বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলা সংস্কৃতির শক্তি

হাসান আজিজুল হক

বাংলা সংস্কৃতির শক্তি

সংস্কৃতিই মানুষকে মানুষের পরিচয়ে বাঁচিয়ে রাখে। এমন নয় যে, এটা দেখা যায়। সংস্কৃতি শব্দটি মনে এলেই আমরা কিছু উপাদান এবং উপসর্গ সামনে দেখতে পাই। আমাদের সংস্কৃতির একটা নিজস্ব চেহারা আছে। যদিও সংস্কৃতির রূপটি এখন দিনে দিনে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে, তারপরও আবহমান বাংলা সংস্কৃতির একটি নির্দিষ্ট রূপ ছিল এবং আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের এই সংস্কৃতির শক্তি কোথায়? বলা যায়, সংস্কৃতির শক্তি হলো সাধারণ মানুষ। কিন্তু এটি এত বৃহৎ প্রসঙ্গ যে, একটি মাত্র বাক্যে এর নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। কারণ, সংস্কৃতির সঙ্গে দেশের আর্থ-সামাজিক বিষয়ও জড়িত। ফলে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটে।

মাটিতে প্রোথিত বৃক্ষ-সংস্কৃতিকে যদি এই বৃক্ষের সঙ্গে তুলনা করা যায়; বৃক্ষটি খুব সুন্দর। এবার বৃক্ষটি উপড়ে ফেললে দেখা যায়, অনেক গভীরে এর শেকড়-বাকড় নিহিত। সংস্কৃতিও তেমনি। এর শেকড় অনেক গভীরে। সাধারণ অর্থে মানুষের নিত্যদিনের জীবনাচরণ, আচার-অনুষ্ঠান তার সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু আমাদের জীবন নিয়তই পরিবর্তনশীল। ফলে সংস্কৃতিও পরিবর্তন হচ্ছে; আর সভ্যতার বিভিন্ন পর্বে বিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কৃতি এগিয়েছে, বিভিন্ন সময় ও বাস্তবতায় রূপবদল ঘটেছে তার।

আজকের প্রেক্ষাপটে বাংলা সংস্কৃতির বিষয় যদি বিবেচনা করি, দেখা যাবে আমাদের সংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রয়েছে। মেলা ও বিভিন্ন পূজা-পার্বণের সময় যে সব কৃত্যাচার সম্পন্ন হয়— সবকিছুই আমাদের সংস্কৃতির উজ্জ্বলতা ও উত্তরাধিকারকেই প্রমাণ করে। এগুলো প্রাণ পেয়েছে সাধারণ মানুষের হাতে। সেই মানুষ, যারা নিরন্ন, যারা অধিকারবঞ্চিত- সেই সব প্রান্তিক মানুষই আমাদের সংস্কৃতির শেকড়ে রস সঞ্চার করে চলেছে। বাংলা সাহিত্য উচ্চবিত্তের হাতে তৈরি হয়নি। মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের হাতেই সাহিত্যের কাঠামো তৈরি হয়েছে। একইভাবে সংস্কৃতির নির্মাতাও এরা। খুব বেশি দূরে যেতে হবে না— আমরা যদি আমাদের গণআন্দোলনগুলোর দিকে তাকাই দেখতে পাব, প্রতিটি আন্দোলন জোরালো হওয়ার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে গণমানুষ। এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ মানুষের মুখে মুখে ফিরে জয়ী হয়ে উঠেছেন। বিশেষ করে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সাধারণ মানুষের যূথবদ্ধতার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। ফলে আমাদের জীবন ও সংস্কৃতি বারবার শক্তিশালী হয়েছে ওই সাধারণ মানুষের উদ্দীপনার ভিতর দিয়ে।

২.

এক্ষণে আরেকটি প্রশ্ন উত্থাপন জরুরি মনে হচ্ছে। এই সময়ে, যখন আমাদের আবহমানকালের সংস্কৃতিকে নানাভাবে লণ্ডভণ্ড করা হচ্ছে; পরিবর্তিত অর্থনীতি, বিশ্বায়ন প্রভৃতির নামে সংস্কৃতির মধ্যে ঘুণপোকার অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে— বাংলা সংস্কৃতির কী হবে?

সংস্কৃতির দশ দশা আছে, মরণদশা বলেও একটা কথা আছে। বাঙালি সংস্কৃতি এখন কোন দশায়, সেটা নিশ্চয়ই আমরা চিন্তা করে বের করতে পারব। আপাতত আমার একটি কথা মনে হচ্ছে, বাঙালি সংস্কৃতি মরেনি, এখন প্রতীকী মর্যাদা অর্জন করেছে। বেশিরভাগ জিনিসই পুরনো হয়ে গেলে প্রতীকী হয়ে পড়ে, দুষ্প্রাপ্য বা দুর্মূল্য হলেও প্রতীকী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আধুনিকতাও এক রকম প্রতীকতা। আধুনিক মঞ্চে প্রতীক ছাড়া আর কিছু মেলা কঠিন, এটা কাকতাড়ুয়া বসিয়ে দিয়ে বলা যায় গভীর অরণ্যে ধানক্ষেত, মানুষ না মিললে প্রতীক মানুষকেও অভিনয়ে খাটিয়ে নেওয়া যায়।

বাঙালি সংস্কৃতির খবর থাকুক আর না থাকুক, নববর্ষে অন্যান্য বছরের মতোই প্রতীকী সংস্কৃতি পালন নিশ্চয়ই হবে। নির্ঘাত পান্তা খাওয়া হবে। এটা প্রতীকই তো! ব্রেকফাস্টের তোড়ে জলখাবারই নেই তো পান্তাভাত! দলবদ্ধভাবে যারা বাঙালি সংস্কৃতি করবেন, তারা দলবদ্ধভাবেই পান্তা খাবেন আর যারা মনেপ্রাণে ভীষণ বাঙালি, গরদের পাঞ্জাবি রাত থেকে আলনায় ঝুলিয়ে রেখেছেন, আধুনিক জীবনযাপনের চাপে বাঙালি থাকার এতটুকু ফুরসত পান না, পান্তা খেতে কেমন যেন লাগে, তবু তারা বাড়িতেই যথোচিত সতর্কতার সঙ্গে পান্তা খাবেন। তবে আমার ধারণা, পান্তাভাতে সংস্কৃতিও নেই, প্রতীকও নেই। দুধ থেকে সর তুলে নেওয়ার মতো আলাদা করে সংস্কৃতি বলেও কিছু নেই। জীবন আছে, তাই সংস্কৃতিও আছে। রাঢ় দেশে দেখেছি পান্তা খাওয়া! রাঢ়ে পান্তা বলে না, ভিজে-ভাত, বাসি-ভাত। রাতের গুমোট গরমে ভাত আহ্লাদে ডগমগ হয়ে ফেঁপে উঠত, বেলা ১১টায় উঠত গেঁজিয়ে। মসুর কিংবা কলাইয়ের ঘন ডালসিদ্ধের সঙ্গে পোড়া শুকনো মরিচ, কাঁচা পেঁয়াজ আর সরষের তেল মাখিয়ে নিয়ে বাসি ভাতের স্বাদ যে অমৃতেরই স্বাদ, সে যারা খেত তাদের মুখ দেখেই টের পাওয়া যেত। এর মধ্যে এক ফোঁটাও সংস্কৃতি ছিল না— যা ছিল তা হলো রাঢ়ের প্রতি শুকনো হাড়-ফাটানোর গরম।

যা বলছিলাম, এসবের মধ্যে সংস্কৃতি নেই। যেমন নেই আটচালা, চারচালা, দোচালা বাংলাঘরে। এসব এখন প্রতীকী হয়ে গেছে। তবে হাজার হাজার বছরের জীবনযাপন বদলায় বলে জীবনযাপনের সব ঘরকন্না আলাদা হয়ে যায়, জমা হয়, থেকেও যায় অনেকটা। তাকে সংস্কৃতি বললেও বলতে পারি। অনেকটা মৃত তারার আলোর মতো, পৃথিবীতে যখন পৌঁছায়, তারার তখন মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু আলো তো! বর্তমানেও সে আলো। আমাদের মুশকিল, বর্তমান তছনছ হয়ে গেছে, সময়ের কাঠামো বিকারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সন্দেহ এই যে, বাংলার নগর-সংস্কৃতির মতোই লোকজ-সংস্কৃতির নানা ধরনের প্রকাশ আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যা বিলুপ্ত হয়নি তা বিকৃত বা পরিবর্তিত হয়েছে। চর‌্যাপদের কবিতাগুলো বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গীত হতো, তা এখন আর কেউ শোনার আশা করে না। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেও যে যাত্রা বা কবিগান গ্রামাঞ্চলে হতো এখন আর তা দেখা বা শোনার কোনো উপায় নেই। রুচির বিকার ঘটেছে, এমন কথা যদি না-ও বলি, যাত্রাগান যে এখন তারকা অলঙ্কৃত মাইক্রোফেন-নিনাদিত প্রযুক্তিশাসিত এক ভিন্ন বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছে তাতে কে দ্বিমত হবেন?

তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেও রাঢ় অঞ্চলে মাঠে-ঘাটে গৃহস্থের উঠোনে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীরা কীর্তন গাইতেন, তারা এখন লুপ্ত বাংলার বাসিন্দা। বীরভূম বর্ধমানের গায়করা পিতা-পিতামহের ধারা বজায় রাখার বৃথাই চেষ্টা করছেন। যারা করেন তারা এক ঘরে, অন্যেরা জনমনোরঞ্জনে আধুনিক প্রযুক্তি ও আধুনিক ভেকধারণে ব্যস্ত। তারা জীবিকার কথা বলেন এবং সে কথা উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। সময়ের হাওয়া, মানুষের জীবনযাপনের আগ্রাসী ব্যাকুলতা সব তছনছ করে দিয়েছে। আমার ধারণা, আমাদের সংস্কৃতির সব ক্ষেত্রে এই অবলুপ্তি ও পরিবর্তন সমানতালে চলছে। আমি কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির রূপান্তর বা ক্ষেত্রবিশেষে অবলুপ্তি নিয়ে আফসোস করি না। যা এসেছে তা বদলানোর এবং চলে যাওয়ার জন্যই এসেছে। যা কিছু জীবন্ত তার মৃত্যু ঘটবে, তবু মৃত্যু ঘটলেই জীবনের পরাজয় ঘটে তা নয়। জীবনের মহিমা আপন জীবনী শক্তি বলেই প্রকাশ পায়। যখন আর তার প্রকাশ দেখা যায় না, তখন জীবনী শক্তির শেষ তৈলবিন্দুটি পুড়ে গেছে বলে ধরে নিতে হবে। যা পছন্দ হয়, তাকে চিরকালের দৃঘ মুষ্টিতে আঁকড়ে ধরে রাখলে একদিন মুষ্টি খুলে দেখা যায় শটিত শূন্যতা ধরে আছি। যেন উইপোকার খাওয়া কাঠ। যাত্রা পালাগান আর নেই বলে আমরা চাই না গ্রামের অশিক্ষিত গোঁয়ার জমিদারবাবু মদ্যপান করে গ্রামের একটি মাত্র কাঠের চেয়ারে এসে বসলে রাত ১১টায় কনসার্ট বেজে যে যাত্রা শুরু হবে, সেই যাত্রাকে চেয়ার ও জমিদারবাবুসহ ফিরিয়ে আনব। চাইলেই তা হবে না। ওই জমিদারবাবু এবং ওই সিংহাসন এখন অদৃশ্য। এখন মোমে জ্বলা ঝাড়বাতি নেই, কারবাইড বাতি পাওয়া যাবে না। হ্যাজাক, ডে-লাইট পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে গেছে। ফ্লাডলাইটে গ্রামকে গ্রাম আলোর বন্যায় যখন আলোকিত করে তোলা যায় তখন হ্যাজাক আর ডে-লাইটের জন্য দুঃখ করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। অতএব যা নেই, তার জন্য দুঃখ নেই এ কথাটি ঠিক বটে, কিন্তু যা আছে বা সংস্কৃতির অঙ্গনে যা দেখা দিচ্ছে, প্রকাশ পাচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্যে যদি বিকার, নৈরাজ্য পর-সংস্কৃতির জন্য অক্ষম লোলুপতা ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ না পায় তখন নিজের অবলম্বন, নিজের খুঁটি ধরে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য পেছনে ফেলে আসা সামগ্রীগুলোর দিকে চোখ ফেরাতেই হয়। তখন দেখা যাবে অবলুপ্তির পরিবর্তন রূপান্তরের বহমান স্রোতের মধ্যে বহু নিত্যশিল্প রয়ে গেছে, যাকে সময় প্রহার করতে ব্যর্থ হয়েছে, যা জীবনের চিরন্তনতা ও সৃষ্টিশীলতা প্রকাশে আজও আয় আয়ুষ্মান। এই আয়ুষ্মানতার দীপ থেকে বর্তমানের নিভন্ত প্রদীপগুলো জ্বালিয়ে নেওয়া আমাদের কাজ। এ কাজটি ঠিকঠাকমতো করতে পারলেই বাংলা সংস্কৃতির শক্তির দিককে আরও স্পষ্টভাবে আলোয় আনা যাবে।

 লেখক : শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর