বুধবার, ১৫ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাংবাদিকতায় নৈতিকতা

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

সাংবাদিকতায় নৈতিকতা

শিল্পকর্ম : আবদুস শাকুর

প্রত্যেক গণমাধ্যমের একটা নীতিমালা থাকে। সেটা সম্পাদকীয় নীতি। অর্থাৎ গণমাধ্যম কী সমর্থন করবেন, কী বিরোধিতা করবেন ইত্যাদি। এই নীতিমালা গ্রহণের ব্যাপারে গণমাধ্যম মোটামুটি স্বাধীন। তবে কোনো গণমাধ্যম ইচ্ছে করলেই দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে না। সাম্প্রদায়িকতার পক্ষেও অবস্থান গ্রহণ করতে পারবে না। কারণ এগুলো রাষ্ট্রীয় নীতি। এর বাইরে একটি গণমাধ্যম মোটামুটি স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করতে পারে। গণমাধ্যমের মালিক বা মালিক গোষ্ঠী তাদের পছন্দমতো কিছু নীতি ঠিক করতে পারে। সেই নীতির আলোকেই প্রতিটি গণমাধ্যম পরিচালিত হয়। গণমাধ্যমে কর্মরত সব সাংবাদিক সেই নীতি অনুসরণ করেই কাজ করে থাকেন। এটা মোটামুটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি পথ।

এর বাইরে প্রত্যেক গণমাধ্যমের একটা নৈতিকতা থাকে। ইংরেজিতে যাকে বলে এথিকস। গণমাধ্যমের নীতি যাই হোক না কেন, এথিকস তাকে মেনে চলতেই হবে। এটাও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। একটি গণমাধ্যম একজন বা একাধিক ব্যক্তির অর্থ বিনিয়োগে পরিচালিত হলেও গণমাধ্যমের মালিক বা পরিচালক যা খুশি তা করতে পারেন না। যে দেশের গণমাধ্যম সেই দেশের সাধারণ মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ইত্যাদির আলোকে গণমাধ্যমের নৈতিকতা নির্ভরশীল। এই এথিকস পৃথিবীর সব দেশে একরকম নয়। বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন মূল্যবোধ দ্বারা তা পরিবর্তিত হতে পারে। বাংলাদেশের গণমাধ্যম বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হবে। বিকিনি পরা একজন মহিলার ছবি বিলাতের কাগজে বড় করে ছাপা হলে তা দোষণীয় হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের খবরের কাগজে বা টিভিতে তা প্রায় অসম্ভব কাজ। বিষয়টা এরকম।

সংবাদপত্রের একটি স্বাভাবিক কাজ হলো : বিভিন্ন সংবাদের প্রতিবাদ ছাপানো। অনেক সময় নানা কারণে সংবাদপত্রে ভুল তথ্য প্রকাশিত হয়। তখন যার সম্পর্কে লেখা তিনি বা তার অফিস প্রতিবাদ করেন। সেই প্রতিবাদপত্রও সংবাদপত্রে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করতে হয়। সংবাদপত্র তথা রিপোর্টারের নিজস্ব বক্তব্য থাকলে প্রতিবাদপত্রের সঙ্গে তা যুক্ত করা যায়। কিন্তু প্রকাশিত রিপোর্টের প্রতিবাদ পাঠানো হলে তা প্রকাশ করতেই হবে। এ ব্যাপারে সংবাদপত্রের কোনো অজুহাত ধোপে টিকবে না।

কিন্তু আজকাল দেখা যায় অনেক সংবাদপত্রে, এমনকি বহুল প্রচারিত খ্যাত পত্রপত্রিকাতেও ‘প্রতিবাদ বিজ্ঞপ্তি’ প্রকাশ করা হয় না। এজন্য সম্পাদক অবশ্যই দায়ী। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করেন, তাহলে সেই সম্পাদকের শাস্তি হতে পারে।

কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে রাজনৈতিক, আর্থিক, আয় কর বা অন্যান্য বিষয়ে অভিযোগ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হলে সেই অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য অবশ্যই রিপোর্টের সঙ্গে থাকতে হবে। ঐ ব্যক্তির বক্তব্য ছাড়া ঐ সংবাদ প্রকাশ হতে পারে না। কিন্তু ঢাকার বহু পত্রিকা অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য ছাড়াই প্রায়শ বিভিন্ন অভিযোগ সংবলিত খবর প্রকাশিত হচ্ছে।

আয়কর একটি খুবই স্পর্শকাতর বিষয় এবং খুবই ব্যক্তিগত বিষয়। কোনো ব্যক্তির আয়কর সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ থাকলে তা আয়কর অফিস ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসা হওয়ার কথা। কারণ এটা ব্যক্তির গোপনীয় বিষয়। একমাত্র আদালত নির্দেশ দিলে এনবিআর ব্যক্তির আয়কর সংক্রান্ত তথ্য আদালতকে দিতে পারে। আদালত ছাড়া এনবিআর ব্যক্তির আয়কর সংক্রান্ত তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারে না। প্রকাশ করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আমাদের এনবিআরের এক চেয়ারম্যান কয়েক বছর আগে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ব্যক্তি বিশেষের আয় ও আয়কর সংক্রান্ত তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন। কোনো পত্রিকা বা সাংবাদিক এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। এ ব্যাপারে এনবিআরের চেয়ারম্যানের কোনো দাফতরিক বা নৈতিক অধিকার আছে কিনা কোনো সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেননি। সাংবাদিক শুধু নিজের নৈতিকতাই দেখবে না, সরকারি কর্মকর্তারও নৈতিকতা দেখতে হবে। কোনো বিশেষ স্বার্থে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা নৈতিকতা বর্জিত আচরণ করলে তা সংবাদপত্র উন্মোচন করবে। যদি সংবাদপত্র তা উন্মোচন না করে তাহলে এই অনৈতিক আচরণই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। তখন সংবাদপত্র হবে এই অনৈতিকতার সহযোগী। অনৈতিক কাজ বোঝার মতো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সাংবাদিকের থাকতে হবে।

মাঝে মাঝে বিচারাধীন মামলা নিয়েও গণমাধ্যমের অতি উৎসাহ দেখা যায়। অভিযুক্ত ব্যক্তির খবর, ছবি গণমাধ্যমে এমনভাবে দিনের পর দিন প্রকাশ করতে থাকে যে ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি’ ও ‘দোষী প্রমাণিত ব্যক্তির’ মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলার রায়ে সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারেন। সংবাদপত্র ও টিভি মিডিয়া বিচার চলাকালীন যেভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মিডিয়ায় উপস্থাপন করে, তাতে ঐ ব্যক্তির যে সম্মানহানি হয়, তা ফিরিয়ে দেবে কে?

এখানে আমার আরও একটি পর্যবেক্ষণ আছে, তা আদালত নিয়ে। আদালতও বিচার চলার সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতি সুবিচার করতে পারে না। বিচারকার্য চলার সময় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে কেন? কাঠগড়া একটা নেতিবাচক জায়গা। অভিযোগ প্রমাণ ও শাস্তি হওয়ার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতে সম্মানের সঙ্গে বসানো উচিত। কারণ এখনো আইনের চোখে তিনি নির্দোষ। আদালতের এই আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি সাংবাদিকদেরও প্রভাবিত করেছে। আমি মনে করি, আদালতের এই নিয়ম পর্যালোচনা করা উচিত।

