শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ জিতবে

আকরাম খান

বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ জিতবে

ক্রিকেট টুর্নামেন্ট জয়ের পরে খেলোয়াড়দের উল্লাস

সময়টা তখন ফুটবলের। দেশের জনপ্রিয় ফুটবলার মোনেম মুন্না, কায়সার হামিদ, সাব্বিরদের মতো ফুটবলারদের নিয়ে চারদিকে আলোচনা। তখনকার দিনে ক্রীড়াঙ্গনের তারকা বলতে ফুটবলাররাই! আবাহনী-মোহামেডান লড়াই বলতেও ফুটবলকেই জানত, বুঝত মানুষ। দেশের ক্রীড়াপাগল মানুষগুলো ফুটবল নিয়ে এতটাই মেতেছিল, অন্যদিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় তাদের ছিল না। সে সময় ফুটবলের মানও ছিল দারুণ। ডিফেন্স, মিডফিল্ড কিংবা উইংয়ে অসাধারণ ফুটবলাররা পারফর্ম করেছেন। কত নামকরা ফুটবলারই না ভক্তদের ইচ্ছে পূরণ করেছেন। ক্রিকেটের জন্য সে সময়টা কঠিনই ছিল। ক্রিকেট তখন ফুটবলের পেছনেই হাঁটত। জাতীয় পর্যায়ে এতটা রমরমা অবস্থা ছিল না ক্রিকেটের। নব্বইয়ের দশকের আগে ক্রিকেট নিয়ে এ দেশের মানুষ খুব একটা চিন্তা করেনি, তবে দৃশ্যটা বদলে যেতে থাকে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। মানুষ ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহী হতে থাকে। গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে থাকে খেলাটা। টেনিস বলে ক্রিকেট খেলার ধুম পড়ে যায় সবখানে।

প্রথমবারের মতো ১৯৯৪ সালে ক্রিকেট নিয়ে বেশ সাড়া পড়ে। সেবার আইসিসি ট্রফি এবং সাফ ক্রিকেট খেলেছিলাম আমরা। টুর্নামেন্টগুলো দর্শকদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল। এভাবেই একটু একটু করে এগিয়ে চলছিল ক্রিকেট। ১৯৯৭ সাল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে একটা মাইলফলক হয়ে থাকে। সবকিছু বদলে যায় এই বছর। মালয়েশিয়াতে অনুষ্ঠিত হয় আইসিসি ট্রফি। বরাবরের মতোই আমরা অংশ নিই। দলটা ছিল দারুণ। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই আমরা দারুণ খেলছিলাম। হংকংকে ৭ উইকেটে এবং নেদারল্যান্ডসকে ৩ উইকেটে হারিয়েছিলাম গ্রুপ পর্বে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটা বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল।

অবশ্য আমরা গ্রুপ পর্বের শীর্ষে থেকেই সেমিফাইনালে উঠি। স্কটল্যান্ডকে ৭২ রানে হারিয়েই আমরা বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম। সেই ম্যাচটার কথা কখনোই ভুলব না। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে পাইলট আর আমিনুলের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে আমরা ২৪৩ রান করেছিলাম। জবাবে মোহাম্মদ রফিক আর এনামুলের দুরন্ত বোলিংয়ে ১৭১ রানেই থেমেছিল স্কটিসদের ইনিংস। দারুণ এ জয়ের পর সারা দেশেই বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিল। রঙের মেলা বসেছিল যেন। আনন্দ মিছিল বের হয়েছিল। এলাকায় এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেছিল ক্রিকেটভক্তরা। এরপর থেকেই দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে বইতে লাগল নতুন হাওয়া। ফুটবলের মতোই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করল ক্রিকেট। এখন তো দেশের এক নম্বর খেলা ক্রিকেট। জনপ্রিয়তায় অন্য সব খেলাকেই বহু পেছনে ফেলে এসেছেন মাশরাফি-সাকিবরা। বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন ক্রিকেটের দিকে সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করল। নতুন উদ্যোমে স্রোতের মতোই ক্রিকেটের দিকে আকৃষ্ট হতে লাগল তরুণরা। ১৯৯৭ সালেই আমরা আইসিসি ট্রফির ফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে জিতেছিলাম। সেই জয়ের স্মৃতিটাও ছিল মধুর। প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসটা দেশের ক্রিকেটের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী হয়েই থাকবে।

এরপরের ঘটনাগুলো যেন দ্রুত ঘটতে লাগল। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। একের পর এক সফলতা আসতেই থাকে। পরের বছরই আমরা আইসিসির পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ পাই। টেস্ট খেলার যোগ্যতা অর্জনও নতুন যুগের সূচনা ছিল। আইসিসির দশটি পূর্ণাঙ্গ সদস্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নামও যোগ হয়।

তবে ক্রিকেটে পথচলাটা সহজ ছিল না। একদিকে শত শত বছর ধরে পরিচর্যার মধ্য দিয়ে ক্রিকেটকে রপ্ত করা অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দল। অন্যদিকে ক্রিকেট রাজ্যের নতুন সদস্য বাংলাদেশ। আমাদের সামনে কেবল কঠোর সাধনা করে যাওয়াই ছিল প্রয়োজন। নতুন শতকে এই সাধনাই করেছে বাংলাদেশ। ধীরে ধীরে উন্নতি করেছে। বিশ্বসেরা দলগুলোর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর গৌরব অর্জন করেছে। এখন ওয়ানডেতে আমরা অন্যতম দল। র‌্যাঙ্কিংয়ের সাত নম্বরে অবস্থান করছি। আপাতত আমাদের লক্ষ্য র‌্যাঙ্কিংয়ে ধীরে ধীরে আরও উপরের দিকে উঠে আসা। এর জন্য সবাই মিলেই কঠোর পরিশ্রম করছি আমরা। টি-২০ ক্রিকেটেও দারুণ করছে বাংলাদেশ। তবে টেস্ট ক্রিকেটটা রপ্ত করতে আরও সময় লাগবে। ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলোকেও দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেট চর্চা করতে হয়েছে বর্তমান অবস্থানে আসতে।

দীর্ঘদিন ধরে পরিচর্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট অনেক কিছুই পেয়েছে। আমরা আসলে খুব ভাগ্যবান। দারুণ কিছু ক্রিকেটার রয়েছে বাংলাদেশের। মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক, রিয়াদ, তামিমদের মতো বিশ্বমানের ক্রিকেটাররা নিজেদের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি দলের অন্যদের নিয়েও ভাবেন। তারা ক্রিকেটের উন্নয়নে প্রচুর কাজ করেন। মাঠের বাইরেও ক্রিকেট নিয়ে চিন্তা করেন। কেবল ক্রিকেটাররাই নয়, এখন সংগঠকরাও প্রচুর পরিশ্রম করছেন। ক্রিকেটের এই যে উন্নতি, এখানে কোনো ব্যক্তি বিশেষের নাম করলে ভুলই হবে। সাধারণ মানুষ, মিডিয়া, ক্রিকেটার এবং সংগঠকরা একযোগে কাজ করেছেন বলেই ক্রিকেট এতদূর এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ক্রিকেটের প্রয়োজনে তিনি সবকিছুই করেছেন। মানসিক, আর্থিক দিক দিয়েই কেবল নয়, যখন যা প্রয়োজন হয়েছে তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। নিরাপত্তার দিকটা নিশ্চিত করেছেন। অবকাঠামোগত উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমান ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্টও কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ক্রিকেটের উন্নয়নে।

ক্রিকেটে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। আরও এগিয়ে যাবে। তবে বিশ্বসেরা দলগুলোর সমান্তরালে পৌঁছতে আরও অনেক সাধনার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা সবাই মিলেই এগিয়ে যেতে চেষ্টা করছি। সমস্যাগুলো খুঁজে বের করছি। কিন্তু এই কাজটা একা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) করলে হবে না। জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এখন আমরা কেবল এইজ গ্রুপ থেকেই ক্রিকেটার খুঁজে বের করি। জেলা পর্যায়ে নিয়মিত খেলা হলে ক্রিকেটাররা একদম ভিতর থেকে উঠে আসবে। অবশ্য এ জন্য জেলা পর্যায়ে সুযোগ-সুবিধাও বাড়াতে হবে। ভালো মাঠ দিতে হবে। পরিবেশ দিতে হবে। তবেই ভালো খেলা হবে। সেখান থেকে উঠে আসবে নতুন নতুন ক্রিকেটার। মূল কথা আমাদের ডমেস্টিক ক্রিকেটটাকে শক্তিশালী করতে হবে। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড কিংবা অন্য সেরা দলগুলোর ডমেস্টিক ক্রিকেটটা ভালো বলেই তাদের কখনোই ক্রিকেটারের অভাব হয় না। আমাদেরও সে পথেই হাঁটতে হবে। ডমেস্টিক ক্রিকেট যত শক্তিশালী হবে আমাদের জাতীয় দলও ততটাই সমৃদ্ধ হবে। ভালো মানের ক্রিকেটাররা সুযোগ পাবেন। সবার মধ্যে দায়িত্ব বোধও আরও বাড়বে।

কেবল ক্রিকেটের জন্যই নয়, অন্যান্য ক্রীড়া ইভেন্টগুলোর উন্নয়নের জন্যও জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। ফুটবল আর ক্রিকেট ছাড়াও অন্যান্য ক্রীড়া ইভেন্টেও বাংলাদেশের ভালো করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এর জন্য জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলোকে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। কেবল তবেই আমরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে নিজেদের বিজয় ঘোষণা করতে পারব।

ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন আকাশ ছাড়িয়েছে। অনেকে কেবল আবেগ দিয়েই ভাবতে চায় সবকিছু। কিন্তু বাস্তবতা সব সময় আবেগকে সমর্থন করে না। ভক্তরা চায়, বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জয় করুক। এই চাওয়া তো সবারই। তবে বাস্তবতা ভিন্ন রকমের। আমি মনে করি, বাংলাদেশ বিশ্বকাপ জয় করবে। তবে এর জন্য আরও একটু সময়ের প্রয়োজন। দিনে দিনে আমাদের ক্রিকেট অনেক উন্নতি করছে। এখন সবার সামনে বুক ফুলিয়ে আমরা বলতে পারি, এমন কোনো দল নেই যাদেরকে নিজেদের দিনে হারাতে পারবে না বাংলাদেশ। ওয়ানডে আর টি-২০’র মতো টেস্টেও আমাদের জয়ের যুগ শুরু হয়েছে। কিন্তু বিশ্বকাপ জয় করাটা সত্যিই কঠিন কাজ। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। আমি মনে করি, বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ জিতবে। আর এ জয়ের জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। কেবল ভক্তরাই নয়, বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নটা এখন ধীরে ধীরে ক্রিকেটারদের মনেও দাগ কাটছে। সেদিন হয়তো খুব দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে মেতে উঠবে।

 

লেখক : পরিচালক, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।

অনুলিখন : রাশেদুর রহমান

সর্বশেষ খবর