যে পার্থক্য কী?

আরেফিন সিদ্দিক : অনেক পার্থক্য। এর কারণ হলো- পরিবর্তনটাকে আমরা একাডেমিকভাবে অত সহজে নিই না। একটা রক্ষণশীল মনোভাব কাজ করে। আবার অনেক ক্ষেত্রে আমরা নিউজের যে বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা পড়াই, নানামুখী চাপে পেশাগত জীবনে সেটার প্রতিফলন পুরোপুরি পাওয়া যায় না। তবে এই পার্থক্য থাকা উচিত না। নীতি কথাগুলো সব সময় বলা মুশকিল। কিন্তু এটাই বাস্তবতা।

 

বা. প্র. পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

আরেফিন সিদ্দিক : মানবসমাজের অগ্রযাত্রার জন্য সব পেশাই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসক যেমন একজন রোগীর জৈবিক অস্তিত্ব বজায় রাখতে কাজ করেন, তেমনি একজন সাংবাদিককে বলা হয় সমাজের প্রকৌশলী। তিনি নীরবে সমাজের সংস্কার করে চলেছেন। সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব বজায় রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজের নানা বিচ্যুতি তুলে ধরে তা সংশোধনে ভূমিকা রাখছেন। এ জন্য অনেক সময় তাকে বিপদেও পড়তে হয়। এ কারণে বলব, সাংবাদিকতা দেশ ও মানব সেবার এক মহৎ এবং ঝুঁকিপূর্ণ পেশা।

 

বা. প্র. কীভাবে সাংবাদিকতা পেশার আরও উন্নয়ন সম্ভব?

আরেফিন সিদ্দিক : এই পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে হবে। যত বেশি মেধাবী ছেলেমেয়ে আসবে, সাংবাদিকতা ততই সমৃদ্ধ হবে। সে জন্য দরকার অন্যান্য পেশার সঙ্গে সমন্বয় রেখে সাংবাদিকতা পেশায়ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। না হলে মেধাবীরা আসবে না, এলেও থাকবে না। সাংবাদিকদের সামাজিক মর্যাদা, সম্মান, জীবনধারণের জন্য সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজনটা তো অস্বীকার করা যাবে না। কিছু সংবাদ মাধ্যম সাংবাদিকদের ভালো সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, তবে সবাই নয়। অল্প পয়সায় অযোগ্যদের এই পেশায় যুক্ত করলে তা শুধু পেশারই নয়, ওই প্রতিষ্ঠান ও দেশের জন্যও মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনবে। শেখ হাসিনা প্রশাসনকে ধন্যবাদ, তারা নবম ওয়েজবোর্ডের মাধ্যমে সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিয়েছেন।

 

বা. প্র. সমকালীন সাংবাদিকতা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

আরেফিন সিদ্দিক : সাংবাদিকতা অনেক দৃঢ় একটা ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেছে। হাতের মোবাইল সেট আর সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে দেশের প্রতিটা নাগরিকই এখন বলা যায় সাংবাদিক। যে কেউ যে কোনো ঘটনা তৎক্ষণাত সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করতে পারছেন। সেই কারণে সাংবাদিকতার শক্তিও বহুগুণে বেড়ে গেছে। তবে এই শক্তি ভুলভাবেও ব্যবহার হচ্ছে যেটা অপসাংবাদিকতা। তথ্য-প্রযুক্তির উত্তরোত্তর প্রভাব সাংবাদিকতা পেশার সীমারেখা বিলুপ্ত করে ফেলছে। টেলিভিশন স্ক্রিন, কম্পিউটর মনিটর, মোবাইল এখন সংবাদ দেখা ও পড়ার মূল মাধ্যম হয়ে যাচ্ছে। ছাপা পত্রিকায় যা পড়ছি সেই একই জিনিস কম্পিউটারেও পড়তে পারছি। সবকিছু যেন একই বিন্দুতে চলে আসছে। সংবাদমাধ্যমে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আসছে। মাধ্যমের পরিবর্তন হবে, কিন্তু সাংবাদিকতার মূল জায়গায় কোনো পরিবর্তন করা যাবে না। বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতায় আপস চলবে না। সংবাদমাধ্যমকে তার ব্যাকরণ মেনেই চলতে হবে। সেই জায়গায় আমি কিছু কিছু ঘাটতি দেখি। যেমন : অনলাইন নিউজ পোর্টালে কি সঠিকভাবে সংবাদ সম্পাদনার ব্যবস্থা আছে? সংবাদ প্রচারের আগে যাচাই-বাছাই হচ্ছে? দেখা যায় যিনিই সংবাদ সংগ্রহ করছেন, তিনিই সেটা পোর্টালে আপলোড করছেন। কিন্তু, সাংবাদিকতার প্রাণ হচ্ছে সম্পাদনা। যাচাই-বাছাই ও সম্পাদনা ছাড়া সংবাদ জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক স্বার্থে কোনো কোনো গণমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত না করে চটকদার সংবাদ প্রচার করছে। এগুলো সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়। সংবাদমাধ্যমের কাজ নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা নিশ্চিত করে সংবাদ প্রচার করা। সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসরণ করাই যেন আজকের সাংবাদিকতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

বা. প্র. দেশ ও জাতির কল্যাণে স্বাধীন সাংবাদিকতার গুরুত্ব কতখানি?

আরেফিন সিদ্দিক : স্বাধীন সাংবাদিকতার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলো’। সংবিধান প্রণেতারা জানেন, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে স্বাধীন গণমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই। তথ্য একটি জাতির জন্য অক্সিজেন স্বরূপ। অক্সিজেন ছাড়া একজন মানুষ যেমন বাঁচতে পারেন না, সঠিক তথ্য ছাড়া একটি জাতি সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারে না। এ জন্যই সাংবাদিকতাকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়।

 

বা. প্র. ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, মানহানির মামলা, আইসি অ্যাক্টের মতো কিছু আইনি কাঠামো স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বাধা বলে সমালোচনা আছে। আপনি কী মনে করেন?

আরেফিন সিদ্দিক : সাংবাদিকতার প্রধান রক্ষাকবজ সত্য কথা বলা। সত্য বলায় যদি কাউকে আদালতে যেতে হয়, আমার মনে হয় তিনি নিষ্কৃতি পেয়ে যাবেন। তবে সত্য বলার জন্য কিছুটা সময় তাকে চাপে থাকতে হয়। মামলার মধ্যে পড়ে যেতে হয়। এ কারণেই সাংবাদিকতাকে পৃথিবীর অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ ও ঝামেলাপূর্ণ পেশা বলা হয়। কারণ, সাংবাদিকরা কাজ করেন সত্য নিয়ে। আর সত্যের শত্রু সর্বত্র। যিনি সত্যের সৈনিক হবেন তাকে তো সেই সব বাধা মোকাবিলা          করতেই হবে।

 

বা. প্র. আমাদের গণমাধ্যমে কোনো ধরনের প্রতিবেদনের অভাব আছে বলে মনে করেন?

আরেফিন সিদ্দিক : সাধারণ মানুষের অর্জনগুলো তুলে আনতে হবে। আমরা শহরের কিছু হাইপ্রোফাইল মানুষের কথা পত্রপত্রিকায় প্রায় দেখি। তাদের ছবি দেখি। কিন্তু, আমাদের সমাজে বহু মানুষ আছে যারা নিরলসভাবে, নিঃস্বার্থভাবে সমাজকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছেন। বহু উদ্যোক্তা আছেন একেবারে মাথায় ঝুড়ি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, এখন বড় বড় শিল্প-কারখানার মালিক। গ্রামে-গঞ্জেও এমন অনেক মানুষ আছেন। সেই মানুষগুলোর কথা সংবাদমাধ্যমে দেখি না। তাদের জীবনের ঘটনাগুলো তুলে আনা দরকার। এই একটি ঘটনা বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। তাদের কথা সংবাদমাধ্যমে এলে আজকের তরুণ প্রজন্ম বেকারত্বের হাত থেকে মুক্তি পেতে সেই সব দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। এতে সমাজ উন্নয়ন হবে। সমাজের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরার পাশাপাশি মানুষকে আশান্বিত করাও সংবাদমাধ্যমের একটা বড় দায়িত্ব। সেই হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিদিন একটা ব্যতিক্রমী ভূমিকা রাখছে বলে মনে হয়। লক্ষ্য করি পত্রিকাটি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সুখ-দুঃখের কাহিনীগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়।

 

বা. প্র. টেলিভিশন, অনলাইন, মোবাইল এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষ তাৎক্ষণিক খবর পেয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ কি হুমকির মুখে?

আরেফিন সিদ্দিক : ছাপানো পত্রিকার আবেদন বিলুপ্ত হবে না। হয়তো পাঠক সংখ্যা কমবে। কিছু কিছু পাঠক সব সময় থাকবে যারা বিশ্লেষণসহ বিস্তারিত খবর জানতে চায়। হ্যাঁ, আজকাল অনলাইন পোর্টালেও কিছুটা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পাওয়া যায়, তারপরও সকালবেলা মানুষ সংবাদপত্র হাতে নিয়ে সারা দিনের ঘটনাগুলোর যে আদ্যোপান্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পায়, এটা অন্য মাধ্যমে সম্ভব না। তবে এটা ঠিক, সংবাদমাধ্যম একটা কনভার্জেন্স মোডের দিকে যাচ্ছে। অর্থাৎ সংবাদপত্র যে শুধু পত্রিকার পাতায় ছাপানোটাই পড়তে হবে তা নয়, অনলাইনেও একই আদলে বের হতে পারে। তবে সেখানেও সংবাদপত্রের ব্যাকরণ অনুসরণ করতে হবে।

 

বা. প্র. বিশ্ব মিডিয়ায় আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ কী? বাংলাদেশের মিডিয়া কীভাবে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে?

আরেফিন সিদ্দিক : সারা পৃথিবীতে আমরা দেখছি এখন সত্যের বিকল্প খোঁজা হচ্ছে। অল্টারনেট ফ্যাক্টস। ফেক নিউজ। নিউজ আবার ফেক হবে কেন? সংবাদের মধ্যে সত্যতা না থাকলে তো সংবাদ হবে না। সেই চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। সংবাদমাধ্যমের ব্যাপ্তি এতটা বেড়ে গেছে যেখানে বহু মানুষ, বহু প্রতিষ্ঠান এই পেশায় যুক্ত হয়ে গেছে। সাংবাদিকতার স্বার্থে নয়, অন্য কোনো স্বার্থে তারা এই পেশায় যুক্ত হয়েছে। সেই জায়গা থেকে সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বের করে আনা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

 

বা. প্র. রাজনৈতিক দল দ্বারা অনেক সাংবাদিক প্রভাবিত হন। কীভাবে দেখছেন?

আরেফিন সিদ্দিক : রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকা দোষের কিছু নয়। কিন্তু, যখন তিনি সংবাদ লিখতে বসবেন তখন তাকে একেবারেই বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষভাবে কাজটি করতে হবে। যখন তিনি মতামতধর্মী কলাম, সম্পাদকীয় বা উপ-সম্পাদকীয় লিখবেন, তখন তিনি রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটাতে পারেন।

 

বা. প্র. অনেক বছর পর ডাকসু নির্বাচন হলো। নির্বাচন নিয়ে নানা বিতর্ক হচ্ছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?

আরেফিন সিদ্দিক : যে কোনো নির্বাচনের মূল জায়গাটি হলো তার বিশ্বাসযোগ্যতা। ভোটাররা সঠিকভাবে ভোটটা দিতে পারলেন কিনা, ভোটের ফলাফলে সঠিক রায়টি প্রকাশিত হলো কিনা এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে কিনাÑ এ বিষয়গুলো দিয়েই আমরা একটা নির্বাচনের মূল্যায়ন করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ২৯ বছর পর অনুষ্ঠিত হয়েছে। সারা দেশের মানুষের এ ব্যাপারে আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। গণমাধ্যম ডাকসু নির্বাচনকে গুরুত্বসহকারে কাভারেজ দিয়েছে। এতেই বোঝা যায় ডাকসু দেশবাসীর আকর্ষণের একটা বড় জায়গা ছিল। কিন্তু, ভোটের দিনের কিছু সংবাদ নির্বাচনকে নিয়ে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। নির্বাচনের শুরুতেই একটা হলে সিল দেওয়া ভোটপত্র পাওয়া, নির্বাচনের ব্যালটপত্র আরেকটি হলে স্ত‘পাকারে পাওয়া, দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও ভোট দিতে না পেরে ভোটারদের চলে যাওয়া, ভোটের আগের রাতে হঠাৎ করে ব্যালট বাক্স হলকেন্দ্রগুলোতে পাঠানো, অস্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার করাÑ এগুলো নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এই প্রশ্নগুলো যাতে দেখা না দেয় সে জনই তো নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। এটা ঠিক দীর্ঘদিন পর নির্বাচন হওয়ায় অনেক অনভিজ্ঞতা কাজ করেছে। তার পরও একটা স্বদিচ্ছা দরকার। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স সংগ্রহে কোথায় বাধা ছিল? প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল নির্বাচনের দিন সকালে কেন্দ্রে ব্যালট বাক্স পাঠানো হবে। সেটা আগের রাতে কেন পাঠানো হলো? এই বিষয়গুলো এখন তদন্ত করে দেখার দরকার আছে। মানুষের মনে প্রশ্ন এসেছে। গণমাধ্যম প্রশ্নগুলো করছে। শিক্ষার্থীরা প্রশ্নগুলো সামনে এনে পুনর্নির্বাচন দাবি করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক মর্যাদা ও ভাবমূর্তি সারা দেশের জন্য অমূল্য সম্পদ। আমার মনে হয় এখন একটা সুষ্ঠু তদন্ত করে যাদের অবহেলা ও ব্যর্থতায় এ ঘটনাগুলো ঘটেছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানমর্যাদা পুনরুদ্ধার করা উচিত। এই ক্ষেত্রে প্রশাসনকে শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিতে হবে।

 

ধন্যবাদ।

সর্বশেষ খবর