ইলেকট্রনিক মিডিয়া সম্পর্কে একটা বিষয় আলোচনা হওয়া দরকার। তা হলো : কোনো উচ্চপদস্থ সরকারি ব্যক্তি কোনো বক্তৃতায় কারও নামে একটা অভিযোগ করলে তা টিভি ও বেতারে সারা দিন অসংখ্যবার প্রচারিত হয়। এতে অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্মানহানি হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু পরদিন যখন এই অভিযুক্ত ব্যক্তি বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান ও প্রকৃত তথ্য তুলে ধরেন তখন কোনো টিভি চ্যানেল বা বেতার তা প্রচার করে না। যদিও বেশির ভাগ সংবাদপত্র তা প্রকাশ করে। এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের সঙ্গে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এই পার্থক্য কেন? ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে প্রতিবাদ প্রচার না করার অধিকার কে দিয়েছে? অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য বা প্রতিবাদ প্রকাশ বা প্রচার করা যে কোনো মিডিয়ার অন্যতম শর্ত। ইলেকট্রনিক মিডিয়া সেই শর্ত ভঙ্গ করেছে দিনের পর দিন। যদি ইলেকট্রনিক মিডিয়া কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘তারা কারও প্রতিবাদ প্রচার করতে পারবে না।’ তাহলে একই সঙ্গে তাদের ‘অভিযোগ’ প্রচার থেকেও বিরত থাকতে হবে। কারও সম্মানহানি করার অধিকার ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নেই।

বিষয়টা আমরা নৈতিকতার দিক থেকে বলছি। মিডিয়া কর্তৃপক্ষ সম্মিলিতভাবে তাদের ফোরামে বিষয়টা আলোচনা করতে পারেন।

কোনো কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল এরকম অনৈতিক কাজ করে যাচ্ছে তা জানার উপায় কী? কোনো মিডিয়া প্রতিষ্ঠানের এই দায়িত্ব নেওয়া উচিত। যেমন : বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট ও জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট। তাদের বিভিন্ন গবেষণার মধ্যে এ বিষয়গুলোর স্থান থাকা উচিত। যেমন : কোনো কোনো পত্রিকা অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য ছাড়া রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে তার তালিকা করা যেতে পারে। এ বিষয়ে সেই পত্রিকার রিপোর্টার ও সম্পাদকের বক্তব্যও জানা দরকার। সম্পাদককে এজন্য পত্রিকায় ভুল স্বীকার করা উচিত। কোনো কোনো টিভি চ্যানেল অভিযুক্ত ব্যক্তির প্রতিবাদপত্র প্রচার করেনি তাদেরও ত্রৈমাসিক তালিকা হওয়া উচিত। তাহলে দর্শক ও পাঠকরা জানতে পারবেন কোন কোন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল সাংবাদিকতার নৈতিকতা অনুসরণ করেন না।

আজকাল অনেক পত্রিকা ও টিভি সম্পাদক সেমিনারে ও টিভি টক শোতে সরকার, বিরোধী দল ও বিভিন্ন ব্যক্তির সমালোচনা করেন। প্রস্তাবিত এসব গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে দেখা যাবে, যারা অন্যের সমালোচনা করছেন, নিজের পত্রিকা বা টিভি চ্যানেলে তারা শুদ্ধ সাংবাদিকতা বা সাংবাদিকতার নৈতিকতা মেনে চলেন না। যারা নিজেরা সৎ সাংবাদিকতা করার যোগ্যতা রাখে না তাদের মুখে অন্যের সমালোচনা শোভা পায় না।

শতভাগ প্রাসঙ্গিক না হলেও আজকের আলোচনার সঙ্গে তা উত্থাপন করা দোষের হবে না। অনুমান করছি, বিষয়টা অনেকে লক্ষ্য করেছেন। জাতীয় সংসদের অধিবেশনে অনেক মাননীয় সংসদ সদস্য বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যক্তির সমালোচনা করে বক্তৃতা করে থাকেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনুপস্থিত ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করে সমালোচনা করেন। সংসদ অধিবেশন একটি টিভি চ্যানেলে লাইভ প্রচার করা হয়। ঐদিন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ‘খবরে’ ও পরদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রে অভিযোগটি প্রকাশিত হয়। এগুলোর মূল উৎস জাতীয় সংসদের অধিবেশন। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা জনাব ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে একজন সংসদ সদস্য সংসদ অধিবেশনের বক্তৃতায় তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। ঢাকার সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ সংসদে অনুপস্থিত ব্যক্তিকে এভাবে আক্রমণ করায় তার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। এর কয়েক বছর আগে খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদেরও সমালোচনা করা হয়েছিল সংসদ অধিবেশনে। এগুলো খুবই নিন্দনীয় কাজ। সংসদে যে ব্যক্তির সমালোচনার জবাব দেওয়ার সুযোগ নেই সেই অনুপস্থিত ব্যক্তির সমালোচনা করা ও তাকে প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ না দেওয়া অনৈতিক ও কাপুরুষধর্মী কাজ। এরকম সমালোচনার নানামুখী প্রভাব থাকে। ১) একতরফা সমালোচনা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে। (বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বসে এই সমালোচনা শুনতে ও পড়তে পেরেছেন।) ২) এই সমালোচনা সংসদ অধিবেশনের কার্যবিবরণীতে স্থান পেয়েছে। (যদি না এক্সপাঞ্জ করা হয়) আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরে এই কার্যবিবরণী পড়ে কোনো গবেষক যদি গবেষণা করেন তাহলে জনাব ইকবাল সোবহান চৌধুরী সম্পর্কে তিনি কী ধারণা লাভ করবেন?

সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ এই সমালোচনার নিন্দা করেছেন বটে, কিন্তু এ ব্যাপারে আর কোনো কাজ করেননি। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের উচিত ছিল স্পিকারের সঙ্গে দেখা করে এর একটা বিহিত করা। কীরকম বিহিত হতে পারে? আমার ধারণা :

 ১) অভিযুক্ত ব্যক্তির ‘প্রতিবাদপত্র’ সংসদের অধিবেশনে পড়ে শোনানো যেতে পারে। তা সংবাদপত্রে, টিভিতে ও বেতারে বাধ্যতামূলক প্রচার করতে হবে। যেহেতু অভিযোগ সংক্রান্ত বক্তৃতা সব মিডিয়া প্রচার করেছে।

২) কার্যববিরণী প্রকাশের সময় ঐ বক্তৃতার সঙ্গে প্রতিবাদপত্রও প্রকাশ করতে হবে। যাতে পাঠক দুটো ভার্সনই পড়তে পারেন।

৩) অনুপস্থিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বক্তৃতা করার অধিকার বন্ধ করতে হবে।

৪) এ ব্যাপারে পৃথিবীর অন্যান্য পার্লামেন্টে কী রীতি প্রচলিত রয়েছে তা পর্যালোচনা করতে হবে।

আমাদের দেশের সাংবাদিকতা এখন অনেক সমৃদ্ধ। তবু মাঝে মাঝে সাংবাদিকতায় নানা দুর্বলতা দেখা যায়। এই দুর্বলতাগুলো যেন আর না থাকে, সে ব্যাপারে পর্যালোচনা করে নানা পদক্ষেপ নিতে হবে। যথাযথ পর্যালোচনা ও পদক্ষেপ না নিলে এসব দুর্বলতা সাংবাদিকতায় থেকেই যাবে। আমাদের দুর্ভাগ্য, সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেস ইনস্টিটিউট, গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট কেউই সাংবাদিকতার মান উন্নয়নে সক্রিয় নয়।

অনেকের মনে হতে পারে, সাংবাদিকতার নৈতিকতার এসব বিষয় আমার বা আমার মতো কয়েকজনের চিন্তার বিষয়। বিষয়টি তা নয়। সাংবাদিকতার নৈতিকতার বিষয়টি আন্তর্জাতিক। পৃথিবীর সব মিডিয়াকে সাংবাদিকতার নৈতিকতা মেনে চলতে হবে। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল’ যে নীতিমালা প্রচার করেছে এই লেখার সঙ্গে তা জুড়ে দিলাম। নবীন সাংবাদিক প্রেস কাউন্সিলের এই বিধিগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন আমি আমার লেখায় কোনো অতিশায়োক্তি করিনি।

“প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট এর ১১(বি) ধারা অনুযায়ী প্রণীত সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থাসমূহ এবং সাংবাদিকদের জন্য অনুসরণীয় আচরণবিধি :

১. জনগণকে আকর্ষণ করে অথবা তাঁদের ওপর প্রভাব ফেলে এমন বিষয়ে জনগণকে অবহিত রাখা একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব। জনগণের তথা সংবাদপত্র পাঠকগণের ব্যক্তিগত অধিকার ও সংবেদনশীলতার প্রতি পূর্ণ সম্মানবোধসহ সংবাদ ও সংবাদভাষ্য প্রস্তুত ও প্রকাশ করতে হবে।

২. সংবাদপত্র ও সাংবাদিককে প্রাপ্ত তথ্যাবলীর সত্যতা ও নির্ভুলতা নিশ্চিত করতে হবে।

৩. বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য কোনোরূপ শাস্তির ঝুঁকি ছাড়াই জনস্বার্থে প্রকাশ করা যেতে পারে। এ ধরনের জনস্বার্থে প্রকাশিত, সংবাদ যদি সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে থাকে এবং প্রাপ্ত তথ্য যদি যৌক্তিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য বিবেচিত হয়, তবে এ ধরনের প্রকাশিত সংবাদ থেকে উদ্ভূত প্রতিকূল পরিণতি থেকে সাংবাদিককে রেহাই দিতে হবে।

৪. গুজব এবং অসমর্থিত প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে সেগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে এবং যদি এসব প্রকাশ করা অনুচিত বিবেচিত হয় সেগুলি প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে হবে।

৫. যে সকল সংবাদের বিষয়বস্তু অসাধু এবং ভিত্তিহীন অথবা যেগুলির প্রকাশনায় বিশ্বস্ততা ভঙ্গের প্রয়াস জড়িত সে সকল সংবাদ প্রকাশ করা যাবে না।

৬. সংবাদপত্র ও সাংবাদিকগণ বিতর্কিত বিষয়াবলিতে নিজস্ব মতামত জোরালোভাবে ব্যক্ত করার অধিকার রাখেন, কিন্তু এরূপ করতে গিয়ে;

ক) সত্য ঘটনা এবং মতামতকে পরিচ্ছন্নভাবে প্রকাশ করতে হবে।

খ) পাঠককে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে কোনো ঘটনাকে বিকৃত করা যাবে না।

গ) মূলভাষ্যে অথবা শিরোনামে কোনো সংবাদকে বিকৃত করা বা অসাধুভাবে চিহ্নিত করা যাবে না।

ঘ) মূল সংবাদের ওপর মতামত পরিচ্ছন্নভাবে তুলে ধরতে হবে।

৭. কুৎসামূলক বা জনস্বার্থের পরিপন্থী না হলে, বাহ্যত ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থবিরোধী হলেও যথাযথ কর্তৃপক্ষ স্বাক্ষরিত যে কোনো বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে প্রকাশের অধিকার সম্পাদকের আছে। কিন্তু এরূপ বিজ্ঞাপনের প্রতিবাদ করা হলে সম্পাদককে তা বিনা খরচে মুদ্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।

৮. ব্যক্তি অথবা সম্প্রদায় বিশেষ সম্পর্কে তাদের বর্ণ, গোত্র, জাতীয়তা, ধর্ম অথবা দেশগত বিষয় নিয়ে অবজ্ঞা বা মর্যাদা হানিকর বিষয় প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৯. ব্যক্তি বিশেষ, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান অথবা কোন জনগোষ্ঠী বা বিশেষ শ্রেণির মানুষ সম্পর্কে তাদের স্বার্থ ও সুনামের ক্ষতিকর কোনো কিছু যদি সংবাদপত্র প্রকাশ করে তবে পক্ষপাতহীনতা ও সততার সাথে সংবাদপত্র বা সাংবাদিকের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান/সংস্থাকে দ্রুত এবং সঠিক এবং উল্লেখযোগ্য সংগত সময়ের মধ্যে প্রতিবাদ বা উত্তর দেয়ার সুযোগ দেয়া।

১০. প্রকাশিত সংবাদ যদি ক্ষতিকর হয় বা যথাযথ না হয় তা অবিলম্বে ও তাত্ক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার, সংশোধন বা ব্যাখ্যা করাই (এবং ক্ষেত্র বিশেষ ক্ষমা প্রার্থনা করা) উচিত যাতে ভ্রমাত্মক বা অসত্য সংবাদ পরিবেশনার দ্বারা জনমনে সৃষ্ট (খারাপ বা ভুল) ধারণা প্রশমিত হয়।

১১.  জনগণকে আকর্ষণ করে অথচ জনস্বার্থ পরিপন্থী চাঞ্চল্যকর মুখরোচক কাহিনীর মাধ্যমে পত্রিকা কাটতির স্বার্থে রুচিহীন ও অশালীন সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না।

১২. অপরাধ ও দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে সংবাদপত্র এমন যুক্তিসংগত পন্থা অবলম্বন করতে পারবে যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারও কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।

১৩. অন্যান্য গণমাধ্যমের তুলনায় সংবাদপত্রের ব্যাপ্তি ও স্থায়িত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি। এ কারণে যে সাংবাদিক সংবাদপত্রের জন্য লিখবেন তিনি সূত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সংবাদের সত্যতা সম্পর্কে বিশেষভাবে সাবধান থাকবেন এবং ঝুঁকি এড়ানোর জন্য সূত্রসমূহ সংরক্ষণ করবেন।

১৪. কোনো অপরাধের ঘটনা বিচারাধীন থাকাকালীন সব পর্যায়ে তার খবর ছাপানো এবং মামলাবিষয়ক প্রকৃত চিত্র উদঘাটনের জন্য আদালতের চূড়ান্ত রায় প্রকাশ করা সংবাদপত্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তবে বিচারাধীন মামলার রায় প্রভাবিত হতে পারে, এমন কোনো মন্তব্য বা মতামত প্রকাশ থেকে চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগ পর্যন্ত সাংবাদিককে বিরত থাকতে হবে।

১৫. সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত পক্ষ বা পক্ষসমূহের প্রতিবাদ সংবাদপত্রটির এমন এক পৃষ্ঠায় দ্রুত ছাপাতে হবে যাতে সংবাদটির প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি সহজে আকৃষ্ট হতে পারে। সম্পাদক প্রতিবাদলিপির সম্পাদনকালে এর চরিত্র পরিবর্তন করতে পারবেন না।

১৬. সম্পাদকীয় কোনো ভুল তথ্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত কোনো পক্ষ যদি প্রতিবাদ করে, তবে সম্পাদকের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে একই পাতায় ভুল সংশোধন করে দুঃখ প্রকাশ করা।

১৭. একটি বিদ্বেষপূর্ণ খবর প্রকাশ বিদ্বেষহীন ভুল খবর প্রকাশের চাইতে অনেক বেশি অনৈতিক।

১৮. একটি সংবাদপত্রের সকল প্রকাশনার পরিপূর্ণ ও একক দায়িত্ব স্বীকার করা সম্পাদকের নৈতিক কর্তব্য।

১৯. কোনো দুর্নীতি বা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আর্থিক বা অন্য কোনো অভিযোগ সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রতিবেদকের উচিত হবে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে সাধ্যমতো নিশ্চিত হওয়া এবং প্রতিবেদককে অবশ্যই খবরের ন্যায্যতা প্রতিপন্ন করার মতো যথেষ্ট তথ্য জোগাড় করতে হবে এবং অভিযোগের বিষয় অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

২০. প্রতিবাদ হয়নি এবং দায়িত্বশীল এমন প্রকাশনা খবরের উৎস হতে পারে, তবে পুনঃমুদ্রণ করা হয়েছে নিছক এই অজুহাতে কোনো সাংবাদিকের কোনো খবর সম্পর্কে দায়িত্ব এড়ানো অনৈতিক।

২১. আমাদের সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের অধঃপতনমূলক খবর তুলে ধরা সাংবাদিকের দায়িত্ব, তবে নারী-পুরুষঘটিত অথবা কোনো নারী সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষেত্রে একজন সাংবাদিকের অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করা নৈতিক দায়িত্ব।”

লেখক : মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর