বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বইমেলার গভীরে

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

বইমেলার গভীরে

বইমেলায় গিয়েছেন লক্ষ মানুষ, কিনেছেন হাজার বই। এর মধ্যে ক’টা বইই বা আপনি কিনতে পেরেছেন অথবা পড়বেন? চলুন, আজ মেলায় ঘুরে আসি। একটা বই নিয়েই যদি সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে পারি, কেমন হয়?

সেটাই করব। বাংলাদেশের প্রধান কবির নাম আল মাহমুদ। তাকে উৎসর্গীকৃত : ‘নক্ষত্র বিভাব’। নবীন লেখক, নাম : সীমান্ত আকরাম। মাত্র ৭১ পৃষ্ঠার বইতে বাংলাদেশের কিছু শ্রেষ্ঠ মানুষের সঙ্গে দেখা করে আসতে পারেন। আজ তাদের কাছে নিয়ে যাব।

প্রথম লেখাটি কুমিল্লায় নজরুল নিয়ে। যারা কুমিল্লায় যান, তারা পথে পথে তাকে খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কোথায় নজরুল? কেন দৌলতপুর? এখানেই তো তার মানবপ্রিয়া নার্গিসকে খুঁজতে যাই আমরা। এখানেই গোমতী নদীর অদূরে বুড়ি নদী ও আরচি নদীর কোলঘেঁষা দৌলতপুর। উদাম দুপুরে যেখানে নজরুল বাজিয়েছিলেন বাঁশি। দৌলতপুরের দৌলতখানায়, শাহজাদি মুন্সী বাড়ির আবদুল খালেকের মেয়ে সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস খানমের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়, প্রেম, পরিণয়। তবু বাসরঘরে দুইজনের দেখা হয়নি। বিয়ে হয়েও [১৭ জুন, ১৯২১] দুইজন দুই পথে। ব্যথাবিদুর হৃদয়ের কাহিনী শুনতে হলে যেতে হবে ওই গজলগুলোর কাছে। তার বিচিত্র জীবনের খণ্ডিত অংশ পেলাম আকরামের বইয়ে। মুগ্ধ হয়ে পড়লাম তার লেখাটি। যখন তিনি লিখছেন নজরুলের মনের কথা : ‘হয়ত আমার সুন্দরকে এখানেই পাব। হয়ত পাব না। শুরু হবে ছুটে চলা...’।

পেয়ে হারান, সে যে অনেক ব্যথা। মন হয়ে যায় ব্যথায় বিদীর্ণ। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, দোলনচাঁপা, প্রলয়শিখা, ছায়ানট, পুবের হাওয়া, চক্রবাঁক, ঝিঙেফুল, কতবার পড়েছি। কিন্তু সেগুলো নিয়ে আর কোথাও পড়াবার কোনো জায়গা তৈরি হয়নি। ছাত্রছাত্রীরা বইগুলো কিনে নেননি। কত যে মধুর, কত যে সুন্দর, তার মনে গাথা এই ছন্দের মালা, জাতি জানল না। হায় হতভাগ্য বাঙালি! নজরুল লিখলেন : ‘বাসর শয়ানে হারায়ে তোমাকে পেয়েছি চির বিরহে’। অথবা যখন টেলিভিশনে শুনি সুজিত মুস্তাফার মোহন কণ্ঠে ‘তোমার আমার এই যে বিরহ, একজনমের নহে’ অথবা যখন শুনি নাশিদ কামালের কণ্ঠে ‘আজও মধুরও বাঁশরি বাজে’।

ক্লাসের ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাই দৌলতপুরে। দেখাই পুকুরের ঘাটগুলো। কিন্তু, এ কি আমার চোখে যে অশ্রু বন্যা। মুছব কি দিয়ে? যখন নিজেই গাই ‘ভুলি কেমনে, আজও যে মনে, বেদনা সনে রহিল আঁকা’/ ‘আজও সজনী দিন রজনী সে বিনে গনি সকলি ফাঁকা’। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। সবাইকে ভালো লাগে। তবুও কেন যেন একজনের প্রতি অনুরাগ। তখন নজরুলের এ গানটি প্রায়ই গাইতাম রেডিওতে। বুঝিনি নজরুলকে তখনো। দৌলতপুরে এসে বুঝলাম। প্রেম কীভাবে মানুষের জীবনে ব্যথার মোচড় দিয়ে গজল লেখায়।

নার্গিসের দেওয়া চিঠির উত্তর শৈলজানন্দের অনুরোধে। আমার মেয়ের গানের আসরে সুজিতকে বললাম গানটি গাইতে। ‘যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই/ কেন মনে রাখ তারে/ ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে’।

নার্গিসকে দেখেছি। এত সুন্দর মেয়ে কম হয়। আব্বাকে দেখতে এসেছিলেন পাতলাখান লেনে। প্রেমের কিছুই জানিনি। নজরুলের তিনি নন্দিনী, ‘আর প্রমিলা ছিলেন বাইরের সৌন্দর্যের প্রতীক’, বলছেন সীমান্ত আকরাম। তাজমহল রচিত হয়েছিল শাহজাহানের আগ্রায়। আমাদের অমর তীর্থস্থান : কুমিল্লার দৌলতপুর। কবি ছিলেন সেখানে আড়াই মাস। নজরুল উঠে গেলেন বিয়ের পিঁড়ি থেকে। কল্পনা করুন নার্গিসের মনের অবস্থা। নজরুল গবেষক বুলবুল ইসলাম [১৯৫৭-১৯৯৮] লিখছেন : ‘বস্তুত নার্গিসই নজরুলের প্রেম, ধ্যান, জীবন সাধনা, প্রিয় ও পৃথিবী’। দৌলতপুরে গিয়ে হয়ে পড়ি নজরুল, প্রেমের আঘাতে বিধ্বস্ত। হয়ত আমার মতো আর কেউ হবেন না। কারণ নজরুলকে চিনতে পেরেছি। এত সুন্দর অধ্যায়ে রচনা করেছেন সীমান্ত আকরাম, যে প্রথম প্রবন্ধেই কারও চোখে পানি আসবে।

গেলাম দ্বিতীয় অধ্যায়ে। সেখানে নজরুল উপস্থিত তার ঈদের সম্ভার নিয়ে। টিভি প্রডিউসাররা খুঁজে পান না ঈদের দিনে। কারণ তারা পড়াশোনা করে না। তারা পড়েনি নবযুগে ‘কৃষকের ঈদ’ ও ‘ঈদের চাঁদ’। পড়ুন :

বেলাল! বেলাল! হেলাল! উঠেছে পশ্চিম আসমানে,/ লুকাইয়া আছো লজ্জায় কোন গোরস্থানে!/ হের ঈদগাহে চলিছে কৃষক যেন প্রেত কঙ্কাল/ কসাইখানা যাইতে দেখেছ শীর্ণ গরুর পাল?/ রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রু সলিলে হায়,

বেলাল!/ তোমার কণ্ঠে বুঝি গো আজান থামিয়া যায়!/ থালা, ঘটি, বাটি বাঁধা দিয়ে হের চলিয়াছে ঈদগাহে,/ তীর খাওয়া বুক,/ ঋণে-বাঁধা শির লুটাতে খোদার রাহে।

আরবি ফারসির তোড় দেখে সেকুলার টিভি মালিকরা তাকে বিদায় জানিয়েছেন। এমনকি, ‘খুশির ঈদ’ কবিতাটাও কোনো টিভিতে আবৃত্তি হয় না। হায়রে বাংলাদেশ! হায়রে মুসলমান! তোমাদের জন্যই লিখেছিলেন নজরুল এই কবিতা। নাম : ‘শহীদি ঈদ’

শহীদের ঈদ এসেছে আজ/ শিরোপরি খুন-লোহিত তাজ,/ আল্লার রাহে চাহে সে ভিখ্;/ জিয়ারার চেয়ে পিয়ারা যে/ আল্লাহর রাহে তাহারে দে,/ চাহি না ফাঁকির মণিমানিক।

যদি আরবি ফারসিতে আপনাদের কষ্ট হয়ে থাকে, তার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। তবে নিশ্চয়ই অনুরোধ করব নজরুল ইসলামকে পুনরাবিষ্কারের জন্য সীমান্ত আকরামের এই অধ্যায়টি পড়ে দেখতে।

তৃতীয় অধ্যায় নজরুলের নাট্যচর্চা নিয়ে। তিনি ছিলেন লেটোর দলের ওস্তাদ। রেকর্ডের নাটক হিসেবে যেগুলো পাওয়া গেছে, তা হলো : ১. ঈদুল ফিতর, ২. খুকি ও কাঠবিড়ালী, ৩. আল্লাহ্র রহম, ৪. কবির লড়াই, ৫. কলির কেষ্ট, ৬. কানামাছি ভোঁ ভোঁ, ৭. বনের বেদে, ৮. শ্রীমন্ত, ৯. কালোয়াতী কসরত, ১০. পুতুলের বিয়ে, ১১. পুরোনো বলদ, ১২. নতুন বৌ, ১৩. বাঙালির ঘরে হিন্দি গান, ১৪. বিলাতি ঘোড়ার বাচ্চা, ১৫. ছিনিমিনি খেলা, ১৬. জুজু বুড়ির ভয়, ১৭. পণ্ডিত মশায়ের ব্যাঘ্র শিকার, ১৮. খাদু দাদু, ১৯. চারকালা, ২০. বিয়ে বাড়ি, ২১. ভ্যাবাকাণ্ড, ২২. প্ল্যানচেট, ২৩. বিদ্যাপতি, ও ২৪. জন্মাষ্টমী প্রভৃতি। তার লেখা বেশিরভাগই রূপক ও সাংকেতিক শ্রেণির নাটক।

এরপর জসীমউদ্দীনের গানে আবহমান বাংলার চিত্ররূপ। অথচ টেলিভিশনের একটি অধ্যায়ে শুধু জসীমউদ্দীনের গান থাকতে পারে প্রতি সপ্তাহে। রয়েছে এত সুন্দর সুন্দর গান যার তুলনা হয় না। ইসলামি গানের ভুবনে কবি ফররুখ আহমেদ-এর গান। এ গানগুলো এদেশ থেকে ওঠে গেল। অথচ আমরা জানি নজরুলের পর আর কেউ এ রকম গান লেখেনি। গানগুলো হলো :

 

- তুমি ছাড়া আল্লাহ্ মাবুদ তো আর নাই/ - আমরা সবাই সত্য-ন্যায়ের উজ্জ্বল পথে চলব/ - যখন আমায় ডাকবে না কেউ/ - শোন মুজাহিদ শোন জেহাদের ঝাণ্ডা যেন রয় উঁচা/ - আল্লাহ্ হাদী করো তুমি সুপথ প্রদর্শন/ - আজ আমিনা মায়ের কোলে কে এলো কে এলো/ - আজ বিশ্বব্যাপী অবিচারের এ কোন অভিশাপ/ - চল মুমিন চল আবার জুম্য়ার জামাতে/ - নামাজ পড়ো জামাতে ভাই/ - তারা চাসনে কিছু কারো কাছে খোদার মদদ ছাড়া/ - শোন মৃত্যুর তুর্য-নিনাদ, ফারাক্কা বাঁধ ফারাক্কা বাঁধ/ - শহীদের খুন রাঙা কাশ্মীর কাশ্মীর/ - আজকে ওমরপন্থী পথিক দিকে দিকে প্রয়োজন/ - যখন আমায় ডাকবে না কেউ ডাকবে তুমি/ - সকল তারিফ তোমারি আল্লাহ্- রাব্বুল আ’লামীন/ - তোমার নেতা আমার নেতা আল-আরাবি মোস্তফা/ - জাগরে আঁধার রাতের ভালে নবী মোহাম্মদ/ - ও আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান/ - উঠো রাহাগির রাত হল অবসান/ - তোমার দয়া আছে খোদা জানি সকল দিকে/ - আমরা সবাই আলোর খুনীদীপ্ত কিশোর দল/ - রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী/ - রোজ হাশরে তোমার নবী মুহাম্মদের সম্মুখে/ - আরজ শোন খোদা, আমায় খাতেমা বিল খায়ের করো/ - ইঞ্জিলে দেন ঈসা নবী তোমার আসার সুসংবাদ

এ বই নিয়ে লিখতে গেলে অনেক পাতা লাগবে। এতে রয়েছে : দরদি গানের মরমি কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দিনের কথা [৭ পাতা], বহুমাত্রিক সাহিত্যের অনবদ্য পুরুষ তিতাস চৌধুরীর কথা [৫ পাতা], আধুনিক চিত্রকল্পের কবি আল মাহমুদের কথা [৫ পাতা], সমাজসেবী ও শিক্ষানুরাগী নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণীর সম্পর্কে কথা, রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রস্তাবক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথা। আরও আছে সংগীতের মহারাজা শচীন দেববর্মণ ও উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের কথা ও আরও অনেক। যতই পড়বেন ততই অবাক হবেন।

ড. আখতার হামিদ খানের কথা কেউ বলেনি। তিনি আলোকিত বাংলাদেশের প্রথম মানুষ। তিনি অবাঙালি ছিলেন। তাতে কি? বাঙালিকে ভালোবেসেছিলেন, সেটাই যথেষ্ট। সীমান্ত আকরামের বইটি পড়ে আমি অভিভূত।

 

লেখক : সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর